জ্বলদর্চি

বাংলাদেশ (গারাে পাহাড়)-র লোকগল্প / চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লােকগল্প - বাংলাদেশ (গারাে পাহাড়)

চিন্ময় দাশ

বাঘের ভােজ

বিশাল বিশাল সব পাহাড়। সেসব পাহাড়ের ঢালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গড়ে উঠেছে ছােট ছােট গ্রাম। খুব গরীব সব লােকজন বাস করে সেসব গ্রামে। পাহাড়ের বন-জঙ্গল পুড়িয়ে জমি হাসিল করে তারা। সেই জমিতে চাষবাস করে সংসার চালায়। বড়ই মেহনতের কাজ। আর না করেই বা উপায় কী ? পেট চালাতে হবে তাে।

তবে, এর সাথে বিপদও আছে অনেক। ফসল পাকার সময় হলাে, অমনি কতরকমের উৎপাত শুরু হয়ে যায়। বুনাে শুয়াের, ইঁদুর, খরগােশ - শত্রুর যেন অভাব নাই। ওৎ পেতে থাকে সবাই। সূযােগ পেলেই হল। সবাই এসে ঝাপিয়ে পড়বে মিষ্টি পাকা ফসলের ওপর। দেখতে না দেখতে গােটা মাঠ সাবাড়। তাই ফসল পাকার সময় হলে, চিন্তার শেষ থাকে না চাষীদের। দিন নেই, রাত নেই খেতে পাহারা থাকতে হয় তখন। তা নাহলে যে উপবাস দিতে হবে সারা বছর।

সারাদিন খেতে কাজ সেরে, ঘরে ফিরেছে এক চাষী। বড় মেয়েকে বলল-- আজ রাতে তুই পাহারায় যাবি, মা। মেয়ে বলল-- বাবা, আমি তাহলে ছােট বােনকেও নিয়ে যাই। দু'জনে গল্পগুজব করে পাহারা দেওয়া যাবে। বাবা বলল-- তাই যা।

বনের মধ্যে বড় বড় সব গাছ। তার উঁচু ডালে মাচা বাঁধে চাষীরা, পাহারা দেওয়ার জন্য। দুই বােন সেই মাচা-ঘরে পাহারা দিতে এল।

রাত বাড়ছে। ঝিঁঝিঁ পােকা ডাকছে গােটা জঙ্গল জুড়ে। দু'-একটা রাতচরা পাখি উড়ে যাচ্ছে মাঝে মধ্যে। তাদের ডানা ঝাপটানাের শব্দ শােনা যায়। দুই বােনের কিন্তু এসবে কোন ভয় নাই। তাদের ভয় শুধু ঘুমপরীকে। একবার যদি চোখের পাতায় এসে ভর করে, তাহলে আর দেখতে হল না। চোখের পাতা বন্ধ হলেই বিপদ। কখন যে শয়তানগুলাে এসে সব সাবাড় করে দিয়ে যাবে, জানতেই পারা যাবে না।

সত্যি সত্যিই বড় বােনের ঘুম পেয়ে গেল এক সময়। সে বলল-- বােনটি, আমার কিন্তু ঘুম পাচ্ছে।

ছােট বােনও ভয়ে ভয়ে বলল-- আমারও ঘুম পাচ্ছে, দিদি। কী হবে তাহলে ? বড় বােন বলল-- তাহলে এক কাজ করা যাক। আমরা বরং গান-বাজনা করি, আয়।

তার বােন বলল-- সেই ভাল। বেশ আনন্দ হবে। ঘুমও পাবে না। 
মাচাঘরের দেওয়াল থেকে হার্প (এক ধরণের বাদ্যযন্ত্র। আমাদের জঙ্গলমহল এলাকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের "কেঁদরি" যেমনটি) নামাল তারা। ভারী মিষ্টি হার্পের সুর। আঙুল ছোঁয়ালেই হল। দারুণ মিষ্টি সুর ঝরে পড়ে সরু সরু তার থেকে। সুরের মায়ায় মেয়ে দুটিও মুগ্ধ। বাজনার সাথে গানও গাইতে লাগল তারা। সেই গান আর বাজনার সুরের মায়া খেলা করতে লাগল রাতের বাতাসে।

হয়েছে কি, এক বাঘ শুয়ে বিশ্রাম করছিল তার গুহায়। বাতাসে ভেসে সেখানেও পৌঁছেছে সেই সুর। কান খাড়া করে শুনল একটুক্ষণ। তারপর আড়মােড়া ভেঙে উঠে পড়ল বাঘ। গুটি গুটি পায়ে গুহা থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। কান খাড়া রেখে এগােতে লাগল বনের ভেতর দিয়ে।

সুরের খোঁজ করতে করতে মাচা-ঘরটার কাছে এসে হাজির হল সে। কিন্তু সেই সুরের এমনই যাদু, বাঘ নিজেই নাচতে আরম্ভ করে দিল। কিন্তু বাঘের অত বড় ভারী শরীর। তার উপর মনের আনন্দে নাচ বলে কথা। ধুপ ধাপ শব্দ হতে লাগল। বাঘের কিন্তু সেদিকে খেয়াল নাই।

কিন্তু দুই বােনই শব্দটা শুনতে পেয়েছে। বড় বােন বলল-- নীচে যেন কিসের শব্দ হচ্ছে, বােন।

বােন বলল-- আমিও শুনেছি। চল, দেখি কীসের আওয়াজ। মাচা-ঘরের জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখতে গেল তারা। যেই বাঘকে দেখতে পেল, তাদের তাে কাহিল অবস্থা।

মজা হল, গান বন্ধ হতে বাঘেরও গান বন্ধ হয়ে গেছে। জানালা দিয়ে মুখ-বাড়ানাে মেয়ে দুটোকে দেখতে পেয়ে গেল সে। কতক্ষণ নেচে নেচে তার মনমেজাজ বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠেছে। তার ওপর দু-দুটো মেয়ের সন্ধান পেয়ে, তার আর আনন্দ ধরে না মনে। কচি কচি মেয়ে, নধর শরীর তাদের। নরম তুলতুলে মাংস। এমন তােফা একটা ভােজের কথা ভাবতেই, বাঘের মনে দারুণ পুলক। লােভে জিভ দিয়ে লালা গড়াতে লাগল তার। একটাই ঝামেলা, গাছে চড়তে হবে।

দু’ পা হেঁটে গাছের তলায় এল বাঘ। তার হাঁটার মস-মস শব্দ হােল ঘাসপাতার ওপর। মেয়ে দুটো দেখতে পেল বাঘ গাছের দিকে এগিয়ে আসছে। ভয়ে কাঁপতে লাগল তারা। বুক ধড়ফড় করতে লাগল। পা কাঁপছে তাদের। শরীর হিম হয়ে গেল। বড় বােন বলল-- বেশ তাে নাচছিল শয়তানটা। এখন কেমন এগিয়ে আসছে, দেখ। 
ছােট বােন বলল-- দিদি, তাহলে আবার গান করি, আয়।

দু’জনে মিলে আবার গান গাইতে লাগল। সাথে হার্পের বাজনা। আবার সেই মনমাতানাে মিষ্টি সুর। বাঘ আবার নাচতে লাগল সব ভুলে। কতক্ষণ এভাবে চলতে লাগল। গান গাইছে বটে, বড় বােনটার ভাবনা, কী করে জব্দ করা যায় শয়তানটাকে। মনে মনে একটা ফন্দি আঁটল সে। ছােট বােনকে বলল-- বােন, তুই বাজনাটা বাজিয়ে যা। থামাবি না। আমি ব্যবস্থা করছি হতভাগার।

ছােট বােন হার্প বাজাচ্ছে আর গান গাইছে। বড় বােনও গান গাইছে। গানের সাথে কাজও করছে হাতে। শীত কালের রাত। ঘর গরম করার জন্য মাচার একধারে আগুন জ্বলছে চুল্লিতে। সে মাচাঘরের কোন থেকে একটা পাকা কুমড়াে বার করল বেছে বেছে। চুল্লির ওপর এনে বসিয়ে দিল সেটা। তারপর খুঁচিয়ে গনগনে কজে তুলল আগুনটাকে। কুমড়ােটা গরম হতে লাগল তাতে।
কতক্ষণ পরে বােনকে গান বাজনা থামাতে ইঙ্গিত করল সে। নিজেও গান বন্ধ করে দিল। বাজনা থামতে বাঘের নাচও বন্ধ। মাচাঘরের নীচে ছিল একটা খড়-বিচালির গাদা। মেয়েটা চুল্লি থেকে কুমড়ােটাকে তুলে নীচে ফেলে দিল। গাদার ওপরে ধপাস করে পড়ল কুমড়ােটা। সাথে সাথে ওপর থেকে বড় বােনের চিৎকার--- হায়, হায়। এ কী হল ? এখন আমি কী করি? আমার কোলের বাছা পড়ে গেল হাত ফসকে। হায়, হায়, আমার বাছার কী হবে?

দিদির কৌশল বুঝতে কষ্ট হল না বােনের। সেও চিল-চিৎকার জুড়ে দিল সাথে সাথে-- হায়রে হতভাগী, এ তুই কী করলি ? এই আঁধার রাতে কোলের বাছাকে নীচে ফেলে দিলি তুই ? এখনই বাঘের পেটে যাবে বাছা। ওকে কি আর ফিরে পাব আমরা। দুই বােনের কান্নায় বনের বাতাস কেঁপে উঠল। 
ধপাস করে কুমড়াে পড়বার শব্দটা শুনেছিল বাঘ। এখন মেয়ে দুটোর কান্না শুনে ভারী আমােদ হল তার। গাছে চড়তে হচ্ছে না, নীচে বসেই ভােজ সারা যাবে।

তার আর দেরী সইল না। এক লাফে খড়ের গাদায় হাজির হয়ে গেল। হয়েই এক বিশাল কামড়। যেন পারলে এক কামড়েই গিলে খায় বাচ্চাটাকে।

কুমড়ােটা তাে তেতেই ছিল। যেই না তাতে দাঁত বসেছে বাঘের, বিকট আওয়াজ করে ফেটে গেল সেটা। মুখ চোখ পুড়ে গেল বাঘের। দলা দলা গরম শাঁস মাখামাখি হয়ে গেল তার গায়ে মাথায় গলায়। ছটফট করতে করতে মরে গেল বাঘটা।

তাই না দেখে, মেয়ে দুটোর সে কী আনন্দ। আবার বাজনা বাজিয়ে গান জুড়ে দিল দু’জনে। এবার কিন্তু ভয়ে নয়, মনের আনন্দে।

এজন্যই বনপাহাড় দেশের মানুষেরা বলে-- বিপদ দেখলে, ভয় পেয়াে না। ঠান্ডা মাথায় উপায় খুঁজে দেখ।
--------
আরও পড়ুন।  ক্লিক করুন। 

জ্বলদর্চি পেজ-এ লাইক দিন।👇


Post a Comment

0 Comments