জ্বলদর্চি

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান - ১৮/ অনিন্দ্যসুন্দর পাল

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান
(Ancient India, History & Science)
অনিন্দ্যসুন্দর পাল
অলংকরণ- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য

"অষ্টাদশ পর্ব- "সাহিত্য ৭"

অশ্বঘোষের পর ভারতবর্ষে শুরু হয় সাহিত্যের সুবর্ণ যুগ। এই পঞ্চম থেকে অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত অধিকাংশ সময়টাই গুপ্ত ঘেঁষা। মহাকবি কালিদাস, বিখ্যাত নাট্যকার ভারবি, শূদ্রক, ভর্তৃহরি, ভবভূতি, বানভট্ট প্রভৃতি কবি এই সুবর্ণযুগেরই। কালিদাস নাটক থেকে শুরু করে কাব্য, এমনকি গীতিকাব্যতেও তার বিস্তৃতি এতটাই মসৃণ ও সরল ছিল যে তাঁকে শুধু এই যুগের নয় সমস্ত সংস্কৃত সাহিত্যে কালিদাসই একমাত্র শ্রেষ্ঠ কবি। শুধু ভারতবর্ষের প্রান্তে না, সমগ্র বিশ্ব সাহিত্যে কালিদাসের স্থান ভীষণ উচ্চ। বর্তমানে যদি শ্রেষ্ঠ কবিদের তালিকার দিকে নজর রাখা যায় তবে বুঝব শুধু সমগ্র বিশ্বে নয় সমস্ত বিশ্বসাহিত্যে কালিদাস তাঁদের অন্যতম। বলা হয় রবীন্দ্রনাথের আগে একমাত্র কালিদাসই জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যাঁর শ্রেষ্ঠত্বের কাছে কবি তো দূর, এমনকি সমকক্ষ কবিও কেউ জন্মগ্রহণ করেন নি। যাঁর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সেইকথার প্রমান মেলে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষায়-
"সর্ব্বোৎকৃষ্ট নাটক, সর্ব্বোৎকৃষ্ট মহাকাব্য, সর্বোৎকৃষ্ট খন্ডকাব্য লিখিয়া গিয়েছেন। ।কোন দেশের কোন কবিই কালিদাসের ন্যায় সর্ববিষয়ে সমান সৌভাগ্যশালী ছিলেন না, এরূপ নির্দ্দেশ করিলে বোধ হয় অত্যুক্তিদোষে দূষিত হইতে হয় না।"
কিন্তু দুঃখের বিষয় কালিদাসের জন্মস্থান বা কাল এখনও পর্যন্ত নির্ণীত হয়নি। অধিকাংশ পন্ডিতের মতে কালিদাস পঞ্চম শতাব্দীর লোক ও হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে তাঁর জন্মস্থান মালবের অন্তর্গত মন্দ্সর। তবে কালিদাস নিজ ধর্মমত হিসাবে যে শৈব ছিলেন তা তাঁর লেখা দেখলে বা পড়লেই বোঝা যায়। তাঁর রচিত গ্রন্থই তার প্রমাণ দেয়। উল্লেখযোগ্য মালবিকাগ্নিমিত্র, শকুন্তলা ও বিক্রমোর্বশী, তাঁর এই তিনটি নাটকের মঙ্গলাচরণে শিবের মহিমা বিবৃত আছে।
   কালিদাসের উপরিক্ত তিনখানি নাটক, কুমারসম্ভব ও রঘুবংশ নামক দুইখানি কাব্য, মেঘদূত নামক গীতিকাব্য, ও ঋতুসংহার সবকটি গ্রন্থেরই রচয়িতা। এরপরও নলোদয়, শৃঙ্গারতিলক , শৃঙ্গারাষ্টক, দ্বাত্রি‍ংশৎ পুত্তলিকা ও শ্রুতবোধ এইগুলিও কালিদাসের লিখিত বলেই ধারণা করা হয়। তবে অনেকের মতে শেষোক্ত গ্রন্থগুলো কালিদাসের রচিত না। এতদপরেও রাজেন্দ্র বিদ্যাভূষণ কালিদাসের কাব্য সম্বন্ধে লিখেছেন-
   "মহাকবি কালিদাসের অমৃতময়ী কাব্যাবলীর প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে দেখিতে পাই পৃথিবীর মধ্যে যাহা সুন্দর, হৃদয়ের উন্মাদকর, অপাপবিদ্ধ, প্রকান্ড, যাহা বিরাট, অনুপম, তাহাই কালিদাসের কাব্যের উপজীব্য বা জীবন। যাহা অসুন্দর-নীচ, তাহা তিনি স্পর্শ করেন নাই। তাঁহার উন্মাদিনী কল্পনা স্বর্গের অলকা হইতে মর্ত্যের-ভারতের তথা তাহার নিজের বড় আদরের উজ্জয়িনী পর্যন্ত জুড়িয়া বসিয়া আছে। অল্প কথায় সুন্দর পদার্থ-প্রকান্ড পদার্থ বর্নন করিবার- সম্পূর্ণরূপে বিচিত্র করিবার এবং সেই বিচিত্র মুর্ত্তিতে দর্শকগণের মনপ্রাণ, বাহু অভ্যন্তর,-বিমোহিত ও পরিপূরিত করিবার ক্ষমতা কালিদাসের তুল্য অন্য কোনো কবির ছিল না। কালিদাসের এই সার্থকতার- এই সাফল্যের নিদান হইল-যাহার মাত্রাজ্ঞান নৈপুণ্য ও পরহৃদয় জ্ঞান নৈপুণ্য।"

   তবে কালিদাসের নাটকের মধ্যে শকুন্তলাই শ্রেষ্ঠ। ইউরোপের কবি-কুলগুরু গেটে শকুন্তলা সম্বন্ধে লিখছেন-
   "কেউ যদি তরুণ বৎসরের ফুল ও পরিণত বৎসরের ফল, যা আকৃষ্ট করে ও বিমোহিত করে, যা ক্ষুধার নিবৃত্তি ও পুষ্টিসাধন করে, এবং স্বর্গ ও মর্ত্য একত্রে দেখতে চায় তবে শকুন্তলায় তা পাবে।"
এই কটা কথার মধ্যে দিয়ে গেটে শকুন্তলা নাটকটির বর্ণনা দিয়েছেন। মনে রাখতে হবে সংস্কৃত সাহিত্যের একটি বিশেষত্ব বহিঃপ্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ পরিস্ফুট করে তোলা। যা ভীষণ ভাবে সুস্পষ্ট বাল্মীকির রামায়ণে, মহাভারতের নলোপাখ্যানে, ভাসের নাটকে, ও অশ্বঘোষের বুদ্ধ-চরিতে। কিন্তু অনেকের অভিমত কালিদাসের শকুন্তলাতেই যে সর্বাধিক পরিপূর্ণতা লাভ করেছে তা তাঁর লেখনী পড়লেই বোঝা যায়, তবে এখানে ওনার শ্লোক উদ্ধৃত করে কাব্যপ্রতিভার প্রমাণ দিচ্ছি না, তার থেকেও বড় দুশ্চিন্তার বিষয় এই কোন শ্লোক ছেড়ে কোন শ্লোক উল্লেখ করব, যেটাই এড়িয়ে যাব সেটাতেই কালিদাসের প্রতি অন্যায় হবে।

   প্রসঙ্গত, মনে পড়ে গেল, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রাচীন সাহিত্যের শকুন্তলা নামক এক প্রবন্ধে লিখেছেন-
   "অভিজ্ঞান শকুন্তলা নাটকে অনসূয়া-প্রিয়ংবদা যেমন, কন্ব যেমন, দুষ্মন্ত যেমন, তপাবন প্রকৃতিও তেমনি একজন বিশেষ পাত্র। এই মূক প্রকৃতিকে কোনো কোনো নাটকের ভিতরে যে এমন প্রধান- এমন অত্যাবশ্যক স্থান দেওয়া যাইতে পারে, তাহা বোধ করি সংস্কৃত সাহিত্য ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় নাই।"
ইংরেজ পন্ডিত উইলিয়ম জোন্স কালিদাসকে ষোড়শ শতাব্দীর সু-প্রসিদ্ধ ইংরেজ নাট্যকার শেক্সপিয়ারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। শেক্সপিয়ারের 'As you like it' নাটকে বহিঃপ্রকৃতির খুব উচ্চ স্থান দেওয়া হয়েছে কিন্তু সেখানেও মূকপ্রকৃতি নাটকের মুখ্য হয়ে ওঠে নি। আবার অনেকে শকুন্তলাকে শেক্সপিয়ারের 'Tempest' নাটকের সাথে তুলনা করেছেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর প্রবন্ধে tempest এর সঙ্গে তুলনা টেনে শকুন্তলা নাটকের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ রেখেছেন। তাঁর ভাষায়-
   "শকুন্তলার মতো এমন প্রশান্ত গম্ভীর এমন সংযত সম্পূর্ণ নাটক শেক্সপিয়ারের নাট্যাবলীর মধ্যে একখানিও নাই।"
   এই লেখা পড়ে আমার ধারণা অনেকে শকুন্তলা পড়তে ইচ্ছুক ও অভীপ্সা প্রকাশ করবেন, তাই সবার মতো আমরাও একই মত, কোন আম কতটা মিষ্টি সেটা নিজে মুখে খেয়ে দেখলে বেশি স্পষ্ট হয় তাই সবার মতো আমিও প্রত্যেক কৌতূহলী পাঠককে কালিদাসের শকুন্তলার পাশাপাশি রবিঠাকুরের শকুন্তলা প্রবন্ধটি পড়তে অনুরোধ জানাচ্ছি। প্রঙ্গত, একদিকে যেমন পদ্মপুরাণের শকুন্তলার উপাখ্যান কালিদাসের রচনা অবলম্বনেই রচিত, আবার অন্যদিকে জানিয়ে রাখা ভালো শকুন্তলা নাটকের মূল ঘটনা মহাভারতের। কিন্তু কবি অনেক স্থানে পরিবর্তন এনে নাটককে কাব্যাংশে শ্রেষ্ঠই করছেন, একথাও সত্য।
(ক্রমশ........)

পেজ-এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 
.

Post a Comment

1 Comments