জ্বলদর্চি

পার্শিবাগান কবিতাগুচ্ছ/ যশোধরা রায়চৌধুরী

পার্শিবাগান কবিতাগুচ্ছ
যশোধরা রায়চৌধুরী


স্খলিত শব্দের মত বাক্যের ভেতরে ফাঁক জমা হল। মামার হারমোনিয়াম ছিল, দোলের রঙে চোবানো, গোলাপি ছোপানো। তার  থেকে খুলে নেওয়া ভাঙা  রিড যেন অথবা কাকার সেই টাইপরাইটার, যার একটা আধটা আঙুল জখম। 'পি' কাজ করেনা আর 'এস' কাজ করেনা, ফলত, 'পি' এর বদলে আমরা ব্র্যাকেট চিহ্নের আশ্রয় নিই। 'এসে'র বদলে আসে ডলার চিহ্নেরা।

সাদা কাগজের বুকে ঝরে পড়ে খটখট অক্ষরপ্রবণ ধাতুমুখরতা। আর, 
খাটের নিচের থেকে হারমোনিয়াম টেনে  মামা একদিন বসে গেল 
আলি আকবরজির মেধাবী বাজাতে। 

পার্শিবাগানের এক কোণা থেকে অন্য কোণায় শুধু রোদ বেঁকে যাবে
ট্যারচা আলোর দাগ কোণাকুণি পড়ে আছে , আর 
দলা মোচড়ানো কাগজের স্তূপে হস্তরেখাবিশারদ রয়েছে নিরত। 

চশমার কাচ শুধু স্ক্র্যাচে স্ক্র্যাচে ভরা। 

এদিকে গাছের টবে শুকনো গাছ। ওদিকে একাকী এক ছেঁড়া গামছার লাল আভা। 

একদিন প্রতি উচ্চারণ থেকে ফাঁক জন্ম নেবে। 
দাঁতের ভেতরে যেইমত
ক্ষয় জন্ম নেয়, আর ব্যথা। 

একদিন টের পাব আমার নতুন করে ফ্রলিকা বুলিয়ে আঁকা চতুর পোশাকে
মায়ের আলপনা হাত ঢুকে গেছে, আর

প্রতিটি লেখার মধ্যে মৃদু অক্ষরের ফাঁক, গোল্লাছুটে লাফ দিয়ে দিয়ে চলে যাওয়াটি রয়েছে। 


নস্টালজিয়ার কাছে সমস্ত পৃথিবী হেরে যায়। 
অথচ বর্তমানে বসে বসে আমরা আসলে
অতীত চারণা করি। প্রতিদিন বর্তমান ঘটমান মুহূর্তেরা আসলে সতত
হারানো মুহূর্তের জন্য এক কাতরতা আনে। 

সুতরাং বর্তমান মানেই গোটানো সেই খবরকাগজ
ট্যাক্সিওয়ালার নিজ প্রিয় চৌখুপিতে
পলাতক প্রেমিকা ও লোকনাথ বাবার ভেতরে
হলুদ টিনের তেতে ওঠা গাড়িটির বডি ব্যেপে
আস্তে আস্তে গড়ে ওঠা পৃথিবীর খোঁজ  আপাতত নিই। 

এই মুহূর্তেই যেন হারানো সততা
হারানো সময় , কাতরতা তারই, ক্ষয়ের ভেতরে
প্রতিদিন আলো ফেলে দেখা, যেন টর্চ মেরে মেরে
দেখেছ দেরাজে কোন লাল সালুবাঁধা
পুরনো টাকার গোছ আছে কিনা। বৃথা নষ্ট দিন
কুকুরের কুন্ডুলি পাকানো আর খোকাদের রুটি ছুঁড়ে দেওয়া
সবকিছু আছে কিনা কেবলই দেখেছ। 


তীব্র আর্তনাদ বাজল। ছুটে গেলে। দেখলে তখন
তোমার ও বাড়ির মধ্যে লম্বাটে ফাটলে
গড়িয়ে পড়েছে কার উইলচেয়ার, কার যেন এক পাটি মোজা
গড়িয়ে পড়েছে এক লুডোবোর্ড, ডিকশনরি, ক্যালেন্ডার, ঘটি

সব হারানোর মধ্যে জেগে আছে শুধু একখানি ফোন, বালকভোলানো।

এই ফোনে ধরে রাখ পার্শিবাগান।
প্রতিটি অক্ষরে আজ অভ্র ফেটে ফেটে
কান্না এসে বসে... আর পরিবারতন্ত্র জমে ওঠে।
বংশলতিকা থেকে ছড়ায় লতার মত প্রতিদিন নানা আকর্ষেরা...

চশমা মুছে মুছে আজ খয়েরি র‍্যাপারগুলি ভিজে ঢোল... মামার দুহাতে
এখনো প্রাচীন সব গান যেন হারমোনিয়ামের ভাঁজে বেজে ওঠে
তুমি শুধু প্রাণপণে বেলো করতে থাক... 
দুই ফুসফুসে হাওয়া ভরে দাও,  পার্শিবাগানের...

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 
গুচ্ছ কবিতা / শ্যামলকান্তি দাশ 

Post a Comment

3 Comments

  1. যশোধরা, খুব ভালো লাগল এই কবিতাগুলো।

    ReplyDelete
  2. অন্যরকম লেখা। একটুকরো সময় উঠে এলো। ভালো লাগলো।

    ReplyDelete