জ্বলদর্চি

এক জীবন্ত মডেলের কথা/গৌতম বাড়ই


এক জীবন্ত মডেলের কথা

গৌতম বাড়ই

শীতটা দু-দিন হল একটু জমিয়ে পড়েছে। তা  পৌষমাস তো এসেই গেল ভাইয়া -- বাজারের দিনুদা বললেন‌। বলি নলেন গুড় কি চেখে দেখেছ? এবারে কি জয়নগর - মজিলপুরের সেই অমৃত স্বাদের নলেন গুড় পেয়েছ? ভাইয়া দিব্যি বলছি, এই বেহালা বাজারে আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেকার সেই অমৃতের স্বাদ এখনও জিভের গোড়ায়। কী খাসা!কী খাসা! জয়নগর-মজিলপুর ছাড়িয়ে আরও বহুদূর থেকে আসত সেই অমৃত রসের কলসী। তোমাদের শক্তি কবির দেশের বাড়ি গো ওখানে। শোননি? এই খেজুর রসের হাঁড়ি নিয়ে অমিত বচ্চনজীর মতির গুড় মনে পড়ে?

এই বলে দিনুদা দম নিলেন।

এরকম শীতের মধ্যে করোনা উপেক্ষা করে নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে চললাম এক আত্মীয়ের বাড়ি শান্তিপুরে। তবে রসের খোঁজে না। বিয়ের অনুষ্ঠানে। দক্ষিণ ছেড়ে উত্তরের পথেই এ যাত্রা। ভাগ্নের বৌ-ভাতের অনুষ্ঠান। সকাল- সকাল বেড়িয়েছি। সত্যি  উপেক্ষা করলাম একপ্রকার করোনা অণুজীবকে। অনেক ভয় দেখিয়েছে সেই ২০২০ - র মার্চ মাসের মধ্যভাগ থেকেই। এবার ভয় জয় করে বেরিয়ে পড়া। অসামাজিক কাটল তো অনেক দিন মৃত্যুভয়ে। এবার সামাজিক হই একটু, যখন মৃত্যুভয় ফিকে হচ্ছে একটু একটু করে।

শান্তিপুরে গাড়ি নিয়ে ঢোকা ইস্তক দেখতে পেলাম মুখোশহীন সব লোকমুখ। ভয়ের লেশমাত্র আর লেগে নেই এখানকার মানুষের মুখে। আমিও বারকয়েক মুখোশ নামিয়ে প্রকৃতির মুক্ত বাতাসের শ্বাস নিয়েছি রাস্তায়। কলকাতার বাইরে বেরিয়ে এসে এই মুক্ত কর ভয় হয়েছি বোধহয়।

বিয়েবাড়ি হৈ-চৈ, এদিকে বরপক্ষ আর ওদিকে কনেপক্ষ।সব মিলেমিশে একাকার। সাজানো সিংহাসনে বর-কনে আর উভয়পক্ষের ফটোসেশন চলছে। স্মৃতিটুকু থাক।স্মৃতিটুকু থাক-- এই করে। এখন তো হাতে-হাতে মেগা-পিক্সেল লেন্স। প্রো- ফটোগ্রাফার ও আছেন। ভিডিও আর স্টিল চলছে ফোকাস লাইট মেরে। বিয়েবাড়ি শীত সন্ধ্যায় গিয়ার আপ হচ্ছে ক্রমশ। 

আরে ও কোণে দাঁড়িয়ে কে? মানুষ না স্ট্যাচু? হাতে ফুলের তোড়া।

সামনে এগিয়ে গেলাম। পেছন থেকে দেখলাম। সাইড মেরে সাইড কেটে, নো হেলদোল। এতো তাহলে শান্তিপুরের সেই জীবন্ত বা লাইভ মডেল। যা শুনেছি বা পড়েছিলাম খবরের কাগজে। আর আমার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়াল বিয়েবাড়ির জমজমাটি অনুষ্ঠানের মাঝে এই মডেল। আমি এবারে ফটোগ্রাফার হয়ে ফটো  তুললাম ফটাফট। আলাপ করবার ইচ্ছেটা জমে রইলো ভেতরে।

কতক্ষণ দাঁড়াবে গো এই মডেল? পাশ থেকে এক শান্তিপুরের ছেলে- ছোকড়া বলে উঠল, অন্তত ঘন্টাতিনেক তো বটে।

আমাদের ধূমায়িত কফি মডেলের ঠোঁট ছুঁয়ে চলে যাচ্ছিল। ফিসফ্রাইয়ের গন্ধে বাতাস ম-ম করছে। আর পেশার জীবন দাঁড়িয়ে আছে স্থির।

কত পায় গো?

এবারে সেই ছেলে বললে-- ঘন্টা প্রতি বর্তমানে দু'শো শুনেছি। ঐ মেরে কেটে ছয়শো টাকা রোজগার এক - একটা বিয়ে বাড়িতে। তবে সবাই পায়না একদর।

মনে পড়ে গেল আজ থেকে বছর দুই আগের দৈনিক পত্রিকার একটি প্রতিবেদন। ঐ ২০১৮ সাল নাগাদ বেরিয়েছিল। শান্তিপুরের এই  জীবন্ত মডেল নিয়ে। যা আজ চাক্ষুস করছি আজ।
আমি মডেলের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। সত্যি আমাদের এই মানুষ নামে প্রাণীটি বড় অদ্ভুত। কত বিচিত্র সব পেশা। তবে কিছু পেশায় আসতে গেলে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিকে ভালবেসে আসতে হয়। এই জীবন্ত মডেল পেশাটিও তাই। 

অবশেষে একটুখানি খণ্ড-সময় পাওয়া গেল জীবন্ত মডেল শ্রীলোচন ভৌমিক-কে (নাম পরিবর্তিত) নিয়ে। নড়েচড়ে বিয়েবাড়ির লোক মাঝারে ঘন্টা তিনেক পরে এলেন।

আমি জিগ্গেস করি-- আপনার এই পেশা কতদিনের?

-- দাদা দিন কী বলছেন! আজ নয়-নয় করেও প্রায় সতের বছর তো  হবেই।

-- কেমন লাগে? শুধুই পেশা? নাকি অন্য কোন টানে?

-- জানিনা দাদা। কী এক অমোঘ টানে আর সংসারের প্রয়োজনে এ পেশায় নেমে পড়ি। যখন এ পেশা বন্ধ থাকে, যজমানি করি। পুরুতমশায়। ঠাকুর দেবতার পূজা করি। শান্তিপুরের এই জীবন্ত মডেল শিল্পের আদিগুরু অমরেশ রায়ের কাছে একদিন হাজির হই। তারপর দীর্ঘ অনুশীলন, ধৈর্য এবং মনঃসংযোগ অবশ্যই। ধীরে ধীরে একজন স্থির মডেল শিল্পী হয়ে ওঠা।

আমি জিগ্গেস করি আবার---- তাহলে প্রতিষ্ঠা মানে এখানেও অর্থাৎ এ পেশার ক্ষেত্রেও লড়াই প্রতিযোগিতা আছে? যেমন অন্যান্য পেশায় থাকে?

----- তা দাদা আছে বই কী। তবে রে রে তেড়ে যাওয়া নয়। প্রায় হাজারের ওপর শিল্পী এই পেশার সাথে যুক্ত, শান্তিপুর এবং সন্নিহিত এলাকার। আজকেই আমি আরও ছ'জায়গায় লোক দিয়েছি। তারাও জীবন্ত মডেল করবে। দক্ষিণবঙ্গ এবং উত্তরবঙ্গের নানা জেলা ছাড়াও অসম, বিহার, ঝাড়খণ্ডের মত ভিনরাজ্য থেকে ডাক পান এখানকার শিল্পীরা। বিভিন্ন পুজো বা উৎসব তো আছেই, সঙ্গে জন্মদিন, বিয়ের মতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁরা ডাক পান। শুধুমাত্র স্থির মডেলের মাধ্যমে নানা সামাজিক বার্তা, সাম্প্রতিক কালের ঘটনা তুলে ধরা হয় ইদানীং। এ ছাড়াও নানা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে তাঁরা হাজির হন গোপাল ভাঁড়, ছোটা ভীম, মিকি মাউস বা চার্লি চ্যাপলিনের সাজে। আমার নিজের কাছে দাদা জানেন তো, আমার পারফর্ম করা চার্লি চ্যাপলিন জীবন্ত মডেল প্রিয়। এর জন্যে কম হ্যাপা সামলাতেও হয় না।

--- কী রকম?

--- একবার ঝাড়খণ্ডে গিয়েছি এক শিল্পপতির বাড়ি এক জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। চার্লি চ্যাপলিনের জীবন্ত মডেল। অপলক চোখে তাকিয়ে। হঠাৎ পশ্চাৎ দেশে বিষম জ্বালা। এক বদমাশ বাচ্চা কোথা থেকে এক উলের কাটা নিয়ে এসে পেছনে খোঁচাচ্ছে। আমি চিল্লিয়ে উঠি। তারপর বড়রা সেই বাচ্চাকে পাকড়াও করবার পর নিস্তার, নিজেই এই বলে হাসতে লাগলেন। তবে খুব আদর যত্ন করেছিলেন । তিনদিন ছিলাম। তিনদিন ধরে অনুষ্ঠান। পাঁচ হাজার টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলাম খাওয়া-দাওয়া আর যাতায়াত খরচ বাদে।

--- তাহলে লোচনবাবু (নাম পরিবর্তিত) এই পেশার তাগিদে রাজ্যের বাইরেও যেতে হয় ঘনঘন?

-- হাঁ দাদা। পেট আর সংসার-ই তো মানুষকে পরিযায়ী করে তোলে। যোগব্যায়াম নিয়মিত করতে হয় দাদা এ পেশায়। মাংসপেশীর নড়াচড়া চলবে না। অনেক ভালবাসা না থাকলে এ পেশায় আসা যায় না।

--- এই করোনা লক- ডাউন আপনাদের পেশাতেও নিশ্চয় আঘাত এনেছে?

---- দাদা থাক সেই দুঃখের কথা। আমি পেছন ফিরে দেখি না।এমনিতেই সারা বছর এই পেশা থেকে ঘর-সংসার চলে না। শো করে যখন ঘরে ফিরি, মনে থাকে এক অনাবিল আনন্দ। ছোটদের আনন্দ মুখর মুখগুলো যেমন মনে পড়ে, তেমনি বড়দের ঐ গম্ভীর মুখগুলোতে আনন্দ অনুষ্ঠানের মাঝে এক চিলতে হাসি ছড়িয়ে পড়লেই আমি খুশী। ওটাই বড় পাওয়া। বড়রা যখন ছোট হয়ে ওঠে তখনই তো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে খুশীর আলো। ওতেই খুশী আমি। রাত গভীরে যখন মেকআপ তুলে এই আজকের ওয়েলকাম জীবন্ত মডেল বা কখনও নবাব শাহ্জাদা থেকে একটু একটু করে আমার নিজস্ব জগতে ফিরে আসি, আমি শ্রী লোচন ভৌমিক হয়ে উঠি, তখন পেশার থেকেও বেশি হিসেব করি ঐ শিল্পী জীবন--- আপনাদের কতটুকু মনোরঞ্জন করতে পারলাম।

শান্তিপুরের বিয়েবাড়ি সেরে আমিও গভীর রাতে বাড়ি ফিরে আসি। আমার বিয়েবাড়ির সেরা পাওনা এই জীবন্ত মডেল মনে ভেসে উঠতে থাকে। এক মডেল নয়, এক জীবন্ত শিল্পী আমার কানে-কানে কথা বলে গেল যেন।

মন তুইতো বড় বিবাগী, মন ফিরে চলে তাই ভাটির টানে।
------
ফটো- ১) জীবন্ত মডেল দাঁড়িয়ে স্থির।
           ২) ওয়েলকাম লাইভ-স্ট্যাচু
            ৩) লাইভ মডেলের সাথে একটুকরো আমি।জীবনে পরশ লেগে থাক।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇


আরও পড়ুন


Post a Comment

0 Comments