জ্বলদর্চি

পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা-১২/ বিমল মণ্ডল

Spoken language of the fishing community of East-Medinipur district / Bimal Mondal
পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা
         
পর্ব-১২(তৃতীয় অধ্যায়) 

রূপতত্ত্ব(Morphology) 

৬. সাধিত ক্রিয়া:এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় মান্য চলিত বাংলার মতো এখানে সাধিত ক্রিয়ার ব্যবহার চোখে পড়ে এই উপভাষায়। যেমন—

i.তারে কটিয়া মাচ কাটাইছে।(তার ছেলেটা  মাছ কাটাচ্ছে।) 
ii.পিরান খুলিয়া মাকে ধর‍্যাচ্ছে। (জামা খুলে মা ধরিয়ে দিচ্ছে।) 
iii.অনেক সময় হলা  টকাটাকে পড়াইছে। (অনেক সময় ধরে ছেলেটাকে পড়িয়েছে।) 


     এই জেলার কথ্যভাষায় মান্য চলিত বাংলার মতো তিন ভাগে এই ক্রিয়া দেখা যায়। যেমন—    

৬.১. প্রযোজক ক্রিয়া:-
এখানকার কথ্যভাষায় প্রযোজক ক্রিয়ার ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। যেমন—

i.লোকটা নৌকায় জাল গুনছিলো। (লোকটি নৌকায় জাল বুনেছিল।) 
ii.মা তানকের গপ্প শুনাটে। ( মা তাদের গল্প শোনাচ্ছে।) 
iii.নৌকা লিয়া তানে ডাকথালা। (নৌকা নিয়ে তারা ডাকছিল।) 
iv.মা মাচ রাঁধিকি  আমারমনকে ডাকুছি। (মা মাছ রেঁধে আমাদেরকে ডাকছে।) 
v.  তোনে মোনকের ডাকিয়া এ্যকবার খাওয়াবুনু?(তোরা আমাদের একবার ডেকে খাওয়াবি?) 

৬.২.নামধাতু:
এই মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষার উপভাষাতে নামধাতুর যথেষ্ট প্রয়োগ আছে। এই জেলার উপভাষায় নামধাতু দুই ভাবে প্রয়োগ হতে দেখা যায়। যেমন—
৬.২.১.নামপদের সঙ্গে ক্রিয়াবিভক্তি যুক্ত নামধাতু—

এই জেলার উপভাষায় এই ধরনের নামধাতুর প্রয়োগ ক্রমশ দেখা যায়। যেমন-

নামপদ           + ক্রিয়াবিভক্তি =  নামধাতু     
দেড়িয়্যা            + আছে          =দেড়িয়্যাছে
খাড়া                 +ইছে             =খাড়াইছে
ঘুমা                   +ইছু             = ঘুমাইছু
হাতা                  +ইলু             =হাতাইলু
আঁচড়া              +ইলো           =আঁচড়াইলো
চিল্যা                 +ইথলো     =চিল্যাইথলো
জুতা                  +ইবো       =জুতাইবো
পিটা                  +ইবু          =পিটাইবু

বাক্যে প্রয়োগ 

i.নৌকার লোকগুয়া দেড়িয়্যাছে। (নৌকার লোকগুলো দাঁড়িয়ে আছে।) 
ii.  মাঝু  নদীরো লোকটা নৌকালিকি যাইথলো। (মাঝ নদীতে লোকটা নৌকা নিয়ে গিয়েছিল।) 
iii. চোরটাকে বাঁধিয়া লিয়া আইসিয়া কি পিটা পিটাইলো। (চোরটাকে বেঁধে নিয়ে এসে কি মার মারলো।) 
iv.তানে কান্দোল ধারে খেলথলো। (তারা উঠানে খেলছিল।) 
v.লোকটাকে জুতাইয়া শাস্তি দুয়া হইলো। (লোকটাকে জুতিয়ে শাস্তি দেওয়া হলো।) 
৬.২.২.বিশেষ্য, বিশেষণ পদ বদ্ধরূপিমের সঙ্গে  ক্রিয়াবিভক্তি  যুক্ত নামধাতু—

নামপদ +বদ্ধরূপিম +ক্রিয়াবিভক্তি= নামধাতু     ডুবি    +আ           +ইবু           =  ডুবিয়াবু
ভাপ্        +আ          +ইবো         =ভাপাইবো
জুড়্     +আ        + ইলো            =জুড়াইলো
বুল্          +আ        +ইবো          =বুলাইবো 
টান্          +ই          +থিল           =টানাইথিলা
ডুব্          +ই            আলো          =ডুবিয়ালো

বাক্যে প্রয়োগ

i.অতবড়ো নৌকাটা ডুবিয়ালো। (এতো বড়ো নৌকাটি ডুবে গেল।)  
ii.সকাঁউ উঠিয়া ধান ভাপাইবো। (সকালে উঠে ধান সিদ্ধ করবো।) 
iii. ঘরে সুকুড় পড়িয়া আছে যায়া বুলাইবো। (ঘরে এঁঠো পড়ে আছে গিয়ে মুছতে হবে।) 
iv. কদগা দিন পরে মোরমোনকের মন জুড়াইলো। (কতদিন  পরে আমাদের মন জুড়ালো।) 
v.অখুনি টাকা যদি নাই দউ তাহলে এমন ভাবে টানিয়ালিয়াবো বুজতে পারবু। (এখন টাকা যদি না দিস, তাহলে এমন ভাবে টেনে নিয়ে যাবো বুঝতে পারবি।) 


৬.৩ ধ্বন্যাত্মক ক্রিয়া:
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় যে সব মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করে তারা অধিকাংশ অল্পশিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত। ফলে এখানকার নারী-পুরুষ, বাচ্চা -বুড়ো সবাই প্রায় একইরকম কথা বলে থাকে। তাদের এই কথ্যভাষায় প্রায়শই ধ্বন্যাত্মক ক্রিয়ার প্রয়োগ দেখা যায়। এই ক্রিয়ার তিন রকম ব্যবহার দেখা যায়। যেমন-

৬.৩.১.অনুকার শব্দে 'আ' প্রত্যয় যোগে ধ্বন্যাত্মক ক্রিয়া:

অনুকার+বদ্ধ +ধাতু বিভক্তি=ধ্বন্যাত্মক ক্রিয়া
হাঁস্     +আ          +   টে         =হাঁসাটে
কাঁদ     +আ           +ইলো       =কাঁদাইলো
হাঁক্      +আ           +থলো    =হাঁকাইথলো
ফাঁস্       +আ       +থিলা      = ফাঁসাইথিলা
ফুঁক্        +আ       +ইবো       =ফুঁকাইবো
শুঁক্         +আ      + ইতে       =শুঁকাইতে


বাক্যে প্রয়োগ

i.টকাটাকে কাঁদাইলু কেনি রে?(ছেলেটাকে কাঁদালি কেন?)
ii.  ছোটো ছোটো মাচ গুয়া রোদে শুঁকাইতে দিছে। (ছোট মাছগুলো রোদে শুকনো করতে দিয়েছে।) 
iii.ঘরের বউড়ি রাগিয়া ফুঁসেটে। (ঘরের বউ রাগে ফুঁসছে। 
৬.৩.২. অনুকার শব্দ যোগে ধ্বন্যাত্মক ক্রিয়াঃ-

অনুকার শব্দ+ধাতুবিভক্তি=ধ্বন্যাত্মক ক্রিয়া
হাঁচ্                  +থলো       =হাঁচথলো
শুঁই                   +থেলা       = শুঁইথেলা 
ধুঁক্                    +ইছু           =ধুঁকিছু
গাঁই                    +থলো     =গাইথলো

বাক্যে প্রয়োগ
i. আমার টকাটা হাঁচথলো। (আমার ছেলেটা হেঁচে ছিলো।) 
ii. সোমা ভরনু উঠিয়া গান গাঁইথলো। (সোমা ভোরে উঠে গান গেয়ে ছিলো।) 
iii.কচিয়া বাছুরটা ঠান্ডায় ধুঁকিছু। (ছোটো বাছুরটা ঠাণ্ডায় ধুঁকছে।) 

৬.৩.৩. দ্বিরুক্ত শব্দ যোগে ধ্বন্যাত্মক ক্রিয়া:         

অনুকারশব্দ +বদ্ধ রূপমূল=ধ্বন্যাত্মক ক্রিয়া 
ম্যাড়ম্যাড়         +ইয়া              =  ম্যাড়মেড়িয়া
ঠকঠক্             +আ               =ঠকঠকা
ফটফট              +ই                 =ফটফটি
ভুটভুট                + ই               =ভুটভুটি
মড়মড়               +আ           =মড়মড়া
মচমচ                +ইয়া          =মচমচিয়া


বাক্যে প্রয়োগ  

i.মেইঝিটা বেশ ফটফটি আছে তো। (মেয়েটা বেশ চালাক আছে তো।) 
 ii.পাঁপড় গুয়া মচমচিয়া করিয়া ভাজি লিয়া আয়। (পাঁপড়গুলো মচমচ করে ভেজে নিয়ে আয়।) 
iii.তোকে আইজকে কেনি ম্যাড়মেড়িয়া লাগছে রে? (তোকে আজ কেন ম্যাড়মেড়ে লাগছে?)

এই জেলার উপভাষায় চলিত বাংলার থেকে আলাদা  বিভিন্ন পদের  ব্যবহারিক  বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। পরবর্তী পর্বেও মান্যচলিত বাংলার সঙ্গে এই জেলার কথ্যভাষার পদের শ্রেণি বিভাগ আলোচিত হবে।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments