জ্বলদর্চি

আবৃত্তির পাঠশালা-৬/শুভদীপ বসু

আবৃত্তির পাঠশালা-৬

শুভদীপ বসু

বিষয়: কণ্ঠস্বর(প্রথম অধ্যায়)

কণ্ঠস্বর মানুষের এক বিচিত্র সম্পদ। বহু টাকার ভূ-সম্পত্তি যা মানুষকে স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারে না, সুললিত কণ্ঠস্বর খুব সহজেই তা দিতে পারে। কারোর কণ্ঠস্বর সুন্দর হলে সে স্বাভাবিকভাবেই অন্য সবার থেকে অনেকটাই এগিয়ে দাঁড়ায়। এই কণ্ঠস্বরকে সম্বল করেই সে পায় ব্যক্তি স্বতন্ত্রতা। একে সম্বল করেই সে হয়ে ওঠে কখনও উচ্চমানের শিল্পী। গান করলে হয় সংগীতশিল্পী, আবৃত্তি করলে সকলের মধ্যেই সাড়া পড়ে যায় আবার অভিনয় করলে সেখানেও সুললিত কণ্ঠস্বরের মর্যাদা সর্বাগ্রে।

ভালো কণ্ঠস্বর:

অনেকে ভাল কণ্ঠ বলতে জলদগম্ভীর বা বেস যুক্ত ভরপুর কণ্ঠকে বুঝে থাকেন তাই প্রয়োগের সময় অহেতুক আরোপ করে কথা বলার চেষ্টা করেন।ফলে কৃত্রিমতা ধরা পড়ে।আমার মনে হয় ভাল কণ্ঠস্বর বলতে শ্রুতিসুখকর অর্থাৎ যা শুনতে ভালো লাগে যা শুনলে কানের আরাম হয়, যে কন্ঠে নমনীয়তা আছে, যে কন্ঠ কোনরূপ মুদ্রাদোষ ছাড়া নানা রকম ভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে তাকেই বলা যেতে পারে ভালো কণ্ঠস্বর।
অনেকেই আমাকে বলেন 'যে আমার কণ্ঠস্বর খুব গম্ভীর বা মিষ্টি নয় তাহলে কি আমি আবৃত্তি করতে পারব?'আমি তাদের বলি নিশ্চয়ই পারবে। প্রত্যেকের কণ্ঠস্বরের একটা স্বাতন্ত্র্যতা রয়েছে। আর সকলের কণ্ঠস্বর যে গম্ভীর বা মিষ্টি হতে হবে এমন নয়। আপনারা জানেন এমন অনেকের কণ্ঠস্বর খুব মিষ্টি বা গম্ভীর না হলেও অত্যন্ত জনপ্রিয়। উদাহরণস্বরূপ আমরা বলতেই পারি অভিনেত্রী রানী মুখার্জির কথা। ওই কণ্ঠস্বর এর জন্যই উনি বিখ্যাত হয়ে গেছেন। তাই আমার কাছে ভালো কন্ঠ মানে যা অন্যের কানে আরামপ্রদ হয়।এই কণ্ঠস্বর কিছুটা হলেও ঈশ্বরপ্রদত্ত তাই স্বাভাবিকভাবেই সকলের কণ্ঠস্বর গম্ভীর হবে না,কিন্তু যার যেরকম কণ্ঠস্বর হোক না কেন সেই কণ্ঠস্বরের চর্চার মধ্য দিয়ে সে একজন শিল্পী হয়ে উঠতে অবশ্যই পারে।

কণ্ঠস্বর এর উৎপত্তি:

হারমোনিয়াম থেকে স্বর সৃষ্টি করে তিনটি জিনিস-
১)বেলো ২)রিড৩)রেসোনেটার। যে হারমোনিয়াম যত দামি তার  রেসোনেটের ততো ভালো। তা শুনতে ততোই মধুর। আমাদের শরীরের ভেতরে এরকম তিনটি শব্দ সৃষ্টিকারী যন্ত্র আছে। অর্থাৎ বেলো, রিড আর রেসোনেটার।

১)বেলো-শরীরে বেলো হোল দুটো ফুসফুস।হারমোনিয়ামের বেলো যেমন রিডের মধ্যে হাওয়ার যোগান দেয়,ফুসফুস দুটিও শরীরের স্বর সৃষ্টিকারী রিডগুলোর মধ্যে হাওয়ার যোগান দেয়।

২)রিড-রিড হলো স্বরযন্ত্রের মধ্যে  থাকা দুটি ভোকাল কর্ড। এরা শুধু স্বরবর্ণ সৃষ্টি করে।অন্যান্য রিড যারা আছে তারা ব্যঞ্জনবর্ণ সৃষ্টিতে সাহায্য করে।ওষ্ঠ্য সৃষ্টি করে ওষ্ঠ্য বর্ণ,দন্ত সৃষ্টি করে দন্ত বর্ণ,জিহ্বা- জিহ্বামূলীয় বর্ণ, তালু-তালব্য বর্ণ, মূর্ধা-মূর্ধন্য বর্ণ,নাসিকা-নাসিক্য বর্ণের ইত্যাদি।

৩)রেসোনেটার-শরীরের রেসোনেটার হোল নাক,সাইনাস ও গলবিল। রেসোনেটার কণ্ঠস্বরের মধ্যে অনুরণনের যোগান দেয়।কার কন্ঠস্বর কেমন শুনতে হবে সেটা নির্ভর করে তার অনুরণন সৃষ্টিকারী স্থানগুলির গঠনের ওপর।সেটা অবশ্য ঠিক হয়ে যায় প্রকৃতির খেয়ালে।তবে তাকে আরো সুন্দর করে তোলা টা ব্যক্তিনির্ভর।কেউ কেউ পারে তাকে আরো বাড়িয়ে তুলতে আরও সুন্দর করে তুলতে তার সাধনার মধ্য দিয়ে।আর তা নষ্ট হওয়াটাও ব্যক্তিনির্ভর।ছোটবেলা থেকে কেউ যদি তার কণ্ঠস্বর এর অপব্যবহার করে তাহলে সে জন্ম মুহূর্তে ভালো মাপের রেসোনেটার পেয়েও সুন্দর কণ্ঠস্বর থেকে বঞ্চিত হতে পারে।

বোধ:

ব্রেনের যে সেন্টারটি সহায়তায় আমরা কথা বলি তার নাম ব্রকাস এরিয়া। এটা থাকে ব্রেনের বাম গোলার্ধে। ব্রেনের 45/ 46 নম্বর স্থানে। তাই ব্রেনের বাম গোলার্ধে নাম স্পিকিং ব্রেন। ব্রেনের ডান গোলার্ধেও ব্রোকাস এরিয়া আছে।1986 সালে Sir Rojer Sperry এটি আবিষ্কার করেন। এটাই হলো বোধ সেন্টার। যা আমাদের নানা বোধের জন্ম দেয়। আর এই বোধ কোন জায়গায় কি রকম কণ্ঠস্বর ব্যবহার করতে হবে তা বুঝিয়ে দেয়।
কণ্ঠস্বরের চর্চা:
কণ্ঠস্বরের চর্চার ক্ষেত্রে আমরা নিম্ন কতগুলি বিষয়ে অভ্যাস করলে কন্ঠের যত্ন নিতে পারব।
১) শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুশীলন।
২) জিভ এর সঠিক ব্যবহার।
৩) নাকের পরিমিত ব্যবহার।
৪) দাঁত, ঠোঁট,মূর্ধার সঠিক ব্যবহার
৫) কন্ঠকে বিভিন্ন স্কেলের পীচে অনুশীলন করা।

বিভিন্ন প্রকার শ্বাস-প্রশ্বাস ও তার অনুশীলন:

শ্বাস গ্রহণ করে নিঃশ্বাস ছাড়ার সময় স্বরতন্ত্রী কম্পন সৃষ্টি হয় বলে সর উৎপন্ন হয়। কাজেই কণ্ঠস্বরের সঙ্গে শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়ার নিবিড় সম্পর্ক। মূলত তিন প্রকার দেখা যায়-
ক)প্রবাহমূলক- সব সময় সাধারণভাবে নাক দিয়ে জল স্রোতের মতো জেসাস গ্রহণ করা হয় তাকে প্রবাহ মূলক বা টাইডাল ব্রিদ বলে।
খ)অবশিষ্ট-নিঃশ্বাস ছেড়ে দেবার পরেও দুই ফুসফুসে যে হাওয়া অবশিষ্ট থাকে,তাকে অবশিষ্ট বা রেসিডুয়াল ব্রিদ বলে।
গ)অনুপূরক-গায়ক বক্তা অভিনেতা অথবা শ্রমজীবি মানুষ কঠিন কাজের জন্য যে অতিরিক্ত হাওয়া শ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে তাকে সাপ্লিমেন্টাল ব্রিদ বা অনুপূরক বলে।

শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুশীলন:

১)স্থির হয়ে সুখ আসনে অথবা পদ্মাসনে বসে নাক দিয়ে বুক ভরে দীর্ঘ শ্বাস নিন। দেখবেন আপনার দুটো কাঁধ উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। একে vertical Breathing বলে। এভাবে শ্বাস নেবেন না। ওই একই ভাবে সুখ আসনে বা পদ্মাসনে বসে নাক দিয়ে গভীর ভাবে এমন ভাবে শ্বাস নিন যাতে আপনার কাঁধ উপরের দিকে না উঠে যায়। আপনার তল পেট সামনের দিকে কিছুটা প্রসারিত হয়। নিজের একটা হাত তলপেটের ওপর রাখলে এ বিষয়টি আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন। একে horizontal breathing বলে।তাই মনে রাখতে হবে সঠিক পদ্ধতিতে শ্বাস গ্রহণ মানে তার ওপরের দিকে উঠবে না অথচ তল পেট সামনের দিকে প্রসারিত হবে।
২) মেরুদন্ড সোজা করে বসুন নাক দিয়ে ধীরে ধীরে ৬ সেকেন্ড ধরে ফুসফুস ভরে শ্বাস নিন। 4 সেকেন্ড ধরে রাখুন। আবার ধীরে ধীরে ৬ সেকেন্ড ধরে নাক দিয়ে প্রশ্বাস নির্গত করুন।
৩) একইভাবে মেরুদন্ড সোজা রেখে বসে ছয় সেকেন্ড ধরে শ্বাস নিন 4 সেকেন্ড ধরে রাখুন ও তারপর মুখ দিয়ে আস্তে আস্তে প্রশ্বাস নির্গত করুন।
৪) নাক দিয়ে পরিপূর্ণ শ্বাস নিন। 4 সেকেন্ড ধরে রাখুন প্রশ্বাস ছাড়ার সময় ওম শব্দটি উচ্চারণ করুন।
৫) নাক দিয়ে পরিপূর্ণ শ্বাস নিন কান দুটি আঙ্গুল দিয়ে বন্ধ করুন আর শ্বাস ছাড়ার সময় হুম উচ্চারণ করুন। একে ভ্রামরী প্রাণায়াম ও বলে।
৬) অনুলোম বিলোম,কপাল ভারতি প্রাণায়ামটিও কার্যকরী।
৭) আবৃত্তি, সঙ্গীত অভিনয়ের ক্ষেত্রে দম বাড়ানোর অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এক্ষেত্রে নাক দিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে নিচের পংক্তিগুলো এক নিশ্বাসে উচ্চারণ করা যেতে পারে--
** "আমার ইচ্ছে হলো যে দেখে আসি কিসে পরাক্রম যার ভ্রুকুটি দেখে সমস্ত এশিয়া তার পদতলে লুটিয়ে পড়ে কোথায় সে শক্তি লুক্কায়িত আছে আর্যের মহাবীর্য যার সংঘাতে বিচলিত হয়েছে।"
**"সত্যের জন্ম হয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে সিন্ধু গঙ্গার উপত্যকায় নীল নদের তীরে ইয়াংসিকিয়াং আর হোয়াংহো অববাহিকায় জেরুজালেমের প্রান্তরে সে সত্য অত্যন্ত প্রাচীন সে সত্য কোন বাচাল অর্বাচীন উত্তরপুরুষের হুমকির জবাবদিহি করে না।"
লক্ষণীয় যে,দুটি স্তবক এখানে দেখানো হলো এখানে কোন যতি চিহ্ন নেই।যতি চিহ্ন দেওয়া হয়নি এই জন্য যে,পুরো স্তবকটি প্রথমে শ্বাস নিয়ে তারপর শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে একদমে বলতে হবে।এই দুটি উদাহরণ শ্বাস নিয়ন্ত্রণ তথা দম বাড়ানোর পক্ষে খুব উপযোগী অনুশীলন।অবশ্য এই রকম বড় কোনো সংলাপ বা কিছু বাক্য বন্ধনীও একই রকম অনুশীলন করা যেতে পারে।

(ক্রমশ: কণ্ঠস্বর এর এই অধ্যায়টি  আরো একটি পর্বে শেষ হবে।)
জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇


আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments