জ্বলদর্চি

গৌরা-স্টিল ফার্নিচার কারখানার নেপথ্যে স্বর্ণ-শিল্প/ দুর্গাপদ ঘাঁটি

গৌরা-স্টিল ফার্নিচার কারখানার নেপথ্যে স্বর্ণ-শিল্প 
                    দুর্গাপদ ঘাঁটি 
    
      ঘাটাল মহকুমার গৌরা ও গোবিন্দ নগর বাজার এলাকায় ব্যাপক হারে স্টিল- ফার্নিচার কারখানা গড়ে ওঠার নেপথ্য ইতিহাস লিখতে গেলে একটু পিছন ফিরে তাকানো খুব জরুরী। নদীমাতৃক ঘাটাল মহকুমার দাসপুর থানা যেখানে উর্বর পলিযুক্ত মৃত্তিকা কৃষির ক্ষেত্রে যে কোন শস্য  উৎপাদনে উপযুক্ত। 
     ১৮৩৮ থেকে ১৮৭৩ সালের মধ্যে  ইউরোপের বাজারে পাটজাত দ্রব্যের  ব্যাপক চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলার অন্যান্য অংশের মতোই এই থানার বেশিরভাগ অংশ বিশেষ করে থানার পশ্চিমাংশে ব্যাপক হারে পাট চাষ বৃদ্ধি পায়। বানিজ্যিক ভাবে রফতানির জন্য গৌরাতে বৃহৎ  আকারে মহকুমার একমাত্র জুট কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়ার পাট ক্রয়ের কার্য্যালয় গড়ে ওঠে। ইতিপূর্বে বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলে অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে পূর্ব ভারতে নীল চাষ বৃদ্ধির সাথে সাথে দাসপুরের মাটিতেও ব্যাপক হারে নীল চাষ শুরু হয়। নীলকর সাহেবদের জবরদস্তিতে কৃষকেরা চাষ করতে বাধ্য হলেও তা অাদেউ লাভজনক ছিলোনা। ফলে কৃষকের দুর্গতির অন্ত ছিলোনা তা বোধ করি অনেকের জানা। পরবর্তী সময়ে এলাকায় ব্যাপক আঁখ চাষ বৃদ্ধিতে মুষ্টিমেয় মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা বাড়লেও সেই প্রান্তিক মানুষের অবস্থা তিমিরেই ছিল কারণ বেশির ভাগ জমি ছিল মুষ্টিমেয় মালিকের হাতে। তারপর কাঁসাই,শিলাই,রূপনারায়ণ নদ-নদী ও পলাশপাই খালের বুক দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। বহু আন্দোলনে ১৯৪৭শে দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু এই থানার সিংহভাগ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক ও শ্রমজীবি  মানুষের অভাব ও দুঃখ  জগদ্দল হয়েই রয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষের ছয় এবং সাতের দশকে বারবার বন্যা(কাঁসাই নদীর ভাঙনে মহেশপুর পরে কিশোরপুর এবং ১৯৭৮ সালে বিধ্বংসী বন্যা উল্লেখযোগ্য) মানুষের দুঃখকে আরও দুর্বিষহ করে তোলে। সেই সময় এখানকার সাধারণ দরিদ্র পরিবারের প্রধান প্রধান খাদ্যশস্য অনিশ্চিত আমন ধান,খেঁসারির ডাল ও কুমড়ো চাষের উপরেই ছিল তাঁদের দিন গুজরান। অন্য কোন বিকল্প কাজ তেমন ছিল না।ফলে ঋণ করে জীবন ধারণ করতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত মানুষদের মহাজনদের কাছে সর্বস্ব খোয়াতে হত। এইভাবে নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যন্ত্রণাক্লিষ্ট দাসপুর এগিয়ে চলে দম নিতে নিতে।

    আজ থেকে প্রায় চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছরের মধ্যেকার দাসপুরের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বর্ণনা করলে বিষয়টিকে আরও পরিস্কার করা  যাবে। এই সময়কালের প্রথম দিকে থানার প্রায় পঁচানব্বই শতাংশ মানুষ সম্পূর্ণ কৃষির ওপর নির্ভর ছিল বটে কিন্তু এক ফসলি হওয়ায় দারিদ্র্যতা ছিল ভয়ংকর রকমের।সেচের কোন সু-ব্যাবস্থা ছিল না,ছিলোনা কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি। ফলে প্রায় ২০-৩০% জমিতে মোটামুটি কৃষি কার্য হত তাও সেকেলে পদ্ধতিতে। আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হল দাসপুর থানার পূর্বাংশের গ্রামগুলি গভীর জলাভূমি হওয়ায় বর্ষায় একমাত্র  আমন চাষের ক্ষেতগুলিও জলের তলায় চলে যেত। ফলে ঐ এলাকার মানুষের অভাব নিত্য সঙ্গী ছিল। ধীরে ধীরে ঐ অংশের মানুষের অনেকেই শহর কলকাতা ও হাওড়ায় চলে যেতেন বিভিন্ন কাজে।থানার আপাততঃ একটু উঁচু এলাকার মানুষ কোন রকমে সংসার চালিয়ে নিতেন আটপৌরে ভাবে। 
     ঠিক এই সময় নবজাগরণের মতো একটা রাজনৈতিক পালা বদল ঘটে বাংলায়। সরকারি উদ্যোগে নতুন নতুন সেচ প্রকল্পে আওতায় আসে প্রায় ৭০% কৃষি জমি সঙ্গে ভূমিহীন মানুষের হাতে বেশ কিছু জমিও হস্তান্তরিত হয়। ফলে বহু মানুষ ভূমির ব্যক্তি মালিকানা পেয়ে সরাসরি কৃষি কার্যে নিযুক্ত হন। এলাকায় কৃষিতে বিপ্লব আসে এবং কৃষি জমিগুলি এক ফসলি থেকে দুই-তিন ফসলি জমিতে রুপান্তরিত হয়। ধান বাদেও সব্জী যেমন -ফুলকপি বাঁধাকপি, উচ্ছা, ঝিঙ্গা, শঁশা, আলু সহ নানা ধরনের সব্জী ব্যাপক হারে চাষ হতে থাকে। সেসময় এই থানা সব্জী চাষে পশ্চিম বাঙলার প্রথম স্থান দখলও করেছিলো। 

      যখন সবুজ বিপ্লব হয়েছে তখন সাধারণ মানুষের দুর্দশার অবসান হওয়ার কথা। পাত্র ফুটো থাকলে জল ঢেলে তা পূর্ণ করার বৃথা চেষ্টা।  জাতীয়  উৎপাদনে খরচ দিন দিন বৃদ্ধি ;সার, কীটনাশক,বীজ, স্যালো-মেশিনএর জ্বালানি ও ইলেকট্রিক বিল উত্তরোত্তর অাকাশ চুম্বি হওয়া এবং বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষি নির্ভর মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা কিছুটা উন্নতি হলেও অবস্থার তেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি।

        তার পর হঠাৎ বয়ে আসে স্বর্ণ শিল্পের পশ্চিমী হাওয়া।এই থানার ব্লক-২এর বেশ কিছু গ্রাম থেকে  যেমন- সাগরপুর,চাঁইপাট,দরি,কামালপুর সোনাখালি, সাহাচক্,হরেকৃষ্ণপুর সহ পার্শ্ববর্তী গ্রামের শয়ে শয়ে যুবক নতুন স্বর্ণ শিল্পের কারীগর হিসেবে দিল্লি,বোম্বাই, মাদ্রাজ,সুরাট সহ ভারতের অন্যান্য শহরে ও দেশের বাইরে দুবাই, সিঙ্গাপুরে স্কুল শিক্ষার প্রাথমিক ঞ্জান টুকু নিয়ে চলে যান। রাতারাতি তাঁরা ভালো অর্থ উপার্জন করতেও শুরু করেন। এ খবর থানার অন্যান্য গ্রামে পৌঁছে যায়। তারপর কাতারে  কাতারে থানার বেশির ভাগ দরিদ্র পরিবারের যুবকেরা চলে যান ভীন রাজ্যে। পরে পরে মধ্যবৃত্ত পরিবারের অনেক যুবকও যেতে শুরু করেন।কোন রাজনৈতিক দল অস্বীকার করলেও এটা প্রকৃত সত্য যে ধীরে ধীরে  হাজার হাজার মানুষ উক্ত কার্যে চলে যাওয়ায় থানার অার্থ-সামাজিক অবস্থার প্রভুত উন্নতি হতে থাকে তা কিন্তু সর্ব্বজন সমর্থিত।যাই হোক,এলাকার মানুষের হঠাৎ বেড়ে যায় ক্রয় ক্ষমতা। তার ফলস্বরূপ নতুন নতুন শয়ে শয়ে দোকান বাজার গড়ে ওঠে এলাকায় এলাকায়।বন্যা প্রবণ এলাকা গুলিতে মাটির বাড়ির পরিবর্তে পাকা বাড়ি নির্মাণ হতে থাকে দ্রুত হারে। সঙ্গে আসে দিল্লী,বোম্বে,দুবাই,মাদ্রাজ সহ অন্যান্য আধুনিক শহরগুলির সভ্যতা-সংস্কৃতির ঢেউ। ফলে মানুষের রুচী পাল্টেছে,বাড়ে চাহিদাও। বাড়িগুলোতে আধুনিক সাজ-সরঞ্জাম ও আসবাবপত্রের প্রয়োজনীয়তা বহুগুণ বেড়ে যায়। প্রথম দিকে শহর কলকাতা থেকেই মানুষেরা আসবাব পত্র সহ বিলাসিতার প্রয়োজনীয় সামগ্রী  আনতেন।পরে তার অনেকটাই স্থানীয় বাজার থেকে মিলতে থাকে। ইতিমধ্যে গোবিন্দনগর গৌরা বাস স্টপেজ্ কেন্দ্রীক গড়ে উঠেছিল একটি বাজার। ধীরে ধীরে তা বিশাল আকার নেয়। 
         প্রাক্তন অল বেঙ্গল স্টিল-ফার্নিচার এসোসিয়েশনের সভাপতি দাসপুর থানার পলাশপাই গ্রামের মাননীয় অশোক কুমার মাইতি প্রায় ৪০ বছর আগে শহর কলকাতায় স্টিল ফার্নিচার তৈরির কাজে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসেন।তাঁরই হাত ধরে প্রথম গৌরা গোবিন্দ নগর বাজার সংলগ্ন এলাকায় জয়-স্টিল ফার্নিচার নামে একটি কারখানা গড়ে ওঠে,যা ঘাটাল-পাঁশকুড়ার মধ্যে প্রথম এবং অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার অন্যতম। তারপর মি.মাইতির কারখানায় কাজ শিখে অনেক মানুষই ব্যক্তিগতভাবে অর্থ লগ্নি করে গৌরা ও গোবিন্দনগর গৌরা সংলগ্ন এলাকায় শতাধিক ছোট বড় কারখানা গড়ে তুলেছেন। পরম্পরায় গড়ে ওঠা সুধীর পাল,সুশান্ত পাল,জগন্নাথ সামন্ত, বদ্যিনাথ সামন্ত,মাধব চন্দ্র আদক,নন্দলাল সামন্ত, কার্তিকচন্দ্র আদক, প্রবীর খাঁড়া, মধুসূদন মাজী, নির্মল কুমার মুখার্জী প্রমুখদের কারখানাগুলি অন্যতম। তারপর সময়ের তালে শিল্পের গতি এগিয়ে চলে; কারখানার  সংখ্যাও বাড়তে থাকে, সঙ্গে বাড়ে কর্মসংস্থানও। এবং স্থানীয় ভাবে পূরণ হতে থাকে মানুষের চাহিদা।  

      এই দাসপুর থানার মানুষের  প্রয়োজনীয়তা মিটিয়েও উৎপাদিত স্টিল ফার্নিচার কলকাতা সহ বাংলার বিভিন্ন আধুনিক বাজারে ও উড়িষ্যা,বিহার, ঝাড়খণ্ডে বাণিজ্যিকভাবে রপ্তানি হতে থাকে। উল্লেখ্য দেশের খ্যাতনামা কিছু ব্র্যান্ডেড কোম্পানির অর্ডার সাপ্লাইও করা হয় এখান থেকে।

   এইভাবে স্বর্গ শিল্পের হাত ধরে লৌহ ইস্পাত শিল্পের অগ্রগতির ইতিহাসে গৌরা গোবিন্দ নগর এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবে।  

        বর্তমানে হয়তো ঘাটাল মহকুমা অথবা দুই মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন অংশে অনেক অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে ঠিকই কিন্তু এই গৌরা গোবিন্দনগর চিরকাল এই শিল্পে সবার আলোক বর্তিকা হয়ে থাকবে।

                                  আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments