জ্বলদর্চি

পূর্ব - মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা -২ / বিমল মণ্ডল

Spoken language of the fishing community of East-Medinipur district - 2

পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা
 
বি ম ল  ম ণ্ড ল 
 
পর্ব-২


পূর্ব-মেদিনীপুর জেলার ঐতিহাসিক পরিচয়

পূর্ব-মেদিনীপুর জেলা অন্যান্য জেলার মতো এই জেলারও একটি স্বতন্ত্র ইতিহাস আছে।কথিত আছে এক প্রাচীন পুঁথি অনুসারে ওড়িশার রাজা প্রাণ করের পুত্র মেদিনী করের নাম থেকে এই জেলার নামকরণ। মেদিনী কর বিখ্যাত সংস্কৃত অভিধান 'মেদিনী কোষ' করেছিলেন।তাঁরই হাত ধরে খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকে মেদিনীপুর শহর প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাচীন জনপদের অন্তর্ভুক্ত ছিল মেদিনীপুর। তাম্রলিপ্ত রাজ্যের সঙ্গে সারা পৃথিবীর বানিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এই বন্দরের মাধ্যমে। মহাভারতে তাম্রলিপ্তের উল্লেখ আছে। তাহলো তাম্রলিপ্তের রাজা দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় উপস্থিত ছিলেন। ফা-হিয়েন ছিলেন চৈনিক পরিব্রাজক। তাঁর সময়ে ছিলেন  মগধের রাজা চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য।ফা-হিয়েন দু'বছর তাম্রলিপ্ততে থেকে কয়েকটি বৌদ্ধধর্ম গ্রন্থের অনুলিপি করেছিলেন। এছাড়া কিছু ছবিও এঁকেছিলেন। তারপর তিনি এখান থেকেই বাণিজ্য  জাহাজে চড়ে সিংহলে গিয়েছিলেন। এরপর আনুমানিক সপ্তম শতকে এখানে হিউয়েং সাঙ পায়ে হেঁটে এসেছেন। তাঁর কয়েক বছর পরে এখানে আসেন ইৎসিঙ। সেই সময়ে এই তাম্রলিপ্ততে ছিলো এক বরাহ মন্দির। এই মন্দিরে বসেই তিনি নাগার্জুনের চিঠিপত্র অনুবাদ করেছিলেন।কথিত আছে  এই চিঠি-পত্র গুলো না-কি নাগার্জুন  সাতবাহনকে লিখেছিলেন। এরপরে  আসেন মহাযান শাখার তাঙ। তিনি এখানে বারো বছর থেকে  সংস্কৃত ও শব্দ শাস্ত্র শিখেছিলেন। 
মহাভারত, পুরাণ, জৈন ও বৌদ্ধ গ্রন্থ  এবং গ্রীক বিবরনের উল্লেখ পাওয়া যায় এই তাম্রলিপ্ততে। তবে এঁদের ভ্রমণ বৃত্তান্ত অনুযায়ী সমগ্র মেদিনীপুর জেলাই তাম্রলিপ্ত রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্তমান তমলুক বা তমলুকের কাছাকাছি কোনও অঞ্চল ছিল এর রাজধানী। 

সপ্তম শতকে গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক মেদিনীপুরের দাঁতনে ছিলেন। উৎকল ও গঞ্জাম জেলার কোঙ্গোদ রাজ্য জয় করেন।অষ্টম শতকের পর থেকে তাম্রলিপ্ত বন্দরের অবনতি ঘটতে থাকে। দ্বাদশ  শতকের শুরু থেকে মেদিনীপুরের অধিকাংশ স্থান  উৎকলের রাজা অনন্ত বর্মা চোড়বাঙ্গদেবের অধীনে ছিল।পনেরো শতকের শেষ দিকে গৌড়াধিপতি আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ওড়িশা আক্রমণ করেন। হোসেন শাহের আক্রমণে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের সব দেব মূর্তি নষ্ট হয়। কথিত আছে যে একমাত্র জগন্নাথ মূর্তিটি চিল্কা হ্রদের মধ্যে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল বলে সেটি অক্ষত ছিল। তারপর মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তার ঘটলে মেদিনীপুর ওড়িশার অন্তর্ভুক্ত হয়। 

১৭৬০ সালে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর প্রত্যক্ষ শাসনে শাসনে আসে মেদিনীপুর। কোম্পানির অত্যাচারে মেদিনীপুর তথা বাংলায় বিক্ষোভ-বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তখন অর্থাৎ ১১৭৬ বঙ্গাব্দে (১৭৬৯-৭০) মন্বন্তর দেখা দিলে সারা দেশ জুড়ে প্রায় এক কোটি মানুষ অনাহারে ও অসুখে মারা যায়। ১৭৯৯ সালে মেদিনীপুর জেলায় চুয়াড় বিদ্রোহ বা পাইক বিদ্রোহ দেখা দেয়। কোম্পানির রাজস্ব নীতির বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহে মেদিনীপুরের জমিদার রাণী শিরোমণি ও নাড়াজোল রাজ পরিবারের চুনিলাল খান এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। এই বিদ্রোহে অংশ নেন বাগদি, মাঝি,লোধা ইত্যাদি উপজাতিভুক্ত। 

ইংরেজ রাজত্বকাল জুড়ে মেদিনীপুর ইংরেজেদের কাছে এক সমস্যা স্বরূপ ছিল। সশস্ত্র এবং সহিংস আন্দোলনের কেন্দ্রীয় ভূমি ছিল এই মেদিনীপুর জেলা। স্ত্রী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলমান,জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ স্বদেশী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মেদিনীপুর জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক রাজনারায়ণ বসু ছিলেন চরমপন্থী কাজের প্রধান  নেতা। তাঁর তত্ত্বাবধানে তৈরি হয় গুপ্ত সমিতি। ক্ষুদিরাম বসু ঐ স্কুলের ছাত্র ছিলেন। ১৯৪২ সালে 'ভারত ছাড়ো'  আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা। তিনি মেদিনীপুরের ইতিহাসে বীরাঙ্গনা রূপে পরিচিত হয়ে আছেন। 

স্বাধীনতা আন্দোলন এই জেলায় এমন ভাবে তীব্র আকার ধারণ করেছিলো যে কাঁথি ও তমলুক মহাকুমার বিরাট অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় সমান্তরাল জাতীয় সরকার তমলুকের জাতীয় সরকার। তমলুকের জাতীয় সরকার প্রায় দু'বছর স্থায়ী হয়। ভারতের তিন রঙের পতাকার নকশা এই জেলারই সৃষ্টি। উদ্ভাবক ছিলেন মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক হেমচন্দ্র কানুনগো। 

বর্ধমান বিভাগের অন্তর্গত মেদিনীপুর  পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম জেলা। অবিভক্ত বাংলায় এর স্থান ছিলো দ্বিতীয়। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিমপ্রান্তে এই জেলা অবস্থিত। মেদিনীপুর জেলার আকার অনেকটা আয়তক্ষেত্রের মতো। উত্তর - দক্ষিণে লম্বা গড়বেতা থানার উত্তর সীমা থেকে রামনগর থানার দক্ষিন সীমা পর্যন্ত ১৪০কি.মি।পূর্বের শেষসীমা হলদিয়া থেকে পশ্চিমে গোপীবল্লভপুর থানার শেষ সীমা পর্যন্ত উত্তর- দক্ষিণের মতো লম্বা। জেলার উত্তর -পশ্চিমের উপরের দিকে ক্রমশ ঢিলার মতো দেখতে। মেদিনীপুর জেলার আয়তন ১৩৭২৪৩০ স্কোয়ার কিমি। কিন্তু হুগলি নদীর মোহানা রূপনারায়ণের অর্ধেক এর আয়তন ১৪০৮১ বর্গ কিলোমিটার।

এই জেলার নামকরণ জেলা শহরের নাম থেকে হয়েছে। তবে এই নাম নিয়ে বহু মতামত আছে। 'মিদানাপুর' এই নামটি ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত 'আইনি-আকবরী'তে  এবং 'মেদিনীপুর' নামটি গোপীবল্লভ দাসের 'রসিক মঙ্গল' কাব্যে (১৬৫৯ -৬০ খ্রিস্টাব্দে রচিত) প্রথম পাওয়া যায় বলে কেউ কেউ মনে করেন। তবে কথিত আছে খ্রিঃ তেরো শতকে গাণ্ডিচা দেশে (উড়িষ্যা)  সামন্ত রাজা প্রাণ করের পুত্র মেদিনী কর এই শহর প্রতিষ্টা করেন এবং তাঁরই নামানুসারে এই জেলার নাম হয়েছে মেদিনীপুরপুর। এই মেদিনীপুর শহর বর্তমান আর্য জাতীর নগরী। কিন্তু এই জেলাটি পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড়ো জেলা তাই প্রশাসনের সুবিধার জন্য এই জেলাকে ১লা জুন ২০০১ সালে পশ্চিম মেদিনীপুর ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলা নামে ভাগ করা হয়।

পূর্ব - মেদিনীপুর  জেলা ৫টি মহাকুমা  এবং পশ্চিম - মেদিনীপুর  জেলা  ৪টি মহাকুমা  নিয়ে  গঠিত  হয়। 

১.পূর্ব -মেদিনীপুর  জেলার  ৫টি মহাকুমা  হলো - তমলুক সদর, হলদিয়া, কাঁথি, এগরা। 

২. পশ্চিম -মেদিনীপুর  জেলার  ৪টি মহাকুমা  হলো - মেদিনীপুর  সদর, খড়গপুর , ঝাড়গ্রাম, ঘাটাল।
-----------------------------------------------------------------
প্রতি শুক্রবার প্রকাশিত হচ্ছে ধারাবাহিক। 
আপনাদের অভিমত পেলে ভালো হয়। 
jaladarchi@yahoo.in     

Post a Comment

1 Comments

  1. শিক্ষক দিবস মন্ডলের মেদনীপুর সম্পর্কিত এক বিশাল তথ্যভান্ডার অজানা-অচেনা তথ্য দিয়ে আমার সাধারণ জ্ঞান কে উজ্জীবিত করেছেআশা করি পরবর্তী দিনগুলোতে আরো বহু তথ্য দিয়ে আমাদের এই ক্ষুদ্র কেন ভান্ডারকে জ্ঞানের সাগরে ভরিয়ে দেবে আমরাজানি যে মেদিনীপুর শহর একটি জ্ঞানভান্ডার আর তার প্রমাণ আমরা বহুবার বহুজনের কাছ থেকে পেয়েছি এমনি করে শিক্ষক বিমল বাবুর কাছ থেকে আরও বহু তথ্য আমাদের উপহার দিবেন এই পথ চেয়ে আছে ধন্যবাদ।

    ReplyDelete