জ্বলদর্চি

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান -২/ অনিন্দ্যসুন্দর পাল

Ancient India, History and Science - 2 

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান-  দ্বিতীয় পর্ব

অলংকরণ- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য

অ নি ন্দ্য সু ন্দ র  পা ল  

উৎস ও প্রস্তাবনা

এই প্রলেপ আর ইতিহাসহীনতার মধ্যবর্তী পর্যায়ে দাঁড়িয়ে বর্তমান কালে 'ইতিহাস' শব্দটি প্রাচীন ভারতবর্ষের  বিশদ ও বিস্তৃত রূপকে একক অর্থে একক ভূমিকায় পরিবেশন করে একথা সত্য, কিন্তু তার ব্যাখ্যা আলাপালোচনা এতটাই সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনার, এতটাই সর্বজনস্বীকৃত এবং শিষ্টজনোচিত যে তাদের অভ্যন্তরীণ পারস্পরিক বিষয়গুলো সঠিকভাবে জ্ঞাতব্য হওয়ার পূর্বেই প্রশস্ত বিস্তারের ভারে যেন মাঝে মাঝে কেবলই আবছা হয়ে ওঠে, শুধু তাই নয়; আমাদের ভাসা ভাসা দর্শনের প্রকোপে ছোটখাটো বহু তথ্যাদি পার্শ্বচরিত্রের মত আমাদের দৃষ্টিকে বিকর্ষণও করে ফেলে। এরপরও নিত্য ঘটনা, আন্দোলন , কর্ম বা চিন্তা যাই হোক সেগুলোই নিয়ত সামাজিক সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে ইতিহাস নামেই প্রকাশ পায়, তবে প্রত্ন-পণ্ডিত 'পঞ্চানন মন্ডল' তাঁর 'সাহিত্য প্রবেশিকা'-র তৃতীয় খণ্ডে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস-বিদ্যায় এই বিস্তৃত ক্ষেত্রটিকে একটু অন্যভাবে বুঝিয়েছেন। সেখানে তাঁর সুস্পষ্ট ব্যাকরণে বর্ণনা এইরূপ - 

"ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ- এই চতুর্বর্গ লাভের উপায়স্বরূপ উপদেশ যে পুরাবৃত্ত, তাহাকেই আর্যেরা বলতেন ইতিহাস। আর্যশাস্ত্রে ইতিহাস পরমার্থজ্ঞানের প্রবাহকমাত্র; সে সমস্তই আধ্যাত্মিক অর্থপূর্ণ পারমার্থিক ইতিহাস, আধ্যাত্ম জগতের প্রকৃত ঘটনা ও তত্ত্বকথা"। 

এছাড়াও আরো একটি অন্যতম উল্লেখ্য বিষয় যেটা না বললেই নয়; ধর্মমঙ্গল ধারার কবি যদুনাথের নিজস্ব কাব্য বিভাজন। যেখানে তিনি তাঁর কাব্যকে 'পুরাণ', 'আগম', 'ইতিহাস'- ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন অভিধায় ভূষিত করে সুস্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন প্রাচীন মধ্যযুগ পর্বে ইতিহাস ও সাহিত্যের মধ্যে কোনো বিশেষ ভাগ নেই এবং ছিলও না, তাই যে সকল আখ্যানে পুরাবৃত্ত, অতীত ঐতিহ্য সংস্কৃত প্রভূত আঙ্গিক অনুসারে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হত সেই গুলোই ইতিহাস বলে পরিগণিত হত, অর্থাৎ 'ইতি-হ-আস' এরূপ আকারেই সার্থক ও সমার্থক।
    
      আবার, উনিশ শতকের প্রাথমিক ধাপ থেকে যেহেতু একে একে সমস্ত ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে ঠিক তখন থেকেই বলা হয় যে ইতিহাস চর্চাও একপ্রকার সীমাবদ্ধ হতে চায় একটি সীমায় বা ডিসিপ্লিনে। তাই এই নির্দিষ্ট সীমাটির পরিধি কতটুকু, কতখানিই'বা তার অভিধা, সেই সবকিছুই যেন খুব স্পষ্ট ভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে দীপেশ চক্রবর্তীর স্বরচিত গ্রন্থ 'ইতিহাসের জনজীবন ও অন্যান্য প্রবন্ধ'-এর একটি নিগূঢ় বক্তব্যে- 
 
"উনিশ শতক পর্যন্ত পৃথিবীর অনেক দেশেই সাধারণ অর্থে 'ইতিহাস' বলে কোনও বিষয় ছিল না। মানুষের অতীতবোধ ছিল না, তা বলছি না। বা 'রাজতরঙ্গিনী' বা 'আইন-ই-আকবরী' ছিল না, এমন কথাও বলছি না। কিন্তু 'ম্যাট্রিক পরীক্ষার একটি অন্যতম বিষয় হলো ইতিহাস বিষয়ে যে রকম সাধারণ ধারণা থাকলে এইসব উক্তি করা যায়, সেইরকম ধারণার জন্ম ইউরোপের অষ্টাদশ শতকের শেষে- এমন কথাই কোনও কোনও ইউরোপীয় পন্ডিত বলতে থাকেন।"

এ থেকেই অনুমান করা যায় ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্পর্কিত ধারণা কিভাবে পরিবর্তিত হতে শুরু করেছিল ঔপনিবেশিক শিক্ষাক্রমের উপর নির্ভর করে, সংগৃহিত তথ্যের যাচাই এবং বিশ্লেষণ ও যুক্তি-প্রতিযুক্তির পারম্পর্যে ইতিহাস একদিকে যেমন আখ্যান ও অন্যদিকে সাহিত্য চর্চার একপ্রকার বিরাট কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে শুরু করেছিল নিঃসন্দেহে। কিন্তু বলাবাহুল্য,  সাহিত্য পুরাণ ও ইতিহাস এদের পারস্পরিক নির্ভরতার উপাখ্যানের বিষয়ের থেকেও এই মুহূর্তে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক ইতিহাসের সংজ্ঞা, ইতিহাসের সহজলভ্যতা বা দুষ্প্রাপ্যতা, এর উৎপত্তিগত উৎসের প্রকরণ এবং তার ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনা করার। না হলে একটি বিরাট অংশ বরাবরের মতো পুনরায় বঞ্চিত থেকে যাবে। 
 
      প্রসঙ্গত, ইতিহাস রচনার উপাদান উৎস ও শ্রেণীবিভাগ এবং এর সংজ্ঞা স্থাপন করতে গিয়ে অধ্যাপক মেইটল্যান্ড বলেছেন-  মানবজীবনের শুরু থেকে অদ্যাবধি যা ঘটেছে তা সবই ইতিহাসের অন্তর্গত। কিন্তু মানুষের আবির্ভাব কাল থেকে শুরু করে এখনও অব্দি যা ঘটেছে তা যেমন আমাদের কাছে লিখিত আকারে অনুপস্থিত, ঠিক তেমন বহু দিগন্ত-পরিবর্তনকারী ঘটনার সাল-তারিখ-স্থান-কারণ ইত্যাদি নির্ণয় করাও সম্ভব হয় নি। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে ইতিহাস কাহিনী-গল্পকথায় পর্যবসিত হয়।

      অতএব, যে সকল তথ্য থেকে সত্য নির্ণয় ও সত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব সেটাই ইতিহাসের তথ্য এবং এই ভিন্ন ধরনের বিশ্লেষণ থেকে প্রাপ্ত মানবজ্ঞান,আলোকপাতের প্রাচুর্য,লক্ষ্য লক্ষ্য মতবাদ,ও ঐতিহাসিক বিভিন্ন দৃষ্টিকোণের সমাবেশকে একত্রে মোটামুটিভাবে ইতিহাসের উৎস বলে বর্ণনা করা হয়। 

     তবে, উপযুক্ত উৎসের অভাব প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। একাদশ শতাব্দীতে বিখ্যাত আরবী পন্ডিত আল-বিরুনী ছাড়াও পরবর্তী কালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিকগণ যেমন এলফিনস্টোন, ফ্লীট, স্মিথ নানা কটূক্তি করেছেন হিন্দুদের অনৈতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বিদ্রূপ করে। এই সমালোচনার আঙ্গিকে ভারতীয় ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার, হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর নামও পাওয়া যায়, যারা কিনা একদিকে যেমন ভারতীয়দের অদৃষ্টবাদ ও আবার অন্যদিকে হেরোডোটাস, থুকিডাইসের মতো ঐতিহাসিকদের অনুপস্থিকে এই ইতিহাস বিমুখতার জন্য দায়ী করেছেন। এইসব অপবাদকে স্বীকার করে নিলেও একথা মানতে হবে ইতিহাস রচনার জন্য আধুনিককালে প্রাচীন ভারতের মানুষের কিছুই অবশিষ্ট নেই- এমন ধারণা একেবারেই অমূলক। কেননা প্রাচীনকালের মানুষেরা যখন যেটা  সংরক্ষণের প্রয়োজন বলে মনে করেছেন সেগুলো তাঁরা সযত্নে সংরক্ষণ করেছেন। তাই প্রাচীন ভারতের অতীত বিষয়ক বহু সমালোচনা সত্বেও একথা ধ্রুব সত্য যে 'ইতিহাস' শব্দটি তাঁদেরই সৃষ্টি। তাঁরাই কিন্তু ইতিহাস সৃষ্টির ধারক ও বাহক।
  
     উল্লেখযোগ্য, এই ইংরেজী 'History' শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসাবে এসেছে 'ইতিহাস' শব্দটি। আর ইংরেজী 'History' শব্দটি এসেছে গ্রিক ও ল্যাটিন 'Historia' শব্দ থেকে। যার অর্থ "সত্যানুসন্ধান বা গবেষণা"। আবার ই'তিহাস' শব্দটি 'ইতিহ' শব্দ থেকে গঠিত হয়েছে, যার অর্থ 'ঐতিহ্য'। অতএব পূর্ব উল্লেখিত ইতিহাস কথাটির প্রত্যয় বিভক্তি দাঁড়ায় "ইতি-হ-আস" যার অর্থ "এমনটি ছিল বা এমনটিই ঘটেছিল"।  এমনকি হেরোডোটাস তাঁর গ্রিক ও পারসিকদের অন্তর্বর্তী সামরিক সংঘর্ষের বিবরণ Historia গ্রন্থে উল্লেখ করেন (যার ইংরেজী অনুবাদ হয়েছে Histories নামে)। এরপরও তথ্যের অভাব, প্রাপ্ত তথ্যের অপ্রতুলতাকে উপেক্ষা করে বিখ্যাত ভারতীয় ও বিদেশী ইতিহাসবিদ্গণ যে যার নিজের মতো করে ইতিহাসের সংজ্ঞা দিয়ে গেছেন।
যেমন,

●ডক্টর জনসন (যাঁর মতে-"যা ঘটে তা-ই ইতিহাস)
●ডঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদার (যাঁর মতে-"ইতিহাস হলো মানব সমাজের অতীত কার্যাবলীর বিবরণী")
●টয়েনবি (যাঁর মতে-"সমাজের জীবনই ইতিহাস। প্রকৃত পক্ষে মানব সমাজের অনন্ত ঘটনা প্রবাহই ইতিহাস") এবং 
●শাস্ত্রবিদ ই.এইচ.কার (মনে করেন "ইতিহাস হলো বর্তমান ও অতীতের মধ্যে অন্তর্হীন সংলাপ"),
প্রভূত...
 
একক অর্থে তাঁরা এটাই বোঝাতে চেয়েছেন মূলত ইতিহাস হচ্ছে- অতীতকালীন সময়ের মানব সমাজের ভিন্ন ঘটনা প্রবাহের ধারাবাহিক বিবরণী, যার মধ্যে দিয়ে প্রকট হয় সমাজ রাষ্ট্রব্যবস্থা, সংঘাত, সম্প্রীতি তথা মানব সভ্যতার সম্পূর্ণ পর্যালোচনামূলক ইতিবৃত্ত।

      সর্বশেষে একথা সত্য যে তাঁদের দেওয়া 'ইতি-হ-আস' এর ব্যুৎপত্তিগত ব্যাখ্যা থেকে আরম্ভ করে গ্রীক ''ইস্তোরিয়া'' বা জার্মান ''গেশিস্টের'' থেকে পাওয়া ''ইতিহাস''-সম্পর্কিত ধারণা আধুনিককালে  সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বোধ হয় ব্যাপকতরও বটে। তাই আমার ধারণা সমস্ত অভাব ব্যর্থতা এসবের সমালোচনাকে উপেক্ষা করে প্রাপ্ত তথ্যগুলোকে গুনগত সমালোচনার দ্বারা প্রতিষ্ঠা করা বেশি দরকার এবং অত্যাধিক প্রয়োজন। (ক্রমশ)

(এর পরবর্তী পর্যায়ে ইতিহাসের ঐতিহাসিক উৎস ও তার ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনায় আসব)

Post a Comment

0 Comments