জ্বলদর্চি

একটি সত্যি প্রেমের গল্প : পল ডিরাক ও মার্গিট উইগনার/পূর্ণ চন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ১২

একটি সত্যি প্রেমের গল্প : পল ডিরাক ও মার্গিট উইগনার

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


চোদ্দোই ফেব্রুয়ারি! ভ্যালেন্টাইনস ডে। রোমান্টিক প্রেমের দিন। আদম আর ইভ-এর খাঁটি প্রেমের ন্যায়। যদিও সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ছিলেন একজন খ্রিস্টান পাদ্রী এবং চিকিৎসক। কথিত আছে―একবার এক দৃষ্টিহীন মহিলার দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এমন অলৌকিক ঘটনায় তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই। শুধু একজন খুশি নন। তিনি রোম-সম্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস। দৃষ্টিহীনের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়ার পুরস্কার স্বরূপ ক্রুদ্ধ ক্রাডিয়াস সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে প্রথমে বন্দি এবং পরে চরমদণ্ড― মৃত্যু প্রদান করেন। ২৬৯ খ্রিস্টাব্দে। ধর্ম যাজকের অপরাধ? রোমে খ্রিস্টান ধর্ম নিষিদ্ধ তখন। অথচ তার পৃষ্ঠপোষকতায় উপকৃত কি-না এক রোমান মহিলা! এর পরিণতি সেন্ট-এর মৃত্যু। ৪৯৬ সাল থেকে প্রতি বছর তাঁর মৃত্যুদিনই 'সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে" হিসাবে পালিত হচ্ছে। ঐতিহাসিক এই দিনটি আত্মবলিদানের এক করুণ দলিল। অবশ্য বর্তমানে দিনটি বিশুদ্ধ প্রেমের দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে। তেমনই এক অকৃত্রিম ভালোবাসার টানে আবদ্ধ হলেন তিরিশোর্ধ্ব পল ডিরাক, কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানী। 
         
   ভারী অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ অত্যন্ত মেধাবী এই পল ডিরাক (১৯০২―১৯৮৪)। বয়েস তিরিশের ঊর্ধ্বে; অথচ মা আর ছোট বোন ব্যতীত তৃতীয় কোনও মহিলার সঙ্গে বাক্যালাপ আজ পর্যন্ত করেননি। সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন যান্ত্রিক এক লোক। নিজস্ব ক্ষুদ্র জগতের মধ্যেই তাঁর বিশাল পরিব্যাপ্তি। এক কথায়, সায়েন্টিফিক জিনিয়াস! এর চৌহদ্দির বাইরে 'বিগ জিরো'। মায়া-মমতা-আবেগ কিছুই নেই। সম্পর্কের গভীরতা তাঁর হৃদয় স্পর্শ করে না। সুখ-দুঃখ-আনন্দ-রাগ-বিরহ-অভিমান, এমনকি মৃত্যুতে কীভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে হয় জানেন না। নিজের দাদা ফেলিক্স-এর অকাল মৃত্যুতে মা-বাবা-বোন অঝোরে কেঁদে ভাসালেও তাঁর চোখে একফোঁটা জল নেই। শুধু একটু শূন্যতা অনুভব করেছিলেন, এই যা! পার্থিব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সেন্টিমেন্টের ঊর্ধ্বে তিনি বিরাজমান। সমাজে নীরব তাঁর ভূমিকা। তাঁর এই ভাবলেশহীন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ফিজিক্স। পিএইচডি'র পূর্বে গোটা দশেক থিসিস প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। তরুণ বয়সে রীতিমতো বিখ্যাত তিনি। বিখ্যাত বিজ্ঞানী হিসাবে। মাত্র আঠাশ বছর বয়সে রয়্যাল সোসাইটির ফেলো। একত্রিশ বছর বয়সে ফিজিক্সে নোবেল। ফেলো নির্বাচনের সংবাদ পর্যন্ত দেননি বাড়ির লোকেদের। টিভির খবর দেখে তাঁর মায়ের নজরে পড়ে ছেলে এফ আর এস (FRS) হয়েছে। অথচ আনন্দের জন্য নয়; গবেষণা করা-ই নাকি তা‌ঁর কাজ! জীবনের অঙ্গ। বেঁচে থাকার একমাত্র পন্থা, প্রাত্যহিক অবলম্বন। জীবনে কখনও দুটো কাজ একসঙ্গে করেননি। যেমন ধরুন, 'হাঁটা'র সময় 'কথা বলা'। 'অপেরা' দেখবার সময় 'কেশে ফেলা' বা বাদাম ভাজা খাওয়া। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ ও হেমন্ত সব ঋতুতে তাঁর একই পোশাক। না ছেঁড়া পর্যন্ত দ্বিতীয় কোট কিনবেন না। নিস্তব্ধতা তাঁর খুব পছন্দের। হইচই তীব্র না-পসন্দ। নোবেল, বক্তৃতা, পার্টি―এই হইচই হবার জ্বালায় ঠিক করেছিলেন প্রত্যাখ্যান করবেন নোবেল পুরস্কার। 

   তা শুনে কেমব্রিজে তাঁর ডক্টরেট-গুরু ফাউলার-এর শ্বশুর মশায় লর্ড রাদারফোর্ড বললেন, 'নোবেল পুরস্কার বর্জন করলে তোমাকে নিয়ে প্রতিবছর হইচই হবে। আর গ্রহণ করলে জীবনে একবারই হইচই-এর সম্মুখীন হতে হবে। কী করবে, ভেবে দেখো!' হক কথা। সঠিক যুক্তি! এ কথা শুনে নোবেল বর্জনের বাসনা মন থেকে ত্যাগ করলেন ডিরাক। আসলে মনুষ্য সংসর্গ বর্জিত জীবন কাটানোতেই তাঁর বেশি আনন্দ। হাঁটতে হাঁটতে বড় গাছ দেখলে তাতে উঠে পড়েন। প্যান্ট-কোট পরে। গাছে চড়া তাঁর বরাবরের অভ্যেস। পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সংস্পর্শহীন এমন 'খাড়ুস' মানুষও প্রেমে পড়েন! মেনকা, উর্বশী প্রভৃতি অপ্সরার মতো কঠোর তপস্যায় ভালোবাসার কুম্ভকর্ণের ঘুম ভেঙে জেগে উঠেন পল ডিরাক! প্রেমের বাঁধনে আবদ্ধ হন। তবে হাবুডুবু খাওয়া প্রেম নয়; যেন আবেগশূন্য ভালোবাসা এবং পরে সম্পর্কের গভীরে গ্রথিত হওয়া। আশ্চর্য সেই প্রেমের গল্প তুলে ধরব ভ্যালেন্টাইনস প্রেম-পরবে। 

   ফিজিক্স স্টুডেন্টদের কাছে পল ডিরাক এক সুপরিচিত নাম। ফার্মি-ডিরাক সংখ্যায়ন এবং রিলেটিভিস্টিক কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এ 'ডিরাক সমীকরণ'-সহ একগুচ্ছ আবিষ্কার তাঁর ঝুলিতে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় 'ব্রা' এবং 'কেট' অপেক্ষকের অন্তর্ভুক্তি তাঁর অবদান। এ হেন ডিরাক ১৯৩২-এ কেমব্রিজে এলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান অধ্যাপক হয়ে। একসময় যে পদ অলংকৃত করতেন বিখ্যাত গণিতজ্ঞ আইজাক নিউটন। ক'মাস পরে সেপ্টেম্বর মাসে তিনি পাড়ি জমান প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি। এবার অতিথি অধ্যাপক। সেখানে পরিচয় হল ইউজিন উইগনার-এর সঙ্গে। হাঙ্গেরিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী। পরিচয় বন্ধুত্বে পরিনত হল। কোথায় ভালো খাবার পাওয়া যায়, বিদেশ বিভুঁই-এ কী করা উচিৎ, কোথায় যাওয়া উচিত― প্রভৃতি বিষয়ে বন্ধুকে গাইড করতেন উইগনার। হাঙ্গেরিয়ান উইগনার স্বদেশীয় লিও ৎজেলার্ড এবং এডওয়ার্ড টেলার (হাইড্রোজেন বোমার আবিষ্কারক)-এরও অন্তরঙ্গ বন্ধু।

   ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের সন্নিকটে টাউন সেন্টারে রয়েছে নাম-করা রেস্টুরেন্ট 'Annex Restaurant'। ক্যাম্পাস থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটা পথ। উইগনার তথ্য দিয়েছে। একদিন লাঞ্চ সারতে সেখানে উপস্থিত হলেন ডিরাক। রেস্টুরেন্টের দরজা ঠেলে যেই ভেতরে ঢুকেছেন, অমনি একটা দমকা হাসির শব্দ কানে এল। তিনি ভালো করে লক্ষ্য করলেন শব্দের উৎস দূরে কোনের একটি টেবিল। এক যুবতী মহিলা খিলখিলিয়ে হাসছেন। টেবিলের উল্টোদিকে চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে এক যুবক। ছেলেটি খুব চেনা। ইউজিন উইগনার। উইগনার পেছন ফিরে বসে আছেন। তাই বন্ধুকে দেখতে পাচ্ছে না। মহিলার মুখোমুখি ডিরাক খানিকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। 
'লোকটা অদ্ভুত না?'―মহিলা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
'কে? কোন লোকটা?'― উইগনারের প্রতি প্রশ্ন। 
'পেছনে দেখ। আমার দিকে কেমন হাঁ করে তাকিয়ে আছে!'
   পেছন ফেরে উইগনার। দেখতে পায় ডিরাক দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। ইতস্তত বোধ করছে। 
'কাকে কী বলছিস? ইনি পল ডিরাক। গতবছর নোবেল পেয়েছেন। আমাদের ভিজিটিং প্রফেসর।'
'হায়, প্রফেসর ডিরাক, আমাদের টেবিলে চলে আসুন'― হাত নেড়ে বন্ধুকে ডাক দেয় উইগনার। উইগনারের পাশের চেয়ারে মহিলার মুখোমুখি বসল ডিরাক।
   'আমার ছোট বোন মার্গিট। বুদাপেস্টে থাকে। আমার কাছে বেড়াতে এসেছে'― পরিচয় করিয়ে দেয় উইগনার। যথারীতি চুপচাপ ডিরাক। পরনে দীর্ঘদিনের পুরনো কোট। উস্কোখুস্কো চুল। অগোছালো। ঢিলেঢালা। পোশাকের ছিরি দেখে মার্গিটের মনে হল, নেহাত সাদামাটা একজন বোকা ভদ্রলোক। ভদ্রতার খাতিরে নিস্তব্ধতা ভাঙল মার্গিট। অতিথিকে জিজ্ঞেস করলেন―
   'তারপর কেমন আছেন বলুন?'
  'কেন জানতে চাইছেন?'― সপাট প্রশ্ন ডিরাকের।
   এমন প্রত্যাঘাতে অপ্রস্তুত মার্গিট। খানিক হকচকিয়ে গেলেন। কী উত্তর দেবেন ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছেন না। ডিরাক লক্ষ্য করল আভিজাত্য যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে মহিলার বেশভূষা-পোশাকআশাকে, কথনে, সিগারেট টানার ভঙ্গিমায়। বেশ একটা রাজকীয় ভাব। অ্যারিস্টোক্র্যাসির চূড়ান্ত নিদর্শন। অবশ্য প্রফেসর উইগনার খুব সম্পন্ন বাড়ির বংশধর। জমিদার বললে অত্যুক্তি হয় না। অপরপক্ষে কথায় কথায় হেসে ওঠা মার্গিটের বরাবরের অভ্যেস। এতক্ষণ গুম মেরে বসে থাকবার পাত্রী সে নয়। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কতক্ষণ নীরবে বসে থাকা যায়! পলের আগমনে গুমোট পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

   'বাইরে বেশ দমকা হাওয়া আজ'― খাঁ খাঁ নীরবতা ভেঙে নিরপেক্ষ বিষয় উত্থাপন করল মার্গিট।
এমন সময় বলা নেই, কওয়া নেই; হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ডিরাক। কোনও কথা না বলে সটান বেরিয়ে গেল কক্ষ ছেড়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক মার্গিট ও উইগনার দুজনে। মার্গিট ভাবল হয়তো তার কথায় অসন্তুষ্ট হয়ে প্রফেসর বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু এ কী! তাদের ভাবনা ডাহা ফেল! তারা লক্ষ্য করল বাইরে বেরিয়ে রাস্তার ওপর দু'হাত শরীরের দুপাশে প্রসারিত করে ডিরাক কী একটা মাপতে চাইছে! যেন ঠিক 'টাইটানিক'-এর নায়ক-নায়িকার জাহাজের ডকে ঘনিষ্ঠ দৃশ্য। এখানে 'রোজ' নেই, একা 'জ্যাক'। এই যা রক্ষে! দূর থেকে স্পষ্ট দৃশ্যমান হচ্ছে না ঘটনাটা। মিনিট কয়েক পরে ভুলটা ভাঙল তাদের। ফিরে এসে চেয়ার টেনে বসে পড়ে ডিরাক। তারপর বলল, ' হ্যাঁ, বাইরে বেশ দমকা হাওয়া।' যেন আকাশ থেকে পড়ল মার্গিট। এতক্ষণে পরিস্কার বোঝা গেল ব্যাপারটা― বাইরে প্রফেসর হাওয়ার গতি মাপছিলেন দুহাত বাড়িয়ে। পণ্ডিতেরা বুঝি এমন ক্ষ্যাপাটে হয়! এতক্ষণ মার্গিটের রাগ হচ্ছিল। এবার মনে মনে হাসি পাচ্ছে তার। আর ভেতরে ভেতরে অহংকার বোধ হচ্ছে। ভাবছে চোখের সম্মুখে তার মতো সুন্দরী রমণী বসে আছে আর পণ্ডিতের ধ্যান অন্য কোথাও পড়ে। ধ্যানে মগ্ন ঋষির ঘুম ভাঙাতে মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল সে। যেমন করে হোক তার প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে পণ্ডিতকে। এটা তার চ্যালেঞ্জ।

   প্রিন্সটন ক্যাম্পাসের সন্নিকটে ভাড়া বাড়িতে একাকী থাকেন ডিরাক। কাজে ব্যস্ত উইগনার। ছোট বোনকে সময় দিতে পারছেন না। বাড়িতে বসে বসে বোর হচ্ছে মার্গিট। তার সময় কাটবে কী করে? ডিরাককে সঙ্গ দিতে শুরু করল সে। প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় ডিরাকের ডেরায় হাজির হন মার্গিট। ডিরাককে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ডিনারে। গল্গগুজব হয়। গল্পের বিষয়― বয়সে চার বছরের বড় উইগনারের অত্যাধিক মেধার কথা। নিজের মধ্যমেধার প্রসঙ্গ। কলেজের কথা। প্রেমে পড়ার গল্প। বাড়ির অমতে লাভ-ম্যারেজ। দুজন সন্তান― এক ছেলে ও এক মেয়ে। আট বছর ঘরকন্নার পরে ডিভোর্স। ছেলেমেয়ে নিয়ে দুবছর আগে বুদাপেস্টে বাপের বাড়ি চলে আসার কাহিনী। ইত্যাদি। ইত্যাদি। শেষমেশ মন ভালো করতে এখন ভাইয়ের কাছে বেড়াতে চলে আসা। সময় খুব দ্রুত বয়ে যায়। মুখচোরা ডিরাক উত্তর দেয় কম। বেশিরভাগ সময় মাথা-ঘাড় নেড়ে অভিব্যক্তি প্রকাশ করে শুধু। দুজন সম্পূর্ণ দুই বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। একজন মুখচোরা, অপ‍রজন মুখরা। প্রথমজন অন্তর্মুখী , জিনিয়াস; দ্বিতীয় বহির্মুখী, সায়েন্টিফিক জিরো। 

   এত বৈপরীত্য সত্ত্বেও মার্গিটকে ভালো লাগে ডিরাকের। কিন্তু বুঝতে পারে না, তা ভালোবাসা কিনা। মন একটু উতলা ঠিকই, তবে উৎফুল্ল নয়। বরং সামান্য দ্বিধান্বিত। মার্গিট ঠিক ধরেছেন, প্রফেসর আদপে আবেগশূন্য নিসঙ্গ লোক। একাকীত্ব তাঁর পছন্দ। এ হেন পণ্ডিতের হৃদয়ে আবেগ সঞ্চার করতে নাটক, সংগীত প্রভৃতি শিল্পকলা প্রয়োজন। শুরু হল দুজনের একসঙ্গে সিনেমা দেখা। একান্তে সময় কাটানো। সময়ও গড়গড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত। খ্রিস্টমাসের পূর্বে মার্গিট ফিরে যাবে বুদাপেস্ট। ছেলেমেয়ের কাছে। মায়ের মুখ চেয়ে বসে আছে তারা। আর ডিরাক প্ল্যান করছে ডিসেম্বরে ঠাণ্ডা থেকে মুক্তি পেতে দুসপ্তাহ কাটিয়ে আসবে ফ্লোরিডায়। সংকল্পের কথা মার্গিটকে জানায় সে। অন্য কিছুর ইঙ্গিত পায় মার্গিট। যার আশায় এতদিন ওৎ পেতে শিকারি বাঘের মতো বসে ছিল সে। তার শূন্য হৃদয়ে চাই একটা শক্ত অবলম্বন। বাকি জীবনের খড়কুটো। শক্ত আশ্রয়। এতদিন পর গড বুঝি মুখ তুলে তাকাল! স্বপ্ন সত্যি হবে এবার। বুদাপেস্ট ফেরা স্থগিত রেখে ফ্লোরিডা ছুটি কাটাতে চলে গেল দুজনে।
         
   ফ্লোরিডার উত্তর-পূর্ব উপকূলের মনোরম শহর সেন্ট অগাস্টিন। আটলান্টিক মহাসাগরের দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির কোলে প্রাচীন এক জনপদ। সমুদ্র সৈকত জুড়ে প্রশস্ত বালুচর। নিরিবিলি সময় কাটানোর পক্ষে আদর্শ জায়গা। খুব সুন্দর একটা রিসর্টে উঠলেন তারা। শিহরণ মেশানো ঘোরের মধ্যে ভালো সময় কাটছে দুজনের। জীবনের না-পাওয়া আনন্দমাখা অধ্যায়গুলো দারুণ বিদ্যুতের সঞ্চার করছে শরীরের ভেতর। কেমন করে যে দুসপ্তাহ সময় ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে গেল; দুজনের কেউই তার টের পেল না।

   ফ্লোরিডা থেকে ডিরাক ফিরলেন প্রিন্সটনে। ইউনিভার্সিটি ল্যাবে গবেষণার কাজে সদা ব্যস্ত পণ্ডিতটি। রুটিনমাফিক ঘড়ি ধরে চলছে সব কাজ। সময় মেপে গবেষণা। ১৯৩৫ সালের মধ্য-জানুয়ারিতে মার্গিট চলে আসেন ছেলেমেয়ের কাছে। বুদাপেস্টে। সেখান থেকে প্রতি সপ্তাহে চিঠি লেখেন তাঁর প্রেমিককে। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে শুধু আবেগ আর ভালোবাসার কথা। উল্টোদিকে চিঠির প্রাপকের অকপট স্বীকারোক্তি, আবেগহীন ভাষায়― 
'আমি তোমার মত এত সুন্দর করে চিঠি লিখতে পারি না। আমার অনুভূতি তোমার মতো প্রখর নয়। আমার জীবন মূলত ঘটনার উপর নির্ভরশীল, আবেগের উপর নয়।'

   ব্যাস, কেটে গেল ছন্দ, তাল। বিরহ-বেদনায় ভারাক্রান্ত প্রেমিকার হৃদয়। তার মন খারাপ হয়ে গেল। ফ্লোরিডায় কাটানো দুসপ্তাহের অন্তরঙ্গ মূহুর্তগুলো ডিরাকের কাছে স্রেফ ঘটনা! 'কেমন করে বলতে পারল ও?'― নিভৃতে চোখের জল ফেলে মার্গিট। সে ভাবল, আবেগ দিয়ে অনুভূতি প্রকাশের ক্ষমতা প্রফেসরের নেই। তাই যা করার, মার্গিটকেই দায়িত্ব নিয়ে সব করতে হবে। প্রেমিকের মনের মধ্যে প্রেমের ফিলিংস আনবার জন্য চেষ্টার কসুর করল না মার্গিট। পরের চিঠিপত্রে আরও খুঁটিনাটি বিষয় অবতারণা করতে আগ্রহী হল সে। প্রিন্সটনের ঘটনাপুঞ্জ, ডিরাকের কাজকর্ম, খাওয়াদাওয়া, শরীর, স্বাস্থ্য, সাজ-পোশাক প্রভৃতি বিষয়ে খুঁটিনাটি তথ্য জানতে চেয়ে প্রেমপত্র লেখেন তিনি। চিঠি তো নয়; যেন একগুচ্ছ প্রশ্ন সম্বলিত কোয়েশ্চেন পেপার! প্রশ্ন ধরে ধরে তার উত্তর দেন ডিরাক। কোনও প্রশ্ন চোখ এড়িয়ে গেলে পরের চিঠিতে প্রেমিকা তা ধরিয়ে দেন। আগের সব চিঠি ঘেঁটে প্রেমিক নিঃসংকোচে সিরিয়াল নম্বর উল্লেখ করে তার উত্তর জানিয়ে দেন। বড়ো অদ্ভুত তাদের প্রেমপর্ব। আটপৌরে। সেজন্য হয়তো বড্ড বেশি জীবন্ত।

   একবার মার্গিট লিখছেন― 'আমাকে ছাড়া একা একা তোমার কেমন লাগছে? তোমাকে খুব মিস করছি আমি। তুমিও কি আমাকে একইভাবে মিস করছ?'
   নিরুত্তাপ ভাষায় ডিরাকের প্রত্যুত্তর― 'আমাকে নিয়ে তোমার এত চিন্তা করার দরকার নেই। তুমি তোমার জীবন এবং তোমার পাশে যারা আছেন তাদের কথা বরং ভাবো। আমি একা একা থাকতে ভালোবাসি। মানুষের সঙ্গে যত কম মিশতে হয়, তত আমার মঙ্গল।' শুধু এই নয়, তিনি আরও লেখেন আগের চিঠিতে কী কী ইংরেজি শব্দ ও ব্যকরণে ভুল ছিল তার সবিস্তার উল্লেখ করে একটা তালিকা পাঠিয়ে দেন।
  মার্গিট যখন চিঠির ভেতর নিজের ছবি পাঠান, ছবিতে কমেন্ট করতে ভোলেন না প্রেমিক প্রবর― 'তোমার এই ছবিটা খুব একটা ভালো লাগেনি আমার। তোমার চোখগুলো কেমন বিষণ্ণ, মুখমণ্ডল ফ্যাকাসে; যা তোমার হাসিমাখা মুখের পরিপন্থী।'
  এমন যান্ত্রিক পত্র পেয়ে ভারাক্রান্ত প্রেমিকার মন। তিনি অনুযোগ করেন― 'পল, তুমি আগের চিঠির সব প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর দাওনি।'
   ব্যাস, পূর্বের সব চিঠির তাড়া খুলে যাচাই করে দেখে― আসলে কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে সে ভুলে গেছে। ছক কেটে তালিকা প্রস্তুত করে সকল প্রশ্নের উত্তর লিখে পাঠিয়ে দেয়। কষ্টের পাশাপাশি বেশ মজা উপভোগ করেন মার্গিট। তিনি লিখে পাঠান― 
'তোমাকে আরেকটা নোবেল পুরস্কার দেওয়া দরকার― নির্মমতার জন্য।'
'আমি তো বোকা একটা মেয়ে তাই তোমার মত বিখ্যাত মানুষের মনযোগ আশা করি।'
'আমি তোমার ভালোবাসা পাবার যোগ্য নই।' ইত্যাদি। ইত্যাদি।
   এদিকে প্রেমিকপ্রবর বুঝতে পারেন না এর মধ্যে কোনটা প্রশ্ন আর কোনটা অভিমান। তাঁর সোজাসাপ্টা বিস্ফোরক উত্তর― 'তোমার জানা উচিত যে আমি তোমার প্রেমে পড়িনি। যেহেতু আমি কখনও তোমার প্রেমে পড়িনি, সুতরাং প্রেমের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো আমি ঠিক ধরতে পারি না।'
এবার আকাশ থেকে পড়লেন মার্গিট! শোনো কথা― প্রফেসর প্রেমে পড়েননি? মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন― 'প্রফেসর, প্রেমে পড়া কাকে বলে তা তোমাকে বুঝিয়েই ছাড়বো আমি।'

   ইতিমধ্যে প্রিন্সটনে একবছরের অতিথি অধ্যাপকের সময়সীমা শেষ হতে চলল। ডিরাক মনস্থির করলেন রাশিয়া যাবেন; বন্ধুবর কাপিৎজাকে দেখতে। পারিবারিক কাজে রাশিয়ায় গিয়ে আর কেমব্রিজে ফিরেননি তিনি। বৈজ্ঞানিকের কোনও সংবাদ নেই। স্টালিন সরকার সম্ভবত প্রিয় বৈজ্ঞানিককে গোপন আস্তানায় নজরবন্দি করে রেখেছে। দেশের মধ্যেই। এ ভারি অন্যায়। বিজ্ঞান কেন কূটনীতির দাস বনে যাবে? বিজ্ঞান তো স্বতন্ত্র। বৈজ্ঞানিক স্বাধীন। কাপিৎজার পত্নী শ্রীমতি আনা ডিরাকের সহযোগিতা চেয়ে সংবাদ পাঠিয়েছেন। আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করে কাপিৎজাকে মুক্ত করতে চেষ্টার কসুর করছেন না ডিরাক। সেজন্য রাশিয়া যাত্রা মনস্থির করলেন তিনি।

   ১৯৩৫-এর জুনে আমেরিকা থেকে রাশিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন। জুন-জুলাই-আগস্ট; তিন মাস কাল কাটালেন সেখানে। ডিরাকের ঘোরাফেরায় এতটুকুও বাধা দিল না স্টালিন সরকার।      মানসিকভাবে ভেঙে পড়া কাপিৎজার সঙ্গে দেখা হল। কিন্তু নাহ, কাপিৎজাকে ছাড়তে অপারগ তারা। উল্টে ডিরাককে প্রশ্ন করল― 'ডিরাক মস্কোতে গবেষণা শুরু করছেন না কেন?' অবাক প্রস্তাব। ডিরাক ভাবলেন― কাকস্য পরিবেদনা। কাপিৎজাকে কোনমতেই ছাড়বে না সরকার। ভগ্ন হৃদয়ে কেমব্রিজে ফেরা ছাড়া অন্য গত্যন্তর নেই। 
       
ফিরে আসার পথে সেপ্টেম্বরে বুদাপেস্টে মার্গিটের বাড়িতে হাজির হলেন ডিরাক। যারপরনাই আনন্দিত মার্গিট। ছেলে-মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ির সন্নিকটে ভাড়া বাড়িতে থাকেন তিনি। খুব সম্ভ্রান্ত তাদের ফ্যামিলি। সবদিক থেকে প্রাচুর্য উপচে পড়ছে যেন। ক'দিন আগে সিক্স সিলিন্ডার দামি মার্সিডিজ কিনেছে মার্গিট। হইহল্লার মধ্যে নয় দিন দারুণ আনন্দে কাটল ডিরাক আর মার্গিটের। এ যেন সম্পূর্ণ নতুন ডিরাককে আবিষ্কার করলেন মার্গিট। আবেগে টইটুম্বুর। অনুভূতিতে ভরপুর। 
   কেমব্রিজে চলে আসার পর আবেগাপ্লুত একখানা রোমান্টিক চিঠি লিখলেন প্রফেসর― 'তোমার কাছ থেকে চলে আসার সময় আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। এখানে খুব মিস করছি তোমাকে। আগে কখনও কাউকে এতটা মিস করিনি আমি। আমার মনে হচ্ছে তুমি আমাকে একেবারে বদলে দিয়েছ।'
   আসলে বদলে গেছেন ডিরাক। বদলে গেছে তাঁর চিন্তাভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি। আবেগ, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ফিলিংস সঞ্চারিত হয়েছে তাঁর হৃদয়ে; এতদিন যা অনুপস্থিত ছিল তাঁর মধ্যে। নিঃসন্দেহে এ কৃতিত্বের দাবিদার মার্গিট। ইতিমধ্যে ১৯৩৬ সালের জুন মাসের পনেরো তারিখে ডিরাকের বাবা চার্লস আদ্রিয়েন লেডিসলাস ডিরাক মারা গেলেন। পিতার মৃত্যু হঠাৎ করেই মুক্তির স্বাদ এনে দিল তাকে। কারণ তাঁর পিতা ছিলেন কড়া ধাতের মানুষ। কঠোর অনুশাসনে বেঁধে রাখতেন বাড়ির সবাইকে। স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার ছিল না পরিবারের কারও। সব ডিসিশন নিতেন তিনি একাই। সে-মত চলতে হত সকলকে। এর ব্যতিক্রম কেউ নয়; না ডিরাক, না তাঁর মা ফ্লোরেন্স অথবা বোন বিয়াট্রিস ইসাবেল্লা মারগুয়েরিট। সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এ নিয়ম। নিয়মের বাইরে কেউ নয়।

   তাই পিতার মৃত্যুর পর অনাবিল মুক্তির আনন্দে ভেসে গেল বাড়ির সকলে। শোকের ছিটেফোঁটা নেই। ডিরাক পুনরায় বেড়াতে গেলেন রাশিয়ায়। সেখান থেকে ডেনমার্ক। নীলস বোর-এর প্রতিষ্ঠানে। জেনেটিক্স সংক্রান্ত একটি সেমিনারে অংশ নিতে। সেমিনারে নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেন। সবকিছুর মূলে নাকি 'জিন'! পিতামাতার জিন সন্তানের দেহে সঞ্চালিত হয়। তাই মাতাপিতার দোষ-গুণ-ত্রুটি সন্তানের মধ্যে অটোমেটিক অন্তঃপ্রবিষ্ট হয়ে যায়। রীতিমতো ঘাবড়ে গেলেন একথা শুনে। তার মানে― পিতার সব বৈশিষ্ট্য তাঁর মধ্যে বইছে এবং তারপর তাঁর সন্তানের মধ্যে বইবে। সুতরাং তাঁর নিস্তার নেই। খুব ভেঙে পড়লেন। চিঠিতে সব কথা খুলে বললেন মার্গিটকে। মার্গিট স্বান্তনা দেয় প্রফেসরকে। বলে, সব ভুলে যেতে। 

   ইতিমধ্যে ইউজিন উইগনার তার বোন মার্গিটকে আমেরিকা ডেকে পাঠিয়েছে। আমেরিকা যাওয়ার ফাঁকে অল্প সময়ের জন্য কেমব্রিজে এলেন মার্গিট। সাক্ষাৎ করে প্রফেসরকে সঙ্গ দিলেন সামান্য ক'দিন। মার্গিটের সঙ্গে পরিচয় হয় মিসেস ইসাবেল হোয়াইটহেড-এর। মিসেস হোয়াইটহেড কেমব্রিজে ডিরাকের ক্লাসমেট হেনরি'র মা। ডিরাককে খুব স্নেহ করেন ভদ্রমহিলা। তিনি ডিরাককে পরামর্শ দেন― 'মার্গিট খুব ভালোবাসে তোমাকে। বিয়ে করার হলে এখনই তার সুবর্ণ সুযোগ। মনের মিলন হলেই তোমরা খুশি হবে।'

   ক'দিন আমেরিকা ঘুরে ফিরে আবার হাজির এলেন মার্গিট। সাউথহ্যাম্পটন ডকে তাকে রিসিভ করতে গেলেন ডিরাক। গাড়ি করে লন্ডন আসার পথে স্বাভাবিক নিরাবেগ গলায় তিনি প্রপোজ করলেন― 
'আমাকে বিয়ে করবে মার্গিট?'
হ্যাঁ বলতে এক সেকেন্ডও দেরি করলেন না মার্গিট। ১৯৩৭ সালে জানুয়ারির দুই তারিখে সেন্ট্রাল লন্ডনের হলবর্ন রেজিস্ট্রি অফিসে বিয়ে সারলেন তারা। অতিথি মাত্র চারজন। মিস্টার এবং মিসেস হোয়াইটহেড। ডিরাকের মা আর বোন। বিয়ের পর রেস্টুরেন্টে খাওয়াদাওয়া করে অতিথিগণ যে-যার বাড়ি চলে যান। আর নবদম্পতি উঠলেন ব্রাইটনের হোটেলে। সেটাই তাদের হানিমুন। এত দূর পড়ার পর সচেতন পাঠক ধরে নিতেই পারেন― নিশ্চিত কাহিনীর যবনিকা প্রপাত ঘটল এখানে। কিন্তু নাহ, এখনও অনেক ঘটনা বাকি।

   কেমব্রিজে তখন হইচই পড়ে গেছে― প্রফেসর ডিরাক বিয়ে করেছেন! এমন প্রতিক্রিয়া সংগত। কেউ ভাবতে পারেনি মার্গিটের মতো বিপরীত স্বভাবের একজন লাবণ্যময়ী মহিলাকে প্রফেসর বিয়ে করবেন! অবাক করা ব্যাপার। কেমব্রিজে ফিরে এসে দুটো জিনিসের খোঁজ শুরু করে দিলেন প্রফেসর। এক, বড়সড় একটি ভাড়া বাড়ি। দুই, রোমান্টিক বইপত্র। 'সুখী দাম্পত্যের গোপন রহস্য' খুব প্রয়োজন তাঁর―স্ত্রী বলেছে। এরকম সস্তা চটুল বই পড়ে জীবনে প্রথমবার এক রোমান্টিক প্রেমপত্র লিখলেন নিজের স্ত্রীকে― 
'হে প্রিয়তমা,
        আমার জীবনের প্রথম প্রেমপত্র তোমাকে লিখতে বসেছি। যতই দিন যাচ্ছে আমি বুঝতে পারছি তুমিই আমার জীবনের একমাত্র প্রেম। বিয়ের আগে আমার মনে হয়েছিল বিয়ের পর সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া হবে আমার। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে আমি তোমাকে যত বেশি জানতে থাকবো তত বেশি ভালোবাসতে থাকবো। আমার প্রতি তোমার ভালোবাসাও কি এরকম বাড়তে থাকবে, নাকি এখনই আমি তোমার সর্বোচ্চ ভালোবাসা পাচ্ছি?'
ডিরাক বইতে পড়েছেন স্ত্রীর শারীরিক সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে হয়। তিনি লিখলেন, 'তোমার ফিগার খুবই সুন্দর, তোমার শরীর উত্তেজনাকর মসৃণ। তোমার শরীরের সবকিছুর মালিক এখন আমি ভাবতেই সুখ লাগছে আমার। তুমি কি মনে করো আমার ভালবাসা বড় বেশি শারীরিক হয়ে যাচ্ছে? প্রিয়তমা, তুমি আমার ভালোবাসা। তুমি আমাকে মানবিক করে তুলেছো। আমার জীবনে আর কোন সাফল্য না এলেও আমি শুধু তোমাকে নিয়ে সুখে বেঁচে থাকতে পারবো। আমার মনে হচ্ছে আমি যদি তোমাকে সুখী করতে পারি তাহলেই আমি সার্থক।'

   ১৯৩৭-এর এপ্রিলে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে কেমব্রিজে আসলেন মার্গিট। তার ছেলে গ্যাব্রিয়েল আর মেয়ে জুডিথকে আইনত দত্তক নিলেন ডিরাক। এর পরেও তাদের দুটি কন্যা সন্তান জন্মায়। ১৯৪০ সালে ফেব্রুয়ারির নয় তারিখে তাদের প্রথম কন্যা মেরি এলিজাবেথ-এর জন্ম হয়। দু'বছর পর ১৯৪২ সালে সেপ্টেম্বর মাসের উনত্রিশ তারিখে তাদের দ্বিতীয় কন্যা ফ্লোরেন্স মনিকা ভূমিষ্ঠ হয়। বাবা হিসাবে নিষ্ঠার সঙ্গে চার সন্তানকে সমান স্নেহে মানুষ করে তোলেন ডিরাক। পিতা হিসাবে সব দায়িত্ব পালন করেন। তাদের দীর্ঘ ৪৭ বছরের দাম্পত্য জীবনে কখনও সামান্য চিড় ধরেনি। কারণ স্বল্প কথার মানুষ প্রফেসর স্ত্রী'র শত অভাব-অভিযোগের কোনও জবাব খুব একটা দিতেন বলে জানা নেই। নীরব শ্রোতা ছিলেন তিনি। একপেশে ঝগড়ায় অপরপক্ষ চিৎকার করে করে একসময় যুদ্ধে ক্ষান্ত হতেন। এটাই বোধহয় সফল দাম্পত্য জীবনের একমাত্র চাবিকাঠি। একপক্ষ চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলে অপরজনের উচিত চুপচাপ থাকা, নিজেকে সংযত রাখা। যা হয়ত ভালোমতো আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন প্রফেসর ডিরাক। জন্মগতভাবে।

পেজ-এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments