জ্বলদর্চি

কুয়াশা যখন/ পর্ব ১৩/বাসুদেব গুপ্ত

গল্প ধারাবাহিক 

কুয়াশা যখন   
পর্ব ১৩
বাসুদেব গুপ্ত 

পর্দা ছিঁড়ে  কুটি কুটি 

আজ   রবিবার। বাইরে উজ্জ্বল রৌদ্রোজ্জ্বল পৌষের  সকাল, সূর্যের কিছু রশ্মি জানালার কাঁচ ভেদ করে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে এসে গৌতমের বিছানার ঠিক পাশে থেমে আছে। গৌতম হাত বাড়িয়ে সেটিকে ছুঁয়ে অনুভব করার চেষ্টা করল। এবং তারপর খেয়াল গেল একটি আঙ্গুল অনুপস্থিত। বিষণ্ণতা! হে চিরপ্রিয়া, মনে একটা লাইন ভেসে উঠল। তাও তো গৌতম বেঁচে আছে দিব্যি। পৌষের এই সকাল ডাক দিচ্ছে সবাইকে।  

বেঁচে থাকত না যদি সেই লোকটি না থাকত, যে ওকে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। সমবেত কবি বা বুদ্ধিজীবিরা কেউই তত করিৎকর্মা নয়। কি হতো কে জানে। কিন্তু সেই লোকটা কে? কোথায় গেল সে?

হাসপাতালের সবাই বলেছিল লোকটির নাম সঞ্জিত, সে আবার নাকি  নিজেকে গৌতমের দূরসম্পর্কের ভাই বলে দাবি করেছিল। আশ্চর্য! অ্যাডমিশন ফর্মে লেখা তার মোবাইল নম্বরে নাকি কেউ ধরেই নি।  সম্ভবত নম্বরটির অস্তিত্বই নেই।

লোকটি কে? এই শহরে গৌতমের কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই, তাই সে সম্ভাবনা বাতিল।   অফিসে ছিল কেবল একদল কোডার, যারা ওরা কাজ করের বদলে যাওয়া রূপ ওরা কোড করে।  ওরা খোঁজ খবর নেওয়ার কথা ভাব্বেই না। গৌতম ওদের কে?  তাদের মাথা ঘামানোর কথা নয়।   গৌতম এখানে কিছুটা নির্দয় হচ্ছে, ওরা তো জানেই না।   
কে ছিল ঐ লোকটা? কে সে?

“আপনি খুব লাকি স্যার।  আপনার পুরো হাতটাও উড়ে যেতে পারত। আর একটু পাশে ফাটলেই। এক দেবদূত আপনাকে হাসপাতালে আনলেন,  আপনার জীবন বাঁচিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এ বাবাজির কৃপা। ।    আগের জন্মে খুব পুণ্য করেছিলেন নিশ্চয়।” মালতী কপালে হাত ঠেকিয়ে অদৃশ্য বাবাজীকে কৃতজ্ঞতা জানালো।
🍂

মালতী ছোট একটি সাইড টেবিলে জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিল— ওষুধ, ব্যান্ডেজ এবং ড্রেসিং সামগ্রী। অন্য একটি টেবিলে ছিল নানান ধরনের বই, যার বেশিরভাগই ছিল কবিতা অথবা নানা দেশের নিপীড়িত মানুষের লড়াই ও  প্রতিরোধের কাহিনী।   কম্পিউটারের  বই একটাও না, এখন CodeGPT এই মহাবিশ্বের একমাত্র টিচার, শেখার জন্য আর বই লাগে না কারো। 
“আপনি এত বই খাতা ছড়িয়ে টেবিলটা নোংরা করে রাখেন কেন? দেখুন, সাজাতে আমার প্রাণ যায়।” মালতীর স্বামী দু মাস আগে দশমীর দিন বিসর্জন দিতে গিয়ে হাওয়া। সবাই বলছে জোছনার সঙ্গে পালিয়ে গেছে । মালতীর মাথা তাই  সবসময় আগুন।
গৌতম হাসল। এটাই চিরকালের সমস্যা। যাদের জন্য কবিতা লেখা হয়, প্রতিবাদ মিছিল সংগঠিত হয়, সেই মানুষগুলো নিজেরাই তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়। তারা কেবল কোনোমতে দুবেলার খাওয়া, জামা কাপড়, ঘর আর সম্পর্ক নিয়েই ব্যস্ত, লড়াই করার সময় কোথায়। 


বারবার সেই একই কথা মাথায় ঘুরে ঘুরে আসে। সেই দেবদূতটি আসলে কে? পুলিশ গৌতমকে  কয়েকবার জিজ্ঞাসা করে হাল ছেড়ে দিয়েছিল। গৌতমের একটাই কথা, 
=আমার তো জ্ঞানই নেই, আমি কি করে জানব বলুন তো। আপনারা খুঁজে দেখুন।   
মালতী চা দিতে এসেছিল, গৌতম তাকে পাকড়াল,
“যে নার্স আমার দেখাশোনা করেছিল, তার সাথে আমাকে একটু যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারবে?”
“কেন স্যার, মনে হচ্ছে সরস্বতীর প্রতি আপনার একটু বেশিই টান আছে? আমি কি আপনার যত্ন নিচ্ছি না?” মালতীর আলোছায়া মুখে কপট হাসি খেলে যায়।  মোবাইল ঘেঁটে একটা নম্বর পাওয়া গেল, বলল এটাই হবে। 
“নাম লিখে রাখো না কেন?”
“অত আমরা পারিনা , ইঞ্জিরিতে সব লেখা আসে, অত বুঝি না। এটাই হবে। 

নম্বর পেয়ে গৌতম ফোন লাগাল, একবার বেজেই গেল। আবার কিছুক্ষণ পরে কল করতে সে উত্তর দিল,
“কে বলছেন? আমি কিন্তু হাসপাতালে ভর্তির ব্যাপারে কাউকে সাহায্য করতে পারব না। আমাকে ফোন করবেন না।”

 
“না সরস্বতী ম্যাডাম, এই বেরিয়েছি, , আর ভর্তি হতে চাই না তবে আমি যেভাবে আপনি আমার দেখাশোনা করেছেন, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ থাকব চিরকাল। মনে কি পড়বে, আমার নাম গৌতম।”
“ওহ, সরি স্যার,  বুঝতে পারিনি। আপনি এখন কেমন আছেন? ওষুধ ড্রেসিং ঠিক ঠাক করছে তো আয়ারা” বোঝা গেল ও চিনতে পেরেছে। বুড়োর সঙ্গে ওর বেশ আলাপও জমেছিল ছাড়া পাওয়ার আগে। 

“একটা কথা জানার জন্য আসলে ফোন করলাম। ঐ যে লোকটি আমাকে ভর্তি করিয়েছিল, তাকে নিয়ে ভাবছিলাম। কোন খবর পাওয়া গেল, উনি কে? কোথায় থাকেন। খোঁজ পেলে আমি আমার অনেক কৃতজ্ঞতা জানাতাম।  
“না স্যার, পুলিশ আরও দু’বার এসেছিল এবং সিসিটিভির কপিও চেয়েছিল, কিন্তু আপনি তো জানেন, আমাদের সিসিটিভি সবসময় আউট অফ অর্ডার, রিপেয়ার করার পয়সাও নেই সরকারের। না আমরা  লোকটার কোন খবরই জানি না।”
“আচ্ছা, আপনি কি তার একটু বর্ণনা অন্তত দিতে পারবেন? যেমন— তার উচ্চতা, গায়ের রঙ, চুল, হাঁটার ধরন, পোশাক, কথা বলার ভঙ্গি ইত্যাদি। যদি আমার পরিচিত কেউ হয়, আমি যদি চিনতে পারি। ”
“ওহ স্যার, সে তো এখন মনে করতে হবে, এখন তো ডিউটি চলছে।  একটা কাজ করুন না, আমি যখন ডিউটি শেষ করে বাড়ি ফিরব তখন আমাকে ফোন করবেন। আমি যতটা মনে করতে পারি, চেষ্টা করে আপনাকে বলব।”


গৌতম একটু একটু করে ঠিক হচ্ছেন, শরীরে জোরও বাড়ছে। কিন্তু তত মানসিক চিন্তায়  অস্থির আর অশান্ত লাগছে। আজ মালতীকে ডেকে বলল, রেফাতের লেখা কবিতার বইটা দিতে, মালতী এখন এই অদ্ভুত বই পড়া লোকটার হাল হকিকত বুঝে গেছে, চটপট বইট নামিয়ে দিল আলমারি থেকে। গৌতম হাতে নিলেন, মলাট ওল্টালেন, কিন্তু মনোযোগ দিতে পারলেন না কিছুতেই। ঐ কথাটা কাঁটার মত বিঁধে রয়েছে, কে, কে ঐ লোকটা। 

তাকে জানতেই হবে, কে তাকে হাসপাতালে এনেছিল। তার   ওই মানুষটির কাছে অনেক ঋণ, হয়ত  সে খুব গরিব, গৌতমের পয়সার অভাব নেই, তাকে  আর্থিক সাহায্যও করতে পারেন। 

“শুভ সন্ধ্যা সরস্বতীজি, এখন একটু সময় হবে?” গৌতম ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল। মালতী তখনই শিফট শেষ করে তৈরি হচ্ছিল। সে গৌতমের হয়ে নম্বর ডায়াল করল, কানেকশানও পেল।
—“আরে হ্যাঁ, গৌতমজি, কেমন আছেন? দেখুন, আমি শুধু যা মনে আছে তাই বলব। ভুলও হতে পারে, আমি গোয়েন্দা নই, সব মনে রাখতে পারি না।” ওর হাসির শব্দ শোনা গেল।
—“উনি প্রায় ৫ ফুট ৩, আমার মতোই হাইট, গায়ের রং কালো, সামনের চুল কম, মাথার মাঝখানটা প্রায় টাক। টি-শার্ট আর জিন্স পরেছিল; টি-শার্টটা ছিল হলুদ, নীল আড়াআড়ি ডোরা।”
এটা শুনে গৌতম উত্তেজিত হয়ে উঠল। জিজ্ঞেস করল, —“কোনো চিহ্ন বা দাগ ছিল শার্টে?” —“চিহ্ন ঠিক মনে নেই, কিছু একটা কুমিরের মতো, আর বড় S লেখা ছিল বুকে।”

গৌতম প্রায় বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠল। 
“আরে, ওটা ঐ শার্টটা, আমি জানি, ওই শার্টটা আমার, অফিসের স্বপনকে দিয়েছিলাম। আপনি সিওর, ৫ ফুট ৩, মাঝখানে টাক? আহ, বেচারা! আমরাি ওকে কোম্পানি থেকে বের করে দিয়েছিলাম, আর সে এতদূর এসে আমাকেই বাঁচিয়েছে। একে পরিহাস বলব না তো কি বলব?”
-ক্রমশঃ-
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

2 Comments