অত্যাচারী রাজপুত্র
সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস
কথক- শম্ভু দাস, গ্ৰাম- যুগীশোল, থানা- নয়াগ্ৰাম, জেলা- ঝাড়গ্ৰাম
বহুকাল আগে প্রতাপগড় নামে এক রাজ্য ছিল। সেই রাজ্যের রাজা প্রতাপসিংহ ছিলেন খুবই বুদ্ধিমান, শক্তিশালী ও দয়ালু। তিনি প্রজাদের খুব ভালোবাসতেন। প্রজাদের বিপদে আপদে সবসময় তাদের পাশে থাকতেন। কিন্তু মহারাজের চিন্তা ছিল দুই রাণী ও দুই রাজপুত্রকে নিয়ে। কারণ তার দুই রাণী ছিল অত্যন্ত স্বার্থপর। তারা নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বুঝত না। এছাড়া রাজা প্রতাপসিংহের আরও এক রাণী ছিল। কিন্তু দুই রাণীর ছলনার জন্য রাজা প্রতাপসিংহ ওই রাণীকে অর্থাৎ তার মেজরাণীকে প্রাসাদ থেকে বের করে দিয়েছেন। পরে মহারাজ নিজের ভুল বুঝতে পারলেও মেজরাণীকে আর খুঁজে পাননি।
কিন্তু মহারাজের সবথেকে বেশি চিন্তা ছিল তার দুই পুত্রকে নিয়ে। কারণ মহারাজের দুই পুত্র ছিল খুবই অহংকারী ও অত্যাচারী। রাজপুত্র হওয়ার জন্য তারা মানুষকে মানুষ বলে মনে করত না। তারা প্রজাদের উপর জোর জুলুম করত। প্রজাদের কাছ থেকে অকারণে নানা জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়ে যেত। কারোর ছাগলটা, কারোর জমিটা, আমার কারোর বাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দিত। এইভাবে চলত তাদের অত্যাচারের লীলা।
এরপর রাজপুত্রদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে প্রজারা রাজার কাছে বিচার চাইতে আসে।
প্রজাদের সব কথা শুনে মহারাজ বলেন-“আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি দেখছি এখন তোমরা যাও। উফ্ এই দুটো ছেলের জন্য আমি পাগল হয়ে যাব।”
সেইসময় দাসী এসে বলে-“মহারাজ, চলুন। আপনার খাবারের সময় হয়েছে।”
তখন মহারাজ বলেন-“হ্যাঁ হ্যাঁ চলো চলো।”
সেদিন রাত্রিবেলা মহারাজ নিজের ঘরে বসে মেজরাণীর কথা ভাবতে ভাবতে বলেন-“রাণী, আজ তুমি যদি আমার সঙ্গে থাকতে তাহলে আমাকে এত ভাবতে হত না। কেন যে তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। আমার এই দুই পুত্র কোনো কাজেরই নয়। এরা দুজনেই রাজা হওয়ার যোগ্য নয়। কিন্তু কী আর করতে পারি বলো। এদের দুজনের মধ্যে কাউকে না কাউকে তো আমায় রাজা করতেই হবে। তুমি থাকলে ঠিকই এই সমস্যার সমাধান করতে পারতে। কিন্তু তুমি যে কোথায় চলে গেলে তোমাকে তো আর খুঁজেই পেলাম না।”
তখন দাসী এসে বলে-“মহারাজ, আপনার খাবারের সময় হয়ে গেছে, খাবেন চলুন।”
দাসীর কথা শুনে মহারাজ বলেন-“হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি যাও আমি আসছি।”
এইভাবে দিন কাটতে থাকে। আর এদিকে প্রজাদের উপর রাজপুত্রদের অত্যাচার বাড়তেই থাকে।
একদিন রাজকুমার উমাকান্ত বাগানে ঘুরছিল। ঠিক তখনই তার চোখ পড়ে গাছে বসে থাকা এক বানরের উপর।
বানরটিকে দেখে রাজকুমার উমাকান্ত বলে-“ওই তো গাছে একটা বানর বসে আছে। আজ এই বানরটিকেই আমি ধরব।”
এই বলে সে বানরটির দিকে তির চালায়। এইভাবে অনেক তির চালাতে থাকে। কিন্তু কোনোমতে বানরটিকে ধরতে পারে না।
এদিকে বানরটিও নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। আর নিজেকে বাঁচিয়ে সে রাজকুমারকে বলে-“ এ কী তুমি এভাবে আমাকে মারছ কেন? আমি তোমার কী করেছি?”
বানরের কথা শুনে রাজকুমার বলে-“আরে বাশ! এ বানর তো দেখি কথা বলতে পারে, বেশ মজার তো।”
বানর তখন বলে-“হ্যাঁ, তোমার মজা আর আমার সাজা।”
তখন রাজকুমার উমাকান্ত বানরকে বলে-“এই তুই কথা বলা শিখলি কী করে?”
বানর বলে-“ আমি তো জন্ম থেকেই কথা বলি।”
উমাকান্ত তখন বলে-“বাঃ তাহলে তো একে ধরে রাখতে হয়। একে দেখলে পিতা আমার উপর খুব খুশি হবে।”
এই কথা ভাবতে ভাবতেই রাজকুমার রমাকান্ত জাল দিয়ে বানরটিকে ধরে ফেলে।
তখন বানরটি চিৎকার করতে থাকে আর বলে-“বাঁচাও, বাঁচাও আমাকে কেউ বাঁচাও।”
এইসব দেখে রাজকুমার উমাকান্ত রমাকান্তকে বলে-“এ কী রমা, তুই আমার শিকার ধরলি কেন? ওকে তো আমি পেয়েছিলাম।”
তখন রমাকান্ত বলে-“তোর মানে, তুই তো এটা ধরতেই পারিস নি। তোর যে কত দম তা আমার জানা হয়ে গেছে।”
এই শুনে উমাকান্ত বলে-“মুখ সামলে কথা বল রমা। তুই জানিস না, আমি এই রাজ্যের ভাবী রাজা।”
রমাকান্ত তখন বলে-“হা হা হা, তোর এই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। আমি হব এই রাজ্যের রাজা।”
সেইসময় দাসী সেখানে এসে বলে-“রাজকুমাররা, মহারাজ তোমাদের ডাকছেন।”
তখন রাজকুমার উমাকান্ত বলে-“যাচ্ছি, তুমি যাও।”
রমাকান্ত তখন বলে-“আচ্ছা চল। আর এই কথা বলা বানরটিকে আপাতত খাঁচায় ভরে রাখি, পরে এর বিচার করব যে এই বানরটি কার।”
উমাকান্ত বলে-“ঠিক আছে, তাই হবে।”
এরপর তারা দুজনে বানরটিকে খাঁচায় ভরে মহারাজের কাছে চলে যায়।
মহারাজের কাছে গিয়ে তারা বলে-“পিতা, আমাদের ডেকেছিলে?”
মহারাজ তখন বলে-“হ্যাঁ, তোমাদের সঙ্গে আমার একটা দরকারি কথা আছে। তোমাদের জন্য একটা সম্বন্ধ এসেছে। ঘটক অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তোমাদের জন্য একটা মেয়ের খবর এনেছে। মুক্তাপুরের রাজকুমারী মুক্তামালা। তার যেমন রূপ তেমন গুণ। কিন্তু ………….”
তখন রাজকুমারা বলে-“কিন্তু কী পিতা?”
মহারাজ তখন বলেন-“কিন্তু মুক্তাপুর রাজ্যটি যে কোথায় তা আমরা কেউ জানি না। শুনেছি নীল সাগরের জলে লুকিয়ে আছে ওই রাজ্য। এছাড়া রাজকুমারী মুক্তামালার শর্ত হল যে আগে সেই রাজ্যে পৌঁছে তার খোপায় গোলাপ ফুল গুঁজতে পারবে, রাজকুমারী তাকেই বিয়ে করবে। তাই আমি তোমাদের দুজনকে ঠিক করেছি। এর দ্বারা মুক্তাপুরের সাথে আমাদের সম্পর্ক গড়ে উঠলে আমাদের রাজ্যের অনেক লাভ হবে। এছাড়া আমি এও ঠিক করেছি তোমাদের মধ্যে যে এই কাজ করতে পারবে তাকেই আমি এ রাজ্যের রাজা করব।”
তখন রাজকুমারা বলে-“ঠিক আছে পিতা, আমরা এখনি বেরিয়ে পড়ছি।”
এই বলে রাজকুমাররা সেখান থেকে চলে যায়।
আর এদিকে দাসী রূপী মেজরাণী খাঁচায় ভর্তি বানরটিকে খাঁচা থেকে বের করে দেয়। আর মেজরাণী বানরটিকে যেতে বলে মুক্তাপুরের রাজকুমারী মুক্তামালার কাছে। এমনকি মুক্তামালার শর্তের কথাও তাকে বলে দেয়। রাণী বানরটিকে কেন এই কাজ করতে বলে তা আমরা পরে জানতে পারব।
এরপর বানরটি রাজকুমারদের পেছন পেছন যায়। কিন্তু রাজকুমাররা যে নৌকায় করে মুক্তাপুর রাজ্যের দিকে রওনা দেয় বানরটি সেই নৌকায় না উঠে একটা কাঠের গুঁড়ির উপর চড়ে বসে আর তাতে করেই মুক্তাপুর রাজ্যের দিকে যায়।
কিন্তু কিছুদূর যেতেই ওরা বিশাল এক ঝড়ের মধ্যে পড়ে।
তখন রাজকুমার উমাকান্ত বলে-“নীলসাগর তো চলে এলাম কিন্তু মুক্তাপুর রাজ্যটি যে কোথায় তা তো খুঁজে পাচ্ছি না। আর এদিকে যে ঝড় উঠেছে তাতে তো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। এরপরে ঝড় এত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে যে তারা সবাই একটা ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে।”
এদিকে এইসব দেখে তাদের পেছনে থাকা বানর বলে-“একি এরা সবাই কোথায় গেল? এরা তো দেখছি জলে তলিয়ে যাচ্ছে। আমাকেও এদের পেছনে যেতে হবে। হয়তো এটাই মুক্তাপুর যাওয়ার পথ হতে পারে।”
এই বলে সে ওই ঘূর্ণির মধ্যে প্রবেশ করে। আর ওই ঘূর্ণির মধ্যে প্রবেশ করার পর সে যখন দেখে সে এক রাজ্যের মধ্যে পড়ে আছে।
সে তখন চারিদিকে তাকিয়ে দেখে আর বলে-“আহা কী সুন্দর এই রাজ্য। এটাই মনে হয় মুক্তাপুর রাজ্য হবে।”
ঠিক তখনই রাজপ্রহরীরা তাকে ধরে ফেলে আর বলে-“ এই তুই কে? আর এই মুক্তাপুর রাজ্যে কেন এসেছিস? তোকে এখনি কারাগারে বন্দী করব।”
এই শুনে বানরটি বলে-“সে কী, কেন?”
তখন রাজপ্রহরীরা বলে-“এটাই আমাদের রাজ্যের নিয়ম।”
এই বলে তারা বানরটিকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর বানরটি কারাগারে গিয়ে দেখে দুই রাজকুমারও আগে থেকেই সেখানে বন্দী।”
এই সব দেখে বানর ভাবে-“না না এভাবে বন্দী থাকলে চলবে না। আমাকে যে করে হোক এখান থেকে বের হতে হবে।”
এরপর তার মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। সে তখন মরার নাটক করে। তাকে এভাবে দেখে প্রহরীরা ভাবে হয়তো বানরটি মরে গেছে। তাই তারা তাকে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসে।
🍂
প্রহরীরা চলে আসতেই বানরটি চোখ খুলে ফেলে আর বলে-“হা হা হা, বুদ্ধিটা বেশ কাজে দিয়েছে তো। এবার আমাকে আসল কাজটা করতে হবে।”
এরপর বানরটি লুকিয়ে রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করে আর গিয়ে দেখে মুক্তামালা বারন্দায় দাঁড়িয়ে আছে।
তখন বানরটি রাজকুমারী মুক্তামালাকে দেখে বলে-“আহা কী সুন্দর দেখতে। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়।”
এই বলে সে গাছ থেকে একটা গোলাপ ফুল তুলে মুক্তামালার খোপায় গুঁজে দেয়।
তখন রাজকুমারী মুক্তামালা বলে-“এ কী, কে, কে তুমি?”
বানর বলে-“আমি তোমার স্বামী। তোমার শর্ত অনুযায়ী যে তোমার খোঁপায় ফুল দিতে পারবে তাকেই তুমি স্বামী হিসেবে মেনে নেবে। আর আমি তোমার শর্ত মতো কাজ করেছি।”
তখন রাজকুমারী মুক্তামালা বলে-“হ্যাঁ তা ঠিক। এই ছিল আমার শর্ত। আর সেই হিসেবে তুমিই আমার স্বামী। আমি তোমাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিলাম।”
আর এই কথা বলতেই বানরটি রাজকুমারে পরিণত হয়ে যায়।
এই দেখে মুক্তামালা বলে-“এ কী তুমি, তুমি কে? তুমি তো মানুষ ছিলে না?”
তখন রাজকুমার বলে-“ঠিক বলেছ। আসলে তুমি আমাকে আমার অভিশাপ থেকে মুক্ত করলে। তাহলে শোন, আমি হলাম প্রতাপগড়ের মেজরাজকুমার। আমার মা অর্থাৎ প্রতাপগড়ের মেজরাণীর কোনো ছেলেপুলে না হওয়ায় বড় রাণী ও ছোট রাণীর বুদ্ধিতে মহারাজ প্রতাপসিংহ আমার মাকে তাড়িয়ে দেন।”
মুক্তামালা তখন বলে-“তারপর।”
মেজরাজকুমার বলে-“তারপর আমার মা এক জঙ্গলে সাধুর কাছ থেকে কিছু জড়িবুটি খেয়ে আমার জন্ম দেয় কিন্তু বানর রূপে। তাই সাধুবাবা বলেছিল যেদিন কোনো নারী আমাকে স্বামী হিসেবে গ্ৰহণ করবে সেদিনই আমি আমার মানুষ রূপ ফিরে পাব। তাই আজ থেকে আমি তোমার ঋণী হয়ে রইলাম।”
এই শুনে মুক্তামালা বলে-“না না, তুমি একথা বলো না। তুমি আমার স্বামী। চলো রাজকুমার আমাকে তোমার রাজ্যে নিয়ে চলো।”
মেজরাজকুমার তখন বলে-“হ্যাঁ, তা তো যাব। কিন্তু তার আগে আমার দুই ভাই ও অন্যান্য বন্দীরা যারা ভুল করে এ রাজ্যে এসেছে তাদের তুমি ছেড়ে দাও।”
মুক্তামালা বলে-“বেশ তাই হবে।”
এই বলে রাজকুমারী মুক্তামালা সবাইকে ছেড়ে দেয়। আর মেজরাজকুমার ও রাজকুমারী মুক্তামালার বিয়ে হয়ে যায়। তারপর মেজরাজকুমার মুক্তামালাকে নিয়ে প্রতাপগড়ে আসে। আর রাজা প্রতাপসিংহকে সব কথা খুলে বলে।
সব শুনে মহারাজ বলে-“কী! তুমি আমার ছেলে?”
মেজরাজকুমার বলে-“হ্যাঁ, পিতা আমি তোমার ছেলে। যে রাণীকে তুমি বের করে দিয়েছিলেন, আমি সেই রাণীর ছেলে।”
তখন মহারাজ বলেন-“হায় হায় হায়, এ আমি কী করেছিলাম। আমার রাণী কোথায়? তোমার মা কোথায়?”
মেজরাজকুমার তখন বলে-“মা তো এখানেই আছে পিতা।”
মহারাজ বলেন-“এখানে! কিন্তু কোথায়?”
মেজরাজকুমার তখন বলে-“হ্যাঁ, তুমি তাড়িয়ে দিলেও মা তোমার কথা ভেবে তোমার সেবার জন্য দাসীর ছদ্মবেশে এখানেই থেকে গেছে। ওই ওই যে আমার মা।”
ঠিক তখনই দাসী নিজের পরিচয় দেয়।
এই দেখে মহারাজ বলেন-“রাণী তুমি আমায় ক্ষমা করো। আমি ভুল করেছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দাও রাণী আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
তখন মেজরাণী বলে-“এ তুমি কী বলছ। তুমি আমার স্বামী। সময় আমাদের আবার এক করে দিয়েছে।”
মহারাজ বলেন-“হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। সময়ই আমাকে আমার রাজ্যের আসল রাজার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে। আমার মেজ ছেলে অর্থাৎ এই রাজ্যের ভাবী রাজা।”
এরপর সবাই মেজরাজকুমারের জয় জয়কার করতে থাকে।
0 Comments