জ্বলদর্চি

বেগম রোকেয়া : কলম যাঁর প্রধান অস্ত্র/রোশেনারা খান

বেগম রোকেয়া : কলম যাঁর প্রধান অস্ত্র

রোশেনারা খান
                  

রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামের জমিদার জহিরুদ্দিন মোহম্মদ আবু আলি হায়দার সাবের-এর পরিবারে এতটাই পর্দাপ্রথা ছিল যে বাড়িতে মহিলা আত্মীয় এলেও তাঁর পাঁচ বছরের শিশুকন্যাকে চিলেকোঠার ঘরে সারাদিন না খাইয়ে লুকিয়ে থাকতে হত। অথচ তিনি নিজে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন।জহিরুদ্দিন সাবের ইংরেজি,  হিন্দি,বাংলা, আরবি, উর্দু, ফরাসি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। ছেলেদের তিনি কলকাতায় রেখে সেন্ট জেভিয়ারস কলেজে পড়ালেও মেয়েদের পড়াশোনা করা পছন্দ করতেন না। বড় মেয়ে করিমুন্নেসার পড়াশোনায় আগ্রহ দেখে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেন। ছোট মেয়েটিকে তাই দাদা ইব্রাহিম সাবের গভীর রাতে লম্ফর আলোয় পড়া দেখিয়ে দিতেন। এই মেয়েটিই বড় হয়ে নারীর প্রতি, বিশেষ করে মুসলিম নারীর প্রতি এইসমস্ত অন্যায়, বঞ্চনা, শোষণ, পীড়ন ও অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। আজ সেই সাহসী ও মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের জন্মদিন এবং মৃত্যুদিনও। 

১৮৮০ সালে জমিদার জহিরুদ্দিন সাবেরের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তবে সে যুগে ছেলেমেয়ের জন্ম তারিখ সবাই লিখে রাখতেন না। তাই ৯ ডিসেম্বর রোকেয়ার জন্ম হয়ে ছিল কিনা, এবিষয়ে দ্বিমত রয়েছে।
বেগম রোকেয়া শুধু যে একজন প্রতিবাদী, সাহসী নারী ছিলেন, তা কিন্তু  নয়। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, কথাকার, সমাজ সংস্কারক ছিলেন। তিনি বাঙালি মুসলিম মহিলাদের পথপ্রদর্শক। তিনি আজ থেকে এক শতাব্দীরও পূর্বে, ১৯০৪ সালে তাঁর রচনায় লিখে গেছেন, ‘আমরা সামাজেরই অর্ধ অঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোনো ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে, সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে- একই। তাঁহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা, আমাদের লক্ষ্যও তাহাই।….আমরা অকর্মণ্য পুতুল-জীবন বহন করিবার জন্য সৃষ্ট হই নাই, একথা নিশ্চিত।'
  রোকেয়া তাঁর ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসে লিখেছেন, ‘....আমিও দেখাইতে চাহি যে, দেখ, তোমাদের ‘ঘর-করা’ ছাড়া আমাদের আরও পথ আছে। স্বামীর ঘর-করাই নারী জীবনের সার নহে। মানব-জীবন খদাতালার অতি মূল্যবান দান-তাহা শুধু ‘রাঁধা-উনুনে ফুঁ পাড়া-আর কাঁদার জন্য অপব্যয় করিবার জিনিস নহে।.....’ 

    ১৮৯৮ সালে ভাগলপুরের সৈয়দ সাখাওয়াৎ হসেনের সঙ্গে রোকেয়ার বিয়ে হয়। তিনি একজন উর্দুভাষী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। রোকেয়া তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি রোকেয়াকে বিয়ে করেছিলেন। তাই দুজনের বয়সের অনেকখানি পার্থক্য ছিল। কিন্তু মনের দিক থেকে তাঁরা একে অপরের পরিপূরক ছিলেন। সাধারণত বলা হয়, ‘একজন পুরুষের সফলতার পিছনে একজন নারীর ভূমিকা থাকে। সাখাওয়াৎ হুসেন প্রমাণ করেছেন একজন সফল নারীর পিছনে একজন পুরুষের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। স্বামীর প্রেরণা রোকেয়ার জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে এবং সফলতা পেতে উৎসাহিত করেছে। তাই ১৯০৯ সালে স্বামীর অকাল মৃত্যুর পর রোকেয়ার কলম থেমে গিয়েছিল। দীর্ঘ ১১ বছর পর উনি দ্বিতীয় বার কলম ধরেছিলেন।
কলমই ছিল তাঁর প্রধান অস্ত্র। তিনি শুধু নারীর শিক্ষার অধিকারের জন্যই নয়, পুরুষের সমান অধিকারের দাবি জানিয়ে গেছেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে। তিনি ভাগলপুরে স্বামীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন। পরে তিনি স্কুলটি কলকাতায় স্থানান্তরিত করেন। ১৯১১ সালে মাত্র কয়েকটি ছাত্রী নিয়ে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ নতুনভাবে শুরু করেন। তিনি মুসলিম মহিলাদের জন্য সংগঠনও তৈরি করেছিলেন।

আজকের দিনে ১৯৩২ সালে বেগমের প্রয়াণ ঘটে। তাঁর বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলা সম্ভব নয়। শুধু আজকের দিনে নয়, প্রতিটি বাঙালি নারীর প্রতিমুহূর্তে তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা উচিৎ। নইলে আমরা আমাদের শেকড় হারিয়ে ফেলব।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇


আরও পড়ুন


                  

Post a Comment

0 Comments