জ্বলদর্চি

সেমিকোলনের আত্মজীবনী -১৪/ সায়ন

সেমিকোলনের আত্মজীবনী-১৪

চন্দ্রদোষী হতে রাজি তোমার ভাষায়

সায়ন

একটা বারান্দায় মানুষটা একা গিয়ে বসে আছে। নোনতা রেলিং থেকে জং এর দাগ মিশে যাচ্ছে গোটা আকাশ জুড়ে। আমি করিডোর থেকে একটা দরজা ফাঁক করে তাকে দশ বছর ধরে দেখছি। এখানে সব শান্ত - কিন্তু আকাশের যত ওপারে আছে দেশ , সেখান থেকে ছিটে আছে কোলাহল। মনে হচ্ছে " জবা কুসুমের দেশে তিনি শেষ মাস্টার মশাই/ আমার বালক চোখে তিনি যেন লিও তলস্তয় ।" ( বাঘের লোমের মতো) 

 সিটি কলেজের গেট থেকে যে বিকেল হাঁটতে হাঁটতে কলেজ স্ট্রিট এসে দাঁড়ায় তাকে রহস্যময় ভাষা মনে হয়, তাকে বহু চেনা বলেই অচেনা লাগে। সে এখন কালবুর্গীর মৃতদেহের পাশে বসে সত্যের সঙ্গে কথোপকথন করে, আর the late Kashmiri poet, Agha Shahid Ali puts it: “My book’s been burned/Send me the ashes, so I can say/ I’ve been sent the phoenix in a coffin of light”.

একটা ছেলেবেলা হেটে আসে করিডোর ধরে, তার চেয়ারের পাশে দাঁড়ায় - তখন রাতের গা থেকে নিজের জন্যে চাদর টেনে নিচ্ছে আকাশ, নক্ষত্রের নিচে অনেক পতন শুরু হবে, অনেক দেবতার ঘুম আর শয়তানের বিশ্বাস মাঝে আঁকা হবে চাঁদের ছবি........এ আমার দোষ, আমি চাঁদের কাছে সরল হতে চাই, যেমন সমস্ত নারীর কাছে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে চায় । কিন্তু তার চন্দ্রদোষ তাকে বাধা দেয়....... মানুষটা তাকালো এদিকে
- আমার কথাগুলো শুনে নিলো নাকি! জীবন দেখবার সময় কোনও জীবের কাছে আসতে নেই। মানুষটা লিখছে 'চন্দ্রদোষ ওষুধে সারে না' নিচে কি লিখলেন ,  নাম - সুবোধ সরকার। 

ছেলেবেলা এসে দাঁড়ায়, দেখে, তার একচোখে হাসি একচোখে জল। পিঠে রাখে মানুষ, গাছের একটা একটা পাতা এসে পরছে ছেলেবেলার গা'য়ে, ভবিতব্যের কথা লেখা আছে তার শিরায় "আমি কি করব, কোন দানবের কাছে গিয়ে আমি/ বলব আমাকে দাও বাহুবল, পায়ে দাও জুতো।" (নতু্ন জামার জন্য)
রহস্য দেখে ভাষা তার হাত ধরে নিয়ে যায় সবরমতি গ্রামে। ট্রাম্প নেই আর তবুও কি শান্তির জন্য খোঁজ শেষ হবে বাপুজি? দুনিয়া কাঁপানো কত মুহূর্তের পরও যখন দেখি রহস্য বলে ছেলেবেলার কথা " মুদির দোকান, মুদি, আমি ওই মাস্টারের ছেলে/ একদিন জলদস্যুসম আমি টাকা শোধ দেব।" (জলদস্যুসম), বাপুজির চোখে জল আসে, মুখে তার বিপ্লবের রঙমাখা হাসি। 

সমস্ত পিছুটান ফেলে যে শব্দের জন্য ঘর থেকে পালায়, সমস্ত মানুষভুলে যে প্রেমিকের ঠোঁটে ডুবিয়ে দেয়, সমস্ত শিশুর হাসি ভুলে যে ড্রোন থেকে নেমে আসে বোমা, সমস্ত অরণ্যেবাসীর ঘর থাকা হাড়ি আর তীর - আসলে কবিতার ভিতর লিখে যাওয়া পথের নির্দেশ - 

নির্দেশ এক - " মানুষের জন্য তুমি কতটা সুন্দর হতে পারো?" 
নির্দেশ দুই - " তুমি কি শুতেই জানো শুধু, ভালোবাসতে জানো না?" 
'কঙ্কাল কলস', আর 'সর্বাঙ্গে মেরো না' কবিতা থেকে দুটো রেখা উঠে মিলিয়ে গেলো মনের জঙ্গল " এক জলযান থেকে আমি অন্য জলযানে লাফিয়ে নামব/ যেন এক জন্ম থেকে অন্য জন্ম এত কাছে,"( কী হবে যকৃৎ দিয়ে?) 

মানুষটা সব দেখছে, পারদমাখা এখন তার ছাদের গায়ে । 
- তুমি কথা বলো না? 
- না 
- তাই তো আমি সব শুনি.... 
- কি?
- 'না'
গাছের পাতার মতো যে আকাশ মেলা আছে, তার একাত্ব হয়ে থাকা আহরিত ধন সে ফিরে পেতে চাইছে সমস্ত । মহাকালের কাছে যতটুকু আছে একটা লম্বা মই দিয়ে উঠে এসে রেখে যাচ্ছে তার বারান্দায় শব্দ বর্ণ শ্লেষ বিস্ময় আর একটা " যেন মানুষের পিঠ,আমিও উন্মাদ বলে মৃত্তিকা সরিয়ে/ আবিষ্কার করি প্রাণ, পিঠের ওপরে লেখা, 'পথ হারিও না'।"('পথ হারিও না')

ক্লাসঘরে একজন মাস্টার বলল - কবিতা কি?
একটা উত্তর এল বোর্ডের সামনে থেকে : 'অ্যডজাস্টমেন্ট' , যাকে উপযোজন বলাও যেতে পারে। পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে নিজেকে ঠিকমতো খাপ খাওয়াতে পারা, মানিয়ে নেওয়া । যেমন - 
১ বন্ধ ঘর
২ প্রতিবন্ধ
৩ ফী কাঁচা টাকা
৪ সংক্রমণ 
৫ উপযোজন
৬ অবাধ অনুষঙ্গ
ছাত্রের গালে দাড়ি, চোখে আগুন আর মুখে চুরুট। অনেকটা দেখতে ফ্রয়েড-এর মতো। একজন চন্দ্রদোষী ডাক দেয় " বিদ্বান বন্ধুরা/ এদিকে আসুন/ অস্ত্র বিক্রেতা/ এদিকে আসুন/ আকাশবিজ্ঞানী/ এদিকে আসুন/ আপনি চন্ডাল/ আপনি আচার্য/ এদিকে আসুন/ আর্যাবর্ত এইদিকে।" (আর্যাবর্ত কোনদিকে)
আকাশের রাত মেখে আজ চাঁদ বড় সুন্দর, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘরে আজ অমাবস্যার প্রদীপ। রহস্য এসেছে ভারতের পুঁথি হাতে,
- এই পুঁথিতে লেখাছিল তোমার পতনের নির্দেশ। তুমি হিন্দু বলো, কিন্তু আর্যাবর্ত চেনো না। তুমি নরেন্দ্র চেনো কিন্তু নারায়ণ জানো না। 
- কে তুমি ? 
- সায়ণ। ৪ হাজার বছর আগে ঋগ্বেদ তর্জমা করে এই সময়ে তোমার মত করে দার্শনিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় বলি "পরস্পর বন্ধুত্বযুক্ত ব্রাহ্মণেরা যখন দ্রুত-মানস সহকারে তুষ্ট-হৃদয়ে সমবেত হন,তখন তাঁরা সেই (অজ্ঞ) বেদী-আরোহণোন্মুখ ব্যক্তিকে দূর করে দেন এবং বেদজ্ঞানে চর্চা করেন।।" ঋগ্বেদ ১০.৭১.৮

ব্রাহ্মণ আসলে মানব, কোন গোষ্ঠী নয়। ব্রহ্ম বা মস্তিষ্কের চেতনার দ্বারা বেদ, রাষ্ট্র, কাব্যগ্রন্থ ও শাসকের পতন সবটাই রচনা করা যায় । ভারতের প্রথম কাব্যসংকলন বেদ থেকে যে সামাজিক উত্তরাধিকার তার স্রোতধারা বয়ে মিশে যাচ্ছে 'চন্দ্রদোষ ওষুধে সারে না'র প্রতিটি শব্দ ও সেমিকোলনের কোণায় কোণায়। তারা প্রশ্ন করে বার বার " সঞ্জয় বলবে বাতাসকে/ বাতাস ছুটবে/ বারণাবতের থেকে উত্তর ভারতে/ তেলেঙ্গানা থেকে যখন অঞ্জন/ এক জনগোষ্ঠী নিয়ে ফিরে এসে দাঁড়াবে সামনে/ তুমি কী বলবে?" ( এই সরোবরে) , তারা দেখতে পায় প্রতিটা প্যন্ডেমিক পেরিয়ে ভারতবর্ষের ঘরে " গরীবের মন আছে জাহ্নবীর মতো/ যে বোনের বিয়ে দিতে ভিক্ষা ধরলাম/ প্রতিটি চিহ্নের শেষে তার আয়ুরেখা/ রাক্ষস ঢুকেছে তার বিয়ের প্যান্ডেলে।" (কে নয় রাক্ষস)

লোকটা বসে আছে আরও গভীরভাবে। শহরে একটা বন্দি কোলাহল, জীবনের কথা চিৎকারে করে উঠছে আকাশ ছোঁয়া নক্ষত্রের দরজায় গিয়ে ঠেলা দিচ্ছে। জরায়ুপথে তার ভয় হচ্ছে পৃথিবীর দিকে পা এগিয়ে দিতে। এখানে কোনও জীবন আছে কি সত্যিই আর বেঁচে - " মাথায় কমোড নিয়ে এ জীবন রেখে বলো কী হবে আকাশ?/ তোমাকে না পাই যদি চোদ্দোবার বমি করে আমি মারা যাব।" কেন তুমি মারা যাবে বলো , তুমি কি জানো না ওই যে বসে আছে একান্তভাবে স্থির ওর কাছে আছে " What is it then keeps him in this room,expect the certainty that it's still the best thing to do, the feeling that the whole absurd simplicity of the world has sought refuge here. " এ ভাষা তো অ্যলবের কামুর , কিন্তু মনেরর তো কোনও সীমারেখা নেই ,  সারল্য ও জীবনের চলভাষ লেখা থাকে "... চলমান ট্রাকে, বস্তা বস্তা তেজপাতার ভেতর/ ট্রাক নয়, আটচাকা ষড়রিপু, যেন সেই রিপুর ভেতর / তোমার সঙ্গে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি,.."( এ কি খাওয়ালে)
------------------
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments