জ্বলদর্চি

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান -১৬/ অনিন্দ্যসুন্দর পাল

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান
(Ancient India, History & Science)
অনিন্দ্যসুন্দর পাল
অলংকরণ- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য

ষষ্ঠদশ পর্ব- "সাহিত্য ৫"

গত পর্ব পর্যন্ত এই সাহিত্য পর্যায়ে মহাভারতের বিভিন্ন চরিত্রগুলোকে নিয়ে আলোচনা রাখার চেষ্টা করেছিলাম, আমি মনে করি মহাভারত নিয়ে আলোচনা কোনোদিনই শেষ হওয়ার নয়, সে যতই দীর্ঘ পরিসর হোক না কেন। যদিও এটি ধারাবাহিক, তা সত্ত্বেও আমার ধারনা পাঠকদের কাছে যদি প্রতিটি পর্ব জুড়ে একই বিষয় নিয়ে আলোচনা বা ব্যাখ্যা চালালে থাকি, তাহলে তারা কিঞ্চিৎ বিরক্ত অনুভব করবে বই-কি! তাই লেখাটি যাতে একঘেয়েমির পর্যায়ে পৌঁছে না যায় সে দিকে একটু নজর রাখতেই হচ্ছে, বাধ্য হয়ে। এক্ষেত্রে আমি মন স্থির করেছি এই পর্বে একটু অন্য দিকে নজর রাখব। কারণ, একটা বিষয় সম্পর্কে আমরা কেউই অজ্ঞাত নই যে, প্রাচীন সাহিত্য শুধু মহাভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত নয়, এখানে আরো অনেক কাব্যসাহিত্য, মহাভারত ও রামায়ণের দৃষ্টিকোণ ও অন্যান্য আরো রচনা সমূহ বিদ্যমান। এই প্রসঙ্গক্রমে এইবার ভূমিকা ছেড়ে সরাসরি আলোচনায় আসা যাক।

  তবে, আলোচনার শুরুতে, একটু জানিয়ে রাখি, মহাভারত বা রামায়ণ সম্পর্কে এইটুকু না জানিয়ে শেষ করলে শেষ পাতে আঙ্গুলি চাটন বিষয়টি অক্ষুণ্ন রয়ে যাবে। যাকে বলা যায় "শেষ হয়েও যেন হইলো না শেষ" ধরণের কিছু একটা। যাইহোক, আদি পর্বে অণুক্রমণিকাধ্যায়ে ভারত সংহিতার চব্বিশ হাজার শ্লোক রচিত থাকলেও তা পরবর্তীতে বা বর্তমানে এক বিরাট আকার লাভ করে। কিন্তু, বর্তমানে মহাভারতে প্রায় এক লক্ষেরও বেশি শ্লোকের দেখা মেলে। এটা জেনে রাখা জরুরি, রামায়ণ ও মহাভারত এই দুই কাব্য যে শুধু ভারতবাসী তথা পাঠক বা পাঠিকাকে আনন্দ দিয়েছেই নয় কবিদেরও কলমেও অসীম শক্তি সঞ্চার ঘটিয়েছে। যার ফলহেতু, কালিদাসের রঘুবংশ ও শকুন্তলা, ভবভূতির উত্তর রামচরিত, ভারবির কিরাতার্জুন , মাঘের শিশুপাল বধ ও শ্রীহর্ষের নৈষদ চরিত প্রভৃতি কাব্য একপ্রকার সংস্কৃত সাহিত্যের শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার। তবে নাটক হিসাবে শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক ব্যতীত তেমন কোনো নাটক, উপরিউল্লেখিত কাব্য ছাড়া আর কোনো কাব্য, গ্রন্থ নিজের কোনো স্বতন্ত্র অধিকার দখল রাখতে পারে নি সংস্কৃত সাহিত্যে।

  রামায়ণ ও মহাভারত প্রাগবৌদ্ধ যুগের রচনা ও তন্মধ্যে রামায়ণই অধিক প্রাচীনতর। পিপার বাল্মীকিকে বৌদ্ধের সমসাময়িক অনেক কথা বললেও, ম্যাকডোনেল তার সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে না না যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করেছিলেন রামায়ণ প্রাগবৌদ্ধ যুগের। এছাড়াও পাণিনির ব্যাকরণে যুধিষ্ঠির, বিদুর প্রভৃতি শব্দের ও মহাভারতের উল্লেখ মেলে। রামকৃষ্ণ ভান্ডারের মতে পাণিনি যেহেতু খ্রীস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর লোক, তাই মহাভারত তারও আগের ও এমনকি গীতাও এই মহাভারতের অংশ। জানিয়ে রাখা ভালো গীতা খ্রীস্টপূর্ব নবম শতাব্দীতে রচিত। অতএব, মহাভারত যে প্রাগবৌদ্ধ যুগের এই বিষয়ে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইলো না।
  রামায়ণ ও মহাভারতের পরবর্তীতে সংস্কৃত সাহিত্যে ভাসের নাটকসমূহ বেশ প্রাচীন। বিংশ শতাব্দীতে প্রথমভাগে গণপতি শাস্ত্রীর প্রতিজ্ঞাযৌগন্ধরায়ণ, চারুদত্ত, স্বপ্নবাসবদত্তা, প্রতিমা প্রভৃতি তেরোখানা ভাসের নাটক আবিষ্কার করেন। গণপতি শাস্ত্রীর মতে ভাস কৌটিল্যের পরবর্তী, ও তিলকের মতে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতাব্দীর পরে নয়। এছাড়াও ফণিভূষণ তর্কবাগীশের মতে অন্ততঃ খ্রিস্টপূর্ববর্তী সুপ্রাচীন। তবে, এই উপরিক্ত সমস্ত নাটক ভাসের রচনা কিনা তা নিয়ে বেশ মতো পার্থক্য রয়েছে।

  ভাসের নাটকের ভাষা অনেক সরল প্রাঞ্জল, জটিলতা অনেক কম। কালিদাসের কাব্যশক্তি ও শূদ্রকের রসবোধের যে সমাহারের দেখা মেলে টা হয়ত ভাসের লেখায় পাওয়া যায় না, কিন্তু এরপরও অনেকের বিশ্বাস ওনার রচনায় সামাজিক ও বহিঃপ্রকৃতির জটিলতা না মেলায় তা সর্বসাধারণের কাছে অনেক বেশি সহজবোধ্য ও জনপ্রিয় হয়েছে বলেই মনে করা হয়। ভাসের নাটকসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ স্বপ্নবাসবদত্তার উপর দৃষ্টিপাত রাখলেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়। বৎসরাজ উদয়ন, ও তাঁর স্ত্রী অর্বস্তী রাজকন্যা বাসবদত্তা, এই দুই নায়ক নায়িকার মধ্যবর্তী প্রেম বিরহ ভালোবাসার যে প্রগাঢ় দিকটি নানা ভাবে বর্ণিত করেছেন টা একপ্রকার নিপুণ হস্তের পরিচয়। যদিও নাটকটি একেবারেই ত্রুটি শূন্য নয়। এতদপরেও কবির আক্ষরিক উদ্দেশ্য সাধন সার্থক বলা যায়।

  তবে, স্বপ্নবাসবদত্তা নিয়ে আলোচনা না রাখলেও চারুদত্ত নাটক নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। এই চারুদত্ত অবলম্বনেই সংস্কৃত সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নাটক মৃচ্ছকটিক রচিত। শুধু একথা বললে আমার বিশ্বাস ভাসের প্রতি অবিচার নয় অন্যায় পর্যন্ত করা হবে। চারুদত্তের নাটকটি অসম্পূর্ণ, মাত্র চারটি অঙ্কে সমাপ্ত। তবে যদি মৃচ্ছকটিকের সাথে মিলিয়ে দেখা হয়, বোঝা যাবে দুটোরই বিষয় বস্তু শুধু এক তা নয়, মৃচ্ছকটিকের বিষয়ভাবনা চারুদত্তের ওই চার অঙ্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এমন কি ভাষা ও উপভাষার মিলও আশ্চর্যজনক। এই কারণেই বহু পন্ডিত দাবি করেন দুটি নাটকই বোধ হয় একজনেরই রচিত। এই কারণেই হয়ত বোধ করি কালিদাস ভাসকে খ্যাতিনামা নাট্যকার বলেছেন।
( ক্রমশ...)

পেজ- এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments