জ্বলদর্চি

চিকনিশাক/ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৯৯

চিকনিশাক

ভাস্করব্রত পতি

শীতের মিঠে রোদে পিঠ ঠেকিয়ে বাড়ির ফুলবাগানে বা ধান কেটে নেওয়া জমিতে বা ভিজে স্যাঁতসেঁতে মাঠে বা নদীর জল শুকিয়ে যাওয়া চর এলাকায় খুঁটে খু্ঁটে চিকনি শাক তোলার অভিজ্ঞতা এবং মজা গ্রামাঞ্চলে একসময় দেখা যেত বেশ। 

এরা এমনভাবে খুব ঠাসাঠাসি করে থাকে যে, যেন মনে হয় কেউ চাদর বা কার্পেট বিছিয়ে রেখেছে মাটির বিছানায়। হঠাৎ করে খালি চোখে এই শাক চেনা যায় না। খুব ধৈর্য ধরে তুলতে হয়। এর নরম পাতা আর চিকন ডাঁটার জন্য একে 'চিকনি' বলা হয়। হয়তো এখন আর সেই শাক তোলার দৃশ্য তেমন দেখা যায় না। কিন্তু জমি থেকে উপড়ে আনা সেই চিকনি শাক যখন সোজা এসে ওঠে হেঁসেলগামী রসুইঘরে, তখন গৃহিণীর হাতের নানা উপাদান সমৃদ্ধ সহকারে তা হয়ে ওঠে 'চিকনি চামেলী'।
চিকনি চামেলী!!

এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Ponnaganti Kura (Alternanthera sessilis)। এটি Amaranthaceae পরিবারভুক্ত। একে বলা হয় Sissoo Spinach, Small knotweed, Common Knotweed, Brazilian Spinach, Sessile Joyweed, Dwarf Copperleaf ইত্যাদি। তবে পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র্য পর্ষদ কর্তৃক চিকনির বিজ্ঞানসম্মত নাম করা হয়েছে Polygonum plebeium। যা Polygonaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। কেউ কেউ একে মালঞ্চ শাকও বলে। এছাড়াও মারাঠীতে গুলাবী গোধাদি, ওড়িয়ায় মুথিশাক, সংস্কৃতে সর্পাক্ষী, হিন্দিতে মেচেচি, মেইতেই ভাষায় তরাকমনা, গুজরাটিতে জিনাকো ওখরাদ বলে। 
চিকনি..

সুন্দরবন সহ উপকূল এলাকায় চিকনি শাকের কদর দারুণ। নিউমোনিয়া এবং পেটের অসুখের ক্ষেত্রে চিকনি শাক খাওয়ার নিদান দেওয়া হয়। এক অপূর্ব স্বাদের রান্না! চিকনি শাকের সাথে বেগুন, আলু, ফুলবড়ি, খেসারির ডাল, চিংড়ি মাছ, সীম ছোট ছোট করে কেটে মিশিয়ে তৈরি হয় নানা পদ। সাধারণ ডালের সাথে চিকনিশাক মিশিয়ে তৈরি হয় বিশেষ ডাল। এছাড়াও চিকনির ঘন্ট বানানো হয় চিকনি দিয়ে। যা ভাতের সঙ্গে অনবদ্য রেসিপি। গ্রামের মানুষের উপাদেয় খাদ্য। প্রাচীনকালে এটি অন্যতম ভেষজ উদ্ভিদ হিসেবে ব্যবহৃত হত। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ এবং গাইনোকোলজিক্যাল রোগ নিরাময়ে চিনদেশে বহুল প্রচলিত ছিল। 
বাজারে এখন এই চিকনি শাক বিকোয় ১০০ টাকা কেজি দরে

মাটির সাথে লেপটে থাকা তথা শোয়ানো গাছ। ডাঁটির ওপর পাতাগুলো একটা ছেড়ে আর একটা গজায়। এইভাবেই সাজানো। চিকনির প্রতিটি পাতা বেশ সরু এবং লম্বাটে ধরনের। একটু পুরু এবং মাঝখানে একটা স্পষ্ট শিরা রয়েছে যা পাতার তলার দিকে থেকে ভালভাবেই বোঝা যায়। একটু বুড়ো হয়ে গেলে অবশ্য ডাঁটা গুলো শক্ত হয়ে যায়। তখন খাওয়া যায় না। তখন গোলাপী রঙের গুঁড়ি গুঁড়ি ফুল পাতার কোলে গোছায় গোছায় ফুটতে দেখা যায়। অনেকটা ঠিক ফুটকির মত দেখতে লাগে। পরে ফল হয়। আর ফলের বা দানার মাথায় ছোট রোঁয়ার মত গর্ভডাঁটি জন্মায়।

বাংলার মাটির অতি পরিচিত গেঁয়ো শাক এই চিকনি। বাজারে তেমন একটা পাওয়া না গেলেও ইদানিং হাটে বাজারে এক ধরনের চিকনি শাক অবশ্য মিলছে। যদিও তা ঐ নদীর চর কিংবা ধানজমি থেকে তুলে আনা নয়। রীতিমতো চাষ করা হচ্ছে জমিতে। এই শাক হাইব্রিড প্রজাতির বলেই অনুমান। বাজারে ১০০ টাকা কিলো দরে বিকোয়।
🍂

Post a Comment

0 Comments