জ্বলদর্চি

পদার্থবিজ্ঞানী জে. জে. টমসন এবং প্রথম মৌলিক কণিকা― ইলেকট্রন /পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী 
পর্ব ― ৩
পদার্থবিজ্ঞানী জে. জে. টমসন এবং প্রথম মৌলিক কণিকা― ইলেকট্রন 

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

স্যার যোশেফ জন টমসন (সংক্ষেপে, জে. জে. টমসন) ১৮৫৬ সালের ১৮-ই ডিসেম্বর, ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারের অন্তর্গত চেথাম হিল-এ জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর জন্মদাত্রী মাতা এমা সুইনডেলস তাঁতবস্ত্র বুননশিল্প পরিবারের মেয়ে। পিতা যোসেফ জেমস টমসন ম্যানচেস্টারে একটি পৈত্রিক প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী বেচা-কেনার দোকান চালাতেন।
       

স্থানীয় ছোট প্রাইভেট স্কুলে ছোট্ট টমসনের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি। সেখানে তাঁর তীক্ষ্ম মেধার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ছোটবেলা থেকে বিজ্ঞানের প্রতি তার তীব্র আসক্তি। মাত্র ১৪ বছর বয়সের মধ্যে স্কুলের সব পাঠে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে কিশোর টমসন রওনা দিলেন ম্যানচেস্টারের ওয়েনস কলেজে পড়তে। বর্তমানে যা 'ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার' নামে অধিক পরিচিত। ১৮৭০ সালে এই কলেজে ভর্তি হলেও তাঁর পিতার খুব ইচ্ছা ছিল শার্প স্টেওয়ার্ট অ্যান্ড কোং-এ একজন শিক্ষানবিশ ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে তার নাম নথিভুক্ত করতে। সেই মতো সব প্রস্তুতি চলছিল। বাধা হল নিয়তি। ১৮৭৩ সালে পিতার অকাল প্রয়াণ ঘটল। অপূর্ণ থেকে গেল স্বপ্ন। অর্থের অভাবে লেখাপড়ায় ছেদ পড়ার উপক্রম। ভেঙ্গে গেল হৃদয়। সেই ভগ্ন হৃদয়ে তার গণিতের অধ্যাপকদের কথায় বৃত্তির আবেদন করলেন কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে। সেটা ১৮৭৬ সাল। সেখান থেকে চার বছর পর গণিতে দ্বিতীয় স্থান পেয়ে 'Bachelor of Arts' ডিগ্রি লাভ করেন। জিতে নিলেন স্কলারশিপ। তারপর ফেলোশিপ নিয়ে ১৮৮৩-তে 'Master of Arts' ডিগ্রি।

লেখাপড়ার এমন কঠিন অথচ সফল পরিসমাপ্তির পর ১৮৮৪-এর ১২-ই জুন তিনি লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির সভ্য নির্বাচিত হলেন। ঐ বছরই পদার্থবিজ্ঞানে ক্যাভেনডিস প্রফেসরের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন নোবেলজয়ী খ্যাতনামা অধ্যাপক লর্ড র‍্যালে (Lord Rayleigh)। গ্রেট ব্রিটেনে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ক্যাভেনডিস ল্যাবরেটরিতে ফলিত গবেষণার জন্য ফিজিক্স প্রফেসরের পদটি অত্যন্ত সম্মানীয় গণ্য করা হয়। স্বাভাবিক ভাবেই ঐ সম্মানীত পদ পূরণ করার জন্য উপযুক্ত অধ্যাপকের সন্ধান করে কর্তৃপক্ষ। তার জন্য গঠন করা হয় একটি নির্বাচন কমিটি। কমিটিতে বিদায়ী অধ্যাপক লর্ড র‍্যালেও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনিই পরবর্তী ক্যাভেনডিস প্রফেসর পদের জন্য ২৮ বছরের যুবক টমসনের নাম সুপারিশ করেন এবং কমিটির সব সদস্য তাতেই সিলমোহর দিয়ে দেন। ২২-শে ডিসেম্বর, ১৮৮৪ সালে ক্যাভেনডিসে এলেন টমসন। কিন্তু তাঁর এই নির্বাচন যতটা না আকষ্মিক, তার থেকে বেশি বিস্ময়কর। অভূতপূর্বও বটে। কারণ তিনি একজন গণিতবিদ। অথচ ক্যাভেনডিসে ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞানী হিসাবে তিনি নির্বাচিত। সে-সময় ওসবর্ন রেনল্ডস বা রিচার্ড গ্লেজব্রুক-এর মতো খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানী কিন্তু সিলেকশন কমিটির সুনজরে থাকা সত্ত্বেও। 
                 

কথায় আছে, রতনে রতন চেনে। তাই বিজ্ঞানী র‍্যালে-র জহুরী চোখ ঠিক মানুষের সন্ধান করেছে। এই ক্যাভেনডিসে থাকাকালীন গণিত এবং ফলিত পদার্থবিজ্ঞানে টমসনের একের পর এক যুগান্তকারী আবিষ্কার তথাকথিত বিশুদ্ধ পদার্থবিদদের বিস্মিত ও আকৃষ্ট করে। তিনি অসংখ্য জমকালো এক্সপেরিমেন্টের নকশা তৈরি করেন।

১৮৯০ সালের ২২-শে জানুয়ারি ক্যাভেনডিসে নিজের গবেষক ছাত্রী কুমারী রোজ প্যাগেট-এর সঙ্গে শুভ পরিণয় বন্ধনে আবদ্ধ হন টমসন। তাঁদের এক ছেলে এবং এক মেয়ে। জর্জ প্যাগেট টমসন ও জন প্যাগেট টমসন। তাঁর আদুরে কন্যা জন প্যাগেট প্রায়শই বাবার সঙ্গে ঘুরতে যেত।

তাঁর আবিষ্কারের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে (১৮০৮ থেকে ১৮৯৭) মৌলিক পদার্থের পরমাণুর 'অভঙ্গুর' থাকার মিথ ভেঙে যায়। দুর্দান্তভাবে পরিকল্পিত তাঁর নিজের তৈরি ক্যাথোড রশ্মি নলের সাহায্যে ইলেকট্রনের অস্তিত্ব প্রমাণ করলেন তিনি। তার ফলে পরমাণু ভেঙে তার অভ্যন্তরে ঢুকে পরমাণুর নাড়ির কথা প্রথম জানতে পারল বিশ্বের মানুষ। শুরু হল পদার্থবিজ্ঞানের নতুন শাখা: সাব-অ্যাটমিক ফিজিক্স তথা কণাবাদী বলবিদ্যা। সেই কণা-বিজ্ঞানের প্রথম আবিষ্কৃত কণিকার স্বীকৃতি পেল ইলেকট্রন। আর এ হেন আবিষ্কারের জন্য প্রফেসর জে. জে. টমসন পেলেন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার, ১৯০৬ সালে। তিনি ১৯১৩ সালে অতেজস্ক্রিয় স্থায়ী মৌলের আইসোটোপ বা সমস্থানিকের সত্যতা সর্বপ্রথম প্রমাণ করেন। ভর পার্থক্যের জন্য নিয়ন-২০ এবং নিয়ন-২২ আইসোটোপ দুটির পৃথকীকরণ হল Mass Spectrometry-এর প্রথম উদাহরণ। পরে Mass Spectrometer যন্ত্র উদ্ভাবনে বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।

১৯০৫ সালে তিনি পটাশিয়াম মৌলের স্বাভাবিক তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেন। ১৯০৬ সালে হাইড্রোজেন মৌলের প্রতিটি পরমাণুতে একটি ইলেকট্রন থাকার কথা প্রদর্শন করেন।
                       

মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে তিনি সবকিছু অর্জন করে ফেললেন। অন্তত একজন পদার্থবিদ হিসাবে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ফিজিক্স ল্যাবরেটরির পরিচালক। নিজের কাজের জন্য বিশ্বজোড়া খ্যাতি। নামের পাশে একটি মৌলিক আবিষ্কার। এবং নোবেল প্রাইজ। এমতাবস্থায় একজন ফিজিসিস্ট হয় অবসর নিয়ে বড়শিতে মাছ ধরতে যাবেন; অথবা বড় বড় নীতিমাখা বক্তব্য আওড়াবেন। কাগজে-মঞ্চে-সেমিনারে সবাই তাঁর গুণকীর্তন করবে। কিন্তু না, এসবের কোনটি তিনি করলেন না। আসলে তিনি অন্য ধাতুতে গড়া। যে ফিজিক্স তাঁকে এত নাম-যশ-অর্থ-প্রতিপত্তি দিয়েছে, তার সেবায় দিনরাত এক করে ফেললেন তিনি। তাঁর মহৎ শিক্ষা দানের হাত ধরে এক একজন রত্ন-সুলভ শিক্ষার্থী উঠে আসে বিজ্ঞানের সেবায়।

তাই শুধুমাত্র ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণার কাজে নয়, উন্নত মানের ছাত্র তৈরির ক্ষেত্রে তাঁর অনস্বীকার্য অবদান সর্বোত্তম শিক্ষকের আসনে তাঁকে অধিষ্ঠিত করেছে। একটা পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি আরও পরিস্কার হবে। তাঁর ৭৫ জন ছাত্র বিশ্বব্যাপি ৫৫ টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজে যুক্ত। রয়্যাল সোসাইটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন ২৭ জন। তাদের মধ্যে ৬ জন শিষ্য পদার্থবিজ্ঞানে এবং ২ জন রসায়ন বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রাপক। এরা প্রত্যেকে একক ভাবে নোবেল সিদ্ধি লাভ করেছেন। তাঁর সেরা শিষ্য ১৯০৮ সালে রসায়নে নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড পরে ক্যাভেনডিস প্রফেসরের পদ অলংকৃত করেন। ১৯১৯ সাল থেকে।

এখানেই শেষ নয়। ১১-ই নভেম্বর ১৯১২ সালে ২২ বছর বয়সী তাঁর এক তরুণ ছাত্র এক্স-রশ্মি দ্বারা কেলাসবিদ্যা বিশ্লেষণের ওপর একটি রিসার্চ পেপার প্রকাশ করেন। ঐ পেপারটি 'কেমব্রিজ ফিলোজফিক্যাল সোসাইটি'র বিচারে ১৯৩ বছরের ইতিহাসে সেরা হিসাবে মনোনীত হয়। সেই তরুণ বিজ্ঞানী আর কেউ নন, অস্ট্রেলিয়া-জাত উইলিয়াম লরেন্স ব্র্যাগ। উক্ত পেপারটির সৌজন্যে মাত্র ২৫ বছর বয়সে নোবেল প্রাপক এই বিজ্ঞানী এখনও পর্যন্ত সর্বকনিষ্ঠ নোবেল জয়ী পদার্থবিজ্ঞানী হিসাবে সমগ্র বিশ্বে সমাদৃত ও স্বীকৃত। 

শুধু তাই নয়, নিজের একমাত্র পুত্র জর্জ টমসন নোবেল পুরস্কার পান ১৯৩৭ সালে। কেলাস দিয়ে ইলেকট্রনের অপবর্তন আবিষ্কারের জন্য। নোবেল ইতিহাসে খুব অল্প সংখ্যক এমন সৌভাগ্যবান পিতা-পুত্র আছেন যাদের নোবেল প্রাপ্তি হয়েছে। 
            

১৯১৫ থেকে ১৯২০ পর্যন্ত প্রফেসর টমসন রয়্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট হিসাবে কার্যনির্বাহ করেন। ১৯১৮ সালে তাঁকে আমৃত্যু 'Master of Trinity College' ঘোষণা করা হয়। ১৯১৯ সালে ক্যাভেনডিস প্রফেসরের পদ থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তারপর কেমব্রিজে Leys School-এ নিজের নামাঙ্কিত 'Thomson Building'-এর দ্বারোদ্ঘাটন করেন ১৯২৭-এর নভেম্বরে। তাঁর সম্মানে Mass Spectrometry-তে 'Mass to Charge Ratio' রাশি পরিমাপের একক রাখা হয় 'Thomson', যা Th চিহ্ন দিয়ে প্রকাশ করা হয়।

শেষমেশ ১৯৪০ সালের ৩০ আগস্ট তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে-তে আইজাক নিউটন ও প্রিয় ছাত্র আর্নেস্ট রাদারফোর্ড-এর পাশে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।

তাঁর মৃত্যুর পর কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির পশ্চিম দিকের বিল্ডিং-এর নাম 'জে. জে. টমসন অ্যাভেনিউ' রাখা হয়েছে এবং The Thomson Medal Award স্পনসর করে International Mass Spectrometry Association।
         

তাঁর লেখা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই হল :–
(১) The Atomic Theory (1914)
(২) The Corpuscular Theory of Matter (1907)
(৩) Electricity and Matter (1904)
(৪) The Discharge of Electricity through gases (1898)
(৫) Elements of the Mathematical Theory of Electricity and Magnetism (1895)

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন

Post a Comment

1 Comments