রুদ্ধ সংকেত
পুলককান্তি কর
মাসে অন্তত একবার নিয়ম করে আসে মেয়েটা। গত দু তিন মাস আসা যাওয়াটা প্রায় সপ্তাহে একবার করে হচ্ছিল বলেই মনে মনে কথাটার চর্চা বেশ মজবুত হয়ে উঠেছিল নীলাদ্রির কাছে। এ মাসে তাই তিন সপ্তাহ পার হতে চলল। এখনও কেন দেখা নেই ওর? টুকটাক কথার ফাঁকে যেটুকু খবর, মেয়েটি এখনে কোথাও কাজ করে। সম্ভবত অশোকনগরের ওদিকে বাড়ি। তেমন করে কথাবার্তা হয়নি এতদিন যাতে করে ওর ফোন নম্বর ইত্যাদি রাখা যায় । ফোন তো দূরের কথা, নামটুকুও কি জানে সে মেয়েটির? ওর বন্ধু স্বপন চা দিতে এসে কয়েকবার দেখে থাকবে। ও ওর নাম দিয়েছে 'কাঁপন'। ওকে দেখে নাকি নীলাদ্রির বুকে কেঁপে কেঁপে ওঠে তাই এমন নাম। নীলাদ্রি যদিও মুখে বলে 'শালা তোর নিজের বুক কাঁপে আর অন্যের ঘাড়ে দোষ দিস?' ইদানিং যদিও একথা আর বলে না কেননা মেয়েটি অন্য কারোর বুকে কাঁপন তুলুক - এমন সম্ভাবনায় ওর আজকাল বুকের ভেতরটা কেমন মুচড়ে ওঠে। তবে কি স্বপন ঠিকই বলে? ও কি প্রেমে পড়ে যাচ্ছে মেয়েটার? পৌনে নটায় স্বপন তার চায়ের ফ্ল্যাস্কটা নিয়ে স্টেশন চত্বর থেকে বাড়ীর দিকে রওনা দেয়। নীলাদ্রি মজা করে বলে ডাউন প্যাসেঞ্জার। নীলাদ্রির দোকানটাই শেষ ঠেক। ডাউন টাইমে চা টা প্রায় দিনই স্বপনের তরফ থেকে। ওর পয়সা ও নেয় না। পাশে একটা ডালবড়ার দোকান দেয় নাড়ু। ও ডাল বড়া সাপ্লাই দেয় কোনও কোনওদিন। কোনওদিন শম্ভু তার ভুষিমাল দোকান থেকে এটা ওটা নিয়ে আসে। ওটা ওটা বলতে নানান রকমের বিস্কুট। আজ স্বপন যখন এল, তখন ঠিক রাত নটা দশ। বলল, ‘কীরে নীল বাকিরা কই ?’
- এই তো তোর হুইসেলের অপেক্ষায় সবাই। এই এলো বলে।
- হ্যাঁরে কাঁপন এসেছিল আজ?
- নারে!
- তুই কি ওর সাথে অন্য কোথাও দেখা করে কাঁপন থামিয়ে আসছিস নাকি রে শালা?
- মনে হচ্ছে তোর চুলকানিটাই বেশী?
- আমার আর কি? তোর জন্যই ভাবি। আমার তো বাড়ি ফিরলে কাউকে জড়িয়ে ধরে শোওয়ার লোক আছে। তুই কতদিন স্বপ্ন দেখে জামা কাপড় খারাপ করবি?
- চুপ শালা! এত চেঁচিয়ে বলার কী আছে? দেখছিস না ওদিকে কাস্টমার দাঁড়িয়ে আছে?
- তা কাস্টমার কি মানুষ না, নাকি হাগে মোতে না?
- তোর যত নোংরা কথা!
- আচ্ছা বাবা। ওকি পটি করে না, না ইউরিনেট করে না?
- এর সাথে পটি ইউরেনেট এর কী সম্পর্ক?
- বলতে চাইছি পটি করাটা যেমন স্বাভাবিক ব্যাপার, নাইট ফলস টাও পুরুষদের একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। ওই ধেড়েবুড়োর নিশ্চযই সেই বোধ আছে।
নীলাদ্রি স্বপনের হাত ধরে টেনে দোকান থেকে বাইরে বের করে আনল। রাগত স্বরে বলল, ‘তুই কি আমার কাস্টমার ভাগাবি নাকি রে শালা?’
🍂
- কেন বাওয়া কী করলাম?
- ওই সব বিশ্লেষণ দিচ্ছিস লোকটাকে, ওর কানে গেলে দোকানে জীবনে আসবে?
- ফিসফিস করে বলছি তো। কানে যাবে কী করে?
- এইতো তোর সমস্যা। তুই মনে করিস ফিসফিস করে কথা বলছিস। কিন্তু আদতে যে সবাই শুনতে পায় তোর ফিসফিসানি - সে হুঁশ তোর নেই।
- যা হোক আজকেরটা শুনতে পায়নি - গ্যারান্টি।
- কী করে বুঝলি?
- তাহলে এতক্ষণে তেড়ে আসতো। শালা, ধেড়ে বুড়োকে ধেড়ে বুড়ো বলার উপায় নেই। কী অবস্থা সংসারে মাইরি।
- এমন ভাব করছিস যেন আগে বলা যেতো। বর্ণপরিচয়ে পড়িসনি বিদ্যাসাগর বলে গেছেন - কানাকে কানা খোঁড়াকে খোঁড়া বলিও না।
- অত কি শালা মনে আছে? আর মনে থেকেই বা কী? ওটাই সবচেয়ে সহজ আইডেন্টিফিকেশন। যারা পড়াশোনা করে কেউ কেটা হয়েছে, তারা বলে না ওই ল্যাংড়ার দোকানের চা খেতে যাবো? বা ওই চোখ কানা, গণশার মেয়েটা এখন বাপের ব্যবসাটা বেশ ধরেছে!
- হ্যাঁরে স্বপনা, অনেকদিন ধরেই কথাটা শুনেছি, সত্যি সত্যি গনেশদা কি এখন একদম চোখে দেখতে পাচ্ছে না?
- তাই তো শুনি।
- দোকানে আসে না আজকাল?
- একদমই না। গত চার মাস আমি একদিনও দোকানে দেখিনি।
- কী হয়েছে?
- শুনলাম নাকি মাথার মধ্যে একটা টিউমার হয়েছে। একটা চোখ তো আগেই খারাপ ছিল, এবার আরেকটাও গেল।
- দোকানটা কে চালায় এখন?
- ওই যে ওর মেয়েটারে- গৌরী, ওই তো দোকানটা চালায়।
- ও তো এম.এ পড়ছিল না ?
- অত শত জানিনা। কিছু একটা পড়ছিল। তুই তো দেখিছি মেয়েটার হাঁড়ির খবর রাখিস রে নীল! বলি ব্যাপার কী?
- ব্যাপার মানে?
- ওদিকেও মন উচাটন মনে হচ্ছে? দেখব নাকি চেষ্টা চরিত্র করে? নাকি এখনও কাঁপন বুকে নাচন লাগে?
এই ফাঁকে নাড়ু, শম্ভু, অরুণ, টুপিরা জড়ো হয়েছে। টুপী এদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ।ও বলল, ‘কী ব্যাপার স্বপনদা, কাব্য করছ কী নিয়ে?’
নীলাদ্রি বলল, ‘ছাড় তো ওর কথা। যা বরং একটু পাঁপড় ভাজা নিয়ে আয়। আমার থেকে পয়সা নিয়ে যা।’
- এখন কী রথের মেলা নাকি নীলুদা, তোমার জন্য কে পাঁপড় বানাবে এখন!
- তোরা না সত্যি! বাজারে দিন রাত ঘুরে বেড়াস জানিস না? অশোকদার বউ ইদানিং সন্ধ্যায় অশোকদার স্টলটায় পাঁপড় আর ঘুগনি নিয়ে বসে। কী রে স্বপনা?
- স্বপনদার মুখে এখন বাক্যি বেরোবে না। রাইভ্যাল বলে কথা। ফোড়ন কাটল নাড়ু ।
- স্বপন ওই অশোক আর তার বউকে পরোয়া করে না, বুঝলি নাড়ু। স্বপন বেশ আগেকার দিনের যাত্রা দলের নায়কদের ঢঙ্গে কথাটা আওড়ালো।
- কেন বাবা স্বপন? তুমি পরোয়া করো না কেন শুনি? অশোকদার বউয়ের হাতে ঝাড় খেয়েছো বলে? শম্ভু চিমটি কাটল হঠাৎ।
- তোরা না এক একটা গাড়োল। কম্পিটিশন সমানে সমানে হয়। অশোকের সাথে বা তার বউয়ের সাথে আমার কোথায় কম্পিটিশন হবে? পাঁপড় ভাজার সাথে লেমন টির? তাও আবার স্বপন কুমারের বিখ্যাত লেমন টি- যা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একমাত্র এই শর্মাই বানাতে পারে! স্বপনের গলায় উত্তেজনা।
- স্বপনদা তোমার চা-টা নিশ্চযই ভালো। কিন্তু ভুলে যেও না অশোকদার দোকানটাও চায়েরই। নাড়ু মোলায়েম গলায় বলল ।
- হলেই বা! কটা চা সারাদিনে বিক্রি করে ও। আরে বাবা স্টলের মাথায় জগন্নাথ হয়ে চড়ে বসে থাকলে কটা লোক আসবে দোকানে? দেখ না, আমি সন্ধ্যে পাঁচটা থেকে পৌনে নটা পর্যন্ত ফ্লাস্ক নিয়ে বাস স্ট্যান্ড থেকে স্টেশন টহল দিই, এতেই তিনশ কাপ চা বিক্রি। তোরাই বল একটা দোকানেও কি অশোকের চা ঢোকে? সবাই আমার খদ্দের।
- এজন্যই তো বৌদি পাঁপড় আর ঘুগনির দোকান দিল স্বপনদা। এই ঝটকায় তোমার...। কিছু অশ্লীল শব্দে বাক্য পূরণ করল নাড়ু।
স্বপন ততোধিক নাটুকে গলায় বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বলল ‘আমার এইটা...।’
নীলাদ্রি বলল, ‘থাম না তোরা। য তো টুপী পাঁপড়টা নিয়ে আয়।’
শম্ভু বলল, ‘আমরা আসার আগে স্বপন কী নিয়ে কথা বলছিলিস রে? মনে হচ্ছে কাঁপন দিদিমনির কথা হচ্ছিল!’
স্বপন একটু কাঁচুমাচু মুখে নীলাদ্রির দিকে তাকাল। দেখল নীলাদ্রির মুখটা বেশ রাগে থমথমে। স্বপন সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে বলল ‘ওই মানে আর কি। জিজ্ঞাসা করলাম- চা বানাবো তো কটা বানাবো? দিদিমণি এলে ওর জন্যও একটা বরাদ্দ থাকে কিনা!’
- শালা তুই কি ওরটা মগনা খাওয়াস? নীলাদ্রি তেড়ে উঠলো।
- আহা চটছিস কেন নীল? মাগনা বিক্রির কথা হচ্ছে না। কটা বানাবো সেই কথাই বলছিলাম।
শম্ভু বলল ‘কী ব্যাপার রে নীল, মেয়েটা তো অনেকদিন আসে না। বলি ব্যাপার কি? পাখি ফুড়ুৎ নাকি রে?
- তা আমি কী করে জানব শম্ভুদা? একটা মানুষ মাসে কটা গিফট আইটেম কেনে? নীলাদ্রি সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করল।
- তা এতদিন সপ্তাহে সপ্তাহে কিনছিল যখন, নিশ্চই দেওয়ার অনেক লোক আছে। শম্ভু ফোড়ন কাটলো।
- তা কাস্টমার বেশী বেশী কিনলে আমার জন্য ভালো না খারাপ? নীলাদ্রি একথা বলতে না বলতে স্বপন বললো ‘কটা গিফট ফ্রিতে যেতো সেটা জিজ্ঞেস করো শম্ভুদা।’
- তাই নাকি রে নীল? ব্যাপারটা তো তাহলে সিরিয়াস রে।
নাড়ু বললো ‘শম্ভুদা তোমার তো অশোকনগরের দিকে রিলেটিভ থাকে, খোঁজখবর নাও না!’
শম্ভু তেড়ে বলল, ‘অশোকনগর কি ছোট জায়গা না কি রে? নাম নেই, ছবি নেই - বললেই খোঁজ নেওয়া যাবে? নীলকেই খোঁজ খবর নিতে হবে। নিদেন পক্ষে নাম ঠিকানা না জানলে কীভাবে খবর নেবো?’
অরুণ বলল, ‘গোয়েন্দা লাগাও।’
- তুই পয়সা দিবি? শালা যতসব ফালতু কথা। স্বপন ছোট করে খিস্তির নামতা শুনিয়ে দিল।
অরুণ বলল 'তবে উপায় বল। এদিকে নীলদার বয়স যে তেতাল্লিশ চুয়াল্লিশ হতে চললো সেদিকে খেয়াল আছে? সবচেয়ে বড় কথা ওই মেয়েটিকে তো দেখলে চব্বিশ পচিঁশ লাগে। নীলদার সাথে বয়সের তফাত অনেক হয়ে যাবে না কি?
স্বপন বলল- ‘আজকাল ওসব নিয়ে ভাবিস না। আমি এক হেকিমের চেম্বারে চা দিতে যাই। ও তো পেপারে বিজ্ঞাপন দিয়ে এসব রোগই দ্যাখে।’
- এইসব রোগ মানে? অরুণ সাদাসিদে ভাবে জিজ্ঞাসা করল। ওর কথা শুনে খ্যা খ্যা করে হেসে উঠলো সকলে। শম্ভু বললো, ‘বাচ্চাদের সাথে ঠেক মারলে এই এক সমস্যা হয় রে নীল। এ শালাদের এখনো গাল টিপলে লালা ঝরে, লাল পড়ার গল্প শুনিয়ে এসবের মানে বলবে কে?
- মানে? ফের হাঁদার মতো চোখ তুলে প্রশ্ন করল অরুণ। এমন সময় টুপী পাঁপড় হাতে ফিরে এলো। নীলাদ্রি বলল, ‘স্বপন দে দে, চা দে এবার।’
২
নীলাদ্রি বাংলায় এম.এ পাশ করে বহুদিন চাকরীর চেষ্টা চালিয়ে শেষমেশ একটা গিফ্ট আইটেমের দোকান দিয়েছে। দোকানটায় আগে ওর বাবার একটা মনোহারী দোকান ছিল। বাবার মৃত্যুর কিছুদিন আগে সে যখন মনস্থ করল এবার ব্যবসাতেই মন দেবে তখনই বাবার সম্মতি নিয়ে দোকানের আগাপাস্তালা বদলে ফেলল। ওর বাবার ইতিমধ্যে দুবার স্ট্রোক হয়ে যাওয়ার কারণে দোকানে আসা প্রায় বন্ধই হয়ে এসেছিল। ছেলে দায়িত্ব নেওয়ার কথা তুলতে তিনি যেন হাতে চাঁদ পেলেন। দুই মেয়ের এক মেয়ে বিয়ে দিতে পেরেছেন, একটি এখনও বিবাহযোগ্যা হয়ে নিয়মিত পাত্রপক্ষের সামনে পরীক্ষা দিয়ে চলেছে। নীলাদ্রিকে খাবারটা সাজিয়ে দিয়ে সে আবার টিভির কোনও সিরিয়ালে মনোনিবেশ করল। খাবার পরের সময়টুকুতে টিভির অধিকার নীলাদ্রির। তার আগে পর্যন্ত মা আর বোনের দখলেই থাকে টিভিটা। বাড়ির ও রোজগেরে বলে নীলাদ্রি আলাদা একটা সম্মান এবং সুবিধা পায়, আজকাল সেটা বুঝতে পারে। কিছুদিন আগেও টিভির রিমোট নিয়ে ভাই বোনের ঝগড়া লাগত। নীলাদ্রি হয়তো স্পোটর্স চ্যানেল দেখতে চাইতো আর বুল্টি সিরিয়াল। ইদানিং বাবা মারা যাওয়ার পর বুল্টি নিজে থেকেই নীলাদ্রির হাতে রিমোটটা দিয়ে শোওয়ার ঘরে উঠে যায়। প্রথম দিকটা নীলাদ্রির অবাক লাগতো, ইদানীং অভ্যাস হয়ে গেছে। তবে ও বুঝতে পারে বুল্টির সাথে সেই ভাই বোনের খুনসুটি এখন আর বেঁচে নেই। ও কখন এবাড়ির গৃহকর্তা হয়ে সম্ভ্রমের পাত্র হয়ে গেছে খেয়ালও করেনি। নীলাদ্রি রাত্রে দেরী করে বাজার থেকে আসে বলে ইদানিং মা আর বুল্টি একসাথে আগে ভাগে খেয়ে নেয়। কিছুক্ষণ বাদে বুল্টি বলল, ‘দাদা আর কিছু নিবি?’
নীলাদ্রি অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিল 'না'। তারপর হঠাৎ কী মনে হতে বলল, 'বুল্টি এখানে এসে বোস না।' সিরিয়াল দেখতে দেখতে বুল্টি বলল, ‘কী হল? ওখান থেকেই বল না।’
নীলাদ্রি কিছু বলল না। বুল্টিও কী ভেবে এক মিনিট বাদে টিভিটা বন্ধ করে ওর সামনে এসে বসল।
- কিছু বলবি দাদা?
- না না। তেমন কিছু না ।
- ডাকলি যে!
- আজকাল তো তোর সাথে কথাই হয় না বুল্টি। কতদিন তোকে ভালো করে দেখি না।
- দেখবি কখন? আটটায় ঘুম থেকে উঠিস নটায় বেরিয়ে যাস। দুটোয় আসিস চারটায় বেরিয়ে যাস। আবার…
- থাক থাক। তোকে আর ফিরিস্তি দিতে হবে না। কাজেই তো যাই না কি? একটু যেন তিরিক্ষে জবাব দিল নীলাদ্রি।
- তুই এভাবে বলছিস কেন দাদা? আমি কি কোনও অভিযোগ করেছি। তুই বললি দেখার সময় পাস না তুই, সেটাকে সমর্থন করার জন্যই তোর শিডিউলটা বললাম।
নীলাদ্রি বুঝল একটু বেশী জোরে কথাটা বলে ফেলেছে।
আসলে ওর মনে হয় বুল্টির এতদিন বিয়ে না দিতে পারার জন্য ওর মনে কোন ক্ষোভ আছে। হয়ত সেই কথার বহিঃপ্রকাশ ছিল ওটা। নিজে মনে মনে লজ্জিত হয়ে আড়চোখে দেখলো বোনকে। একটা ছিট কাপড়ের নাইটি পরা উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের মিষ্টি চেহারা। বয়স প্রায় চল্লিশ হতে চলল, যদিও দেখে ত্রিশ বত্রিশের বেশী মনে হয় না। ওর একটাই সমস্যা, বড্ড বেশি রোগা ও। চোখে মুখে এতখানি লাবণ্য, অথচ ভগবান অন্যত্র যে এমন করে কার্পণ্য করেছেন - পাত্রপক্ষ প্রত্যেক দর্শনে এসে এটা বুঝিয়ে দেয়। এই নারীত্বের অপমান সইতে সইতে বুল্টি আজকাল বড় বদলে গেছে। ওর হাবভাব দেখলে মনে হয় যেন একটা বিয়ে না হওয়াই যেন ওর জীবনে সবথেকে বড় অভিশাপ। অথচ নীলাদ্রির বাবা বেঁচে থাকতে থাকতেই যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন, নীলাদ্রিও চেষ্টা করেছে। জেনে শুনে তো যার তার হাতে বোনকে তুলে দেওয়া যায় না। বয়সটা মিথ্যে বলতে হয় লোককে। তাও কত কম বলা যায় ? পঁয়তিরিশ তো বলতে হয়। অধিকাংশ পাত্রই হয় ডিভোর্সি, নয় পঞ্চাশোর্ধ। আজকাল বুল্টিকে দেখলেন মনে হয় ওর এতেও আপত্তি নেই! অথচ নীলাদ্রি কি ওদের কষ্টে রাখে? দাদার উপর এই ভরসা নেই যে বয়সকালে ওর অযত্ন হবে না? না কি এই ভয় পায় যদি নীলাদ্রি বিয়ে করে বসে, তার বৌদি না দেখে? নীলাদির নিজেও বিয়ে করেনি এতদিন, সে কি বোনের জন্য নয়? নইলে গনেশদা তো আকারে ইঙ্গিতে অনেকবারই বলেছিল ওর মেয়ের সাথে নীলাদ্রির বিয়েটা দিতে চায়। গৌরিও যে খুব অমত করতো- তা নয়। নীলাদির ইদানিং একটু চুলটুল উঠে গেছে, নইলে বেশ পাতলা মিষ্টি চেহারা তার। বয়সের তুলনায় অনেক ছোটই দেখতে লাগে ওকে, গৌরীর বয়স যদিও ওর চেয়ে তেরো চোদ্দ বছর কমই হবে তবু কেন কে জানে গৌরীর চোখের দৃষ্টিতে কোথাও একটা প্রশ্রয় ছিল। গৌরী যখন বাংলাতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হল তখনই এটা ওটা ছুতো নাতায় ওর কাছে আসতো। গনেশদার স্ত্রী সরলা বৌদিও ডেকে পাঠাতেন। বছর দুই আগেও এম. এ ক্লাসে ভর্তি হবার আগে ওর সাথে যোগাযোগ করেছিল গৌরী। নীলাদ্রি সিম্পলি বিয়েটাকে গুরুত্ব দেয়নি। মা দু একবার ওর বিয়ের কথা তুলেছিলেন যদিও, কিন্তু বুল্টির কারণে সেটা আর আমল পায়নি। বেশ কিছুকাল এই নিয়ে প্রসঙ্গ ওঠে না আর। হয়তো বা মেয়ে আর নিজের নিরাপত্তার চিন্তা ইদানীং মায়ের কাছে মূখ্য হয়ে উঠেছে। আজকাল পেপার খুললে মেয়েদের রোগা থেকে মোটা হওয়া বা এই জাতীয় অনেক ওষুধের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। কিন্তু নীলাদ্রি দাদা হয়ে বোনকে এসব ওষুধ এনেই বা দেয় কী করে! তবু কায়দা করে দু-একবার ডাক্তার কবিরাজ করেছে। বুল্টিও নিজের থেকে এসব ওষুধ দোকান থেকে কিনে এনে খেতো- নীলাদ্রি বুঝতে পারতো আগে, কিন্তু ইদানিং বোধহয় ওরও ধৈর্যচ্যুতি হয়েছে বা বিশ্বাস টলে গেছে। এখন বুল্টি এসব ওষুধ ব্যবহার করে না সম্ভবত। নীলাদ্রি বলল, ‘হ্যাঁরে তোর শরীর ঠিক আছে তো?’
- ঠিক থাকবে না কেন? এইতো দিব্যি আছি।
- আচ্ছা মায়ের শরীর ভালো তো?
- তুই সরাসরি জিজ্ঞাসা করতে পারিস তো। মা খুশি হবে!
- তা তো পারি। তবু বুল্টি তুই এক কাজ কর না, কাল পরশু একবার পাড়ার অনিমেষ ডাক্তারের কাছে গিয়ে তোর আর মায়ের রুটিন চেকআপ করিয়ে আয় না! সেই বাবা মারা যাওয়ার পর ই সি জি, এক্স-রে, ব্লাড ইত্যাদি করানো হয়েছিল। বহুদিন তো করানো হয়নি।
- সে নিয়ে যেতে পারি মাকে। আমার দেখানোর কিছু নেই। আমি সুস্থ আছি।
- সে তো না হয় বাইরে বাইরে সুস্থ আছিস। আদতে কেমন সেটা তো ডাক্তারই ভালো বলতে পারবে না?
- আরে বাবা ডাক্তারকে গিয়ে বলা যায় দেখুন তো আমি সুস্থ আছি কিনা? কিছু একটা হলে জিজ্ঞাসা করা যায় কিংবা বলা যায় কিছু!
- তোর তো রাতে ভাল ঘুম হয় না।
- তুই তো ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোস । তুই বুঝলে কী করে?
- সে আমি বুঝি। আর তাছাড়া তোর চোখের কোলটাও একটু কালো কালো লাগে আজকাল। এসব তো বলতেই পারিস। এছাড়া মেয়েদের আরও কত রকমের সমস্যা।
- দূর! গেলেই একগাদা টেস্ট আর একগাদা ওষুধ! তাও যদি খেয়ে কোন লাভ হত!
- ঠিক আছে। এই ডাক্তার পছন্দ না হলে অন্য কোনও ডাক্তারের কাছে যা। মোদ্দা কথা, যা কালকে।
- আচ্ছা।
- হ্যাঁ রে দাদা তোর দোকানে টুম্পাকে রেখেছিস। কত নেয় মাসে?
- সাড়ে চার হাজার।
- আমাকে রাখ না । তোর টাকাও বাঁচবে আমার সময়ও কাটবে।
- দূর বোকা! তুই দোকানদারী করতে যাবি? লোকে কী বলবে।
- এতে লোকে বলার কী আছে? আর তাছাড়া টুম্পাও তো কোন বাড়ির মেয়েই।
- তা নয় বুল্টি। তোর দাদা কি তোর ভরণপোষণ করতে পারে না? আর তাছাড়া তুই চলে গেলে মা একা একা কী করে থাকবে বাড়িতে? তুই থাকলে বাড়ীর কাজকর্মে তো মায়ের সুবিধা হয়।
- আমার যদি বিয়ে হয়ে যেত দাদা?
চুপ করে রইল নীলাদ্রি। এই একটা প্রসঙ্গ উঠলে বড় অসহায় লাগে তার। কেমন যেন একটা অপরাধ বোধ গ্রাস করে তাকে। সে আন্তরিকভাবেই চায় বুল্টির বিয়েটা হোক। আলাদা করে কিছু টাকাও জমিয়ে রেখেছে সে। মায়ের যা কিছু গয়নাগাঁটি আছে দু-একটা রেখে বাকি সবই দিয়ে যদি ওর বিয়েটা হয়ে যায় তবে তার মতো সুখী কেউ হবে না! ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বুল্টি যেন পুনরায় কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়ার জন্যই বলল, ‘কীরে দাদা কিছু বললি না তো।’
- কী বলব রে বুল্টি। বিয়ে হয়ে গেলে তখন অন্য ভাবনা ।
- অন্য ভাবনা বলতে?
মনে মনে বিরক্ত হল নীলাদ্রি। বুল্টি কি অন্য ভাবনা বলতে ওর বিয়ে করাকে ইঙ্গিত করছে? তবু গলাটাকে যতটা সম্ভব মোলায়েম করে বলল, ‘বিয়েটা আগে হোক না। তখন ভাবা যাবে।’
- বিয়ে আর হবে না দাদা। মিছিমিছি চেষ্টা করিস না ।
- তোকে বলেছে?
- চল্লিশ বছর পার হয়ে গেল দাদা । এখন বিয়ে হয়েই বা লাভ কী?
নীলাদ্রি ভেবে পেল না এতে লাভ লোকসানের কী আছে। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বলল ‘ক্ষতিটাও তো বুঝলাম না।’
- থাক দাদা ওসব আলোচনায় কাজ নেই। আমার শুধু শুধু বাড়ি বসে থাকতে বোর লাগে। যদি কোনও কাজকর্ম জুটিয়ে দিতিস তো টাইমপাস হত।
- তুই কি কোন ভোকেশনাল কোর্স ফোর্স করতে চাস? পার্লারের কাজ, কম্পিউটার বা অন্য কিছু? ইচ্ছে হলে বলিস ব্যবস্থা করে দেওয়া যাবে।
- আচ্ছা তুই কি এখন টিভি দেখবি?
- কেন?
- তাহলে আমি শুতে যাব।
- আচ্ছা যা তাহলে।
৩
চা এর আড্ডায় আজ জোর জটলা। স্বপন ট্রেনের একজন চা হকার এর সাথে যোগাযোগ করে 'কাঁপন' এর ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছে। সে নাকি একটা হোটেলে বার ড্যান্সারের কাজ করে। নীলাদ্রি চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনছে সবার কথাবার্তা। এই বিষয়ে বলার তো কিছু নেই। সবাই এমনভাবে সহানুভূতির কথা বলছে যেন নীলাদির সাথে প্রেম ওর ছিলই অথচ ও তার পেশাটা গোপন করেছে। টুপী বলল ‘স্বপনদা বার ড্যান্সাররা কি প্রেম করে না, নাকি তাদের বিয়ে হয় না?’
- হবে না কেন? নীল কি এমন মেয়েকে জেনেশুনে বিয়ে করবে?
- সবই পেটের দায়! তুমি বি. এ পাস করে ফ্লাস্কে করে চা বেচবে কখনও ভেবেছিলে নাকি নীলদা এম.এ পাস করে দোকানদারির কথা ভেবেছিল? টুপির সোজাসাপ্টা কথা।
নীলাদ্রি মনে মনে ভাবছিল কাপঁনের কথা। হয় তো সেভাবে প্রেম হয়নি, কিন্তু শেষের দিকে মনে মনে কোথাও ওর বুকটা ছলাৎ করে উঠতো নাকি ওকে দেখে? হয়তো অনেকটাই ছোট, হয়তো ওর পক্ষ থেকে কোনও কিছু ছিল না ওর প্রতি, তবু কোথাও কি সপ্তাহে একবার ওকে একবার দেখতে চাইতো না সে? তার ভালো লাগার মানুষ অন্য লোকদের কামনা-মুখর চাওনির সামনে শরীরের বিভঙ্গ তোলে- ভাবতেই মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল তার।
শম্ভু বলল, 'বুঝলি নীল, আমার মনে হয় এবার তোর দোকানে এলে সরাসরি তোর জিজ্ঞাসা করা উচিৎ?’
স্বপন বললো, 'তোমারও বলিহারি বুদ্ধি শম্ভুদা । নীল কী জিজ্ঞাসা করবে? তুমি কী কর? আরে বাবা জানা যখন হয়েই গেল ফালতু এর মধ্যে আর ঢোকার দরকার কী? সিম্পলি কাস্টমার হিসাবেই ডিল করুক না।’
শম্ভু বলো, ‘যদি এই পেশার ব্যাপারটা সত্যি না হয়?’
- একশ ভাগ সত্যি! যে খবর দিয়েছে সে জেনুইন লোক।
- তবুও যাচাই করে নিলে হয় না? শম্ভু নিজের বক্তব্যকেই প্রতিষ্ঠা করতে চাইলো।
টুপী বলল, ‘কী নীলদা? ধর সত্যি সত্যি মেয়েটা যদি বার ড্যান্সার হয়, তুমি কি আপত্তি করবে? আমার তো মনে হয় তোমার অপছন্দ হলে ওর কাজটা বন্ধ করে দিতে পারো। কিন্তু এই অপরাধে মেয়েটাকে ত্যাগ করা উচিৎ হবে না।’
নাড়ু বলল- ‘তোর এত উটকানি পীরিত তো তুই কর না! নীলদাকে ভেড়াচ্ছিস কেন?’
অরুণ বলল, ‘স্বপনদা তুমি চা টা দাও তো। এসব চর্চা করে কোনও লাভ নেই।’
চা দিতে দিতে স্বপন বলল, ‘নীল, দ্যাখ তোর বয়েস তো আমার মতোই। তুই আর দেরী করিস না? বিয়ে করতে হলে অলরেডি বয়স চলে গেছে। এবার সিরিয়াসলি ভাব। না হয়, আমরাই মাসিমাকে বলি?’
- না রে স্বপন। বুল্টিটার বিয়ে না হলে আমি বিয়ে করব না।
- ধর বুল্টির বিয়ে হল না, তাহলে তুইও কি করবি না?
- না।
-তুই এই বাজারের মধ্যে কাউকে তোর বোনের জন্য ভাবছিস না কেন নীল? শম্ভু জিজ্ঞাসা করল।
- কার কথা ভাববো?
- এই ধর অরুণের পাশের দোকানটা। কী নাম ওর যেন রে অরুণ?
- বাপ্পা।
- ছেলেটার রোজগার তো খারাপ নয়। জেরক্স সেন্টার কাম স্টেশনারী। তবে অনেকগুলো বোন। এখনও তিনটের বিয়ে হয়নি।
- তুমি বল শম্ভুদা, এর পরও কি ওখানে বুল্টির সম্বন্ধ ঠিক করা যায়? কাতর গলায় বলল নীলাদ্রি।
- তাহলে আজীবন ও আইবুড়ো নাম আর খণ্ডাবে না নীল। তুই মনস্থির কর, আমি না হয় ওর বাড়ীতে গিয়ে কথা বলব।
স্বপন বলল, ‘নীল রাগ করিস না। আজ একটা গোপন কথা সবাইকে শেয়ার করতে চাই। শম্ভুদা তুমি তো সিনিয়র লোক, তুমি বরং গনেশদার বাড়িতে গিয়ে নীলের বিয়ের ব্যাপারটা বল।’
শম্ভু, আকাশ থেকে পড়ে বলল, 'গণেশদার বাড়ী গিয়ে বলব কেন?'
- গণেশদার একটা বিবাহযোগ্য মেয়ে আছে জানো, নাকি জানো না? স্বপন জিজ্ঞাসা করল।
- ও তো শিশুরে স্বপনা। নীল কি বুড়ো বয়সে শিশু বধ করতে যাবে নাকি? শম্ভুর গলায় কৌতুক।
- তুমি জানো না বলেই মজা করছ। স্বপন গলায় সুর তুলে বলল 'ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে খোকাবাবু'। স্যরি ভুল বললাম, টেনসে। খাচ্ছে না খাচ্ছিল।
- জলও কি ডুবে ডুবে খোকাকে খাচ্ছিল? ফোড়ন কাটলো অরুণ।
- তাই তো মনে হয় রে।
নীল সজোরে একটা ধমক দিয়ে বলল, ‘তোরা একটু চুপ করবি? সেই তখন ধরে কী নিয়ে পড়েছিস?’
- তোকে নিয়েই তো পড়েছি সবাই। তোর একটা হিল্লে করতে চাই। স্বপন বলল।
- আমাকে নিয়ে তোদের আর ভাবতে হবে না বাবা। ক্ষ্যামা দে। আর কচকচি ভালো লাগছে না।
অরুণ একটু সিরিয়াসলি বলল, ‘নীলদা, শম্ভুদা কিন্তু কথাটা মন্দ বলেনি। আমার মনে হয় বাপ্পাদার বুল্টিদিকে পছন্দ।’
নীলাদ্রি বলল, ‘বুল্টিকে বাপ্পা দেখল কোথায়?’
বুল্টিদি পয়লা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়ায় তো তোমার দোকানে আসে। তখনই দেখে থাকবে।
- আমাকে এতদিন বলিস নি কেন?
- আমার মনে হতো, কী জানি তোমায় বললে যদি তোমার খারাপ লাগে।
শম্ভু বলল, ‘ঠিক আছে নীল। তুই এক কাজ কর, বুল্টির একটা ভালো দেখে ফটো রেডি করে কাল নিয়ে আসিস। আমি কাল গিয়ে বাপ্পার মায়ের সাথে দেখা করবো।’
অরুণ বলল, ‘আমিও বাপ্পাদাকে কাল একটু হিন্টস দিয়ে রাখব।’
- শম্ভুদা বিয়েটা লাগিয়ে দাও তো দাদা। নীলটার বিয়েটা নিয়ে তারপর চুটিয়ে ভাবা যাবে। আন্তরিক ভাবেই বলল স্বপন।
টুপী বলল ‘নীলদার বিয়েতে কিন্তু তোমার লেমন টি’র একটা স্টল লাগিও স্বপনদা। পুরোটা ফ্রি তে কিন্তু।’
- দূর দূর! বিয়েতে কেউ লেমন টি’র স্টল দেয় না। অশোকদাকেই চা'টার দায়িত্ব দিতে হবে। ফোড়ন কাটল নাড়ু।
শম্ভু বলল, 'গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল করিস না। আর তাছাড়া বুল্টির বিয়েটা তো আগে লাগবে। আগে তাতে চা'র জন্য কার স্টল লাগবে ঠিক কর। নীলেরটা পরে ভাবা যাবে।’
সবাই চা টা খেয়ে ধীরে ধীরে বিদায় নিতে স্বপন বলল, ‘নীল কাপঁনের খবরটা শুনে কি খারাপ লাগলো তোর?’
খানিকটা যেন গলা চড়িয়েই নীল বলল, ‘দূর! যার নামটুকু জানি না, তার সম্বন্ধে কি এসব ভাবনা চলে? নেহাৎ তোরা ইয়ার্কি মারতিস। সেইটুকুই ওর প্রতি ইনভলভমেন্ট। তবু একটা কথা- কোনও চেনা মেয়ের এমন জীবিকা শুনতে তো ভালো লাগে না স্বপন। সেটুকু খারাপ তো লাগছেই।’
- এর মধ্যে তবু একটা ভালো ব্যাপার হলো রে নীল। ঠাকুর ঠাকুর করে যদি বাপ্পার সাথে বুল্টির বিয়েটা লেগে যায় তবে তোর একটা বোঝা কমবে।
- স্বপন বোঝা শব্দটা বলিস না। ও কি আমার বোঝা?
- স্যরি। ওভাবে বলতে চাইনি কথাটা। তবে তোর একটা দায়মুক্তি তো হবেই। ওই বিয়েটা না হলে তোর নিজের বিবেক দংশন হবে, তুই আর বিয়েই করতে পারবি না।
- তা ঠিক। তবে শম্ভুকে যে তুই গৌরীর কথাটা বললি, না বললেই বোধ হয় ভালো হত।
- দ্যাখ নীল সবার মাঝে কথাগুলো উঠল বলেই না বাপ্পার কথাটা বেরাল। আর তাছাড়া আমরা সবাই তো বন্ধুই। বন্ধুর দরকারে আর একজন পাশে দাঁড়াবো না?
- আমি ঠিক তা বলতে চাইছি না রে স্বপন। যদি গৌরী না করে দেয়? ও তো অনেকটাই ছোট রে।
- ছোট তো কি হয়েছে? কুড়ি-পঁচিশ বছরের ছোট বড়তে বিয়ে হচ্ছে আজকাল।
- কিন্তু 'না' বলে দিলে মান সম্মান থাকবে নারে স্বপন।
- এতে মান সম্মানের কী হলো নীল? বিয়ের কথা চলাচলি না করলে কথা এভাবে কী করে? আর সব কথাতেই 'হ্যাঁ' বলতে হবে- এমন কোথায় লেখা আছে?
- তা নয়। আসলে চেনাশোনার মধ্যে তো! গৌরী ভাববে নির্ঘাত আমি শম্ভুদাকে পাঠিয়েছি।
- ভাবলে তো ভালোই। কে বলতে পারে ওর এতদিন বিয়ে না করে থাকাটা তোরই প্রতীক্ষায় কিনা?
- যাঃ!
- যা কী রে! এরকম কত হয়।
- দ্যাখ গিয়ে অন্য কারুর জন্য অপেক্ষায় রয়েছে হয়ত।
- নীল আমরা তো প্রস্তাবটুকু দেব। তেমন হলে রাজী হবে না। সে সব তো ওদের হাতেই আছে। তুই আর এই নিয়ে চিন্তা করিস না। বাড়ি গিয়ে বরং তোর মায়ের সাথে কথা বল। বুল্টির একটা ভালো দেখে ফটো নিয়ে আয় কাল।
- স্বপন বাপ্পার বয়স কেমন হবে?
- উনচল্লিশ-চল্লিশ তো হবেই।
- তাহলে তো বুল্টির বয়সী হবে রে। এখানে এগোনোটা কি ঠিক হবে? সবাই জানাশোনার মধ্যে।
- ছাড় তো। আগ বাড়িয়ে কে ওর বার্থ সার্টিফিকেট দেখতে চাচ্ছে। আর তাছাড়া তখন তো বার্থ সার্টিফিকেটে তেমন প্রচলিত ছিল না- মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ডই চলতো। চাইলে বলবি- হারিয়ে গেছে। ব্যবসায়ী ঘর; কেউ তো আর চাকরী করতে পাঠাবে না বউকে।
- তবু।
- দ্যাখ নীল, বেশী সতীপনা করিস না। এই করে বোনের এতদিন বিয়েটাই হয়নি।
- নিজের বিবেক বলে তো একটা ব্যাপার আছে রে।
- ছাড় তো। বিবেককে ভেজ দো তেল বেচ নে। ছেলের পছন্দ যদি থাকে, তুই আগ বাড়িয়ে 'আমি তো কলা খাইনি', মার্কা ডায়লগ দিতে যাস না। তুই চুপ করে থাক না। যদি বাপ্পার পছন্দ থাকে তবে সে নিজেই সব ম্যানেজ করে নেবে।
- শুনলাম যে বাপ্পার তিনটে বোনের বিয়ে হয়নি।
- সেটা ওদের সমস্যা। বাপ্পা তো তুই নয়- সে এই অবস্থায় নিজেই তো বিয়ে করতে চাইছে।
- আমি সেটার কথা বলছি না। বুল্টি এত ননদ নিয়ে ঘর করতে পারবে তো?
- তুই বুল্টিকে জিজ্ঞাসা কর। আর তাছাড়া খারাপ মনে করিস না, কয়েকদিন আগে বুল্টির সাথে কথা বলে মনে হল ওর শুধু এখন একটা বর চাই। এসব বাধা তার কাছে এই মুহূর্তে বড় হয়ে দাঁড়াবে না আশা করি।
- আমি বাবার কাছে ছোট হয়ে যাবো না তো রে স্বপন?
- তোর বাবা কি চেষ্টা চরিত্র করে ওর বিয়ে দিয়ে যেতে পেরেছে? ছাড় এসব। সব ভাগ্যের ব্যাপার।
রাতে যখন নীল বাড়ি ফিরল তখন রাত প্রায় সাড়ে দশটা। অনেকখানি মন খারাপ ছিল আজ তার; কিন্তু বুল্টির বিয়ের সম্ভাবনাটা তাকে কাঁপনের দুঃখ অনেকখানি ভুলিয়ে দিয়েছে। মনে মনে একসময় গৌরীকে তার পছন্দই ছিল। পরিস্থিতির চাপে এতদিন তার কথা মনেই করতো না। আজ বছর দুয়েক আগে দেখা তার মুখটা মনে পড়তে হালকা একটা বসন্ত বাতাসের ছোঁয়া অনুভব করলো সে।
বাড়িতে ঢুকে দেখলো, বুল্টি আজ টিভি দেখছে না। বোধ হয় শুয়েই পড়েছিল। বেল বাজাতে একটু দেরী করেই দরজা খুলল। নীলাদ্রি মনে মনে ভেবে এসেছিল বুল্টিকে আজই সম্বন্ধের খবরটা দেবে, ওর একটা ভালো মত ছবি চাইবে, কিন্তু ওর মুখটা দেখে মনে হল থাক, কাল সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই কথাটা বলবে। আজ বরং একটু গৌরীর সাথে দেখা হওয়ার স্মৃতিগুলো নাড়াচাড়া করে দেখবে সে শুয়ে শুয়ে। কাঁপন কদিনেই মনে বড় দাগ ফেলে দিয়েছিল তার। আচ্ছা গৌরীর কাছে প্রস্তাব পাঠানোর আগে কাপঁনের জন্য কয়েক দিন অপেক্ষা করে দেখবে না কি সে? একবার খোলাখুলি কথা বলে নিলে বোধ হয় সারা জীবন আফসোস থাকবে না। ওর যদি ওকে পছন্দ থাকে ওর কাজটা ছাড়িয়ে দিলেই হবে। তবে স্বপনরা ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখবে না- তা ঠিক। মা জানতে পারলেও মানবে না- গ্যারান্টি। বুল্টি বলল, ‘দাদা- হাতমুখ ধুয়ে নে তাড়াতাড়ি। খেতে দেব।’
- তোদের খাওয়া হয়ে গেছে?
- এ আর নতুন কী কথা দাদা? আমরা তো সাড়ে নটায় খেয়ে নিই। আজ হঠাৎ জিজ্ঞাসা করছিস।
আজকাল বুল্টি বড় ক্যাটস ক্যাটস কথা বলে। নীলাদ্রি আর কথা বাড়ালো না। বলল ‘তুই খেতে দিয়ে দে।’ বুল্টি খেতে দিয়ে অদূরে একটা চেয়ারে চুপ করে বসে রইল। নীলাদ্রি বলল, ‘আমি আর কিছু নেব না বুল্টি। তুই শুয়ে পড়। আর শোন না- কাল আমাকে একটু সকাল সকাল ডেকে দিস তো।’
- কেন রে? কোথাও যাবি?
- না রে, কাল মায়ের সাথে কিছু জরুরী কথা আছে। বলেই মুচকি হাসলো নীলাদ্রি।
বুল্টি আর কথা না বাড়িয়ে বলল, ‘আচ্ছা।’
একটু পরেই বিছানার মধ্যে গিয়ে ঢুকলো নীলাদ্রি। বুল্টি বিছানা পেতে মশারি টাঙিয়ে রাখে। আজ শুয়েই বুল্টির জন্য বুকের কোণটায় একটু চিন চিন করে উঠলো তার। 'ঠাকুর ঠাকুর বুল্টির বিয়েটা যেন হয়ে যায়।' মনে মনে ঈশ্বরকে প্রণাম জানালো সে। এই বাড়ীর অনেক কিছুই বুল্টির স্পর্শে সজীব থাকে। টবের গাছগুলো, আলনা-বিছানা-ঘরের দেয়াল-তাক - সবকিছুতেই ওর যত্নের ছোঁয়া। বুল্টির কথা ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ল সে। ভোরের দিকে মায়ের ঠেলায় ঘুমটা ভেঙে গেল তার।
- পল্টু -ওঠনা শিগগিরি।
- কি হয়েছে মা?
- বুল্টি কোথায় জানিস?
- মানে? বাথরুমে গেছে নাকি দেখেছ?
- সকালে বাথরুমে যাওয়ার জন্য উঠে দেখি ও বিছানায় নেই। ভাবলাম ওর তো ভালো ঘুম হয় না। ভোরে উঠে ছাতে টাতে গেছে বোধ হয়। চারিদিক দেখে তবেই তোকে ডাকছি। কোথাও নেই রে পল্টু। ঘরের মেন দরজা খোলা। মা এবার কাঁদতে শুরু করে দিলেন।
- মা তুমি থামো। কেঁদো না এখন। ও কি সকালে উঠে রাস্তায় হাঁটতে টাঁটতে যায়?
- না বাবা। কোনদিন যায় না। আর তাছাড়া এভাবে দরজা খুলে যাওয়ার মেয়ে ও নয়। গেলে আমাকে বলেই যেতো।
নীলাদ্রি কোনও দিশা পেল না। থানায় যাবে? সবে বিয়েটার কথা উঠলো। এমন সময় থানা পুলিশ হলে জীবনে বিয়ে হবে? মা কে বলল, ‘মা দ্যাখোতো ওর জামা কাপড়। কোনও ব্যাগ ট্যাগ কিছু নেই কিনা দ্যাখো।’
নীলাদ্রিও ওর ঘর তন্ন তন্ন করে দেখলো কিছু চিঠি পত্র লিখে গেছে কিনা। খানিকক্ষণ বাদে মা কাঁদতে কাঁদতে ডাইনিং টেবিলের উপর থেকে একটা কাগজ এনে ওর হাতে দিলেন। বুল্টির চিঠি। মা কে উদ্দেশ্য করে লেখা।
‘মা, আমি জানি আমার জন্যই দাদার বিয়ে হচ্ছে না। আমার যা কপাল আমার জন্য দাদাও সারা জীবন এমনি করে কাটাবে। তুমি এবার উঠে পড়ে দাদার বিয়েটা দিও মা। আমার জন্য থানা পুলিশ করো না। আমি আজ সকালের ট্রেনে বিহার যাচ্ছি। কার সাথে যাচ্ছি নিশ্চযই কৌতুহল হচ্ছে? আমাদের যে ময়লা নিতে আসে 'প্রসাদ' নামের লোকটা, তার সাথে যাচ্ছি। গতকাল মন্দিরে গিয়ে ওর সাথে বিয়ে করে এসেছি। তোমার আশীর্বাদ পাবো না জানি। তাই সেই চেষ্টা করিনি। হয়তো তোমাদের সম্মানহানিও হবে এর জন্যে। পারলে ক্ষমা করো।’
ধপ করে বসে পড়ল নীলাদ্রি। বুকের ভেতরটা কেমন দলা পাকিয়ে উঠল তার। মা কে বলল ‘কী হল মা? তুমি কি টের পাওনি কিছু?’
- না রে বাবা।
- প্রসাদ তো মাতাল মা। রেলগেটের ওপারে থাকতো, বউ বাচ্চাও তো আছে বলেই জানি। আমি এক্ষুনি পুলিশে যাবো মা। নির্ঘাত বেচে টেচে দেবে।’
মা দৃঢ়স্বরে বললেন- ‘ছাড়। মরতে দে ওকে। যার এইটুকু হুঁশ নেই তার মরাই ভালো।’
- জানো তো মা কালকেই ওর একটা সম্বন্ধ মোটামুটি স্থির করে আনলাম। ওটা ওর শোনার তরটুকুও সইলো না মা।
- ভাগ্য বাবা।
নীলাদ্রির চোখ গেল দেয়ালের দিকে। ওর বাবার মস্ত একটা ছবি যেন ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। যেন বলছে ‘এইটুকু দায়িত্বও সামলে নিতে পারলি না পল্টু? বাড়ীর মুখে চুন মাখিয়ে চলে গেল যে।’ নীলাদ্রি চোখ বন্ধ করে মনে মনে বার কয়েক আওড়ালো- 'ক্ষমা করো। বাবা ক্ষমা করো।'
গতকাল হঠাৎ করে ভেসে আসা বসন্তের বাতাস যেন দম বন্ধ ঘরের চারপাশে থমকে রইল সারাক্ষণ। বাবার ফটোটার দিকে চাইতে গিয়েও আনমনে চোখ নেমে গেল নীলাদ্রির।
0 Comments