জ্বলদর্চি

ফ্রেডরিক নীটশে /সন্দীপ কাঞ্জিলাল


"সত্যের পাহাড়ে আরোহণের সময় ব্যর্থতার কোন অবকাশ নেই। হয় আজ তোমার উত্তরণ হবে আরো উচুঁ কোনো বিন্দুতে অথবা তা তোমাকে শক্তিশালী করে তুলবে আরো কোনো উচ্চতর বিন্দুতে উত্তরণের জন্য।" 

Friedrich Nietzsche 
ফ্রেডরিক নীটশে 
(১৫/১০/১৮৪৪ - ২৫/০৮/১৯০০)
 
স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল

বেশ কয়েকদিন আমার স্ত্রী অসুস্থ। অপারেশনের প্রয়োজন। দরকার মোটা অঙ্কের টাকা! খানিকটা মনমরা ও বটে। একাকী আধো আলো, আধো অন্ধকারে শুয়ে আছি। হঠাৎ নিজের অজান্তে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, হে ঈশ্বর। চমকে উঠলাম, এই পরিবর্তনশীল জগতে আমি নিত্যতার আশা করছি। আর তার ফলেই আমার মনে কল্পিত হচ্ছে ঈশ্বর। আরো অন্ধকার গাঢ় হতেই দেখি, একটা বন্ধ ঘরে কে যেন উন্মাদের মতো পায়চারি করছে। মাঝে মাঝে মাথার চুল ছিঁড়ছে আর বিড়বিড় করছে। ভালোভাবে লক্ষ্য করতেই, দেখতে পেলাম- আরে ঐ লোকটা তো, হ্যাঁ হ্যাঁ ঐ লোকটা যে নতুন জগৎ সৃষ্টির জন্য অধ্যাপনার চাকরি ছেড়েছিল। এখন যাঁর খাওয়ার জোটে না, ঔষধ পায় না। যিনি লিখেছিলেন তাঁর প্রিয় অধ্যাপক 'বুকহার্ট'কে, "প্রিয় অধ্যাপক, ভগবান হওয়ার চাইতে বাসেলে অধ্যাপকের পদলাভ বেশি কাম্য বটে, কিন্তু সেই লোভনীয় পদের জন্য নতুন জগৎ সৃষ্টির দায়িত্ব ত্যাগ করবো এতটা আত্মকেন্দ্রিক আমি নই।" লেখক- 'ফ্রেডরিক নীটশে' (Friedrich Nietzche) তাঁর জন্ম ১৫ই অক্টোবর ১৮৪৪। 
জার্মানির লাইপজিগের রোয়েকন গ্রামে ধর্মযাজক কার্ল লাডউহগ নীটশে বাবা এবং মা ফ্রানজিসকা নীটশে। দু ভাই এক বোন। 'নীটশে' যেদিন জন্মগ্রহণ করেন সেদিন ছিল প্রুশিয়ার তৎকালীন সম্রাট 'ফ্রেডরিক উইলিয়ামের' ৪৯তম জন্মদিন। তাই তাঁর নাম রাখা হলো 'ফ্রেডরিক'। পিতা ধর্মযাজক, যাঁর পুত্র একদিন ঘোষণা করবে 'ঈশ্বরের মৃত্যু।' যে ঘোষণা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করবে। সৃষ্টি হবে নতুন ইতিহাস। 

যখন নীটশের মাত্র পাঁচ বছর বয়স, তখন তাঁর বাবা মারা গেলেন। বন এবং লাইপজিগের বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন, ভাষাতত্ত্ব এবং ক্লাসিকস ছিল তাঁর বিশেষ চর্চার বিষয়। তিনি পালিত হতে থাকেন মাতামহের কাছে।আর সেই সাথে হয়ে উঠল শিলার, নোভালিস, হফম্যান, শোপেনহাওয়ার আর রোশেফুকোর দর্শনের অনুগামী। ভয়ঙ্কর খাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন এক আগ্রাসী বিষণ্ণতায়। স্বপ্ন দেখলেন অনন্ত  মহাজীবনের। খাদের কিনারা থেকে ফিরে এলেন 'মুক্তশক্তি আর 'বিশুদ্ধ ইচ্ছাশক্তি'র অনির্বাণ মশাল হাতে। আর সেই আগুনের তাপে গলে গেলো সহস্র  বছরের জমে থাকা স্তূপীকৃত বরফের স্তূপ।

মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে বাজেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ল্যাসিক্যাল ফিলজফির চেয়ারে প্রফেসর  পদে  অধ্যাপনা শুরু করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করাকালীনই প্রকাশ  করলেন তাঁর প্রথম  বই ''ট্র্যাজেডির জন্ম"(The birth  of tragedy"। ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হল অ্যাপোলোনীয় ডায়োনিজীয় ভাবনার। নিৎসে বোঝালেন, শোপেনহাওয়ারিয়ান জাজমেন্ট অনুসারে সমস্ত কিছুর প্রাথমিক অভিব্যক্তি হল সঙ্গীত। গ্রিক অতিকথার দুই দেবতাকে নতুন করে আবিষ্কার করলেন। প্রথমজন হলেন ডাওডিনাস। যিনি মদ ও হর্ষোচ্ছ্বাসের দেবতা। সমুচ্চপ্রাণ শক্তির দেবতা। সঙ্গীত, নৃত্য, নাট্যকলার দেবতা। আর দ্বিতীয়জন হলেন অ্যাপোলো। তিনি  হলেন শান্তি ও অবকাশ, ভাবগম্ভীর যুক্তিশীলতা, দার্শনিক স্থিতাবস্থা, স্থাপত্য-ভাস্কর্য শিল্প ও মহাকাব্যের দেবতা। এক নতুন  আলোকে স্থাপিত হল অ্যাপোলোনীয় ও ডায়োনিজীয় ভাবনার সুসংবদ্ধ মেলবন্ধন। 

তিনি প্রমাণ করতে চাইলেন সভ্যতার সমকালীন সংকট থেকে সাময়িকভাবে সম্ভাব্য উদ্ধারকর্তা হিসেবে কল্পনা করেন সেই অভিজাত 'অতিমানব' দের যারা গ্রিক ট্রাজেডির দেবতা ডায়োনীয়াজের মতো জীবনের সমগ্রতাকে পরম উল্লাসে স্বাগত করে ধ্বংসের ভেতর দিয়েই। হয়তো ধ্বংসোত্তর নবযুগের প্রবর্তন করবে। তবে একথা ঠিক যে, তিনি কোনদিন হিটলার-মুসোলিনীকে উত্তরসাধক হিসাবে কল্পনা করেননি। স্রিন্ডবার্গ, রিলকে, টমাসমান, আঁদ্রে জিদ, সার্ত্র, কাম্যু, ফকনার প্রভৃতি দিকপালের লেখায় নীটশের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। 
বাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে দশ বছর (১৮৬৯-৭৯) অধ্যাপনার পর চিররুগ্ন নীটশে এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েন যে তাঁকে অধ্যাপনার কাজ থেকে স্থায়ীভাবে অবসর নিতে হয়। পরের দশ বছর ভগ্নদেহ নিয়ে এক স্বাস্থ্যনিবাস থেকে অন্য স্বাস্থ্যনিবাসে ঘুরেছেন। গৃহহীন, বন্ধুহীন, উপার্জনহীন।অথচ এই দুরবস্থায় তাঁর মন এবংলেখনী নিরবচ্ছিন্ন ভাবে  সক্রিয়। আসলে অধ্যাপনা তাঁর ধাতুে ছিল না; চলতি ধ্যান-ধারণাকে উড়িয়ে দিয়ে নিজস্ব অনুভব  থেকে নতুন এক জগৎ সৃষ্টি করার বৈপ্লবিক ভূমিকা তিনি বেছে ছিলেন। 

নীটশের মনে অসংখ্য জিজ্ঞাসাবাদ। তিনি অন্যান্য দার্শনিকের মতো কোন সুনিশ্চিত সুপরিকল্পিত দর্শনাশাস্ত্র লেখেননি। অনেক প্রশ্নের উত্তর খুজতে গিয়ে যেটার উত্তর তিনি খুঁজে পেয়েছেন, তাকে তিনি ভাষায় রূপ দিয়েছেন। সহজ সমাধান বা সহজ উত্তরে তাঁর কোনদিনই আস্থা ছিল না। উত্তরহীন জিজ্ঞাসা যে কত যন্ত্রণাদায়ক, তা জেনেও নিজেকে স্তোক দিতে মিথ্যার আশ্রয় নেননি। 

মানুষ সর্বদা পরিবর্তনশীল অস্তিত্বে, সবসময় নিত্যতার সন্ধান করে। মানুষের জন্ম হলে মৃত্যু হবেই। কিন্তু মানুষ মরতে রাজি নয়। নিয়ত পরিবর্তনশীল অস্তিত্বে নিত্যতার সন্ধান করে। আর তাই করতে গিয়ে কল্পিত হয় ঈশ্বর, দেবদেবী, সত্তা, বিমূর্ত ধ্যানধারণা। অস্তিত্বের বহমানতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষ আশ্রয় নেয় ধর্মে, প্রতিষ্ঠানে। তাদের কাছে সত্যের চাইতে নিরাপত্তা অনেক বেশি কাম্য। নীটশে লিখলেন নিয়ত পরিবর্তনীয় জগতে কোন সম্পর্ক স্থায়ী হতে পারে না। তাছাড়া বহমান অনিত্যকে নিয়ে নির্ভরযোগ্য  ধারণা, নিয়ম বা বিজ্ঞান সৃষ্টি হতে পারে না। আর এই নিরুদ্দেশ নিরর্থ প্রবাহে উচিত-অনুচিত, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় প্রভেদে নিজেকে মিথ্যা স্তোক দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি মনে করেন নৈতিকতার কোনও চিরকালীন মাপকাঠি নেই। আজ যা সত্য কাল তা মিথ্যা হতে পারে। তাই আজ যা নৈতিকতা বলা হচ্ছে, তা উপর থেকে চাপানো ভঙ্গুর। তাই বহমান অনিত্য অর্থাৎ যার কোন স্থিরতা নেই, তাকে নিয়ে কোনো ধারণা বিজ্ঞান দাঁড়াতে পারে না। আর তাকে ভিত্তি করে তাঁর উপর দাঁড়িয়ে উচিৎ অনুচিত কারন, তারও কোনও অস্তিত্ব নেই। প্রথমত এই ধারণা মানুষের কাছে আতঙ্কের কারণ। এতদিন ধরে যে ধারণা সে পোষণ করে আসছিল, হঠাৎ সেসব তাসের ঘরের মতো ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। একদল মানুষ আবার আনন্দ পায়। কারণ তাকে জ্ঞান পাওয়ার পর এমন এক অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়, যার কোন স্থিরতা নেই। যা সর্বদা পরিবর্তনশীল। তখন তাকে প্রমাণ দিতে হয় আদিম শূন্যতার সামনে দাঁড়িয়ে তার ভিতর সে সামর্থ্য আছে কিনা, যার সাহায্যে সে এই শূন্যতাকে তোয়াক্কা করে নিজস্ব মূল্যমান গড়ে নিতে পারে। নীটশের বিচারে সব মানুষের এই ক্ষমতা নেই। যাদের ভিতর আছে তারাই প্রকৃত দার্শনিক শিল্পী। তাঁরা স্রষ্টা ও বীর মায়ামোহমুক্ত সত্যকাম। তাঁরা গড়পড়তা মানুষ নয়। তাঁরাই অতিমানব। 

আবার তিনি বললেন, "ধর্ম ও বিজ্ঞান দুই-ই প্রাণের বহমানতার বিরোধী। শক্তিমান বা শাসক ধর্মকে বর্ম করে, দুর্বল ও শাসিত মানুষের মধ্যে দাস্যভাব জাগিয়ে রাখে।" আবার বিজ্ঞান সম্পর্কে বলেন, "যেখানে কোনকিছু নিত্য নয়, তাই কোনকিছু আবিষ্কার স্থির নয়। বিজ্ঞান এক ধরনের আত্ম-সম্মোহনের উপায়, যার সাহায্যে নিজের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে।" তাঁর মতে যে সমস্ত ধারণা রাজনীতিকে অবলম্বন করে এই সভ্যতা এখনো দাঁড়িয়ে আছে তাঁরা যে একেবারেই শূন্যগর্ভ, অলীক,তাদের কাছে আশ্রয় খোঁজা যে নিজের সঙ্গে ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়। 

 তিনি লিখলেন "On the mountains of truth you can never climb in vain: either you will reach a point higher up today, or you will be training your powers so that you will be able to climb higher tomorrow". সত্যের পাহাড়ে আরোহণের সময় ব্যর্থতার কোন অবকাশ নেই। হয় আজ তোমার উত্তরণ হবে আরো উঁচু কোন বিন্দুতে, অথবা তা তোমাকে শক্তিশালী করে তুলবে আগামীতে আরো উচ্চতর কোন বিন্দুতে উত্তরণ লক্ষ্যে।

যিনি সনাতন মূল্যবোধ ও বিশ্বাস পরিত্যাগ করে অনায়াস দক্ষতায় আরোহণ করতে প্রয়াসী হন সত্যের পাহাড়ে; তার জীবনদর্শন মানবিকতাকেও অতিক্রম করে অনুধাবন করতে সচেষ্ট হয় এক স্বাধীন আনন্দ অনুভূতির। অনুসন্ধান করে চলে মুক্তির। তাই প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মযাজকের সন্তান হয়েও স্পষ্ট ভাষায় বলতে পারেন, " যদি খ্রীষ্টধর্ম মানে হয় এক ঐতিহাসিক বা ঘটনার প্রতি আস্থা, আমার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু এর অর্থ যদি হয় মুক্তির প্রয়োজনে, তবে আমার আমিকে আমি আগলে রাখতে রাজি।" ইনিই হলেন নিৎসে, ফ্রেডরিক নিৎসে। যিনি ধর্ম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, "ঈশ্বরের মৃত্যু।" 

১৮৫৫ সালে তার একমাত্র ধার্মিক বোন এলিজাবেথ কে লেখা চিঠিতে তিনি লিখেছেমন, "মানুষের পথ বিভক্ত, যদি তুমি আত্মার শান্তি ও আনন্দ কামনা কর তাহলে তুমি ধর্মে বিশ্বাস কর; আর সত্যের অনুরাগী হও তাহলে অনুসন্ধান কর।" 
( "Hence the ways of men part: if you wish to strive for Peace of soul and pleasure, then believe; if you wish to be devotee of truth then enquire...")
বর্তমান আমাদের দেশে প্রচলিত যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, তাকে নীটশে প্রবল ভাবে ঘৃণা করতেন। তাঁর ভাষায়, "গণতন্ত্র ব্যক্তিকে পর্যবসিত করে অতিক্ষুদ্র, গোলাকার, পলকা, বালুকণায়। গণতন্ত্রে সকলেই তুল্য মুল্য, তাই অসৎ উপায়ে সংখ্যার প্রাধান্যে যারা নিতান্ত নিকৃষ্ট তারা প্রতিভাধর গুণীজনকে বিনাশ করে গুণহীন গড়পড়তার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে।" তিনি 'অতিমানব' বলতে বুঝতেন- ধীর, স্থির, প্রসন্নচিত্ত, নির্ভীক, আত্মনির্মাণে সমর্থ, প্রচলিত রাজনীতি বিশ্বাসের আগাগোড়া নতুন করে মূল্যায়নে উদ্যোগী, শিল্প ও সৌন্দর্যের স্রষ্টা, ভোক্তা, স্বাধীনবৃত্তি ও অনিয়ন্ত্রিত- স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে এসব গুণের যারা অধিকারী তারা 'অতিমানব।' এই নিয়ত পরিবর্তনশীল এবং অনতিক্রম্য দ্বন্দ্বচালিত জগতে কোন স্থায়ী মূল্যমান প্রতিষ্ঠা কি সম্ভব? এবং তা যদি না সম্ভব, এই শূন্যবাদ থেকে আত্মরক্ষার জন্য ধর্মবিশ্বাসের মিথ্যা স্তোকবাক্যের কি প্রয়োজন? 
১৮৭২ সালে প্রকাশিত  প্রথম বই Die Geburt der Tragodie(The Birth of Tragedy) তেই নীটশের সৃষ্টিশীল  ভাবুকতার স্পষ্ট পরিচয় মেলে।তারপরে (১৭৭৮-৮০) Menschliches Allzumenschliches (Human,All too Human); ১৮৮১তে Morgenrote(The Dawn of the day); ১৮৮২ তে  Die frohliche Wissenschaft (The Joyful Wisdom); ১৮৮৩-৯২ এর মধ্যে Also sprach Zarathrustra(Thus spake Zarathustra); ১৮৮৬ তে Jenseits von Gute und Bose (Beyond Good and Evil); ১৮৮৭ তে Zur Genealogie der Moral (Towards the Genealogy of Morals); ১৮৮৮তে Der Anti-Christ- -একটির পর একটি কাব্যগুনসম্পন্ন, ভাবুকতা সমৃদ্ধ পাঠকমনে বিভিন্ন চিন্তার উদ্দীপক বই। ১৮৮৯ সালে তাঁর মানসিক ব্যাধি প্রবল হয়ে ওঠে, এবং পরবর্তী দশ বছর অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় কাটিয়ে ১৯০০ সালে গোয়েটের স্মৃতি বিজড়িত হাইমারে মারা যান। তারঁ মৃত্যুর পর তাঁর বোন থেরেসা এলিজাবেথ যে অসুস্থ ভাইকে  শেষ পর্যন্ত দেখাশোনা করতেন- নীটশের ফেলে যাওয়া খসড়া নোটগুলি সম্পাদনা করে Die Wille Zur Match(The Will to power) নামে বই আকারে বের করেন। নীটশে এই বইটির জন্য ভূমিকার যে খসড়া  লিখেছিলেন তা থেকে মনে হয় তারঁ পরিণত চিন্তাকে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের আকারে রূপ দেবার পরিকল্পনা তাঁর ছিল। মতি বিভ্রংশের ফলে সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি।১৮৮৮ সালে লেখা Ecce Homo প্রকাশিত হয় নীটশের মৃত্যুর আট বছর পরে ১৯০৮ সালে।

চিরনিঃসঙ্গ তিনি। সেই শৈশব ও তারুণ্য থেকেই নিঃসঙ্গতাই তার চিরসঙ্গী। শুধু শোপেনহাওয়ার আর অল্প কিছুদিনের জন্য রিচার্ড ভাগনার ছিলেন তাঁর বান্ধব। সঙ্গীতকার ভাগনার থাকতেন বাজেলের কাছাকাছি ট্রিবশনে। একটা সময়ে যথেষ্ট অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে নীটশে ও ভাগনারের মধ্যে। তাঁর 'ট্রাজেডির জন্ম' বইতে নীটশে যেমন ভাগনারকে অভিহিত করেছিলেন 'নতুন যুগের দেবদূত' বলে, তেমনি ভাগনারও বইটিকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এক মহাগ্রন্থ বলে। 

এই নিঃসঙ্গতা নাকি বা হয়তো আত্মপ্রেম বিয়ে করা থেকেও বিরত রেখেছিল তাকে। ১৮৮২ র গ্রীষ্মে বান্ধবী লু সালোমের সঙ্গে তার পরিচয়। কিন্তু গ্রীষ্মের উত্তাপ পারেনি নীটশের এই প্রেমে উষ্ণতা আনতে। নীটশে প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন সালেমো। সে বছরের শীতেই সম্পর্কেও আসে শীতলতা যার অনিবার্য ফলশ্রুতি বিচ্ছেদ।

এক নতুন উপলব্ধির শুরু হলো, শক্তিই অনন্ত সুখ। সৃষ্টি হলো 'দাস স্পোক জরাথরুস্ট'। নীটশে জরাথরুস্ট বয়ে আনল নতুন ভাবনার দিশা। আবির্ভাব হল য়্যবেরমেনশ (ubermensch) এর। ইংরেজি পরিভাষাতে যার অর্থ হল 'সুপারম্যান' বা 'ওভার ম্যান' বা 'সুপারহিউম্যান'। জরাথরুস্ট বলেছিলেন, "আমি তোমাদের সুপারম্যান শেখাচ্ছি। সে মানুষকে অতিক্রম করে যাবে। তাকে অতিক্রম করবার জন্য তুমি কি করছ? (I teach you over man. Man is something that shall be overcome. What have you done to overcome him?)

নীটশে বিশ্বাস করতেন সুপারম্যান এর পক্ষেই সম্ভব বিশাল জীবন প্রবাহকে অনুসন্ধান করবার। তাঁর সঠিক মূল্যায়ন করবার। কারণ সে নির্ভর করে প্রবল ইচ্ছাশক্তির ওপর। অনন্ত সংগ্রামের মাধ্যমে একমাত্র মানুষই পারে জীবনের জয়গাঁথা গাইতে। পাথরের দেবতার পক্ষে তা সম্ভব নয়। 

পাশ্চাত্যের প্রায় সমস্ত দার্শনিকের চিন্তাপদ্ধতির মধ্যে নীটশে খুঁজে পেয়েছেন শুধু সীমাবদ্ধতা। কান্ট, হেগেল, ডেকার্তে, প্লেটো, মিন, স্পিনোজা কেউ বাদ যাননি। অনন্ত মহাজীবনের চরম মূল্যায়নে এরা প্রত্যেকেই ব্যর্থ। 

১৮৮৯ এর জানুয়ারি মাস থেকে মানসিক অবসাদ গ্রাস করলো তাঁকে। তারতম্য শুরু হলো মানসিক ভারসাম্যেরও। দীর্ঘ সময় ধরে মাইগ্রেনের যন্ত্রণা, ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে লাগলেন। প্রতারণা শুরু করলো দৃষ্টিশক্তি। ডিনামাইট যেমন চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেলে পাহাড়ের শিলা; মানসিক অবসাদও খান খান করে দিতে থাকলো তাঁকে। 

ঈশ্বরের মৃত্যু ঘোষণা করে আবাহন করেছিলেন এক নতুন শক্তির; চিত্রায়িত করেছিলেন ঈশ্বরহীন এক আধুনিক মহাজীবনের প্রতিচ্ছবি। তাঁর আত্মকথা 'একে হেমো' (Ecce Homo) (১৯৮৮) তে তিনি স্পষ্ট লিখলেন, "যেসব মূল্যবোধকে উপাসনা করা হয়েছে তার উল্টোটাই মানুষের অগ্রগতি, ভবিষ্যৎ আর ভবিষ্যতের মহৎ আবিষ্কারকে নিশ্চিত করতে পারে।" চিন্তাধারার নিজস্বতাই তাঁকে করে রেখেছিল চিরনিঃসঙ্গ। তিনি একাকী; কিন্তু অনন্ত শক্তির অধিকারী। যখন সুস্থ থেকেছেন তাঁর ভাবনা, তাঁর মেধা, তাঁর চিন্তাপদ্ধতি পাহাড়ের চূড়ার মতই গগনচুম্বী হয়েছে। 

অবশেষে ১৯০০ সালের ২৫ শে আগস্ট থেমে গেল মহান দার্শনিক নীটশের পথ চলা। যে সত্যের পাহাড়ে একাকী আরোহণ তিনি শুরু করেছিলেন শোপেনহাওয়ারের বিষণ্নতাকে সাথে নিয়ে; অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে, পথ দেখালেন ক্ল্যাসিক্যাল ফিলজফি থেকে পোষ্ট মডার্ন ফিলজফিতে উত্তরণের। দিশা দেখিয়ে গেলেন এক নতুন ভাবনার, এক নতুন চিন্তাধারার। তার চিন্তাধারা যেন পাহাড়ের বাঁধভাঙা খরস্রোতা নদীর মতই দুর্দম, দুর্বিনীত।
______________________
 আরও পড়ুন

এডগার এলান পো
 শ্রদ্ধা ও স্মরণে সন্দীপ  কাঞ্জিলাল


Post a Comment

0 Comments