জ্বলদর্চি

দিল্লি দর্পণ -১৪ / কালীপদ চক্রবর্ত্তী

দিল্লি দর্পণ – ১৪ 


কা লী প দ  চ ক্র ব র্ত্তী

দিল্লিতে দুর্গাপুজো

দিল্লিতে দুর্গাপূজা মানেই হল এক বিরাট আনন্দ উৎসব। দিল্লির প্রবাসী বাঙালিরা সারা বছর এই দিনগুলোর জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। কিন্তু এবছর আমাদের সকলের মনই খুব খারাপ। দিল্লির সব জায়গায় পুজো হচ্ছে না। শুধুমাত্র মন্দিরগুলোতেই নিয়ম রক্ষার জন্য পুজো করা হবে। মায়ের প্রতিমাও ছোট হবে। সেখানে সাধারণ জনতার সবার প্রবেশের অনুমতি থাকবেনা ইত্যাদি ইত্যাদি, এরকম অনেক কিছুই শোনা যাচ্ছে। বিভিন্ন পাড়ার পুজোগুলো এবছর বেশিরভাগই হবে না। তাই করোনা মহামারী দিল্লির বাঙালিদের কাছে অভিশাপ ছাড়া কিছু নয়। অনেক  কিছুতেই নিষেধাজ্ঞা জারী হয়েছে। 
 
গ্রাম বাংলার মত হয়তো দিল্লীর সর্বত্র শিউলি ফুল ফোটে না, পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙে না অথবা যমুনার পাড়ে না গেলে কাশফুল ও দেখা যায় না কিন্তু দিল্লীতে থেকে দুর্গাপূজা উপলব্ধি করার যে আনন্দ তা একটু অন্য রকম। নিজের সংস্কৃতিকে নিজের সীমানার বাইরে পাওয়ার এক বিশেষ সুখকর অনুভূতি। পুজোর ক’দিন কোথাদিয়ে কেটে যায় তা বোঝাই যায় না। মেশিনে যেমন তেল বা জ্বালানি দিলে চলতে থাকে, ঠিক তেমনি আমাদের প্রবাসীদের কাছে দুর্গাপূজা সেই আনন্দ ও উত্তেজনা এনে দেয়, যা সারা বছর সজীব রাখে আমাদের।

দিল্লীতে দুর্গাপূজার ক’দিন বাঙালিরা উৎসবের খুশীর মেজাজে থাকেন। কারো ঘরেই উনুন জ্বলে না। সকাল থেকেই মণ্ডপে অঞ্জলি দেওয়া, প্রসাদ খাওয়া, ভোগ খাওয়া এবং রাতে অনুষ্ঠান দেখার ফাঁকে স্টলগুলো থেকে রাতের খাবার সেরে নেওয়া প্রায় সব বাঙালিরই এটা এখন রুটিনে দাঁড়িয়ে গেছে। পূজার কদিন এক অদ্ভুত আনন্দ অনুভূতি। মণ্ডপে বহু পুরানো বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে সাক্ষাৎ এবং উচ্চনীচ ভেদাভেদ সব ভুলে একাত্ম হয়ে যাওয়ার সে এক আশ্চর্য অনুভূতি, যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বহু বাঙালিকে দেখেছি বছরের পর বছর পুজোর সময় এখানে এসে মণ্ডপে বসে ফল কাটতে, প্রসাদ বিতরণ করতে। অনেকটা শীতের পাখিগুলোর মত। এ নেশা বা ভালবাসা তো অহেতুক হতে পারেনা। এবছর এসব কিছুই হবেনা, একথা ভেবেই মনটা উদাস হয়ে যাচ্ছে। 
পুজোর কদিন দিল্লীর পূজামণ্ডপগুলি কলকাতা ও মুম্বাই-এর শিল্পীদের অনুষ্ঠানে সরগরম থাকে। দিল্লীতে এসে অনুষ্ঠান করেননি এরকম নামকরা বাঙালি শিল্পী হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবেনা। এমনকি বাংলাদেশের রুনা লায়লা থেকে রেজওয়ানা চৌধুরী (বন্যা) ও বাদ যাননি। 

ঐতিহাসিক দিল্লী শহরের  একশো বছরের ওপর দুর্গাপূজার ইতিহাস বেশ বৈচিত্র্যময়। দিল্লীতে প্রথম দুর্গাপূজা হয়েছিল ১৮৪২ সালে। জনৈক ভবানী মজুমদার শাহজাহানাবাদের কোন এক স্থানে এই পূজার আয়োজন করেছিলেন। এরপর ১৮৭৫ এবং ১৯০২ সালে দিল্লীতে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয় তবে তার বিশদ বিবরণ জানা সম্ভব হয়নি। উপরোক্ত সালগুলির দুর্গাপূজা বাদ দিলে দিল্লীতে প্রথম দুর্গাপূজা হয়েছিল ১৯১০ সালে চাঁদনীচক এলাকায় বল্লিমারান-এর রোশনপুরা কালীমন্দিরে। সেবার ঘটপূজা হয়। ১৯১১ সালে কোলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লীতে স্থানান্তরিত হয়। খুব স্বাভাবিক কারণেই বহু বাঙালি সেই সময় দিল্লীতে আসেন বা আসতে বাধ্য হন। 

১৯১১ সালেই প্রথম মূর্তি বানিয়ে পূজা শুরু হয়। সেবার প্রতিমা এসেছিল বেনারস থেকে। পূজা হয়েছিল একই পাড়ায় অর্থাৎ চাঁদনীচকে, তবে লালা লছমীনারায়ণের ধর্মশালায়। শোনা যায়, দশমীর দিন আশে পাশের ব্যবসায়ীরা যে পথ দিয়ে ঠাকুর ভাসান যাবে সেই এলাকাটাকে নিজেদের খরচায় সাজিয়ে দিতেন। 

যখন সরকারি ছাপাখানা অর্থাৎ গভর্নমেন্ট প্রেস কোলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত হয় সিভিল লাইন্স এলাকায়, তখন দুর্গাপূজাও এক থেকে দুই হয় ১৯১৪ সালে। দিল্লীতে পূজা সংখ্যা বাড়ার একটি কারণ দূরত্বও বটে।

তবে সার্বজনীন পূজার প্রথম সূত্রপাত করে “দিল্লী দুর্গাপূজা সমিতি, কাশ্মীরী গেট ১৯১০ সালে। এটিই দিল্লীর প্রাচীনতম, ঐতিহ্যময় সার্বজনীন দুর্গাপূজা। বল্লিমারণ ধর্মশালা, লছমীনারায়ণ ধর্মশালা, দিল্লী পলিটেকনিকের মাঠ, উইমেনস পলিটেকনিক ও তারপর আলীপুর রোডের বেঙ্গলী স্কুল – এত জায়গায় অনুষ্ঠিত হয়ে দিল্লী দুর্গাপূজা সমিতির আয়োজিত দিল্লীর সবথেকে পুরনো দুর্গাপূজা যা এখন কাশ্মীরী গেট পূজা বলে পরিচিত। ১৯১১ সালে এই কাশ্মীরী গেট দুর্গাপূজা সমিতি-ই প্রথম বেনারস থেকে ঠাকুর বানিয়ে নিয়ে এসে মূর্তি পূজা শুরু করেন।  কথিত আছে ১৯৩৮ সালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস (Congress President)ও মেঘনাদ সাহা অষ্টমীর দিন সন্ধ্যায় নিউ দিল্লী দুর্গাপূজা সমিতির মণ্ডপে আসেন ও শক্তি পূজার ওপর এক মনোজ্ঞ বক্তৃতা দেন।  
      
১৯১৬ সালের আগে অব্ধি দিল্লীতে প্রতিমা আসতো বাইরে থেকে। ১৯১৬ সাল থেকে দিল্লীতেই প্রতিমা গড়ার ব্যবস্থা হয়। মৃৎশিল্পীরা কৃষ্ণনগর / কুমারটুলি থেকে আসতেন। এদের মধ্যে গৌর পাল ও বঙ্কিম পাল বহু বছর প্রতিমা গড়েছিলেন।

যারা দিল্লীর পূজার সাথে জড়িত তাঁরা কখনও পূজার সময় দিল্লী ছেড়ে বাইরে যেতে চাইবেন বলে মনে হয় না। জাতি, ধর্ম, উচ্চ, নীচ ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একসাথে আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার যে কি আনন্দ তা উপলব্ধি না করলে লিখে প্রকাশ করা যাবে না। বহু, নামী, জ্ঞানী, গুণী লোকেদের দেখেছি সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে দুর্গাপূজার সময় একাত্ম হয়ে যেতে।  দুর্গাপূজা মণ্ডপ ওই কদিন  যেন এক মহা মিলনের সঙ্গমে পরিণত হয়। সারা বছরের গ্লানি ধুয়ে মুছে যায়। শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। তাই প্রতি বছর দিল্লীর বাঙালিরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে সেই দিনগুলোর জন্য। 
পুজোর ক’দিন বাঙালি, অবাঙালি ও হিতৈষীরা সব কাজ ভুলে পূজা প্রাঙ্গণে এসে একত্রিত হন এই মহামিলন মেলায়। সকলেই ভেদাভেদ ভুলে মেতে ওঠেন মাতৃ আরাধনায়। মা-দুর্গা নিজের বাড়ীতে ফিরছেন তাই চারিদিকে তাঁকে বরণ করার ধূম শুরু হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে পুলকিত হয় বাঙালির মন। 

পাঠকেরা শুনলে হয়তো একটু অবাক হবেন যে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত (নিউদিল্লী দুর্গাপূজা সমিতি) মহিলারা চিকের আড়ালে বসে অনুষ্ঠান দেখতেন। ১৯৪৯ সালে কাশ্মীরী গেট পূজা কমিটি প্রথম চাঁদা দাতাদের নাম ছেপে প্রথম প্রকাশ শুরু করেন। ১৯৫০ সালে দিল্লীতে প্রথম সন্তোষ মজুমদারের সম্পাদনায় শারদোৎসব পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়।

দিল্লী শহরের পূজা একটু আলাদা। কলকাতার দুর্গাপূজাগুলোতে পূজা মণ্ডপ এবং মূর্তিগুলির মধ্যে ফুটে ওঠে শিল্পীর নিপুণ হাতের বৈচিত্র্য। পরিস্ফুট হয় শিল্পকলা। থিমের ও আলোক-সজ্জার বৈচিত্র্য এনে দেয় এক নতুন রূপ। দিল্লীর পূজামণ্ডপগুলিতে আগে সেই বৈচিত্রতা হয়তো লক্ষ্য করা যেত না, তবে আজকাল দিল্লীর পূজা মণ্ডপ ও মূর্তি গুলোও পিছিয়ে নেই। দেখা যায় শিল্পকলার প্রাচুর্য, থিমের ও আলোক সজ্জার রোশনাই এনে দিয়েছে এক নতুন রূপ। দিল্লীর পূজাগুলিতে আলোর রোশনাই কলকাতার মত না হলেও আজকাল থিম এবং বায়োফ্রেন্ডলি মণ্ডপের সূচনা হয়ে গেছে। এছাড়া আছে ভোগ খাওয়ার এবং বড় বড় শিল্পীদের অনুষ্ঠান দেখার আনন্দ। এখানে আনন্দ উৎসবে ভেসে গিয়ে একাত্ম হয়ে যাওয়ার একটা অনুভূতি উপলব্ধি করা যায়। আজকাল প্রতিমাগুলোও দিল্লীতেই তৈরি হয়। কোন কোন পূজা মণ্ডপেই দুর্গা মূর্তি বানানো হয়। সর্বত্রই পূজার সম্পূর্ণ নিয়ম কানুন মেনে নিষ্ঠা সহকারে পূজা হয়।

_______________________________________
আরও পড়ুন 

দিল্লিতে বাঙালি পাড়াগুলোতে অর্থাৎ চিত্তরঞ্জন পার্ক, নিবেদিতা এনক্লেভ, মহাবীর এনক্লেভ ইত্যাদি জায়গায় বাঙালিদের মোটামুটি প্রায় সব জিনিসই পাওয়া যায়। 
----------------------

Post a Comment

5 Comments

  1. Replies
    1. ধন্যবাদ আপনাকে। আপনারা পড়ে আনন্দ পাচ্ছেন জেনে লিখতে উৎসাহ পাচ্ছি। ভাল থাকবেন।

      Delete
  2. দারুণ লাগছে, এই বছর পুজোর জাঁকজমক না হলেও এই লেখাটা থেকেই পুজোরস আস্বাদন করলাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ আপনাদের। এটাই লেখকের বড় প্রাপ্তি।

      Delete
  3. দিল্লির দুর্গাপূজা নিয়ে অনেক কিছু জানা গেলো. দিল্লী দর্পন আরো আমাদের আলোকিত করুক. ধন্যবাদ.

    ReplyDelete