জ্বলদর্চি

কুয়াশা যখন /পর্ব ৬/বাসুদেব গুপ্ত

কুয়াশা যখন  
পর্ব ৬.   
বাসুদেব গুপ্ত 

ছাঁটাই করার লাটাই

চন্দনের কেবিনে হঠাৎ একটা জোর চীৎকার শোনা গেল। এতই জোরে যে কোডার, ডেভলপার, ইঞ্জিনীয়ার সবাই AI-induced ঘুম থেকে চমকে জেগে উঠল। এখন আর কেউ কোড লেখে না, একদিকে শেওলার মত মনের মধ্যে জমে ওঠা আলস্য, অন্যদিকে হিকোমার স্পষ্ট নির্দেশ—তিনি আর কোনো মানুষের কোডে বিশ্বাস করেন না। সব কিছু CodeGPTকে জিজ্ঞেস করে লিখতে হবে। CodeGPT-ই তাদের জন্য কোড লেখে, তারা শুধু জিজ্ঞেস করে আর কপি করে।
স্বপনের চিৎকার এবার পরিষ্কার শোনা গেল
— “গত বছর আমার মাইনে এত বাড়ালেন কেন, কে বলেছিল?” 
চন্দনের গলা খুব মৃদু-
— “হিকোমা বলেছিলেন। কেন, মাইনে বাড়ানো খারাপ?” 
“অবশ্যই খারাপ, আমি নাতনির জন্য ফ্রিজ কিনেছি, মেয়ে আর স্ত্রীর জন্য স্মার্টফোন। সবই EMI-তে। এখন কিভাবে EMI দেব?” 
আধো ঘুমন্ত কোডারদের ভিড় থেকে কেউ মন্তব্য করল, 
-দেখো, লোকটা কাল খাবার কোথা থেকে পাবে সেটা নিয়ে চিন্তা নেই, EMI নিয়ে চিন্তা করছে। এ থেকেই বোঝা যায় আমাদের আর্থিক প্রগতি সত্যিই হচ্ছে।”
-হ্যাঁ আমি কোড জিপিটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ইন্ডিয়া কেমন প্রগ্রেস করছে, তা যা বলল মিলে গেল, ইন্ডিয়া পৃথিবীর ৪র্থ ইকনমি হয়ে যাচ্ছে। চীন আমেরিকা সবাই আমাদের সমীহ করে চলে।
-হুঁ, চুপ কর শুনি স্বপনদা চেঁচাচ্ছে কেন। 

ওদিকে চন্দনের ঘর থেকে গলার স্বর কমার কোন লক্ষণ নেই।
+ কি ভেবেছেন, আমার অনেক লাইয়ার চেনা আছে। আমার বন্ধু।   আমি যাব, তাদের সঙ্গে দেখা করব, কোম্পানিকে কিন্তু একটা শিক্ষা দেব। আমার পাওনা চাই। গ্র্যাচুইটি কোথায়? ছাড়াবার টাকা?” স্বপনের কথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল।


চন্দন প্রায় মিনমিন করছে, 
=প্রাইভেট কোম্পানি যে কোনো সময় ছাঁটাই করতে পারে। দেখছো না, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, বড় কোম্পানিগুলো কী করছে? ল ইয়ার কি করবে? মিছি মিছি রাগ করিস না। মেনে নে, কি করবি।
-আমি এতসব জানি না, আপনি বলুন, আমি এখন কী করব?”
 স্বপন চিৎকার করে দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল। পৃথা জানালার বাইরে মুখ বাড়িয়ে দেখল, সে নীচে সিকিউরিটির সঙ্গে সঙ্গে ঝগড়া করছে, রাগ ঝাড়ছে।

গৌতম, যাকে সবাই ‘আঙ্কেল’ বলে, এই কোম্পানির ভালো-মন্দ অনেকদিন দেখেছেন। তিনি আর পুরনো মালিক বহু বছর ধরে কলকাতার সেক্টর ফাইভ এলাকায় কোম্পানি চালিয়েছেন। তখন সেখানে শেয়াল ডাকত, রাতে মোডেমের সঙ্গে মারামারি করে ১০ কেবি আপলোড করে ফেরার সময় যেন ঘোড়া ছুটে দেখেছেন আবছা আলোয়। এখন ঝলমল করছে চারদিক, গৌতম এখন বুড়ো, একা থাকেন, বিপত্নীক। গৌতমের কাছে কোম্পানির সব পুরনো কোডের কাসুন্দি জমা আছে। সবাই তার কাছে পরামর্শ চায়, বিশেষ করে পৃথা, যাকে পুরনো প্রোডাক্টগুলো সামলাতে হয়। কিন্তু গৌতম এখন বেশির ভাগ সময় কবিতা লেখায়, আবৃত্তিতে কাটান। আর যখন যার সমস্যা হয়, বলে দেন, কি করে সেটা লিখতে হবে, চালাতে হবে, টেস্ট করতে হবে। আড়ালে তাঁকে বুড়োজিপিটিও বলা হয়ে সেটাও উনি জানেন। 

তিনি বসে বসে শুনলেন ঝগড়া ঝাঁটি, বুঝতে পারলেন ঝড় আসছে, কিছু একটা করতে হবে, নইলে এই গ্রীন ওয়ার ঝড়ের মুখে কুটোর মত উড়ে যাবে।  তিনি পুরনো মালিকের লেফটেন্যান্ট ছিলেন, কোম্পানি ছিল নিজের আর একটা বাড়ি। গৌতম ধীরে ধীরে চন্দনের কেবিনে গেলেন। তিনি  স্বপনকে চেনেন  প্রথম দিন থেকে, তখন সে কুড়ি বছরের ছেলে। এতদিনে সে অফিসের অংশ হয়ে গেছে, যেন থাম বা লোড বিয়ারিং ওয়াল। ও না থাকলে কি হবে, মাথায় ঢোকে না। 



সেই স্বপনকে এখন চলে যেতে হবে! এটা কিরকম হাস্যকর অবিচার! গৌতমের হঠাৎ মনে পড়ল, এক শনিবার স্বপন তার বারান্দার গাছ দেখতে এসেছিল।  নিজেই বসে বসে আগাছা সাফ করল, কিছু গাছ ছাঁটল, আগাছা বাদ দিল। তারপর বলেছিল, “আপনি একদম গাছে নজর রাখেন না স্যার, অনেক গাছ শুকিয়ে যাচ্ছে। আমি প্রতি সপ্তাহে একবার আসব ছাঁটাই করতে।” গৌতম গাছের কিছু জানেন না, তাই হাসলেন, স্বপন যা ইচ্ছা করুক। সেই স্বপন! সেও ছাঁটাই!
মনে পড়ল, স্বপন এসে বাথরুমের ট্যাঙ্ক ঠিক করে দিল, যখন সেটা বন্ধ হতো না, পুরো ওভারহেড ট্যাঙ্ক খালি হয়ে যেত। মনে পড়ল, গৌতমদের গ্রুপের ছেপে আসা শয় শয় ম্যাগাজিন প্যাক করল, পোস্ট অফিসে গেল। আর গৌতমের প্রশংসায় পত্রিকার গ্রাহক সবাই পঞ্চমুখ। এত সুন্দর প্যাকিং কেউ নাকি দেখেনি। প্রশংসা তো পাবার কথা স্বপনের। কিন্তু সেটা আর বলা হয়ে ওঠে নি।
স্বপন ছাড়া কোম্পানি চলবে কীভাবে? হিকোমা ওর গুরুত্ব জানেন না। তার কাছে স্বপন অযোগ্য, বয়স্ক, ছোট, কালো, দেখতে খারাপ। ওকে পছন্দ না, ঠিক ভাইবস দিচ্ছে না। 
গৌতমের মনে হল কিছু করা উচিত। 
কয়েক সপ্তাহ ধরে চন্দনের রুমে restructuring নিয়ে জোর আলোচনা চলছিল। বাইরে কেউ কিছু বলছে না, সবাই মুখ টিপে বসে। গৌতমের কানে এলো, মার্কেটিং গার্ল লিফটে ফোনে বলছে, “তোমাদের কোম্পানিতে কোনো ডিজিটাল মারকেটিঙ্গের পোস্ট খালি আছে?” সবাই ভয় পেয়ে গেছে। গৌতম ভাবলেন  হয়তো নিজেরও চাকরি নিরাপদ নয়। AI তে তাঁর ঢোকা হয় নি। এদিকে এখন সবাইকে নাকি এ আই চালাতে হবে, এ আই না কি সব কিছু লিখে দেবে,  বিজনেস প্ল্যান থেকে ছুটির আবেদন থেকে ওয়েব সাইট থেকে মোবাইল এপ। সব। 

হতেই পারে। এখন স্বপনকে যেতে বলা হচ্ছে, হয়তো একদিন গৌতম আঙ্কেলেরো সময় আসবে। মাইনেটাও বেড়ে বেড়ে এখন ভালই। খরচ কমাতে চাইলে তাকেই আগে দেখা হবে। হলে হবে। গৌতম নিজের খাওয়া দাওয়া জুটিয়ে নেবেন ঠিক। নিজের ফ্ল্যাট আছে। কাজ যদি চলে যায়, এখন মন দেবেন কবিতায়। কত কথা লেখার আছে। 
কিন্তু স্বপনের ব্যাপারটা তা নয়। স্বপনের  বয়স হয়েছে। নতুন চাকরি এখন কোথায় পাবে? আর  চাকরি চলে গেলে তো ফ্যামিলি শুদ্ধু ধ্বংস হয়ে যাবে।



“চন্দন, আমার একটা প্রস্তাব আছে।” গৌতম অনেক দ্বিধা কাটিয়ে চন্দনের রুমে গিয়ে একবার জানালার বাইরে তাকালেন।  চারপাশে নীল কাচের উঁচু বিল্ডিং, ভেতরে সবাই AI নিয়ে ব্যস্ত, কেউ কেউ বিশ্বজুড়ে স্ক্যাম করছে। সবাই বাঁচার অধিকার রাখে, কুকুর, নেতা—সবাই। স্বপন কেন নয়?

“আরে বসুন গৌতমদা। কি ব্যাপার?”
চন্দন অদ্ভুত চোখে গৌতমের দিকে তাকিয়ে রইল। গৌতম সিনিয়র, কিন্তু ম্যানেজমেন্ট গ্রুপে নেই। উনি আবার কী প্রস্তাব দেবেন? চন্দনের কাছে কিছু গোপন খবর আছে, যা এখন গৌতমকে বলা বারণ, হিকোমা না বললে বলবেন না। 
“কী প্রস্তাব? অফিসের ব্যাপারে? আপনি এসব নিয়ে ভেবে চিন্তায় পড়বেন না ? আমাদের ম্যানেজমেন্ট কমিটি পুরোটা দেখছে, সব ঠিকঠাক চলছে, এসব নিয়ে ভাববেন না। যাই হোক, শুনি একবার, বলুন কি প্রস্তাব।” 
চন্দন চশমা খুলে টেবিলে রাখলেন, দু হাত দিয়ে চোখ কচলে টেবিলের ফাইলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। যেন জানেন, গৌতমের কোন প্রস্তাবই কোনো কাজে আসবে না। 
🍂

“আমার প্রস্তাব ছিল, আমার মাইনে কেটে যদি স্বপনকে দেওয়া যায় তাহলে তো ওকে রেখে দেওয়া যায়।”
“ধুর, পাগল হয়েছেন নাকি? হঠাৎ এমন কথা মনে হল কেন?”
 “চন্দন, আমি এতদিন কোম্পানিতে আছি, কোম্পানি আমাকে অনেক কঠিন সময়ে অনেক সাহায্য করেছে। আজ স্বপন, প্রায় আমার সমবয়সী, ওও কি সাহায্য পাওয়ার যোগ্য নয়? দেখ, আমি একা থাকি, বেশি টাকা লাগে না। তাই ভাবলাম…”
 “পুরোটা?”
 “অন্যরা সাবস্ক্রাইব করতে পারে, তাহলে তো ভালোই হয়,” গৌতম ভাবলেন, না বললে চন্দন আবার অপমানিত না হন। মনে হয় না কেউ করবে। 
“না, কেউ রাজি নয়। সবাই মনে করে, রাজা হরিশচন্দ্র হওয়ার দরকার নেই।”
 “ঠিক আছে, তাহলে আমার থেকেই পুরোটা কেটে দিন। ৩০ হাজার, তাই তো?”
 চন্দন কিছুক্ষণ চুপ, ভ্রুর মধ্যে সাপের মত আঁকাবাঁকা একটা ঢেউ উঠল, আবার চুপ।  তীক্ষ্ণ চোখ দিয়ে গৌতমকে দেখলেন। এবার চশমাটা পরে, চোখ বন্ধ করলেন, বললেন,
“১ তারিখে আপনাকে একটা  খবর দেওয়ার ছিল। আপনি এসব প্রস্তাব টস্তাব নিয়ে কথা বলছেন,   তাই বলেই দি। শুনুন, ভাল করে।  হিকোমা ঠিক করেছেন, আপনিও পরের মাস থেকে ছাঁটাই। কাজেই আপনার মাইনে কেটে স্বপনকে দাতব্য আর করা যাবে না। দুঃখিত, এটাই সত্যি।”

গৌতম আশা করেছিলেন চন্দন অন্তত সিরিয়াসলি  প্রস্তাবটা নিয়ে ভাববেন। তাই খুব আগ্রহ নিয়ে  তাকিয়ে ছিলেন। চন্দনের কথা শুনে, আর পরিস্থিতির এমন অদ্ভুত Absurdity দেখে, প্রথমে কথাই খুঁজে পেলেন না, কি বলবেন। ধীরে ধীরে ঠোঁটে একটা হাসি ফুটল, সেটা বাড়তে লাগল, তারপর  হো হো করেই হেসে উঠলেন । 
“কিন্তু কেন? কোম্পানি আমাকে আর চায় না?” 
চন্দন ফাইলের দিকে চোখ রেখে কিছুক্ষণ মুহূর্তটা হজম করে খুব মৃদু গলায় বললেন, 
“গৌতমদা, আপনাকে আর কী বলব? আপনি সিনিয়র, নিশ্চয় বুঝবেন। হিকোমা খরচ কমাতে চান, বলছেন না হলে কোম্পানি চলবে না। জুনিয়ররা বলছে, তারা আপনার সাহায্য ছাড়াই কাজ করতে পারে। আপনার জ্ঞান পুরনো প্রযুক্তিতে। আমি এসব জানি না। তারা বলেছে, এখন AI-এর যুগ, AI-কে জিজ্ঞেস করলেই সফটওয়্যার লিখে দেয়। হিকোমা বলছেন, ক্লড বা ওপেনএআই-কে ১০০০ ডলার দেবেন, আপনাকে দেবেন কেন।”

গৌতম বুঝলেন, চন্দনের সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই, সময় বদলাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ধন্যবাদ, অন্তত আগেভাগে জানলাম, আমার কাজের হ্যান্ড ওভার জুনিয়রদের জন্য তৈরি করতে বসে যাই। কিন্তু স্বপনের জন্য খারাপ লাগছে। ও কী করবে?” 
“অন্যদের নিয়ে ভাববেন না, গৌতমজি। কেউ কারও জন্য ভাবে না।”  চন্দন ফাইল খুলে বসলেন, কথা শেষ। 
-ক্রমশঃ-
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

2 Comments

  1. ChatGPT না হয় কবিতাজিপিটি হবে
    বুড়োGPT কেউ বলেনি।😊🙏

    ReplyDelete