জ্বলদর্চি

কুয়াশা যখন/ পর্ব ১৪/ বাসুদেব গুপ্ত

গল্প ধারাবাহিক  
কুয়াশা যখন  
পর্ব ১৪ 
বাসুদেব গুপ্ত 

চিনিলে না 

গৌতমের কাছে স্বপনের তিনটে নম্বর ছিল। নম্বরগুলো বদলাত, কারণ ওর তিনটে ফোন—একটা নিজের, একটা ঊষার, একটা রেশমির—যখন যেটা খুশি নিয়ে ঘুরত আর ব্যবহার করত। গৌতম শেষ করা নম্বরটা ডায়াল করল। হাতে এখনও ব্যথা, ফোন ভালোভাবে ধরতে পারে না, কিন্তু মালতীকে দেওয়া যাবে না, মালতী শেষ ট্রেন ধরার জন্য তাড়াহুড়ো করছিল।

কেউ ফোন তুলল না। বারবার করা হল, বারবার বেজে গেল। শেষে গৌতম বিরক্ত হয়ে ভয়েস মেসেজ পাঠাল। টেক্সট পাঠিয়ে লাভ নেই, স্বপন ইংরেজি অক্ষর চিনলেও মানে বোঝে না। গৌতম বলল, “প্রিয় স্বপন ভাই, আমি জানি তুমি আমাকে হাসপাতালে এনেছিলে, আমার যত্ন নিয়েছো। আমি তোমার কাছে চিরঋণী। কাল ১২:৩০-এ আসতে পারবে? আমি এখনও বিছানায়, আয়া মালতীজি দেখাশোনা করছেন। এসো, কথা বলতে চাই।”
মেসেজটা পাঠিয়ে গৌতমের শান্তি হল অনেকদিন পরে। তাতে গৌতম বেশ ভালো ঘুমাল। রাতের আয়া নীলিমারও সুবিধে, সেও ঘুমিয়ে পড়লেন। গৌতমের কাছে ঘণ্টা আছে, দরকার হলে বাজাবে।

সে তখন আয়েশার সঙ্গে লুডো খেলছিল, আয়েশা এখন অনেকটা ভালো, খাবার আর টাকার জোগান থাকায়। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল, স্ক্রিনে গৌতমের নাম দেখে কেঁপে উঠল।

স্বপন গৌতম হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর থেকে বাইরে যেত না। কানুদা খবর পাথিয়েছিল রুদ্রকে দিয়ে। বলেছিল কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে। হাসপাতালে থাকাকালীন কাউকে ফোন করেনি। পার্টির সহকর্মীরা কড়া নির্দেশ দিয়েছিল, কোনো অ্যাকশনে গেলে ফোন নিয়ে যেও না, ফোন করতে হলে অচেনা পার্টি ফোন থেকে, ফ্লাইওভার বা বাজারের মতো জায়গা থেকে করো, তারপর সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দাও।
🍂

ফোন বাজতে দেখে ওর প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল ফোনটা তুলে বলি “কেমন আছেন স্যার?”
আর দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া ছিল ফোনটা সুইচ অফ করে দেওয়া। কিন্তু সেটা করলে সন্দেহ বেড়ে । তাই ফোনো বেজে গেল ওও  চুপচাপ বসে রইল, আয়েশার সঙ্গে খেলা চালিয়ে গেল। আয়েশা আধো আধো ভাষায় বলল, “কল কল, দাদু, কথা বলো।” বাজতে বাজতে ক্লান্ত হয়ে একসময় ফোন থেমে গেল। স্বপন হাঁফ ছাড়ল। এক গ্লাস জল গড়িয়ে নিল ওয়াটার ফিল্টার থেকে, কিন্ত যেই জল গলায় ঢালতে গেল,   আবার ফোন বেজে উঠল, ফলে জল গলায় আটকে কাশতে লাগল। আয়েশা এসে পিঠে হাত বুলিয়ে দিল, “শাথ, শাথ,” যেমন মা বলে। ততক্ষণে ফোন আবার থেমে গেল।
তারপর এল মেসেজ—কাল ১২:৩০-, কথা বলতে চাই।

স্বপন এক ঘণ্টা ধরে ভাবল, যাবে কি যাবে না। গেলে কিভাবে বোঝাবে ও শুধুই উদ্ধারকারী, অপরাধী নয়? সত্যি তো, ও যদি জানত, গৌতম সেখানে, কখনো বোমা ছুঁড়ত? বিশ বছর ধরেস ওনার কাছে কত ভাবে ঋণী। চন্দনও বলেছিল, গৌতম নিজের মাইনে কেটে চন্দনের মাইনেটা দিয়ে দিতে চেয়েছিল। আর ও গিয়েছিল গৌতমের গায়ে বোমা ছুঁড়তে?

সেই রাতের যন্ত্রণা আবার তীক্ষনভাবে ফিরে এল, বুকে চিন চিন করে উঠল ব্যথা। একেই  কই বলে পাপ! পাপ ছাড়া আর কি। কিন্তু গৌতম না হয়ে অন্য কেউ হলে? তাহলে ও  কি একটুও ভাবত? রাজনীতিও যুদ্ধক্ষেত্রের মতো, সৈনিক হত্যা করতে যায়, ভালোবাসা ছড়াতে নয়। ঈশ্বরও কুরুক্ষেত্রে বলেছিলেন, যাও, হত্যা করো, এটাই তোমার নিয়তি। সৈনিক কি ভাবে যাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিল ফায়ার করে, তারও ওরই মত এক বাচ্চা আছে, মা আছে, আর ঘরণী আছে, যার আশা যুদ্ধ থেমে যাবে, আবার সে ঘরে ফিরবে। কিন্তু যুদ্ধ কি কখনো থামে?

স্বপন এতসব উচ্চ চিন্তা মাথায় নিতে পারে না। সে তো মাত্র ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে। মা চোলাই বিক্রি করত, বাবা প্রতিদিন মদ খেয়ে সবাইকে পেটাত। পঁচিশ বছর গ্রীন ওয়ারে কাজ করে স্বপন চেষ্টা করেছে ভালো মানুষ হতে, অন্ধকার থেকে বেরোতে। কিন্তু অন্ধকার কাউকে ছাড়ে না। নাহ স্বপনের কোনো দোষ নেই, বাঁচতে হলে যা লাগে করতে হবে। অভিযোগ করার কিছু নেই, লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। 

কিন্তু নিজের মেয়েকে, নাতনিকে কি বোমা মারতে পারত? গৌতম তার কাকার মতো,  যদি জানত, তাহলে কি বোমা ছুঁড়ত? আর না ছুঁড়ে ফিরে এলে পার্টি ওকে কি বলত?  যে সৈন্য শত্রু খুন না করে ফিরে আসে তার কি হয়?  

অনেক ভেবে ভেবে স্বপন নিজেকে বোঝাল,  সে জানত না, সমাজ  তাকে যা কাজ দিয়েছে তাই করেছে। দেখা করতে যাবে ঠিক করল। ঊষাকে বলল, “কাল বাইরে যাব।” 
—“ভালো, কতদিন আর ঘরে বসে থাকবে?” 
—“পার্টির কাজ আসেনি এতদিন, কাল আবার কাজ।”




পরদিন ১২:৩০। মালতীর ডিউটি সবে শুরু,  কিন্তু গৌতম অনেক আগে থেকেই আজ রেডি। নীলিমা শেভ করিয়ে, জামা পরিয়ে দিয়েছে, গৌতম এখন অনেকটা সুস্থ ও সতেজ দেখাচ্ছে। আজ সবকটা  জানালা খুলে রাখা হয়েছে। বাইরে নরম বাসন্তী রোদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে, হালকা বাতাসে ছোট হলুদ ফুল দুলছে। বারান্দার লিলি গাছে প্রজাপতির দল উড়ছে। কোনটা প্রজাপতি কোনটা ফুল বুঝেই পাচ্ছেন না গৌতম। আজ ঠিক করছিলেন, ভাত, ডাল, কলমি শাক আর পাব্দার ঝোল দিয়ে দুপুরের খাবার শুরু করবেন, এমন সময় বেল বাজল।
—“কে?” মালতী দরজা খুলে বলল, “স্যার এখন নাশতা করছেন।”
—“আমি স্বপন। স্যার ডেকেছেন। দয়া করে দরজা খুলুন।”
মালতী গৌতমকে জানাতে, গৌতম মাথা নাড়ল। স্বপন ঢুকল, ঠিক যেমন সরস্বতী বর্ণনা করেছিল;
৫ ফুট ৩, গায়ের রং কালো, সামনের চুল কম, মাঝখানে টাক। টি-শার্ট নয়, সাদা কুর্তা পরা, অনেকদিন ধোয়া বা ইস্ত্রি হয়নি। রক্তের দাগে ভরা টি-শার্টটা যতই ধোয়, দাগ যায় না।
গৌতম একটা লেজি বয়তে হেলান দিয়ে বসে ছিল। বুক ও পা-এ ব্যান্ডেজ, পোড়া অংশ ঢেকে রাখা। বাঁ হাতে চার আঙুলে ব্যান্ডেজ, ছোট আঙুল নেই। স্বপন পায়ে হাত দিয়ে বলল, “কেমন আছেন স্যার? এখন ভাল তো?” মালতীর হাতে দুটো সিমলা আপেল আর এক প্যাকেট আঙুর দিল, “স্যারের জন্য।”
মালতী মুখ বাঁকাল, রান্নাঘরে নিয়ে গেল। গৌতম জানে, এর কিছুটা মালতীরও হবে, তবু গৌতম আজ খুব খুশি, কারণ তার জীবনদাতা সামনে।
—“আপনাকে খুব দুর্বল দেখাচ্ছে। আপনিও বুড়ো হয়ে গেলেন শেষে!,” স্বপন আস্তে বলল, চেয়ারে বসল। তখনই আবার বেল বাজল। এবারে নীচের গেটের। মালতী বারান্দা থেকে মাথা ঝুঁকিয়ে দেখতে গেল তারপর দৌড়ল নীচে। 
-ক্রমশঃ-
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

2 Comments

  1. কেউ চিনেও না চেনে,উত্তর করে না।🙏

    ReplyDelete