কালিদা ও উৎপল দত্তের গল্প
আকাশ নট্ট
সন্ধেবেলায় বাড়িতে কিছু একটা পড়ছিলাম। হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপারের ব্যক্তিটি বললেন— “কী করছিস এখন? ফাঁকা থাকলে চলে আয়।”
আমি যথারীতি প্যান্ট আর শার্টটা গায়ে গলিয়ে কালিদার বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। ঘরে ঢুকতেই দেখলাম কালি দা চৌকিতে বসে একটা বই পড়ছেন। আমাকে ইশারায় টেবিলের কাছে রাখা চেয়ারটিতে বসতে বললেন।
কালিদাকে দেখলে মনেই হয় না যে তিনি আশি পেরিয়েছেন। মনে হয় বুঝি ষাটের কাছাকাছি বয়স। তাঁর পুরো নাম কালিদাস নট্ট। পেশায় একজন তবলা-বাদক এবং সাংবাদিক। তবে সাংবাদিকতা এখন আর করেন না। মাঝেমধ্যে তবলাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করেন। সেই কোন কালে মিউজিক তার রক্তে মিশে গেছে।
তিনি বললেন, ‘আজ তোকে ডাকলাম একটা দারুন গল্প শোনানোর জন্য।’
কালিদার প্রতি আমার আকর্ষণের প্রধান বিষয়টিই ওই— অর্থাৎ বহু বিচিত্র গল্প।
কালিদা বললেন, “চা চলবে তো?”
আমি বললাম, “চলতে পারে— তবে অল্প চিনি দিয়ে লিকার চা।”
— তাহলে কফি খা।
— তা তো অতি উত্তম প্রস্তাব!
— বেশ তবে তাই হোক।
কালিদা তাঁর স্ত্রীকে ডেকে দুজনের জন্যই কফি করতে বললেন। মিনিট দু-তিনেকের মধ্যে কফি চলে এল। কফিতে একটি চুমুক দিয়ে কালিদা শুরু করলেন—
সময়টা ২০১০ কিংবা ১১। আমি তখন একটি পত্রিকায় চাকরি করি— ‘সময় বিকেলবেলা’র কালচারাল এডিটর। সেই সুবাদে শোভা দির বাড়িতে একটি ইন্টারভিউ নিতে গেছি। অশোকনগর বাজার ছাড়িয়ে আজাদগড় এলাকা। সেখানেই শোভা দির বাড়ি— কল্লোল ভবন। সম্ভবত উৎপল দত্তের ‘কল্লোল’ নাটকের নাম অনুসারেই বাড়িটির নাম।
দরজা খুললেই বৈঠকখানার ঘর। বাঁ-দিক থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে উপরে। একতলার দেয়ালে অসংখ্য নাটকের ছবি। দেয়াল ঘেঁষে র্যাক ভর্তি বই— একেবারে তা তিনতলায় পর্যন্ত। সেখানেও তিনটি ঘরে যেন লাইব্রেরীর সম্ভার।
দোতলার একটি ঘরে খাটের ওপর শোভা সেন অসুস্থ শরীরে শুয়েছিলেন। তিনি নাট্য জগতের একটি পরিচিত নাম। তাঁর অসুস্থতার কথা আমি আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু ওই মন কখন যে কী চায়! আমি গিয়ে দেখি উনি কথা বলা তো দূরস্থান, চিনতেও পারছেন না। আমার ক্যামেরাম্যান মদন কয়েকটা ছবি তুলল। ব্যাস ওইটুকুই।
শোভাদিকে প্রণাম করে চলে আসছি হঠাৎ ওঁর নার্স আমাকে ডেকে বলল, “দিদি ডাকছেন।”
আমি আর মদন পুনরায় ঘরে ঢুকলাম। দেখলাম শোভা দি আস্তে আস্তে ইশারায় কিছু একটা বোঝাতে চাইছেন। আমি ওঁর মুখের কাছে আমার কানটা নিয়ে গিয়ে শুনতে পেলাম উনি বলছেন, “লোকনাট্য রিহার্সাল রুমে উৎপল দার সাথে তোর যে ঘটনাটা ঘটেছিল সেটা এপিকে লেখ।”
কালিদা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এপিক মাসিক পত্রিকার নাম শুনেছিস তো?”
আমি মাথা নাড়ালাম।
কালিদা বলতে লাগলেন— আমি তখন রাজি হইনি বুঝলি— শোভাদিকে বোঝাতে পেরেছিলাম যে অত বড় ঔদ্ধত্য আমার মধ্যে নেই।
শোভা দি সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন। সেদিন আর বিশেষ কথাবার্তা হল না। আমরা প্রণাম করে চলে এলাম।
আমি কালিদার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল কেবল একটি কথা— উৎপল দত্তের সাথে কালিদার কী ঘটেছিল?
কালিদা ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিত হাসি জড়িয়ে বললেন— আজ ৮৪ বছর বয়সে হঠাৎ সেই প্রলোভনটা হাতছানি দিয়ে ডাকছে বুঝলি। নিজেকে সামলাতে পারছি না। সেই কারণেই তোকে ডাকলাম। তুই তো লিখিস টিকিস। দেখ কোথাও যদি— আসলে কি জানিস তো অতীতের দিনগুলো প্রতিদিন ঘুমের মধ্যে ফিরে ফিরে আসে। এই বুড়ো হাড় নিয়ে আবার যুবক হতে বলে! সেসব কত রঙিন দিন ছিল— জীবনের বৈচিত্র্যকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। তখন শরীরে জোর ছিল; মনে ছিল উদ্যম।
কালিদা এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
কালিদার কথা শুনতে শুনতে আমার নিজের জীবনটাকে কেমন শুকনো মনে হল। সেই শুষ্কতায় কিঞ্চিৎ রস সঞ্চারের জন্য আমি চাতক পাখি হয়ে শুনতে লাগলাম।
কালিদা বলতে লাগলেন— সময়টা ১৯৭০ সাল। তখন আমি খুব ব্যস্ত। সদ্য লোকনাট্য অপেরায় তবলা-বাদক হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। যদিও তবলার পাশাপাশি ড্রামও বাজাতাম— যখন যেটা প্রয়োজন হত। লোকনাট্যের মালিক ছিলেন নীলমণি দে। বড় ভালবাসতেন আমায়— সম্মানও করতেন।
সেই সময় ‘দিল্লি চলো’ নাটকের রিহার্সাল চলছিল। জায়গাটা চিৎপুর। রিহার্সাল রুমে উপস্থিত ছিলেন প্রতিষ্ঠিত সব শিল্পী-বিদ্বজ্জন— বিজন মুখার্জি, মনোরঞ্জন চক্রবর্তী ওরফে বটু বাবু, শেখর গাঙ্গুলী, নবাগত ইন্দ্র লাহিড়ী। আর যার কথা না বললেই নয় তিনি হলেন বাংলার সেরা নাট্য ব্যক্তিত্ব উৎপল দত্ত। ওঁর সাথে আগেও কয়েকবার দেখা হয়েছে। তবে তখনও পর্যন্ত কথাবার্তা বিশেষ হয়নি। এইবার সেই সুযোগ এসে গেল।
যথারীতি রিহার্সাল শুরু হল—
ব্রিটিশ কর্নেল মিঃ ব্রেনানকে ওয়ারলেসে তাঁর এক অধস্তন সেনা-অফিসার সুভাষের গতিবিধি জানাচ্ছেন— স্যার গ্রামের উত্তরপূর্ব কোন থেকে দুটি লোক ঢুকছে।
ব্রেনান— কীরকম লোক, কী পোশাক?
দুজনেই ভারতীয়, পরনে মিলিটারি উর্দি। পাহাড় থেকে নেমে এইমাত্র দুজনে মাঠে পা দিল। এগিয়ে আসছে স্যার।
এগিয়ে আসুক, কেউ যেন বাধা না দেয়। রেডি রেডি এভরিওয়ান। সুভাষ এসে গেছেন। ...এখন কোথায়?
এখন আপনাদের কুঠির থেকে বড়জোর পঁচিশ গজ।
সব সৈন্যদের এলার্ট দিন। এগিয়ে আসুন নিঃশব্দে।
আর পনেরো গজ স্যার।
সব সৈন্যরা এগোচ্ছে ?
হ্যাঁ স্যার। আর পাঁচ গজ, চার- তিন- দুই... এইবার ঢুকছে
ফায়ার!
আমি কোন নির্দেশনা না পেয়ে জ্যাজ ড্রাম সেটটি আগলে চুপটি করে বসেছিলাম।
অনেকক্ষণ পরে সম্ভবত টি-ব্রেকের সময় উৎপল বাবুর কাছে জানতে চাইলাম, “ দাদা এখানে কোন ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হবে না ?” আমি কোনদিনই কাউকে স্যার বলতে পারিনি। সেই কারণেই দাদা সম্বোধন।
প্রথমটায় উৎপল বাবু চুপচাপ রইলেন। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করায় হঠাৎ আমার প্রতি খুব বিদ্রুপের ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলেন, “ও— আপনি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করবেন নাকি? তা করুন—" বলেই আমার জ্যাজ সেটের সামনে সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়লেন— যেন এক নতুন নাটক শুরু হল! আত্মসম্মান বোধটা চিরদিনই আমার একটু বেশি। আমি শুধু বললাম রিপিট প্লিজ !
পুনরায় দৃশ্য শুরু হল —
ব্রেনান একটার পর একটা প্রশ্ন করছেন আর তার রিপ্লাই আসছে।
আমি প্রতিটা সংলাপের উপরে ক্রমান্বয়ে ক্লাম বক্স, উড বক্স, বেস টমটম, হাই টমটম, হাই হেড, কেটল বিট ড্রাম এবং সিম্বল বাজিয়ে চললাম। তারপর ফায়ার অর্ডার হতেই একসঙ্গে মিলিয়ে দ্রুতগতির একমাত্রার উপরে একটা ক্রাশ করলাম !
কিছু বুঝে ওঠার আগেই উৎপল দা ছুটে এসে আমায় বুকে তুলে নিলেন। ওঁর ওই প্রশস্ত বুকের মধ্যে আমার ছোটখাটো দেহটিকে এমন চেপে ধরলেন যে আমার প্রান যায় যায় অবস্থা! তারপর বাঁধন আলগা করে ওপেনলি ডিক্লারেশন দিলেন— “আজ থেকে যত আবহসঙ্গীতের জায়গা আছে সব আপনি করবেন।”
উৎপল দত্তের ভঙ্গিমায় কালিদা এত সুন্দর ভাবে বিষয়টাকে উপস্থাপন করলেন যে আমি উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে হাততালি দিয়ে বললাম সাবাস! যেন এই মুহূর্তেই আমার সামনে ঘটনাটি ঘটল।
কালিদা হেসে উঠে বললেন— বস, বস। সে এক সময় ছিল রে। তোর এই বয়সটা খুব মূল্যবান— এটাকে অযথা খরচ করিস না। উৎপল দার কথা অনুযায়ী পরবর্তী পালা ‘সমুদ্রশাসন’-এর আবহসংগীতটাও আমি করলাম এবং সেটা সম্পূর্ণ ধ্রুপদী অঙ্গে। দুটোতেই আমার খুব নাম হল। কিছুদিনের মধ্যেই আমি থিয়েটার ছেড়ে সিনেমা জগতে চলে এলাম।
আমি থাকতাম ১৯/ বি নিমু গোস্বামী লেনে পিসতুতো দাদার বাড়িতে। একদিন নিচের গলি থেকে আওয়াজ এল— “কালি আছ, কালি?”
ডাক শুনে নিচে নেমে দেখলাম সংগীত পরিচালক প্রশান্ত ভট্টাচার্য। বললাম, “দাদা আপনি?”
হ্যাঁ, আজকে তোকে আমাদের ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে একটু বাজাতে হবে।
কিন্তু দাদা, আমি তো এখন থিয়েটারে কোন সময় দিতে পারব না।
‘আজকের দিনটা চালিয়ে দে ভাই।’
কিন্তু রিয়ার্সলে তো আমি ছিলাম না! আমি বাজাব কী করে?
ও তুই শুনলেই বুঝতে পারবি।
প্রশান্ত দা মানুষটা খুব দিলখোলা ছিলেন। আমাকে খুব আপন করে নিয়েছিলেন। শেষমেষ ওর কথাতেই গেলাম।
সেদিন আমার কোনো কাজও ছিল না। জিজ্ঞেস করলাম, “আর কে বাজাবে?”
প্রশান্ত দা বললেন, ‘সেরাঙ্গীতে পন্ডিত রমেশ মিশ্র আছেন।‘
অবশেষে আমি মানসিক প্রস্তুতিটা সেরে ফেললাম। সেদিন গিলে করা পাঞ্জাবি, সোনার চেন আর বোতাম পড়ে তবলার ব্যাগ নিয়ে রবীন্দ্রসদনের গ্রীনরুমে ঢুকছি—এমন সময় উৎপল দা দূর থেকে দেখেই চিৎকার করে বলে উঠলেন, “ আরে শোভা, দ্যাখো দ্যাখো কে এসেছেন! সোনার হার, গিলে করা পাঞ্জাবি— এই না হলে তবলা-বাদক! দেখবে আজকে মাহফিল কীভাবে জমে ওঠে!”
ওই নাটকে ছন্দা চ্যাটার্জী অভিনয় করছিলেন। ওঁর কন্ঠে কয়েকটা গান ছিল। আর ছিলেন শ্যামল ভট্টাচার্য।
খেমটা ভাঙা একটা টাইটেল মিউজিক বাই হার্ট বাজালাম। সবাইকে চমকে দিলাম। আগে এমন বাজনা কে কবে শুনেছে! প্রতিটা গানেই আমার সঙ্গত সেদিন নতুন মাত্রা এনে দিচ্ছিল।
নাটকের শেষ দৃশ্যটা আবছা, আবছা মনে পড়ছে— সম্ভবত ব্রিটিশ ক্যাপ্টেনকে দেখে তিতুমীর কোন সংলাপ বলছিল। আর সেই দৃশ্যে পর্দা নামল যখন পুরো হাউস ফেটে পড়ল হাততালিতে। সে কি উচ্ছ্বাস দর্শকের গ্যালারিতে! যেন মনে হল আমিও নাটকের কোন একটা ক্যারেক্টারের মধ্যে ঢুকে গেছি। সেই ইনভল্টমেন্টটা উৎপল দার সঙ্গে চিরদিনই আমার ছিল। যখনই যেখানে দেখা হত এক গাল হাসি নিয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। এত বড় একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পীকে আমি কতটুকু বুঝতে পেরেছি! ওঁর নাটকের সেই যে সংলাপটি— একটা পাহাড়ের উপরে পিপীলিকা ছেড়ে দিলে সে কি কখনো বুঝতে পারে কোনটা উঁচু, কোনটা নিচু?”
কথাটা বলেই কালিদা থেমে গেলেন। দেখলাম এক প্রগাঢ় নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন ওঁর মুখ। আমি আর কিছু বললাম না। টেবিলে রাখা কাপে চুমুক দিতে দেখলাম কফিটা বড্ড ঠান্ডা হয়ে গেছে।
কালিদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন বাইরে এলাম তখন হেমন্তের শিশির পড়তে শুরু করেছে।
2 Comments
ভালো লাগল পড়ে
ReplyDeleteআমারও ভালো লেগেছে।
ReplyDelete