জ্বলদর্চি

কুয়াশা যখন /পর্ব ১/বাসুদেব গুপ্ত

গল্প ধারাবাহিক  

কুয়াশা যখন  পর্ব ১
বাসুদেব গুপ্ত 

জ্ঞান ফিরতেই পুলিশ

এখন কি সন্ধ্যা? না সকাল? না কি গোধূলি? আই সি ইউতে গৌতমের জ্ঞান ফিরল তিন দিন অচেতন থাকার পরে। বোমার ঝলসানিতে পিঠের অর্ধেকটা পুড়েছে, বাঁ হাতের দুটো আঙ্গুল উড়েছে, কানে অনেক মানুষের হট্টগোলের শব্দ আসছে যেন অনেক দূর থেকে। চোখ খুললেন। খুলে বুঝলেন তিনি হাসপাতালে। চোখ বন্ধ করলেন, একটা সাদা আলোর ঝলকানি। কি হয়েছিল? চোখ খুললেন আবার। বড্ড সাদা চারদিক, ওভার এক্সপোজড ফটোর মত। আর সেই সাদার মধ্যে হঠাৎ ভেসে উঠল একটা টুপি। তার পরে দুটো চশমার কাঁচ। পায়ে কেউ টুক টুক করে টোকা দিলো। ইনি কি ট্রাফিক সারজেন্ট, কুয়াশায় রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন তাই, ডেকে তুলছেন? ভালো পুলিশ। কিন্তু মুখটা কেমন কাঠ কাঠ। বকবেন নাকি? আমি তো কোন অপরাধ করিনি স্যার, গৌতমের কথা আর কেউ শুনতে পাচ্ছে না। না না লোকটা আসলে ভালই। এত সব চোর জোচ্চোর, পলিটিসিয়ান, পকেট্মার সামলাতে গেলে ওরকম একটু হয়ে যায়। গৌতমের একটু মায়াও হয়। ঠিক তখন ধাক্কাটা আরো জোরে আসে কাঁধে, চটকা ভেঙ্গে গৌতম পরিষ্কার শুনতে পান, 
“দেখতে পাচ্ছেন আমাকে? এই যে আমার হাত। পাঁচটা আঙ্গুল। আপনার নাম কি?” গৌতম নিজের আঙ্গুল গুলোও একটু নাড়ান, মনে পড়ে যায়, সকালেই নার্স মেয়েটি বলে গেছে, আপনার দুটো আঙ্গুল কিন্তু উড়ে গেছে। এখন কিছুদিন ব্যান্ডেজ বাঁধা থাকবে। নাম বলতে চেষ্টা করেন, গলায় আঙ্গুলের দুঃখ আর মিউকাস ঘড়ঘড় করে ওঠে। আবার চেষ্টা করেন। 
🍂

 
অফিসার সুবিমল পাকড়াশী এমনিতে হাসিখুশি মানুষ। কিন্তু বাংলা বাজারে পুলিশি করা ভারী হ্যাপার। বেশি কঠোর হলে দলগুলো নেমে পড়বে পুলিশি অত্যাচার  বন্ধ করও বন্ধ করো বলে। আবার নরম ভাব দেখালে  মিডিয়া শুরু করবে, পুলিশের অকর্মণ্যতা আর অপদার্থতা বাড়ছে কেন, জবাব দাও। আজকের কেস টা বেশ গোলমেলে। পলিটিকাল হাঙ্গামা একটা হতেই পারে। প্যালেস্টাইন, বামপন্থী, বোমাবাজী কে করতে পারে? বিদেশি শক্তির হাত আছে? যারা চায় না তাদের সমালোচনা হোক? নাকি ভোট আসছে, এগুলো বামপন্থীদের টেররাইজ করার একটা প্রোগ্রাম। 
“আমার নাম… আমার নাম, একটু মনে করতে দিন। “, গৌতমই তো মনে হচ্ছে, কিন্তু পদবীটা?
“বলুন বলুন”, এবারে সুবিমলের গলায় খুব নরম সুর। 
“গৌতম দাস গুপ্ত,  হ্যাঁ ঠিক। এটাই নাম”, গৌতম মনে করার ধকলে আবার একটু নেতিয়ে পড়েন কিছুক্ষণ।
“বাঃ এই তো বলেছেন ঠিক। আপনি একেবারে ঠিক হয়ে যাবেন। চিন্তা করবেন না। আচ্ছা আপনি কেন হাসপাতালে সেটা কি জানেন?”
“কি জানি? শুনলাম দুটো আঙ্গুল নাকি নেই। এক্সিডেন্ট হবে বোধহয়। একটা আওয়াজ কানে আসছে কেবল, দুম করে একটা আওয়াজ”

 
“একটু চেষ্টা করুন। যা মনে পড়ে। একটা আওয়াজ হল। কিসের আওয়াজ?” সুবিমলের গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললেন। 
“খুব জোর আওয়াজ। আগুনের হল্কা। বোম টোম কিছু কি? হ্যাঁ আমার সামনে ধপ করে একটা কি পড়ল।   তারপরই আর কিছু মনে নেই।“
“কেউ সেটা ছুঁড়ল? কে সে? কি রকম দেখতে কিছু মনে পড়ছে?”
“কিচ্ছু না।“
সুবিমল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গৌতমের ওপর লক্ষ্য রাখছিলেন। গৌতম যেন স্মৃতির এলোমেলো আলো আঁধারিতে খুঁজছেন কিছু। আর একটু চাপ দিলেন, যদি কিছু জানা যায়। 
“আপনি ওখানে কি করছিলেন? কিছু পড়ছিলেন? কোন লেখা?”
গৌতমের চোখে ঝলসে উঠল একটা ছবি। একটা মাইক, সামনে লাল রঙ্গের প্লাস্টিকের চেয়ার, জনা পঞ্চাশেক মানুষ। চারদিকে পতাকা। লাল আর সবুজ। কিন্তু মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোল না। 

“আপনি প্যালেস্টাইন নিয়ে লেখা কোন কবিতা পড়ছিলেন। হিন্দ নামের কাউকে নিয়ে। 
এবারে গৌতমের মনে পরিষ্কার ভিডিওর মত ফিরে এল ছবিগুলো। গৌতম পড়ছিলেন হিন্দ রজব, তাঁর লেখা কবিতা। ছ বছরের মেয়েটা, যাকে গুলি করে উড়িয়ে দিয়েছিল সৈন্যরা। হ্যাঁ, সভা হচ্ছিল, গণহত্যা  বিরোধী সভা। তিনি মাথা নাড়লেন আলতো করে। 
 
 
“আমি আপনার কবিতাটা পড়েছি। খুব ভালো। আপনার দিকে কি ছুটে এলো মনে পড়ছে?”
গৌতমের স্মৃতি ক্রমশঃ পরিষ্কার হয়ে আসছে। সঙ্গে বাড়ছে শরীরে অস্বস্তি।  একটা বল, ঠিক টেনিস বল, কমলা রঙ। যেন দূরে কোথাও ক্রিকেট খেলা হচ্ছিল, কেউ ছয় হাঁকিয়েছে। কিন্তু সেটা সামনে এসে পড়তেই… অনেক কষ্টে কটি কথা মুখ দিয়ে বেরোল,
“হ্যাঁ একটা বল, কমলা রঙ্গের”, বলেই চোখ বুজে ফেললেন গৌতম। 
নার্স গীতা নজর রাখছিল, দেখল পালস রেট কমে যেতে শুরু করেছে। তার সঙ্গে অক্সিজেন
“স্যার, মনে হয় উনি আর পারছেন না, সবে তো আইসিইউ থেকে এসেছেন, এখনো ভাইটাল প্যারামিটার সেটল করে নি। আপনি কাইন্ডলি কাল বা পরে করতে পারি?”
সুবিমল জবানবন্দী ঠিক না হলেও, সম্মতি পেয়ে গেছেন অনেকটা, সব লিখে নিলেন। আর একটু যদি জানা যেত, হাসপাতাল যাবার সময় জ্ঞান ফিরেছিল কিনা, কিছু মনে আছে কিনা, সেটা আর হল না। 
  গীতা তাড়াতাড়ি কিছু ইঞ্জেকশান আই ভিতে দিয়ে দিল, একবার চেক করে নিল রক্তচাপ আর অক্সিজেন, গৌতম চোখ বুজে রইলেন, ওষুধের কাজ শুরু হতে, তিনি আবার তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গেলেন। 
অগত্যা সুবিমল বাকী জিজ্ঞাসাবাদ না করার জন্য গীতাকেই পাকড়ালেন।  
“এ কদিনে কেউ এনার খোঁজ করতে এসেছিল? কোন বন্ধু আত্মীয়?”
“স্যার গণহত্যা বিরোধী সমিতি থেকে একজন এসেছিলেন। কিন্তু ইনি আই সি ইউতে আছেন বলে চলে গেছেন। আর-“
“আর? আর কে?”  সুবিমলের পুলিশি কান খাড়া হয়ে উঠল 
“একজন লোক, বেশ গরীব মত, সে ওনাকে এখানে ভর্তি করেছিল, প্রায় খোজ নিত। আমরা কিছু ওষুধ আর রিপোরটের কথা বলেছিলাম, সেগুলোও এনে দিত ল্যাব থেকে, বা আমাদের ড্রাগ স্টোর থেকে। সব থেকে বড় কথা ব্লাড দরকার ছিল, আমরা বললাম, আপনি ব্যবস্থা করতে পারবেন? তো উনি বললেন, ওনার তো সেরকম সংগতি নেই, তবে যদি আমাকে দিয়ে হয়, আমি, দিতে পারি। উনি নিজেই রক্ত ডোনেট করেছেন একবার। “
“বাঃ, তো উনি গৌতমের কে হয় সেটা বলেন নি?”
“না স্যার বলেছিল সামনে দুর্ঘটনা হতে দেখে ও ঠিক থাকতে পারে নি, লোকজন জুটিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছিল। বুড়ো মানুষ, একলা, আবার নাকি কবি মানুষ, তাই ও খোঁজ নিত। আর রক্তদান ও নাকি করেই থাকে। এটা কোন ব্যাপার নয়”।
শুনতে শুনতে সুবিমলের চোখ কপালে উঠছিল, কালো মোটা চশমাটা নামিয়ে, মুখটা একটু মুছে বললেন, “এ তো গান্ধী মহারাজের চেলা দেখছি। নাম কি? ডিটেলস আছে?”

-ক্রমশঃ-
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

2 Comments

  1. মনে পড়ুক আরো, তবেই তো লেখা চলবে ,গল্প চলুক হিন্দ রজব

    ReplyDelete