জ্বলদর্চি

(Edgar Allan Poe)এডগার এলেন পো /সন্দীপ কাঞ্জিলাল

"মনের দরজায় কোনো সতর্ক প্রহরী না থাকলে, বাইরের দরজা দিয়ে যা কিছু অন্যায় ভেতরে চলে আসে। আর তক্ষুনি ওটা করবার জন্য মন আকুল হয়ে ওঠে। মনের ওই বিপথগামী গতি মানুষের হৃদয়ের আদিম মনোবৃত্তিরই স্বরূপ।"

      Edgar Allan Poe
      এডগার এলেন পো    (১৯/০১/১৮০৯-০৭/১০/১৮৪৯)

স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল

সমুদ্রপথে একটি জাহাজ ইংল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে। মাঝপথে জাহাজটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ডুবে যায়। জাহাজের একটি পাটাতনের ওপর চারজন মানুষ ভাসছে। তিনজন নাবিক এবং একজন ১৭ বছর বয়সী কর্মচারী 'রিচার্ড পার্কার'। তাদের সঙ্গে কোন খাবার ছিল না। দীর্ঘদিন ভাসতে ভাসতে, তিনজন নাবিক ক্ষুধার জ্বালায় সেই ১৭ বছর বয়সী কর্মচারী 'রিচার্ড পার্কার' কে খেয়ে ফেলে। না, এটি কোন গল্প নয়, সত্য ঘটনা। ঘটেছিল ১৮৪৪ সালে। 
ভাবলে গা ছমছম করে। হুবহু  এই ঘটনার একটি উপন্যাস লেখা হয়েছিল, এই সত্য ঘটনার ৬ বছর আগে। অর্থাৎ ১৮৩৮ সালে। সেই গল্পের ওই চরিত্রের নাম ও ছিল- 'রিচার্ড পার্কার'। লেখক মুখবন্ধে লিখেছিলেন এটি একটি সত্য ঘটনার উপর বর্ণিত। উপন্যাসটির নাম 'দ্য ন্যারেটিভ অফ আর্থার গর্ডন পিম অব ন্যানটাকেট' (The Narrative of Arthur Gordon Pym of Nantucket)- 1838। এই ঘটনার পর লেখককে ঘিরে শুরু রহস্য, তিনি কি তাহলে ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন? অথবা তার কাছে কি কোন টাইম মেশিন ছিল?

এই রহস্যময় লেখকের নাম 'এডগার এলেন পো' (Edgar Allan Poe)। আমি বুঝতে পারছি না, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "এক গাঁয়ে" পড়বো না 'পো' এর "অ্যানাবেল লি" (Annabel Lee) কিংবা রবীন্দ্র-প্রভাব মুক্ত কবি জীবনানন্দ দাশের 'বনলতা সেন' পড়বো? না, 'পো' এর 'টু হেলেন' (To Helen) পড়বো? এ প্রশ্ন তোলা থাক! পরে আলোচনা করা যাবে। এরমধ্যে মাথায় আবার এক প্রশ্ন। কে ঐ লোকটা যে মৃত্যুর সময় বলছে, "Lord Help My Soul"।  হ্যাঁ, হ্যাঁ ঐ লোকটা তো, যে চারদিন আগে আমেরিকার বালটিমোরের রাস্তায় পড়ে ছিল। পরনে ছিল ছেঁড়া পোশাক! যা তার নিজের নয়, গায়ে ক্ষত। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে! মুখে রক্তের কষ। ভুল বকছে। সবাই পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। কেবলমাত্র চাঁদের কিরণ তার উপর পড়ে ঠিকরাচ্ছে। আর সেই আলোয় জোসেফ ওয়াকার বলে একজন তাঁকে চিনতে পেরে, ওয়াশিংটন মেডিকেল কলেজে নিয়ে গেল। তাঁর তিনদিন পরে, অর্থাৎ ৭ অক্টোবর মারা গেল 'এডগার এলেন পো' (Edgar Allan Poe)।

তাঁর জন্ম ১৮০৯ সালে ১৯ জানুয়ারি। পিতা ডেভিড পো এবং মা এলিজাবেথ আর্নল্ড পো। ১৮০৩ সালে চার্লেস্টন থিয়েটারে নাটকের অভিনয়  দিয়ে  ডেভিড  পো র পেশাগত জীবনের  যাত্রা শুরু। সুদর্শন  ডেভিড পো ছিলেন মদ্যপায়ী, অস্থির চিত্ত খিটখিটে মেজাজের মানুষ। অভিনেতা হিসেবে সাধারণ। অন্যদিকে মা এলিজাবেথ পো ছিলেন পরিশ্রমী এবং অভিনয়ে মানুষকে অভিভূত করার ক্ষমতা। তখনও আমেরিকা, বিশেষ করে নিউ ইংল্যান্ডের অভিজাত শ্রেণির কাছে নাটক ছিল এক অসম্মানজনক পেশা। তবুও বোস্টন থেকে চার্লেস্টন পর্যন্ত এলিজাবেথ নাটকের অভিনয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। এলিজাবেথের প্রথম স্বামী চার্লস হপকিন্স-র মৃত্যুর পর তিনি ডেভিড পো র সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে 'পো' ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁরা যখন 'কিং লিয়র' নাটক অভিনয় করেছিলেন তখন জন্ম হয় এডগারের। তাই তার নাম 'এডগার' রেখেছিলেন। এডগারের জন্মের একবছর পরে তার বাবা তাদের ছেড়ে চলে যায়। তাঁর একবছর পর তার মা 'এলিজাবেথে'র মৃত্যু হয় যক্ষায়। রিচমন্ডের সম্ভ্রান্ত পরিবারের দুই মহিলা, মিসেস জন এলেন এবং মিসেস উইলিয়াম মেকেঞ্জি, 'এডগার পো' এবং তার বোন রোজালিনকে পোষ্য সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেন। 
নিঃসন্তান মিসেস জন অ্যালেনের প্রতি 'এডগার পো' এক ধরনের আকর্ষণ অনুভব করতেন এবং তিনি সারা জীবন এই অনুভূতি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। মিঃ জন অ্যালেন একজন সফল স্কটিশ ব্যবসায়ী এবং আমেরিকার রিচমন্ডে সুপ্রতিষ্ঠিত। ভালো পরিবেশে বেড়ে উঠছিলেন'এডগার পো'। আইনসঙ্গত ভাবে দত্তক পুত্রের স্বীকৃতি না দিলেও এডগার পো-কে তিনি ভালো স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। তাই এডগার পো'-কে ঐ পরিবারের সন্তান হিসেবেই স্বীকার করে নিয়েছিল রিচমন্ডের লোকজন। ব্যবসায়িক কারণে জন অ্যালেন ১৮১৫ সালে ইংল্যান্ড যান। তখন 'এডগার পো' স্কটল্যান্ড ঘুরে দেখার সুযোগ পান। পাঁচ বছর জন অ্যালেন পরিবার নিয়ে ইংল্যান্ডে বসবাস করেন। সে সময় 'পো' দুটি স্কুলে অধ্যয়ন করেন। দ্বিতীয়টি ছিল ম্যানর হাইস্কুল যার সভাপতি ছিলেন ড.জন ব্রান্সবি। এখানেই পো পরিচিত হন 'এডগার অ্যালেন পো' নামে। এখানে তিনি ল্যাটিন, ফ্রেঞ্চ, ইতিহাস এবং সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। পরবর্তী সময় তিনি তার উইলিয়াম উইলসন  চরিত্রে ব্রান্সবিকে চিত্রায়িত করেন। 
অর্থনৈতিক কারণে জন অ্যালেন ১৮২০ সালে রিচমন্ডে ফিরে যেতে বাধ্য হন। 'পো' কে স্কুলে পাঠাতে থাকেন জন অ্যালেন। কয়েক বছর পর স্কুলের প্রধান শিক্ষক জোসেফ এইচ কার্ক, এডগার পো সম্বন্ধে এই মন্তব্য করেন যে, "তাঁর ছাত্রটি খুব অধ্যবসায়ী না হলেও ক্লাসে তাঁর ফলাফল সন্তোষজনক। তার আত্মসম্মানবোধ প্রখর এবং কল্পনাশক্তি অতি উচ্চমানের।" কার্কের স্কুলে পো হোরেস, সিসেরো এবং হোমার অধ্যয়ন করেন। ১৮২৩ সালে উইলিয়াম বার্ক একাডেমিতে প্রবেশ করার পরও তিনি ধ্রুপদী সাহিত্যে এবং অংকশাস্ত্র অধ্যয়ন করতে থাকেন। পিতা মাতা অভিনয়ের সাথে যুক্ত থাকার কারণে রিচমন্ডের স্কুলে অধ্যয়নের সময় 'অ্যালেন পো' কে নানা ধরনের বিড়ম্বনা এবং তাচ্ছিল্য সহ্য করতে হতো। তবে একজন ভালো সাঁতারু হওয়ার কারণে তিনি প্রশংসাও অর্জন করেছিলেন। স্কুলের একজন সহপাঠী রবার্ট স্ট্যানার্ড এর মাধ্যমে এডগার পো সম্ভ্রান্ত এক মহিলা মিসেস জেইন ক্রেইপ স্ট্যানান্ড এর সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। এই মহিলার সহানুভূতিশীল ব্যবহারই ছিল অ্যালেন পোর কবিতার প্রথম আবেগের প্রকাশ, যার জন্য তিনি 'হেলেন এর জন্য'(To Halen) শিরোনামে একটি অনবদ্য গীতি কবিতা রচনা করেন। 

জন অ্যালেন ক্রমশ 'পো' এর জন্য সহানুভূতি হারাতে থাকেন। সারা এলমিরা রয়স্টারের সাথে বাল্য প্রেমের মতো একটি সাধারণ ব্যাপারে অ্যালান পো জড়িয়ে পড়লে, জন অ্যালেন তাদের এই প্রেমের সম্পর্কে বাধা প্রদান করেন। রিচমন্ড থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য অ্যালেন শার্লসভিলে, ভার্জিনিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে 'পো' কে পাঠিয়ে দেন। ১৮২৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী 'পো' উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানে 'পো' এর সামগ্রিক খরচ বহনের জন্য অ্যালেন অপরাগতা প্রকাশ করলে 'পো' অর্থ সংগ্রহের জন্য জুয়া খেলে ২০০০ ডলার হেরে বসেন। জন অ্যালেন এই অর্থ প্রদানে অস্বীকৃতি জানালে ঐ বছরই 'পো' এর নিয়মিত শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটে। তবে তিনি অনার্স নিয়ে ল্যাটিন অধ্যয়ন করেন এবং ইটালিয়ান এবং স্প্যানিশ ভাষা ও অধ্যয়ন করেন। তিনি মার্শালের লেখা ওয়াশিংটনের জীবনসহ ইতিহাস সম্বন্ধে ধারণা লাভে সচেষ্ট হন। অতি মাত্রায় মদ্যপান এবং উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। 
কাগজে লেখালেখি করে অর্থাভাব না মেটায় চার বছর বয়স বাড়িয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন, এবং দু' বছরে আর্টিলারির সার্জেন্ট মেজর পদে উন্নীত হলেন। কিন্তু তত দিনে এডগারের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যদিও কেউ তা পড়েনি। সেনাবাহিনী থেকে এবার তিনি অব্যাহতি চাইছেন। কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে কোনও লাভ হল না। তবে পালিকা মা ফ্রান্সেসের মৃত্যুর পরের দিন এডগার সেখানে উপস্থিত হতে পেরেছিলেন। 

এক দশক ধরে রিচমন্ড, ফিলাডেলফিয়া ও নিউ ইয়র্কে ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছেন তিনি। 'এডগার অ্যালেন পো' কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, একজন বড় লেখক হতে হলে কী লাগে? তিনি জবাব দিলেন, "একটা বড় ডাস্টবিন লাগে। লেখা নামক যেসব আবর্জনা তৈরি হবে তা ফেলে দেয়ার জন্য। লেখকরা ক্রমাগত আবর্জনা তৈরি করেন। নিজেরা তা বুঝতে পারেন না।"

১৮৩৩ সালে অ্যালেন পো Baltimore Sunday Visitor পত্রিকার ছোট গল্প প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে ৫০ ডলার পুরষ্কার লাভ করেন। গল্পটির নাম ছিল The Manuscript Founded in a Bottle। এই গল্পের জন্য তিনি 'সার্দান লিটরারি মেসেঞ্জার' (Southern Literary Messenger) এ চাকরি পান। মাতলামির জন্য চাকরী যায়। পরে ফেরত পেয়ে ১৩ বছর বয়সী জ্ঞাতি বোন ভার্জিনিয়া ক্লেমকে বিয়ে করেন 'এডগার অ্যালেন পো' ১৮৩৫ সালে। তখন 'পো' এর বয়স ২৬। ১৮২৭ সালে তিনি বোস্টনে পালিয়ে যান। এখানে পো ছিলেন নিজের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। জন অ্যালেন এর সাথে সম্পর্কের বিচ্যুতির কারণে বেদনাবিদ্ধ ছিল তাঁর মন। বোস্টনে তিনি একজন অতি অপরিচিত মুদ্রকের সাহায্যে তার প্রথম কবিতার বই Tarmarlane এবং Other Poems প্রকাশ করেন। লেখক হিসেবে নিজের নাম উল্লেখ না করে লেখেন By a Bohemian। এতে তাঁর অর্থ উপার্জন হয়নি, কোন প্রশংসা ও তিনি অর্জন করেননি। অথচ প্রথম সংস্করণের এই কাব্যগ্রন্থটির এক কপির মূল্য ১৯৯২ সালে ধার্য হয়েছিল ১৫০০০ ডলার। এই বইটির প্রথম সংস্করণ এতই দুষ্প্রাপ্য যে এর একটি কপি দুই লক্ষ ডলারে বিক্রয় হয়েছে। 
এরপর ছোটগল্প কবিতা সাহিত্য নিয়ে আলোচনা প্রভৃতি লিখে চলেছেন। 'পো' 'বার্টনস জেন্টেলম্যানস' এবং 'গ্রাহামস ম্যাগাজিনে' সহ সম্পাদকের কাজ করছেন। তাঁর রহস্যময় শ্বাসরোধকারী ছোট গল্পগুলির জন্য তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লেও পয়সার অভাব তার সঙ্গ ছাড়ছে না। এই সময় স্ত্রী 'ভার্জিনিয়া' অসুস্থ। অন্যদিকে 'পো' এর মদ খাওয়া বেড়ে চলেছে। পুরনো কাগজের চাকরী ছেড়ে এবার কাজ ধরলেন 'ইভনিং মিরর' এবং 'ব্রডওয়ে জার্নাল' এ। ১৮৪৫ সালে 'ইভনিং মিরর' এ প্রকাশিত হল তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ 'দ্য রাভেন' ( The Raven)। এবার 'ব্রডওয়ে জার্নাল' এ কাজ ছেড়ে দিয়ে তিনি চলে গেলেন নিউ ইয়র্কের ব্রঙ্কস অঞ্চলের একটি ছোট বাড়িতে। যা এখন 'পো কটেজ' নামে পরিচিত।
সবাই একবাক্যে স্বীকার করবে যে, 'পো' এর মাধ্যমেই আধুনিক গোয়েন্দা সাহিত্যের জন্ম হয়েছে। তাঁর 'দ্য মার্ডার্স ইন দ্য রু মর্গ' (The Muders in the Rue Morgue)- ১৮৪১ এই গল্পে  তাঁর সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র অগ্যুস্ত দ্যুপ্যাঁ, মাও মেয়ের জোড়া খুনের মামলার নিষ্পত্তি করেন। 

পো-র জীবনে নেমে আসে বিষণ্ণতার আরেকটি গাঢ় অধ্যায়। মৃত স্ত্রীর স্মৃতি ভোলার জন্য তিনি নিউইয়র্ক ছেড়ে চলে আসেন এবং বাউণ্ডুলের মতো বহু জায়গায় ঘুরে বেড়াতে থাকেন। ঘুরতে ঘুরতে প্রভিডেন্স আইল্যান্ডে তাঁর দেখা হয়ে যায় প্রাক্তন প্রেমিকা সারাহ এর সাথে। সারাহও তখন বিধবা অবস্থায় ছিলেন, কয়েক বছর আগে স্বামী মারা গিয়েছিল তার। সারাহকে পেয়ে তখন পো-র কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। সারাহ তাকে আর্থিক ও মানসিক বিধ্বস্ত অবস্থা কাটিয়ে উঠতে নানাভাবে সাহায্য করেন এবং একসময় তাঁরা বিয়ের সিন্ধান্তও নেন। কিন্তু বিয়ের মাত্র ১০ দিন আগে ১৮৪৯ সালের ৭ই অক্টোবর 'এডগার অ্যালেন পো' এর আকস্মিক মৃত্যু হয়। 

তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি যা আজও মনে শিহরণ জাগায়, "যারা দিনে স্বপ্ন দেখে তারা এমন কিছু দেখতে পায়, যা যারা শুধু রাতে স্বপ্ন দেখে তা তারা পারে না।" তার ছোট গল্প এক একটি হীরকদ্যুতি। স্বয়ং 'কবিদের রাজা বোদল্যের' ফরাসিতে অনুবাদ করেছেন। অনুবাদ করতে গিয়ে 'বেদল্যের' বলেছিলেন, "যে সীমারেখাগুলি জীবন ও মৃত্যুকে বিভাজিত করে দেয় তা আসলে ছায়াচ্ছন্ন আর আবছা। কে বলবে কোথায় একটির শেষ, আর অন্যটির শুরু।" 

তাঁর 'দ্য টেল-টেল হার্ট' (The Tell-Tale Heart)- ১৮৪৩। যার গল্পের কথক এক শকুন চোখ বৃদ্ধের শরীরকে ছিন্নভিন্ন করে শোওয়ার ঘরে লুকিয়ে রাখে। পুলিশ বৃদ্ধের আত্মার চিৎকারে তদন্ত করতে এলে, কথক শান্ত থাকে। কিন্তু কথকের কানে বাজে বৃদ্ধের হৃৎস্পন্দনের শব্দ। 

১৮২৭ সালে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'টেমারলেন' (Tamerlane) যা প্রচ্ছন্নভাবে প্রেমিকা এলমিরাকে উদ্দেশ্য করে লেখা। তারপর লেখেন 'আল আরাফ' (AL Aaraf)- ১৮২৯। এই কবিতা গুলিতে জন মিন্টন' ও 'টমাস মুর' এর প্রভাব লক্ষণীয়। এরপর 'ইসরাফিল' ও 'টু হেলেন' (Esrafil, To Helen)- ১৮৩১। 

পো জীবনের প্রতি মুহূর্তের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণজাত বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন অনন্যসাধারণ ভাষারীতিতে, দীর্ঘ বর্ণনার মধ্য দিয়ে গল্পের ঘটনা বা অবস্থার যৌক্তিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আগেই বলা হয়েছে যে পো এর লেখা প্রধান প্রধান গল্পগুলো বিভীষিকাময়, উদ্ভট আর বিস্ময়কর এক ভুবন সৃষ্টি করে। তবে নিছকই বিভীষিকাময় অনুভূতির ভুবন নয় তা; মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ও নৈতিক বাস্তবতার তীব্র প্রতিক্রিয়া থেকেই এর সৃষ্টি। কোনো কোনো গল্প তো রীতিমতো গভীর নৈতিক দায়িত্বশীলতার অনুভূতি থেকেই উদ্ভূত। এ প্রসঙ্গে 'দ্য ফল অব দি হাউস অব অ্যাশার' (The Fall of the House of Usher - ১৮৪১) এর কথা উল্লেখ করা যায়। গল্পটি তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। রডারিক আর ম্যাডেলিন আশার দুই যমজ ভাই বোনের গল্প এটি। বোন ম্যাডেলিন অসুস্থতার চরম অবস্থায় অবচেতন হয়ে পড়বার পর ভাই রডারিক তাকে মৃত ভেবে অন্ধকার এক কুঠুরিতে রেখে আসেন। এখানে রডারিক অতিসূক্ষ ধী-সত্তার (Overfied intellect) প্রতীক। আর ম্যাডেলিন অবদমিত সহজ জীবনসত্তার (Suppressed Vital Self) প্রতীক। এই গল্পটি এবং এই ধরনের গল্প মোরোলা এবং লিজিয়ার মাধ্যমে তিনি বলতে চেয়েছেন যে, মানুষের জীবনসত্ত্বা (Vital) আর বুদ্ধিসত্ত্বার (Intellect) দ্রবণই হচ্ছে মানবজীবন। একটাকে ধ্বংস না করে অন্যটাকে নিরঙ্কুশভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। উইলিয়াম উইলসন গল্পের নায়ক উইলিয়াম উইলসন তার অনুরূপ চেহারার বন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে নিজের বিবেককে ধ্বংস করেছে। 'দ্য ব্ল্যাক ক্যাট' (The Black Cat)- ১৮৪৩, দ্য ইমপ অফ দি পরিভার্স' (The Imp of the Perverse)- ১৮৪৪ প্রভৃতি গল্পের বর্ণনাকারী প্রথমে হত্যাকাণ্ড, এবং পরে হত্যাকারী তা স্বীকার করেছে। 'দ্য কাসক অব আমানটিল্যাডো' (The Cask of Amontillado)- ১৮৪১ এবং 'হিপ-ফ্রগ' (Hop-Frog)- ১৮৪০ গল্পের উপজীব্য প্রতিশোধপরায়ণের হত্যাকাণ্ডে। 

কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, "The Rhythmic Creation Of Beauty'। আর ছোটগল্পের সংজ্ঞায় বললেন, " A Skillful Literart Artist has constructed a tale. If wise, he has not fashioned his thoughts  of accomodate his incidents; but having conceived, with delibarate care, a certain unique or single effect to be wrought out, he then invents such incidents- he then combines such events as may best aid him in establishing the proconvinced effort." 

জন আরউইনের মতে 'পো' ফ্রয়েডের সার্থক পূর্বসূরি। আর কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বললেন, 'পো' র কবিতা থেকে তৈরি হল প্রতীকবাদীদের কাব্যভাষা। যখন অনেকে 'পো'র কবিতাকে অশ্লীল ঠুনকো বলছে, তখন তার কবিতা পড়ছেন- কবিদের রাজা বোদল্যের, আধুনিক কবিতার প্রাণপুরুষ মালার্মে। শুধু 'পো' কে পড়ার জন্য মালার্মে ইংরেজি শিখছিলেন। আর পড়ছেন ভেলের্ন সহ আরও অনেক দিকপালেরা। আর বোদল্যের 'পো' এর গল্প পড়ে বন্ধু তেত্তদোর-কে লিখলেন- "প্রথম বার যখন খুলে পড়লাম তাঁর বই, আমি আনন্দ ও ভয়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম সেখানে রয়েছে সেইসব জিনিস যার কথা আমি স্বপ্নে ভেবেছি, সেইসব বাক্য যেগুলোর কথা আমি ভেবেছিলাম। কিন্তু যা কুড়ি বছর আগেই তিনি লিখে ফেলেছিলেন।" 

'পো' র সারাজীবনে প্রায় ১৯টি মতো গল্প, একটি উপন্যাস এবং ৫টি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন।
প্রথমে যে প্রশ্ন রেখেছিলাম, 'পো' এর 'অ্যানাবেল লি'(Annabel Lee)পড়বো না রবীন্দ্রনাথের 'এক গাঁয়ে' পড়বো? তাহলে একটু মেলানো যাক-----
Annabel Lee---By Edgar Allan poe.

It was many and many a year ago,
in a kingdom by the sea,
That a maiden there lived whom you
May know
By the name of Annabel Lee,.
And this maiden she lived with no
Other thought 
Than to love and loved by me----------
এবার দেখি রবীন্দ্রনাথের 'এক গাঁয়ে' কবিতা-----

আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি 
সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ, 
তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি 
তাহার গানে নাচে আমার বুক। --------
এখনও ফুটপাতে ছিন্নভিন্ন পোশাকে, মুখ দিয়ে কারোর  রক্ত উঠছে দেখলে, চমকে উঠে দেখি,এ আমার স্বপ্নের পুরুষ 'এডগার অ্যালেন পো'( Edgar Allan poe) নয়তো? যার স্ফটিক দ্যুতি আমার আজও চোখ মুখ ঝলসে দিচ্ছে?
 ------------------------------------------
অভিমত জানাতে পারেন। 
 jaladarchi@yahoo.in    

Post a Comment

0 Comments