জ্বলদর্চি

ভিয়েতনামের লোকগল্প / চিন্ময় দাশ

Folklore of Vietnam
দূরদেশের লােকগল্প- ভিয়েতনাম
চিত্র- রবীন্দ্রনাথ কপাট 

চিন্ময় দাশ

বাঘের গায়ের ডােরা জামা

এখন তাে বাঘেদের গায়ের রঙ হালকা হলুদ। আর তাতে কালাে কালাে ডােরা কাটা দাগ। বাঘের গায়ে এখন এই জামাই আমরা দেখি। কিন্তু চিরকাল এমনটা ছিল না। অনেক অ-নে-ক কাল আগে, বাঘেরা সবাই ছিল একরঙা। কেউ লাল, কেউ নীল, কেউ হলুদ, তাে কেউ বা আবার ক্যাটকেটে সাদা রঙের। ডােরাকাটা বা ছােপ-ছােপ তাে দূরের কথা, দু'রঙা জামাও ছিল না কোনও বাঘের গায়ে। এই গল্পটা সেই সময়ের। কী করে তাদের জামার রঙ পালটে গেল, তাই নিয়ে গল্প।

একদিন হয়েছে কি, একটা হলুদ রঙা বাঘ বেরিয়েছে বন থেকে। বিশাল চেহারা বাঘের, তাই পেটও বড়। শিকার বড়-সড় না হলে, দিন না যেতেই পেট চুঁই চুই করে তার। সেদিন শিকারের খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে, লােকালয়ের দিকেই চলে এসেছে বাঘ। সামনে ফসলের মাঠ। তার ওপাশে চাষিদের ঘরবসত। মাঠের পাশ দিয়ে যেতে যেতে, থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বাঘটা। দূরে একটা মহিষ চরে বেড়াচ্ছে যেন।

মনটা যেন পেঁজা তুলাের মত হালকা হয়ে গেল বাঘের। দূর থেকেই বুঝতে পারল, বেশ বড়সড় চেহারা মহিষটার। আহা, দু-চারদিন চলে যাবে বেশ। ঝপ করে মাটিতে বুক লেপটে বসে পড়ল বাঘ। ধীরে ধীরে মহিষের দিকে এগােতে লাগল চুপিসারে।

কিন্তু কাছাকাছি এসে দেখল, আর এক ব্যাপার! মহিষটাকে দিয়ে লাঙল টানাচ্ছে এক চাষি। মাথাটা কেমন গুলিয়ে গেল বাঘের। মহিষের তাে এমন তাগড়াই চেহারা। অথচ একটা পুঁচকে মানুষ কিনা তার ঘাড়ে জোয়াল চাপিয়ে খাটিয়ে নিচ্ছে। চাবুকও চালাচ্ছে মহিষের পিঠে। কারণটা কী? মার খেয়েও জোয়াল টেনে যাচ্ছে কেন হতভাগা ?

এদিকে খিদেটাও বেশ চাগিয়ে উঠছে পেটের ভিতর। কিন্তু বাঘের মনে হােল, মহিষটাকে মেরে ফেলবার আগে, ব্যাপারটা থি কী, জেনে নেওয়া দরকার। বাঘ সােজা মহিষের কাছে বসে হাজির হল।

বলল- "এমন তাগড়াই চেহারা তােমার। গায়ে জোরও কত! তবুও এই দুর্বল পুঁচকে একটা লােক তােমাকে খাটিয়ে নিচ্ছে। ব্যাপারটা কী ?"

মহিষ বলল – “সাধে কি আর খেটে মরছি ? পুঁচকে হলে কী হবে, বলবানদেরও খাটিয়ে নেবার মত বুদ্ধি আছে ওর কাছে।"

শুনে, বাঘ তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বলল –  "বুদ্ধি? সেটা আবার কী জিনিষ হে ?" 
মহিষ জবাব দিল-- "সে আমি বলব কী করে? তুমি এই মানুষটাকেই জিজ্ঞেস করে নাও বরং।"
বাঘ হল বনের ভেতর সবচেয়ে বলবান আর ভয়াণক জীব। সেই নিয়ে বেশ গর্বও আছে তার মনে। কিন্তু এই বুদ্ধি জিনিষটার কথা সে কোনদিন শােনেনি। সে একবার ছােট্ট কঙ্কালসার মানুষটার দিকে তাকাল। আর একবার বিশাল বপু মহিষটার দিকে।

বাঘের মনে হল, তাহলে বুদ্ধি জিনিষটা হল খুবই বলবান। এই হাড় জিরজিরে একটা লােক তাই দিয়ে অতবড় মহিষটাকে খাটিয়ে নিতে পারে।  বাঘ ভাবল, বুদ্ধি থাকলে, আমি কী না করতে পারব ? কিছু না হােক, শিকারের চিন্তাটা কোনদিন করতে হবে না আর। যে করেই হােক, খানিকটা বুদ্ধি জোগাড় করে নিতে হবে আজ। ঐ বুড়ােটাকে একটু রগড়ে দিলেই, ঠিক পাওয়া যাবে জিনিষটা।

সে এবার চাষিকে জানতে চাই – “হ্যাঁ হে বুড়াে, বুদ্ধি জিনিষটা কী ? দেখাও তাে দেখি।"

এতক্ষণ নাকের ডগায় একটা জলজ্যান্ত বাঘ দেখে, বুক টিপটিপ করছিল চাষির। এখন বুঝল, ভয় নয়, যা করার মাথা খাটিয়ে করতে হবে। বলল--"আরে, বুদ্ধি কি আমি ট্যাঁকে গুঁজে ঘুরে বেড়াই নাকি ? সে তাে ঘরে রাখা আছে যত্ন করে।” বাঘ গম্ভীর হয়ে বলল---"তাহলে যাও, নিয়ে এসাে ঘর থেকে।" বেশ হুকুমের সুর বাঘের গলায়। 
ফিক করে হেসে দিল চাষিটা। বলল-- "বােকা পেয়েছ আমাকে? আমি ঘরে যাই, আর অমনি আমার মােষটাকে সাবড়ে দাও তুমি। ওটি হচ্ছে না।"

তখন বাঘ বলল-- "মনে রেখাে, আমি হলাম বনের রাজা। কথা দিলাম, তােমার মােষকে আমি ছুঁয়েও দেখব না।”
চাষি বলল – “ওসব রাজা-গজা ঢের দেখেছি আমি। কাউকেই বিশ্বাস করি না। এক শর্তে যেতে পারি। বুদ্ধিও এনে দেখাতে পারি তােমাকে। তবে, যাওয়ার আগে এই গাছটায় বেঁধে রেখে যাব তােমাকে। বলো, রাজী ?"

কী আর করে ? নাচার হয়ে বাঘ বলল – “তাই হােক। আমি রাজি।" 
একটা লম্বা দড়ি দিয়ে বাঘকে গাছের সাথে বেশ করে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বেঁধে, বুদ্ধি আনতে বাড়ি গেল চাষি। খানিক বাদে ফিরে এল বুড়ো। মাথায় একবােঝা শুকনাে খড়। 
খড়গুলাে গাছের তলায় ছড়িয়ে দিয়ে, লিকলিকে সরু একটা ছড়ি দিয়ে সপাং সপাং করে মারতে লাগতে বাঘকে। বাঘ কাতরাতে লাগল-- "আরে, এটা কী হচ্ছে? খামোখা মারছো কেন?" 
চাষি হেসে বলল-- "কেন, দেখতে পাচ্ছ না, এটাই হল বুদ্ধি। লোকালয়ে ঢোকার মজা দেখাচ্ছি আজ বনের রাজাকে।"

বাঘ যত চেঁচায়, বুড়াে তত মারে। মারতে মারতে যখন হাত ধরে গেল, ছড়ি ফেলে, খড়ে আগুন ধরিয়ে দিল লােকটা। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল দেখতে না দেখতে। একটু বাদে বাঁধনের দড়িতেও আগুন লেগে গেল। দড়ি পুড়ছে, আর বাঘের চামড়াও পুড়ছে তার সাথে। পরিত্রাহি চিৎকার করছে বাঘ বেচারা।

আধপােড়া হতেই, দড়ি গেল ছিড়ে। অমনি ধপাস করে পড়ে গেল বাঘ। তারপর সে কী চোঁ-চোঁ দৌড় বাঘবাবাজীর! তখন বুড়াের সাথে মহিষটাও হাসতে লাগল, বাঘের দুর্দশা দেখে।

বেশ কদিন লাগল বাঘের পিঠের পােড়া ঘা শুকোতে। ঘা শুকোল বটে, বাঁধনের কালাে দাগগুলাে কিন্তু রয়েই গেল বাঘের গায়ে। সে দাগ আর কোনদিন ঘুচল না। 
সেই থেকে আজও সব বাঘের শরীরেই হলুদের উপর মােটা মােটা কালাে ডােরা দাগ। আর সেই থেকে মানুষের উপর বাঘেরও ভারি রাগ। ওৎ পেতে থাকে, কখন লাফিয়ে পড়ে ঘাড় মটকানাে যায়। তবে, সামনা সামনি হয় না সহজে। কেননা, মানুষের কাছে বুদ্ধি আছে কিনা !

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇


আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments