জ্বলদর্চি

আফ্রিকার লোকগল্প / চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লােকগল্প 
দক্ষিণ আফ্রিকা-জুলু উপজাতি-র লোকগল্প 

উবুন্তু 

চি ন্ম য়  দা শ

('উবুন্তু'– আফ্রিকার জুলু উপজাতির ভাষার একটি শব্দ। যার সহজ অর্থ হল- আমি নয়, আমরা। কিশােরকালে বালক-বালিকাদের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্যবােধ গড়ে তােলার উদ্দেশ্যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়। কেবল শব্দ নয়, বিখ্যাত একটি গল্পও আছে, এই নিয়ে। পৃথিবীর বহু দেশে বহু ভাষায় অনুবাদ করে, প্রচার হয়েছে গল্পটির। কোথাও গল্পের সরাসরি নাম রাখা হয়েছে- 'উবুন্তু'। কোথাওবা 'আমি নয়, আমরা', কোথাও 'হাতে রাখাে হাত' বা। 'সবার অস্তিত্বেই আমার অস্তিত্ব', 'আমরা সবাই এক' কিংবা এই রকমই কিছু নামে। পাঠকদের জন্য, আমরা "উবুন্তু" নামেই গল্পটি হাজির করলাম এখানে।)

আফ্রিকার একেবারে মাঝ এলাকা এটা। সবাই জানে, বিকেল না হতেই, হঠাৎ করে আঁধার ঘনিয়ে আসে এখানে।

একটা ঝাকড়া গাছের ছায়ায় বসেছিল মুরুগা বুড়ি। পাঁচ-পাঁচটা ছেলে-মেয়ে বাড়িতে। সেই কখন বেরিয়েছিল। দু-চারটে বুনাে আলুর আশায়।

সারা দুপুর খোঁড়াখুঁড়িই সার। একটা আলুও জোটেনি। কয়েকটা ফল-পাকুড় নিয়েছে মুরুগা। আর এক গােছা পাতা। চিবােলে টক টক লাগে। এগুলিই আজ রাতে বাচ্চাদের খােরাকি।

রাতে বিছানায় শুয়ে, মুরুগা তার বড়ছেলে টুবাকে বলল- "কাল বাদে পরশু দৌড় হবে। যাবি নাকি, টুবা?"

বছর বছর দৌড় প্রতিযােগিতা হয় স্কুলের মাঠে। যে সেরা হয়, পুরষ্কার দেওয়া হয় তাকে। ভীড়ও হয় বেশ।

টুবা বলল- "হ্যা, আমি যাবাে।"

ভালােই জমায়েত হয়েছে মাঠে। সাতটা ছেলে নাম লিখিয়েছে মাস্টারের কাছে। এক ঝুড়ি ফল এ বছরের পুরষ্কার। শহর থেকে বেছে বেছে আনা হয়েছে ফলগুলো। যে প্রথমে দাগ ছুঁতে পারবে, সে পাবে ঝুড়িটা।

ড্রাম হল আফ্রিকার বিখ্যাত বাজনা। কাঠের খােলের দু’মাথায় চামড়ার ছাউনি দেওয়া। বাজালে পাহাড়-নদী বন-জঙ্গল সব কেঁপে ওঠে। ড্রাম বাজিয়ে বাজিয়ে লােক জড়াে করা হয়েছে। 
দৌড় শুরু হল। মাঝমাঠে পৌঁছনাের আগেই, দেখা গেল টুবা দৌড়চ্ছে সকলের আগে। 'টুবা টুবা' নাম ধরে চেঁচাচ্ছে সবাই।

হঠাৎই কী হােল, দৌড় থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল টুবা। তার পেছনের ছেলেটা এসে পড়ল একটু বাদেই। হাত বাড়িয়ে সেই ছেলের হাত ধরে থামিয়ে দিল টুবা। সবাই অবাক। ব্যাপার কী? এদিকে একই ভাবে পর পর বাকি পাঁচজনের হাতও ধরে নিল তার পাশের ছেলেরা।

এবার এক সাথে একই লাইনে দৌড়তে লাগল তারা। এক মাপে পা ফেলছে সবগুলাে ছেলে। কেউ চেষ্টা করছে না কাউকে টপকে যাবার।

মাস্টারের চোখ রাগে টকটকে লাল। মাঠে ঢুকে, গরগরে গলায় জিজ্ঞেস করল- "এই বেআদবের দল। দৌড়ের নিয়ম এটা ? সবাই হাত ধরাধরি করে একসাথে দাগ ছুঁলি কেন? এটা নিয়ম নাকি ?"

বাজখাঁই গলা শুনে, ছেলেগুলাে চুপ। বুক ঢিপঢিপ করছে তাদের। টুবাকে তাক করল মাস্টার- "হতচ্ছাড়া। তুই হলি পালের গােদা। বল, কেন করলি এমনটা”

চোখ মাটিতে নামানাে। কিন্তু মুখ খুলল টুবা- "এক ঝুড়ি ফল একজন কেউ একাই পাবে- এ কেমন বিচার? সকলেরই পেট আছে একটা করে। সকলেই কষ্ট পায় খিদের সময়।”

মাস্টার তো থ' একথা শুনে। কোন রকমে বলল- “তাে”?

এখন ভয় নাই টুবার। চোখও তুলে নিয়েছে মাটি থেকে। বলল- “সবাই একসাথে দাগ ছুঁয়েছি । জিতেছি আমরা সবাই। এবার ঝুড়িটা দাও আমাদের। সবাই ভাগ করে নেব আমরা।"

ঠিক তখনই একটা লােক মাঠে দৌড়ে এল। মাস্টারকে বলল- “মােড়ল বলল, আজ নয়, পুরষ্কার আগামীকাল দেওয়া হবে। সবাইকে কাল আসার জন্য বলে দাও।"

মুখ কাঁচুমাচু করে, ছেলে সাতটা মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে গেল। জমায়েতও পাতলা হয়ে গেল ধীরেধীরে।  খাঁ-খাঁ করতে লাগল ভিড়ে ভরা মাঠটা।
মােড়ল কিন্তু বসেই ছিল নিজের জায়গায়। মাস্টার এসে বলল- “পুরষ্কার দেওয়া বন্ধ করলে কেন?”

-- "বলছি, ইস্কুলে চল।"

ইস্কুলে এসে মােড়ল বলল- “শােনগাে, মাস্টার। অনেক বড় কথা বলেছে ছেলেগুলাে। এটা আমাদের বহু পুরােণাে দিনের কথা। আমাদের গােটা জাতি একথা জানে, বিশ্বাস করে। মুখে বলে না। কিন্তু মেনে চলে জীবনভর। অভাবী মানুষ, দুর্বল মানুষ আমরা। পেট আছে, ঘরে ভাত নাই। মাথা আছে, গুঁজবার মত কোনও ছাউনি নাই। শরীর আছে, ঢাকবার মত কানিটুকুও নাই কারও ঘরে। থাকবার মধ্যে আছে আমাদের একতাটুকু। এই মিলমিশটুকুই আমাদের বল। আমাদের ভরসা। ছােট বড় যে কোনও সংকটে এটাকেই আঁকড়ে ধরি আমরা। আজ ছােট ছেলেগুলাে সেই বড় কাজটাই করেছে।”

মাস্টারের মুখে কথা নাই। ঠিকই তাে। সে ভুলে গিয়েছিল কীকরে ? বুড়াে মােড়ল জানে। জানে ছােট ছােট ছেলেগুলােও। আর সে মাস্টার হয়েও... ?

মাস্টার বলল- “কিন্তু পুরষ্কারটা আটকে দিলে কেন।"

মােড়ল বলল-- "আচ্ছা, বলাে তাে, দৌড়টা নিয়মমত হলে, কে জিতত ?"

-- “কেন, ঐ টুবা-ই।”

-- “নিজে এগিয়ে থেকেও, থেমে গিয়ে পাশের ছেলের হাত ধরেছিল কে?"

- “টুবা-ই তাে।”

- "ঠিক বলেছ। এবার বলাে তাে, এ গাঁয়ের সবচেয়ে অভাবী ছেলে কে? মানে, কার ঘরে দিনে একবারও দানা জোটে না ভালাে করে?"

মাস্টার বাইরের মানুষ। এ গ্রামের সকলের হাঁড়ির খবর জানবে কী করে? চুপ করেই রইল সে।

“শােন গাে, মাস্টার। ছােট দেশ আমাদের বুরুণ্ডি। একেবারেই ছােট্ট, এইটুকুন একটা মাটির ঢেলার মত। কপাল চাপড়ে ভাগ্যকে দোষ দেওয়া ছাড়া আর কিছু নাই আমাদের। তবে, আছে আমাদের মুখের ভাষাটুকু। এই ভাষার নাম হােল--কিরুণ্ডি। জানাে মাস্টার, ভাবতে বুক ভরে যায়, শুধু আমরা বুরুণ্ডির লােকেরাই এই ভাষায় কথা বলি, তা নয়। পাশাপাশি তানজানিয়া, কঙ্গো আর উগাণ্ডার লােকেরাও এই ভাষাতেই কথা বলে। কী মিস্টি ভাষা আমাদের এই কিরুণ্ডি!"

মাস্টার একটু অধৈর্য হয়ে উঠেছে। যেই বুড়ােদম নেওয়ার জন্য একটু থেমেছে, অমনি সে বলেউঠল-"ঠিক আছে, একদিন ভালাে করে শুনব তােমার কথা। এখন বল দেখি, পুরষ্কারটা আটকালে কেন ?”

বুড়াের চোখমুখে আলাে জ্বলে উঠল এবার-- "কীকী আছে তােমার ঐ পুরষ্কারেরঝুড়িতে?" 
মাস্টার বলল-- "সবই আছে। কলা, কুইন, আপেল, বেদানা, মিষ্টি আলু, আঙ্গুর, লেবু, এক মুঠো কফি- দানা- এইসব আর কী। সবই এনেছি বুজুসুরা (বুরুণ্ডি-র রাজধানি শহর) থেকে। একবারই তাে দিই বছরে। ভালাে জিনিষই আনিয়েছি আমি।”

-- “তুমি ভালাে জিনিষই দাও, সে আমরা সবাই জানি। এবার তুমি একটা ভালাে কাজ করে দেখাও।”

-- “বলাে তুমি। কী কাজ ?

-- "সাতটা ছেলে নেমেছিল মাঠে। এ বছর সাত জনকেই আলাদা করে পুরষ্কার দাও তুমি।" মােড়লের গলায় একটা আকুতি-- "জানি, তােমার অনেক খরচ হবে। একটা কাজ করাে তুমি। ঝুড়ি ছােট করাে। ফলের সংখ্যা কমিয়ে দাও। কিন্তু দাও সবাইকে। কত বড় একটা ভাবনা ভেবেছে ছেলেগুলাে। তার মর্যাদা দেওয়া দরকার।"

কথাটা মন ছুঁয়ে গেল মাস্টারের। মনে ভাবল-- একটু বেশি খরচ হবে অবশ্য। হােকগে। মাঝে মাঝে খরচের ভয়কে জয় করতে হয়। বিশেষ করে বড় কাজের বেলায়।

শিরা ওঠা দুটো হাত মােড়লের। জড়িয়ে ধরে মাস্টার বলল- “তুমি ঠিক কথাই বলেছ, মােড়ল। ভালাে কাজই হয়েছে পুরষ্কার আটকে দিয়ে। অনেক অ-নে-ক ধন্যবাদ তােমাকে। এখন যাই আমি। শহরে ছুটতে হবে আমাকে।"

পরদিন। মাঠে যেন লােক ধরে না। একটাই আলােচনা সকলের, পুরষ্কার দেওয়াটা আটকে গেল কেন ? এদিকে টুবা ভেবেছিল, মা হয়তাে বকাঝকা করবে তাকে। কিন্তু মা বরং তারিফই করেছে তার-- "ঠিক কাজই করেছিস, বাবা। সবাই গরীব। পেটের খিদে সবারই সমান। খেলে সবাই খাবে।" 
বেলা হতেই মাঠে এসে হাজির হয়েছে টুবা। আজ তার মা মুরুগাও এসেছে, বাকি চারটা ছেলেমেয়েকে নিয়ে।
আজ মােড়লকে মাঠের মাঝখানে এনেছে মাস্টার। মােড়ল বলল-- "সবাই তােমরা জানাে, কত ছােট্ট দেশ আমাদের এই বুরুণ্ডি। গােটা আফ্রিকার মধ্যে সবচেয়ে ছােট্টটি । এতটুকু দেশ। তাতে আবার পাহাড় আর বনজঙ্গল। চাষের জমি আর কতটুকু ? যাও বা আছে, সবই রাজা আর ধনীলােকদের। আমাদের আছে বলতে জীবনভর গায়ে-গতরে খাটা আর অভাব। হাজার মেহনত করেও, দিন দুবেলা ভাল করে দানা জোটেনা পেটে।" 
লােকেরা উসখুস করছে। এসব আর নতুন কথা কী ? সবাই জানে। এসব ছেড়ে, আসল কথাটা বললেই হয়। ফলের ঝুড়িটা আদৌ পাবে তাে ছেলেগুলাে ? পেলে কে পাবে? এই জানতেই তাে সবাই এসে জুটেছে।

মােড়ল বলল-- "দেশ আমাদের ছােট। কিন্তু মন ছোট নয়। আমাদের ছােট ছােট ছেলেমেয়েরাও যে বড় মনের মানুষ, কাল তা প্রমাণ হয়েছে। সাতটা ছেলেকেই পুরষ্কার দেওয়া হবে। এক ঝুড়ি করে ফল। পাবে সকলেই।"

উল্লাসে ফেটে পড়ল সবাই। মাঠ জুড়ে সে কী কোলাহল।

কোলাহল থামলে, পুরষ্কার দেবার পালা। মােড়ল বলল-- "বাড়তি ছ'ঝুড়ি ফল কিনতে অনেক বেশি খরচ হয়েছে মাস্টারের। এ বছর মাস্টারই পুরষ্কার দেবে সবাইকে।"

মাস্টার বলল-- "তা হয় নাকি ? বরং সত্যি কথাই বলি। গ্রামের সবাই শােন। কাল তাে আমি ভয়াণক রেগেই গিয়েছিলাম। ছেলেগুলাের এমন সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড দেখে। মােড়লই আমার চোখ খুলে দিয়েছে। ছােটদের কাছ থেকেও যে বড়দের শেখার আছে, মােড়লের কথাতেই জানতে পেরেছি আমি। ছেলেদের হাতে মােড়লই পুরষ্কার দেবে আজ।" মাস্টারের স্থির গলা।

মােড়ল কিন্তু মাথা নাড়ল সম্মত না হয়ে। নিজে গিয়ে, ভীড়ের ভেতর থেকে এক মেয়েকে ডেকে আনল। বয়স পঞ্চাশ ছোঁয়নি। হাড় জিরজিরে চেহারা। পরণের কাপড়টাও তেমনি জীর্ণ আর মলিন। সে হােল মুরুগা, টুবার হতভাগিনী মা।

মােড়ল বলল-- "আমরা সবাই এক। তােমার ছেলেই আবার মনে করিয়ে দিয়েছে কথাটা। পেটে খাবার দিতে পারােনি, কিন্তু বড় ভাবনা গুঁজে দিয়েছ তুমি ছেলের মাথায়। গােটা গ্রাম আজ তােমাকে সম্মান জানাবে এখানে। মাস্টার নয়, মােড়ল নয়। এ বছর তুমিই পুরষ্কার তুলে দেবে ছেলেগুলােকে।”

সবাই খুশি। সবাই চিৎকার করে উঠল আনন্দে।

প্রথম ঝুড়িটা দেওয়া হােল সাতজন দৌড়বাজের সব চেয়ে ছােটটিকে। এইভাবে সব শেষে এল টুবার পালা। তার হাতে যখন ফল ভর্তি ঝুড়ি ধরিয়ে দেওয়া হল, মােড়লের চোখের জল আর বাধা মানল না। কিগার নদীর (বুরুন্ডি আর রুয়াণ্ডা-র কিছুটা অংশের সীমারেখা হল এই সরু পাহাড়ি নদী) জলধারার মত, দুটো সরু রেখা গড়িয়ে যেতে লাগল মােড়লের দোমড়ানাে গাল বেয়ে।
--------------------
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments