আমরা লাইভ দেখেছি সেই ঈশ্বরের হাত-কে
(শ্রদ্ধা জানাই আমাদের দুরন্ত বয়সের সেই কিংবদন্তী ফুটবল খেলোয়াড় দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা ফ্রান্কো বা শুধুই জনপ্রিয় নাম মারাদোনাকে, 2020 কেড়ে নিল আরও একটি অমূল্য বিশ্ববন্দিত প্রাণ)
আমাদের স্বপ্নগুলো মেক্সিকান বিশ্বকাপের ময়দানে ছুটছিল১৯৮৬ সনে। স্বপ্ন দেখিয়েছিল একটা ছোটখাটো বলিষ্ঠ আর্জেন্টিনীয় ফুটবল খেলোয়াড়। ইওরোপের দেশগুলির ফুটবলের রক্ষণভাগ ভেঙ্গে আমরা তৃতীয় বিশ্ব যেন মারাদোনার সঙ্গে ছুটছি। তার আগে দেখেছি মেক্সিকোসিটি ১৯৮৫ সালের বিশ্বকাপ শুরুর প্রাকমুহূর্তে বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পর হাজার পাঁচেক মৃত্যুর নজরানা দিয়ে কী এক অবলীলা ক্রমে আবার সুন্দরভাবে বিশ্বকাপের আয়োজন করছে।এমন বাঙালি তখনকার দিনে খুঁজে পাওয়া যেতনা যে ফুটবলে একটাও লাথি মারেনি। দেশজুড়ে সবেমাত্র টিভি বা দূরদর্শনের সম্প্রচার শুরু হয়েছে। দিল্লীর মসনদে একটা অনভিপ্রেত দুঃখজনক ঘটনার মধ্যে দিয়ে আসীন ভারতবর্ষের তারুণ্যের প্রতীক নতুন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। ঘরে ঘরে এন্টেনা টাঙ্গিয়ে আমরা টিভি দেখছি দেশের শহরে শহরে গ্রামে গ্রামে।এই প্রথম বিশ্বকাপের লাইভ টেলিকাস্ট দেখছি টিভিতে। আমাদের স্বপ্ন ছুটছে, তৃতীয় বিশ্ব নাড়িয়ে দিচ্ছে ইওরোপের রক্ষণভাগকে। আমরা একাত্ম হচ্ছি। মারাদোনা কোথায়? ওতো আমি আর আমরা ছুটছি ফুটবলের ময়দানে। আমরা তৃতীয় বিশ্বের আর এক কিংবদন্তী ফুটবল খেলোয়াড় সম্রাট পেলেকে পেয়েছিলাম বইপত্তর খবরের কাগজ আর কসমস ক্লাব যেবারে কলকাতায় খেলতে এল বেকেনবাওয়ার আর পেলে ইত্যাদি বিশ্বকাপের খেলোয়াড় নিয়ে রেডিওতে পুষ্পেনদা আর সুকুমার সমাজপতির আকাশবাণী কলকাতার ধারাভাষ্যে। মফসসলে বসে।মারাদোনা আমাদের রাজপুত্র তাই। আমাদের তৃতীয় বিশ্বের স্বপ্ন। বস্তির গলিপথ ছেড়ে জমকালো আলোয় আলোকিত হবার গল্প। যেখানে মিশে থাকে নিষ্ঠা, জেদ, প্রচণ্ড পরিশ্রমের বাস্তব গল্প। মেধাও খানিকটা বটে। আমাদের বুভুক্ষু দেশগুলোর গল্পের উনিশ বিশ তো সর্বত্রই। আমরা গা ভিজালাম মারাদোনার সাথে, আমাদের হিরো। আমাদের দুরন্ত সময়ের দুরন্ত হিরো।
নাইবা গেল খেলতে ভারতবর্ষ ওয়ার্ল্ড কাপে, আমাদের তো ব্রাজিল আছে, আমাদের তো আর্জেন্টিনা আছে।আমরা বিভক্ত হয়েছি এর আগে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনায় কিন্তু ১৯৮৬-তে মারাদোনাকে পেয়ে সারা তৃতীয় বিশ্ব যেন আর্জেন্টিনা হয়ে উঠলাম।আমাদের রাজপুত্র জেতালেন সেই বিশ্বকাপ। অহঙ্কারী পশ্চিম জার্মানি (এখন সংযুক্তির পর পুরোটাই আবার জার্মানি)কে ৩-২ গোলে হারিয়ে দিয়ে। আমরা যেমন কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিতে দেখেছি ঈশ্বরের হাতের গোল আর শতাব্দীর সেরা গোলটাও তো করলেন ফুটবলের রাজপুত্র ঐ ম্যাচে পাঁচজন ইংল্যান্ডের ফুটবলার কে ড্রিবলড করে। ২০০২ ফিফার এক ভোটদানে শতাব্দীর সেরা গোল এইটি। আমাদের হিরোকে নিয়ে ফুটবল যাত্রা শুরু হল। আমরা বাঙালি, আমাদের তখন মহারাজা গাঙ্গুলি আসেননি। সব খেলার সেরা বাঙালির তখনও ফুটবল।
আমাদের স্বপ্ন উড়ানের কান্ডারী মারাদোনা। ক্রিকেটে এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র চলছে ওখানে মারাঠীরা কাউকেই ঘেঁষতে দেবে না। বরুণ বর্মনের মতন পেসার নাকি ভূভারতে অমিল, শুধু বাঙালি বলে দলে আসছে না।আমরা কখনও ক্রিকেটকে গাল দিই এতো রাজা মহারাজা বুর্জোয়া শ্রেণীর সময় নষ্ট করবার আমোদ উপকরণ, এটা কোনও খেলা? গায়ে ১০২ ডিগ্রী জ্বর নিয়েও সেঞ্চুরি করা যায় ব্যাটে! তো মারাদোনা খেলার আসর খেলার কথা খেলার কাগজ, বিদেশ মানস মনোরঞ্জন ভাষ্কর সুব্রত সুদীপ এই নিয়ে বেশ আছি।ফটোগ্রাফার অমিয় তরফদারের সেই অবিস্মরণীয় ছবি নামাবলী গায়ে মারাদোনা। আমরা এ ওকে প্রশ্ন করতাম বন্ধুরা, তাহলে কি মারাদোনা বৈষ্ণব হয়ে যাচ্ছেন? আর মাঝে মাঝে শুনতাম কলকাতায় আসছেন। অবশেষে রাজপুত্র এলেন কলকাতায়।ততদিনে কলকাতা ফুটবল ছেড়ে ক্রিকেটময় হয়ে উঠেছে। ততদিনে পৃথিবীতে বিশ্বায়ন ঘটেছে।কোটি কোটি টাকা উড়ছে ক্রিকেটে। আর অর্থই তো অনর্থের মূল। বাঙালির ফুটবলের একচেটিয়া সাম্রাজ্য কেড়ে নিয়েছে গোয়া আর মণিপুর। আমাদের সেই রাজপুত্র আজ চলে গেলেন, অকাল প্রয়াণ-ই বলব, একজন দুঃসাহসিক মানুষের মৃত্যু। যারা মৃত্যুকে বাজি নিয়েই বাঁচে। ইতালির নেপোলি ক্লাবে থাকাকালীন যেমন দিয়েছে তাকে অনেক, আবার কেড়েও নিয়েছে অনেক।
মহাতারকার সেই নক্ষত্রপথে যাত্রা। ঈশ্বর হাত নাড়ছেন। আমরা মনেপ্রাণে আমাদের জীবনের রিয়েল হিরোকে বিদায় জানাচ্ছি। জানি আমাদের মতন অনেক ঘামের গন্ধ ওনার শরীরেও লেগে।একটা অন্ধ স্যাঁতসেঁতে বস্তির গলিপথ ছেড়ে ধীরে ধীরে আলোর দেশে যাত্রা। ওখানে ভালো থেকো আমাদের রাজপুত্র।
(তথ্য পরিসংখ্যান দেইনি।দেইনি খেলার বিস্তৃত বিবরণ। সব তো পেয়ে যাবেন নেট দুনিয়ায়।মহাজীবনের জন্য নিন্দা বা অপবাদ নয়। তার অকাল পরিসমাপ্তির দুঃখ প্রকাশ)
আরও পড়ুন
0 Comments