জ্বলদর্চি

করোনায় কি করণীয় / ডাঃ দিবাকর সামন্ত

করোনায় কি করণীয়

  ডাঃ দিবাকর সামন্ত 

২০১৯-এর ডিসেম্বরে প্রথম করোনা বা কোভিড -১৯ অসুখের কথা শোনা গেল। এই প্রায় ১০ মাসে সেই চীন দেশ থেকে একে একে পৃথিবীর সব দেশেই ছড়িয়ে গেল অসুখটা। একেবারেই নতুন অসুখ। আগে কেউ কিছুই জানত না। প্রথমত জানা গেল এটা একটা ভাইরাসজনিত অসুখ। তবে এই ভাইরাসটি প্রাকৃতিক না কি তৈরি করা তা এখনো জানা যায়নি। এর আগে এরকম ভাইরাসের অসুখ দেশে দেশে ছড়িয়ে গিয়ে অতিমারী বা মহামারী মানুষকে কম নাজেহাল করেনি। ১৯১৯-এর স্প্যানিশ ফ্লু'র সময় আমরা কেউই ছিলাম না ঠিকই , কিন্তু এইচআইভি, এডস্ , হাম, মামস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, জানা ছিল। 
এনকেফেলাইটিস, ডেঙ্গু, জলবসন্ত-সবই তো আমরা দেখলাম। ওইসব অসুখের সময় কি আমরা আজকের মত আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম? মনে তো হয় না। তাহলে করোনার বেলায় আমাদের এত আতঙ্ক কেন? তার কারণ এই রোগটির ভাইরাসের সংক্রমনের ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি, ব্যাপকভাবে প্রসারিত আর মৃত্যুহার কম হলেও( ১-২ %), বিপুল পরিমাণ আক্রান্ত হওয়ার কারণে মোট মৃতের সংখ্যা  ১০ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। তাছাড়া অবস্থা দেখে এটাও বোঝা যাচ্ছে যে এখনই এর কমার কোন সম্ভাবনা নেই। কত মানুষের অসুখ হবে আর কত মানুষ মারা যাবে তার কোনো ঠিক নেই।

   প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন তথ্য আর তত্ত্বের আমদানি হচ্ছে।  প্রথম বলা হল এটা ড্রপলেট ইনফেকশন-হাঁচি, কাশি, কথা বলা,গান গাওয়া, বা শ্বাস ছাড়ার সময় ভাইরাসটি লালার সঙ্গে মিশে বিন্দু আকারে সামনের কারো মুখ নাক বা চোখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। তাই ১ বা ২ মিটার দূরে থাকলে হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। কিন্তু এখন জানা যাচ্ছে যে ভাইরাসটি হাওয়ায় ভেসে থাকতে পারে এবং আরো দূরে চলে যেতে পারে, হাওয়ার গতির দিকে বেশি যেতে পারে। বদ্ধ ঘরে অনেক বেশি সময় ভেসে থাকতে পারে। অতএব এখন এটি একটি বায়ুবাহিত অসুখের গোত্রে এসে যাচ্ছে।

   প্রথমত শোনা গেল অসুখটি একবার হলে শরীরের ভেতর রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা তৈরি হয়ে যায়, তার আর ওই অসুখ  হবে না। এখন দেখা যাচ্ছে যেসব ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে তা বেশিদিন থাকে না। আবার ওই ভাইরাসের আরো অনেক প্রজাতির সন্ধান মিলছে যারা নতুন উদ্যমে অবাধে সংক্রমিত করতে পারে। যাইহোক অতশত জটিল ব্যাপারে আমরা এখন ঢুকবো না। আজকে এখন জেনে নিতে হবে কি করে এই রোগ থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়। এটা যে খুব কঠিন কাজ তা নয়। একজন করোনা রোগীর শরীর থেকে নির্গত হয়ে ভাইরাসটি যদি অন্য কারো শরীরে প্রবেশ না করতে পারে তাহলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
এই কাজটি সম্পন্ন করতে হলে কতগুলি পদ্ধতি আছে--

১) বহির্দেশ থেকে আগত ব্যক্তিদের আবশ্যিক পরীক্ষা ও পৃথকীকরণ।
২) সংক্রমিত ব্যক্তিদের পৃথকীকরণ।
৩) গৃহবন্দী।
৪) দূরত্ব বিধি।
৫) মাস্ক ব্যবহার।
৬) পরিছন্নতা। 

     প্রথম কাজটি ২০১৯- এর ডিসেম্বর থেকেই সুচারু রূপে করার দরকার ছিল, তা বোধহয় হয়নি। কারণ তা যদি হতো তাহলে ৩০শে জানুয়ারি চীন থেকে আগত কেরলের যে ৩ জন ছাত্র, তাদের বিমানবন্দরে আটকানো হত ও পৃথকীকরণ করা হতো। মার্চের ৪ তারিখে যে কুড়িজন রোগীর সন্ধান পাওয়া গেল তাদের মধ্যে ১৪ জন ইতালি থেকে আগত। মার্চের ১৫ তারিখে যে-যুবক কলকাতা বিমানবন্দর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসে অবাধে দশদিন সমাজে ঘুরে বেড়ালো এমনকি নবান্নেও ঘোরাঘুরি করে ১৮ মার্চে করোনা সংক্রমিত বলে জানা গেল; আর ১৩ মার্চ আমেরিকা থেকে আগত যুবকের করোনা নির্ণয় হল ২২ মার্চ। এরকম বহু উদাহরণ আছে অর্থাৎ আমাদের আরো অনেক শক্ত হাতে সংক্রমণ রোধের ব্যাপারটা মোকাবিলা করার দরকার ছিল। সে যাই হোক এই রকম শিথিলতার মধ্যেই যখন আমাদের দেশে প্রায় হাজারের উপর করোনা রোগীর সন্ধান পাওয়া গেল, পরীক্ষা না-হওয়া কতজন রোগী আছে তার অবশ্য ঠিক ছিল না তখন এল গৃহবন্দীর নিদান।

গৃহবন্দী
----------
হঠাৎ রাতারাতি সব যানবাহন, দোকানপাট, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ সব বন্ধ। জরুরী কাজ ছাড়া বাড়ির বাইরে বেরোনো বন্ধ, বাইরে থেকে আসা বন্ধ, কাজ বন্ধ, রোজগার বন্ধ, খাওয়া বন্ধ। কি দুর্বিষহ অবস্থা।এই অবস্থায় একটি এলাকা থেকে অসুখটি অন্য একটি এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে বাধা পাবে ঠিকই কিন্তু একই এলাকায় একজন রোগী থেকে সুস্থ মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা থেকেই যায়। আবদ্ধ মানুষগুলি যে দূরত্ব বজায় রাখতে পেরেছিল তাও মনে হয়না।

দূরত্ব বিধি
-------------
ভাইরাস সংক্রমণের তত্ত্বটি যদি ড্রপলেট বলি তাহলে অন্তত ১ বা ২ মিটার দূরত্বে থাকলে সংক্রমণের সম্ভাবনা কমে যায়। তবে বায়ুবাহিতের তত্ত্ব মানলে কিন্তু তা হয় না, আরো অনেকটা দূরে উড়ে যেতে পারে। এছাড়া যদি রোগী বদ্ধ ঘরে থাকে এবং ঘরের বাতাস যদি শুকনো হয় অর্থাৎ আর্দ্রতা কম হয় তাহলে অনেকটা সময় ভাইরাসটি বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে। এজন্য দূরত্ব বজায় রাখার সাথে সাথে বন্ধ ঘর;দরজা- জানলা বন্ধ বাস-গাড়ী, সিনেমা হল, মিটিং হল  এড়িয়ে চলতে হবে। উৎসব অনুষ্ঠানের ভিড়ও এড়িয়ে চলতে হবে।
 
পৃথকীকরণ
---------------
যখন কারো মধ্যে করোনা ভাইরাসের সন্ধান মিলবে তখন তাকে একটি পর্যাপ্ত আলো-হাওয়াযুক্ত ঘরে পৃথক করে রাখতে হবে অন্তত ১৪ দিন। অন্যদের যথাসম্ভব ওই  ঘরে না ঢোকাই ভালো। ঢুকতে হলে যথাযথ সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে। ঘরটি দুবেলা জীবাণুমুক্ত করার জন্য স্প্রে করতে হবে। রোগীর ব্যবহৃত সমস্ত সামগ্রী সুচারুরূপে নিষ্পত্তিকরণ(জীবানু মুক্ত) করতে হবে।

একটা সময় রোগটিকে আটকানোর জন্য রোগীর এলাকাটি পুরো ঘিরে দেওয়া হতো। ওই এলাকার মানুষদের শহরে যাওয়া বন্ধ এবং অন্য এলাকার মানুষদের ওই এলাকায় ঢোকা বন্ধ। এই পদ্ধতিতে ওই এলাকার ভেতরে থাকা মানুষজনদের নিজেদের মধ্যে রোগটি ছড়িয়ে পড়া কি করে আটকাবে তা বোঝা গেল না। মাঝখান থেকে যেভাবে রোগীকে তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে  যাওয়া হোতো, যে ভাবে তাকে সামাজিক বয়কট-এর মধ্যে কাটাতে হতো তাতে অন্যেরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ত আর পরীক্ষা করাতেও চাইত না। তবে ইদানিং দেখছি, এই ব্যাপারটি আর নেই।

মাস্ক
------
সবশেষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কার্যকরী পন্থা হলো মাস্ক-এর ব্যবহার। যদি রোগী তার নাক-মুখ ঢেকে রাখে তাহলে ভাইরাসটি বাইরে বেরোতে পারবে না। সুস্থ মানুষ কেউ মাস্ক-এর সাথে সাথে চোখ ঢাকার ব্যবস্থা করতে পারে।সাধারণ কাপড়ের মাস্ক এত সূক্ষ্ম ভাইরাসকে ভালোভাবে আটকাতে পারে না। হয় N95 অথবা ত্রিস্তরীয় সার্জিক্যাল মাস্ক পরতে হবে। মাস্ক এমনভাবে পরতে হবে যেন তার কোন ধারে  একটুও ফাঁক না থাকে, সঠিকভাবে সব সময় নাক মুখ ঢেকে রাখতে হবে। মাস্ক পরা বা খোলার সময় হাত সাবান জলে ধুয়ে নিতে হবে। মাঝে মাঝে অনেককে দেখা যায় মাস্কটিকে নিচের দিকে টেনে নামিয়ে কথা বলে আবার উপরে তুলে দিতে। এতে গলায় লেগে থাকা ভাইরাস মাস্ক-এর ভেতর দিকে লেগে খুব সহজেই মুখে ঢুকতে সুযোগ পেয়ে যায়। একই মাস্ক দিনের-পর-দিন পরা চলে না। সাবান জলে কাচলে মাস্ক-এর কার্যকারিতা হ্রাস পায়। সার্জিক্যাল মাস্ক যদি বারবার ব্যবহার করতে হয়, তাহলে একটা ব্রাউন কাগজের ঠোঙায় ঢুকিয়ে ওভেনে ৬০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড ৩০ মিনিট সেঁকে নিয়ে ঠান্ডা করে ব্যবহার করা যায়।

কোন মাস্ক কেমন কাজ করে,
তার ছবি--


 মাস্ক পরলে কতটা উপকার হয়,
তার ছবি---

পরিছন্নতা
-------------
ভাইরাসকে আটকানোর জন্য অনেককে দেখেছি গ্লাভস আর মস্তকাবরন ব্যবহার করতে। কিন্তু ভাইরাসটি হাত বা মাথা দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে না। ভাইরাস শরীরে প্রবেশের তিনটি পথ- মুখ, নাক, চোখ। যদি মাথায় ভাইরাস বসে এবং  হাত যদি মাথায় লাগে তখন ভাইরাসটি হাতে আসবে, আর সরাসরি ভাইরাসটি যদি হাতে লেগে যায় তাহলে সেই হাত মুখ-নাক বা চোখে  লাগলে ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করবে। কিন্তু তার আগে যদি হাতটি অন্তত ৩০ সেকেন্ড ধরে ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ে নেওয়া যায় তাহলে ওই ভাইরাস তো মারা যাবে, শরীরে প্রবেশের সুযোগ কোথায়? আর যদি মাস্ক পরা থাকে, চোখে চশমা পরা থাকে, তাহলে আর হাতের ভাইরাস শরীরে যাবে কেমন করে? বরং সঠিক পদ্ধতিতে যদি ওই মাক্স বা পিপিই কিট যদি না খুলে ফেলতে পারে এবং নির্বীজকরণ করতে না পারে তাহলে ওইসব থেকেই বেশি সংক্রমিত হতে পারে।

এত কাণ্ড করেও যদি কিছু ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করেও তাহলে আমাদের শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তাদের আটকাতে সক্ষম হবে। যদি না আমরা  আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে  পড়ি, যদি ভিটামিন সি, বি, ই, এ এবং জিঙ্ক যুক্ত খাদ্য খাই, এবং প্রত্যহ প্রাণায়াম ও হালকা ব্যায়াম করি এবং সর্বোপরি মনটাকে উৎফুল্ল রাখি এবং অন্যের অনিষ্ট চিন্তায় মগ্ন না থাকি-- তাহলেই এই রোগের সঙ্গে লড়াই সম্ভব হবে।

Post a Comment

5 Comments

  1. খুব সুন্দর তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। সমৃদ্ধ হলাম।

    ReplyDelete
  2. সোজা সাপ্টা কথা, সাবলীল ভাষায়...
    অমান্য কোরোনা...

    ReplyDelete
  3. সত্যি বলতে পুরোটাই খুব সুন্দভাবে সহজ উপায়ে বিস্তারিত জানতে পারলাম সবাই ,কিন্তু এখন কার এই পরিস্থিতিতে সবাই উদ্বিগ্ন, চিন্তিত সেই অবস্থায় সঠিক ভাবে কিভাবে মেনে চললে এইমারন ভাইরাস থেকে বাঁচা যায় তার উপায় টুকু শুধু বললে সবাই উপকৃত হবো,কি করা উচিৎ

    ReplyDelete
    Replies
    1. দূরত্ববিধি মেনে চলুন।
      বাইরে বেরোলা বা অচেনা মানুষের সামনে এলে অবশ্যই মাস্ক পরবেন।
      মুখে,নাকে,চোখে হাত দেও য়ার আগে অবশ্যই সাবান জলে হাত ধু য়ে নেবেন।
      আনন্দে থাকবেন, নিশ্চিন্তে থাকবেন।

      Delete
  4. খুব সুন্দর লেখা। তবে প্রাথমিক ভাবে কিছু ওষুধের নাম যদি ডাক্তারবাবু দিতেন তাহলে সাধারণ মানুষের খুব উপকার হতো।

    ReplyDelete