জ্বলদর্চি

কুয়াশা যখন /পর্ব ১১/বাসুদেব গুপ্ত

গল্প ধারাবাহিক  
কুয়াশা যখন  
পর্ব ১১ 

বাসুদেব গুপ্ত 

এক দিন সেই দিন   

গণতান্ত্রিক দেশের এক অবশ্যম্ভাবী উৎসব নির্বাচন। দেখতে দেখতে সেই ঘোর উৎসব এ রাজ্যের দরজাতেও কড়া নাড়ল। রাজনৈতিক দলগুলো ভীষণ ব্যস্ত হয়ে উঠল। ভোট, ভোট, ভোট!! দুর্গা পুজো, কালী পুজো, যিশু পুজো—কিন্তু সবকিছুর ঊর্ধ্বে হলো ভোট পুজো। স্বপনও ব্যস্ত হয়ে পড়ল, খুবই ব্যস্ত। বাড়ি গিয়ে ঘুমানোরও সময় নেই তার। মাত্র এক বছরে পার্টির কর্মী হিসেবে মানুষ তার নাম চিনে ফেলেছে। দাদাদের কাছে স্বপন নিজেকে বিশ্বস্ত প্রমাণ করেছে। অটোচালক থেকে শুরু করে সবজি বিক্রেতা, ফুটপাথে বসা অস্থায়ী রেস্তোরাঁ—সবাই তাকে প্রতি সপ্তাহে বা মাসে একবার করে উদয় হতে দেখে। তাদের কাছে সে যেন পুরোহিতের মতো, ধীরেন্দ্রজী ভগবানের প্রতিনিধি।
স্বপনকে সৎ ট্যাক্স কালেক্টর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যে কখনো তোলার টাকা থেকে চুরি করবে না এই বিশ্বাস হয়েছে সবার। সে দাদার কাছ থেকে নিজের শতাংশ নিয়ে খুশি থাকে। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি শেষে বাড়ি ফিরে নিজের মদের কোটা খেয়ে ভাবে—সে কি সত্যিই খুশি? সে জানে, এ ব্যাপারে কারও কোনো নৈতিক দ্বিধা নেই। বাঁচতে গেলে এই দেশে এই যুগে এভাবেই চলটে হবে। স্বপন হয় বড় চাকার একটি দাঁত হয়ে থাকবে, নয়তো পিষে যাবে।

নির্বাচন অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে এলো। অনেক মানুষই গণতন্ত্রের অর্থ বোঝে না, তার ভোট দিতেও অনিচ্ছুক।  তাই প্রতিটি বুথে কমিটি গঠন করা হলো, যাদের কাজ হলো মানুষকে ভোট দিতে নিয়ে আসা এবং একই সঙ্গে প্রতিপক্ষকে বুথে পৌঁছাতে বাধা দেওয়া। স্বপন এখনও নতুন, কিন্তু দ্রুত শিখছে। সবার জন্যই প্রশিক্ষণ ক্লাস আছে। বুথ দখলের দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এক প্রবীণ প্রতিদিন বিকেলে পুরনো পার্টি অফিসে ক্লাস নেন। স্বপন সেখানে যায়। খুব একটা ব্যপার না , তেমন কোন বুদ্ধি লাগে না, তাকত দরকার হয়, দলের তাকত। প্রথম শিক্ষা, প্রতিটি বুথে কতজন বিরোধী ভোটার ভোট দিতে পারবে, তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। পার্টি বস প্রতিটি বুথে কোটা ঠিক করে দেন। যতক্ষণ পার্টি জিতছে, সব শান্তিপূর্ণ। কিন্তু বিপদ এলে পরিস্থিতি বেসামাল হতে পারে। হয় ভোট বাড়াও কোন ভাবে, নইলে ভেস্তে দাও। পুনরনিরবাচন হলে ম্যানেজ হয়ে যাবে। 

“স্বপনদা, কাজ আছে, আজ টেনিস বল আনতে হবে। না না, বাইকে যেও না, বাইক তোমার অপয়া আর বাইকে টেনিস বল আনলে তুমিও বাউন্ডারী হয়ে যাবে। আমরা একটা সাদা ট্যাক্সিক্যাবের ব্যবস্থা করব।“
“শুধু বল?”
= আর কিছু যনতরও পাবে, সব রেডি আছে ডেলিভারির জন্য। আমি একটা তালিকা দেব, তুমি শুধু দেখে নিয়ে আসবে।” সবাই জানত টেনিস বল আর যন্ত্রের মানে কী। কিন্তু স্বপন এসব কখনো হাতে নেয়নি। একশান স্কোয়াডে তার নাম উঠেছে ভোট আসার পরে। সে মনে মনে  কল্পনা করে গ্রেনেড হাতে নিয়ে প্রতিপক্ষ ভোটারদের ভয় দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে ভাবে—হিকোমা জানলে কী বলত? পৃথা ম্যাডাম বোধহয় দুঃখ পেয়েছিলেন। উনি কি ভাববেন যদি জানতে পারেন স্বপন টেনিস বল নিয়ে খেলছে। তবে সবাই জানে, পার্টি কী এবং পার্টির কর্মীকে কী করতে হয়।
🍂

স্বপনের উত্তেজনা বাড়ল। এতদিন মোটামুটি সব শান্তিতেই চলছিল শুধু ট্যাক্স সংগ্রহের কাজ ছিল,   কেউই আপত্তি করত না। নেহাত আপত্তি করলে স্বপন দাদাদের জানাত, পুলিশ ব্যবস্থা নিত। কিন্তু এবার আসল অ্যাকশন। বিরোধীদের বিরুদ্ধে জবরদস্ত লড়াই, যারা শান্তির শাসন ভাঙতে চায়।  ধীরেন্দ্রজীর যত্ন করে গড়ে তোলা উন্নত অগ্রসর বিকশিত দেশে অরাজকতা আনতে চায়। 

“জয় ধীরেন্দ্রজী। দেখো, রাস্তায় আবার ফেটে যাবে না তো?” কন্ট্যাক্ট নম্বর ফোনে তুলে  নিয়ে স্বপন এবারে রেডি যাবার জন্য। 
“আরে না না, কেরোসিনে ভিজিয়ে রাখা হবে, মিষ্টি ছেলের মতো ঘুমোবে। দরকার শুধু একটা বের করে ছুঁড়ে দিলে—ব্যাং! আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব।”
“আমি কখনো বোমা ছুঁড়িনি। ভয় লাগে।”
“কিছু না। দেখো আমার হাত, ২৫ বছর আগে এক আঙুল হারিয়েছি বামদের সঙ্গে লড়াইয়ে। সৈনিক দেশের জন্য জীবন দেয়। পার্টি কর্মী উদ্দেশ্যের জন্য জীবন দেয়। আমার সঙ্গে একবার অশোক ছিল, পুলিশ তাড়া করলে ভয় পেয়ে বোমাটা পকেটে ঢুকিয়ে দিল। শেষ। ভয় পেলে কিন্তু সাটেন ডেথ। ডর গয়া তো মর গয়া।”
“অশোক বিশ্বাস, যার শহীদ বেদি আছে?”
“হ্যাঁ, কিন্তু বেদির নিচে শোয়ার চেয়ে রাস্তায় হাঁটা ভালো। আমি তোমাকে শেখাব। শুধু ভয় পেও না। আর কখনো ভাববে না বোমা ফাটলে কী হবে। তারা শত্রু, যুদ্ধ মানে শত্রু সরানো। তুমি আগে চোখের পলক ফেললে তারাই তোমাকে সরিয়ে দেবে।”
কলকাতা একসময় ছিল মিছিলের শহর । তখ ছোট পার্ক, রাস্তার মোড়, ক্লাবঘরে শত শত সভার আয়োজন হতো, জ্বালাময়ী বিপ্লবের গান হত, শব্দ মার্চ করত চলবে না চলবে না বলে। এখন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট উন্নত হয়েছে, বিশাল মঞ্চে লাখো মানুষের সভা হয়।

কিন্তু এই সভাটা ছিল আলাদা। স্থানীয় কাউন্সিলর খবর দিচ্ছিল—বামদের ধক আবার বাড়ছে, বেশি বেশি সাহস দেখাচ্ছে। সভায় সভায় ধীরেন্দ্রজীর জ্বালাময়ী ভাষণ সব কর্মীর কানে বাজে,
 “তাদের উঠতে দাও, তারা সুন্দরী গাছের মতো ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের কঠিন সংগ্রামে অর্জিত নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করতে হবে।   আমরা দেশের দখল নেওয়ার আগে তাদের হাতে ৫৫ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। সেসব দিন যেন আর ফিরে না আসে” এই সংখ্যা কখনো দশ, কখনো এক লাখ বলা হয়। কিন্তু এতে কর্মীদের খুব রক্ত গরম হয়।
স্বপন জানে সবটাই মিথ্যে। কিন্তু এটাই এখন তার কাজ, পেশা। তার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, কেউ তাকে চাকরি দেবে না। দুর্ঘটনার পর তার পায়ের জোর কমে গেছে, ভারী কাজ করতে পারে না। আত্মহত্যা বা রুটি-তে বিষ মাখানো আর বোমা ছোঁড়ার মধ্যে তার কি কোনো বিকল্প আছে? সে অন্য কিছু ভেবে পায় না ।

তাই, যখন কানুদা দুজনকে ডাকল, একটা ব্যাগে পেটোগুলো দিল আর বলল আজ রাতে বামপন্থীদের সভা হচ্ছে বকুল বাগানের মাঠে, সেই সভা ভেঙে দিতে হবে, স্বপন তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেল। বিক্রম সিং সঙ্গে যাবে, সে বেশি প্রশিক্ষিত, পাশের রাজ্যের পেশাদার,ভোটের সময় এসেছে। কিন্তু কানুদা স্বপনকে বেশি বিশ্বাস করে, বিক্রম সিং কাজের সময় ডাক পায়। 
-ক্রমশঃ-

Post a Comment

2 Comments