জ্বলদর্চি

বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্ক - ৭/ অসীম ভুঁইয়া

Bengali grammar and debate
বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্ক
চিত্র- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য 

পর্ব ৭ 
অসীম ভুঁইয়া

সর্বনামপদের জলসাঘর  

আজকের আলোচ্য বিষয়, বাংলা সর্বনামপদ। প্রথমেই বলতে ইচ্ছে করে, সর্বনামপদের ক্ষেত্রে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে জড়াজড়ি অনুসরণ করতে গিয়েই আমাদের ফল ভুগতে হচ্ছে। 
 
   যাইহোক প্রথাগত ধারণাটা আগে সংক্ষেপে সেরে ফেলা যাক। ১.মৌলিনা কী দারুন নাচ করল!  তবে "সে" আজ কবিতাও বেশ ভালো বলেছে।"  
২.সুজয়রা ছুটি নিয়েছে, কারণ আজ "তাদের" পিকনিক আছে। এখানে প্রথম বাক্যে মৌলিনা বিশেষ্যপদ এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বাক্য - পরবর্তী "সে" শব্দটি মৌলিনার পরিবর্ত হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বারবার মৌলিনা নামটি বললে বাক্যগুলি কেমন যেন একঘেঁয়েমি হয়ে পড়ে, শুনতে মোটেও ভালোলাগে না, তাই পরিবর্ত হিসেবে "সে" শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষ্যপদ মৌলিনার পরিবর্তে ব্যবহৃত এই "সে" শব্দটিকেই সর্বনাম পদ বলা হয়। দ্বিতীয় বাক্যে সুজয়রার পরিবর্তে "তাদের" সর্বনামটি ব্যবহৃত। 

   প্রসঙ্গত বলে রাখি, সকল নামের পরিবর্তে এই পদগুলি ব্যবহৃত হয় বলেই এদের সর্বনামপদ বলা হয়। 

   যে পদগুলি সাধারণত সর্বনাম পদের ভূমিকা নেয় তারা হল- আমি, আমরা, তুমি, তোমরা,  তারা, তাদের, নিজ, স্ব, তিনি, আপনি, এটা, ওটা, যত, তত, কে, কাকে, কার, যাকে, যার, যাদের, যিনি, পরস্পর, নিজেরা, সবাই, সকলে, অমুক, যেখানে, সেখানে প্রভৃতি। 

   সর্বনামপদের শ্রেণি সম্পর্কে একটা যুক্তিসঙ্গত বিভ্রান্তি রয়েছে। এই বিভ্রান্তির মূলে কখনো সংস্কৃতের অনুসরণ, কখনো বা বিদেশি ভাষার অনুসরণ... তবে সবদিক বিবেচনা করে আমরা বাংলা সর্বনামপদের শ্রেণি ৯ টির কম করতে পারলাম না। এরা হল- ১.ব্যক্তিবাচক সর্বনাম,২. নির্দেশক সর্বনাম,৩. অনির্দিষ্ট সর্বনাম,৪. সমষ্টি বা সকলবাচক সর্বনাম,৫. প্রশ্নবাচক সর্বনাম,৬. আত্মবাচক সর্বনাম,৭. ব্যতিহারিক বা পারস্পরিক সর্বনাম,৮. সংযোগবাচক সর্বনাম ও ৯. সাপেক্ষ সর্বনাম।  

   i. ব্যক্তিবাচক সর্বনাম-  ১."আবার ' আমি ' একলা হলাম।"  
২. "ভালোবাসা ' তার ' কাছে শিকড়ের মতো মাটি-মাখা।" 
উদ্ধৃত পদদুটি কোনো ব্যক্তির পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে, তাই এরা ব্যক্তিবাচক সর্বনাম। 
   ব্যক্তিবাচক সর্বনাম তিন ধরনের হয়ে থাকে। আমি পক্ষ, তুমি পক্ষ ও সে বা অন্যপক্ষের সর্বনাম। অর্থাৎ আমরা চালু ব্যাকরণে যাকে উত্তম পুরুষ, মধ্যম পুরুষ ও  প্রথম পুরুষ বলে থাকি।  

   আমি পক্ষ বা তুমি পক্ষের সর্বনাম নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু সে পক্ষ বা প্রথম পুরুষের সর্বনামপদ নিয়ে মারাত্মক বিভ্রান্তি আছে। সে পক্ষের সমস্ত সর্বনামপদকে কিন্তু ব্যক্তিবাচক সর্বনাম হিসেবে ধরা হয় না, যদিও তারা সরাসরি ব্যক্তির পরিবর্তেই ব্যবহৃত হয়। যেমন- ও,যাদের, ওদের, ওরা, এ, উনি, ইনি, এদের প্রভৃতি। এদের অন্যভাগে  আলোচনা করা হয়েছে। তবে প্রথাগত ব্যাকরণে একে ত্রুটিই ধরতে হয়, তাই ব্যক্তিবাচক সর্বনাম এই শ্রেণিটির নামকরণ পরিমার্জনের প্রয়োজন আছে।  সাধারণভাবে ব্যক্তিবাচক সর্বনাম বলতে বোঝায়-  তাকে, তার, তারা, সে, তাদের প্রভৃতি।

ii. নির্দেশক সর্বনাম- ১."উনি" নিরুত্তর। 2. "এ" থালা সোনার হলে/ ভাত চাইতাম না।"  
চিহ্নিত শব্দদুটি নির্দিষ্টকরে কোনো  ব্যক্তি বা বস্তুকে নির্দেশ করছে। তাই এরা নির্দেশক সর্বনাম। অনেক সময় কোনো ভাবের বা বিষয়ের পরিবর্তেও এটি ব্যবহৃত হয়। যেমন-  "সেসব" জানিনা। এখানে "সেসব" বলতে কোনো ভাব বা বিষয়কে বোঝাচ্ছে।  আবার মজার বিষয়-  একই  সর্বনাম, বস্তু ও ব্যক্তি উভয়ের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন- ওটা ভেঙ্গে ফেললে। এখানে "ওটা" শব্দটি বস্তু হওয়ারই সম্ভাবনা  আবার-  ওটাকে আগে তাড়াও।  এখানে "ওটা" কোনো প্রাণীকেই বোঝাচ্ছে।
এভাবে এই সর্বনামটির নানা বৈচিত্র্য রয়েছে। 

   iii. অনির্দিষ্ট সর্বনাম-  "কেউ আর আমার কাছে আসে না এখন।"
" কিছুই কোথাও যদি নেই/ তবু তো কজন আছি বাকি।" এখানে "কেউ," " কিছু"   সর্বনাম পদদুটি  নির্দিষ্টকরে কাউকে বোঝাচ্ছে না, তাই এরা অনির্দিষ্ট সর্বনাম। 
এখানে একটি কথা না বললেই নয়, অনেকে অন্য, অপর, অমুক প্রভৃতি শব্দকে অন্যবাচক বা অন্যাদিবাচক সর্বনামপদ নামে একটি নতুন শ্রেণি করতে চান। তবে আমাদের মতে এরা অনির্দিষ্ট সর্বনামের অন্তর্গত। কারণ এরাও অনির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকেই বোঝাচ্ছে।

   iv. এবার আসি সকলবাচক সর্বনামপদে।
" সকলে প্রত্যেকে একা।"
" সবকিছু আজ তছনছ হয়ে গেল।"  উদ্ধৃত  সকলে, প্রত্যেক, সবকিছু সর্বনামপদগুলি কোনো ব্যক্তি, বস্তু বা  ভাবের সমষ্টি বোঝাচ্ছে, তাই এরা সমষ্টিবাচক সর্বনাম। এক্ষেত্রে "উভয়" সর্বনামটিকেও  সকলবাচক শ্রেণির মধ্যে ধরা হয়। যদিও উক্ত শ্রেণিনামটির সঙ্গে এই সর্বনামটি খুব একটা খাপ খায় না। 

   v. এবার আসি প্রশ্নবাচক সর্বনামে। " কী যে বলি বড্ড ভয় করে।" 
" কারা কারা এসেছে আজ?" এখানে চিহ্নিত "কী" ও "কারা" সর্বনামগুলি প্রশ্ন করতে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই এরা প্রশ্নসূচক। 
একে নিয়ে বিশেষ বলার কিছু নেই। 

   Vi. আত্মবাচক সর্বনামপদ। "নিজে নিজে" করে নাও।
 "নিজের" সঙ্গে কথা বলি চুপিচুপি। আমি "স্বয়ং" গিয়ে তাকে বলেছি। উদ্ধৃতি দেওয়া সর্বনামগুলিতে অন্যের সাহায্য ছাড়া বা অন্যের সাহায্য না নেওয়ার ভাবটি প্রকাশ পাচ্ছে। তাই এরা আত্মবাচক সর্বনাম। এ বিষয়ে যা কিছু বলার একটু পরে বলছি। 

   vii. ব্যতিহারিক সর্বনাম-  তারা "পরস্পর" মিলেমিশে কাজটি করতে চায়।
"নিজেরা নিজেদের"কেই মানছে না। 
চিহ্নিত সর্বনাম পদগুলি দুটি পক্ষের পারস্পারিক নির্ভরতা প্রকাশ করছে। তাই এরা ব্যতিহারিক সর্বনাম।
    ভাষাবিদ শ্রদ্ধেয় পবিত্র সরকার একে আত্মবাচক সর্বনামের একটি বিশেষ রূপ বলতে চান। তবে দুটোর মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য এই যে, আত্মবাচকে শুধু আত্মভাব বা  নিজস্ব ব্যাপারটি প্রকাশ পায়, আর পারস্পরিক সর্বনামে দুপক্ষের পারস্পরিকতা প্রকাশ পায়। তাই আমরা একে পৃথক শ্রেণিতেই আলোচনা করতে চাই। 

   viii. সংযোগবাচক সর্বনামপদ -  "গোলাপকে তুমি ' যে ' নামে ডাকো গোলাপ কিন্তু গোলাপ।"
"বলছি ' কী,' কাল একবার তুমি আসবে?"
 "ওখানে গিয়ে দেখি ' যে,' তুমি নেই।" 
এখানে উদ্ধৃতি দেওয়া সর্বনামগুলি দুটি বাক্যের মধ্যে সাধারণ সংযোগ তৈরি করেছে। তাই এরা সংযোগবাচক সর্বনাম।  আরো সহজ করে বললে, এরা সংযোগসূচক  ভাবের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে।
আপাতদৃষ্টিতে হয়তো এদের সর্বনাম বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে এরা সর্বনাম ছাড়া কিছুই না। 
এ বিষয়ে একটি কথা বলে নেওয়া ভালো, কিছু ব্যাকরণবিদ যেসব( যে ও সব), যেসমস্ত (যে ও সমস্ত) প্রভৃতি সর্বনাম পদগুলিকে দুটি সর্বনামপদের সংযোগে তৈরি বলে "যৌগিক সর্বনাম" নামে একটি পৃথক শ্রেণি করতে চান। কিন্তু প্রয়োগের দিক থেকে এরা সাধারণত সংযোগবাচক সর্বনামই  হয়ে থাকে। তাই শুধু শুধু একটি শ্রেণিনাম বাড়াতে চাইনা আমরা। 

   আলোচনার শেষ সর্বনামপদটি হল- ix.  সাপেক্ষ সর্বনাম-  "যা" ভেবেছ "তা" কিন্তু নয়।
"তুমি ' যাকে' ভার্জিনিটি বলো আমি ' তাকে' বলি নির্জনতা।" এমন ' কে'  আছে ' যে ' তোমাকে চেনে না।
ওপরের প্রতিটি বাক্যে  দুটি বা তার বেশি সর্বনামপদ রয়েছে এবং একটি সর্বনাম অন্য সর্বনামটির ওপর নির্ভরশীল। জোড়ায় জোড়ায় ব্যবহৃত এই সর্বনামগুলোই সাপেক্ষ সর্বনাম। 

   উল্লেখ্য সাপেক্ষ সর্বনামপদও একপ্রকার সংযোগ সূত্র তৈরি করে। তবে সংযোগ বাচক সর্বনামের সঙ্গে এর মূল পার্থক্য হল, সংযোগবাচকে পারস্পারিক নির্ভরতা থাকেনা এবং সর্বনাম পদগুলি জোড়ায় জোড়ায় ব্যবহৃতও হয় না। আর সাপেক্ষ সর্বনাম, জোড়ায় জোড়ায় ব্যবহৃত হয়ে পারস্পরিক নির্ভরতা প্রকাশ করে।

   তবে এ ব্যাপারটির মধ্যেও একটু অস্পষ্টতা রয়েছে। সাপেক্ষ সর্বনাম যদি জোড়ায় জোড়ায় ব্যবহৃত না হওয়া সত্ত্বেও পারস্পারিক নির্ভরতা প্রকাশ করে তাহলে কিন্তু তাকেও আমরা সাপেক্ষ সর্বনামই বলব। ক্ষেত্রবিশেষে আবার সংযোগবাচক সর্বনামের ক্ষেত্রেও আংশিক পারিস্পরিক নির্ভরতা লক্ষ করা যায়। তাই অনেকে সংযোগবাচক ও সাপেক্ষ সর্বনামকে একটিই শ্রেণি হিসেবে গ্রহণ করতে চান। তবে সর্বনাম দুটির সূক্ষ্ম পার্থক্য বোঝার জন্য আমরা কিন্তু দুটি শ্রেণিই রাখলাম। 

   এবার একটি সমস্যার কথা বলে নেওয়া যাক। প্রথমত, সর্বনামপদ শুধু বিশেষ্য পদের বারবার প্রয়োগের একঘেয়েমি দূর করার জন্যই ব্যবহৃত হয়, এই চালু ধারণাটা কিন্তু ঠিক নয়। কারণ আমি, তুমি, আপনি, আমরা, তোমরা, আপনারা প্রভৃতি সর্বনাম ব্যক্তির পরিবর্তে ব্যবহৃত হলেও এদের আগে কোনো বিশেষ্যযুক্ত বাক্যের প্রয়োজন হয় না। এরা একক এবং স্বাধীনভাবেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। 
    
   দ্বিতীয়ত, নাট্য সংলাপ বা  সাধারণ সংলাপের ক্ষেত্রে- বিশেষ পরিস্থিতি, আবেগের বাড়াবাড়ি বা অনুভূতির বৈচিত্র্যের জন্য অনেক সময় একই বিশেষ্যপদ বারবার ব্যবহার করা হয়। বরং সেক্ষেত্রে সর্বনাম প্রাসঙ্গিক হয় না। যেমন- "দিতি, তুমি না খুব সুন্দর! দিতি রাগ করে থেকো না, কথা বলো প্লিজ, কোথায় যাচ্ছ?  দিতি দাঁড়াও, যেও না। দিতি দিতি... "
এটি একটি আবেগময় সংলাপ।

   তবে একথা মনে রাখতে হবে, বাংলায় সর্বনামপদের কিন্তু রমরমা বাজার।  
   
   তৃতীয়ত, সর্বনামপদ অনেকক্ষেত্রেই বিশেষগুচ্ছ বা কোনো গোটা একটা বাক্যের পরিবর্তেও ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন-  "অসম্ভব প্রতিভাধর টেনিস তারকা রজার ফেডেরার" সর্বোচ্চ গ্র্যান্ডস্লাম খেতাব জয় করেছেন। যিনি সুইজারল্যান্ডের নাগরিক। এখানে "যিনি" সর্বনামটি ওপরের উদ্ধৃত অংশটির পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি একটি বিশেষ্যগুচ্ছও বটে। 
"কে জানত, বয়স্ক লোকটা শেষ পর্যন্ত কোভিড আক্রান্ত হয়েই  মারা যাবেন? অবশ্য এটা আমি আগেই অনুমান করেছিলাম।" এখানে "এটা" সর্বনামপদটি ওপরের পুরো বাক্যটির পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে।

   পদের নতুন শ্রেণি বিভাগে "সংযোজক" নামে যে শ্রেণিটি আমরা করেছি, কিছু সর্বনামও তার অন্তর্গত হতে পারে। যেমন-  যে, তাই প্রভৃতি। উৎস ও প্রয়োগের এত বৈচিত্র্যের জন্য পদের পূর্ণাঙ্গ শ্রেণিবিন্যাস সত্যিই কখনো সম্ভব নয়। পদ ও পদের শ্রেণিতে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। 

   সর্বনামপদ বেশ কিছুক্ষেত্রে বিশেষণ হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন- " তখন বললাম তো ভুলে গেছো" 
" এখন যেও না"
" কী কথা তাহার সাথে?" 
 এই "তখন", "এখন", " কী" পদগুলি সর্বনাম হয়েও বিশেষণ হিসেবে প্রয়োগ হয়েছে। এ ধরনের আরো নানা প্রয়োগ দেখানোই যায়।  

   আরেকটি কথা বলে আজকের আলোচনা শেষ করব। বিচিত্র বাংলা ভাষার উৎস ও প্রয়োগ বৈচিত্র্যে অনেক সময় কিছু সর্বনামপদ একইসঙ্গে সর্বনাম ও বিশেষণের বৈশিষ্ট্য বহন করে চলে। অর্থাৎ প্রয়োগ ক্ষেত্রে কিছু কিছু সর্বনামপদ  সবসময়ই বিশেষণ হয়ে থাকে। আবার বিশেষণের আলোচনায় দেখাব, বেশকিছু বিশেষণকে কীভাবে অনায়াসে বিশেষ্যপদ বলা যায়। তাই বিচিত্র এই প্রাণপ্রিয় বাংলা ভাষার পায়ে নমস্কার...
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments