জ্বলদর্চি

অ্যানাই মিরাবিলিস' ― পদার্থবিজ্ঞানী আইজাক নিউটন এবং একটি আপেল /পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ১৮

'অ্যানাই মিরাবিলিস' ― পদার্থবিজ্ঞানী আইজাক নিউটন এবং একটি আপেল 

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

'কয়েক বছর আগে [ক্যালকুলাসের] কিছু থিওরেম-সংবলিত একটি পাণ্ডুলিপি আমি একজনকে ধার দিয়েছিলাম; তা থেকে বেশ কিছু জিনিস টুকে নেওয়া হয়েছে। তাই এবার আমি সবটা প্রকাশ করলাম।'

টুকে নেওয়া হয়েছে? এ যে মারাত্মক অভিযোগ, টুকলির! এমন বিতর্কিত মন্তব্য বিশ্ববিশ্রুত এক বৈজ্ঞানিকের। তিনি মূলত পদার্থবিজ্ঞানী। নাম আইজাক নিউটন। ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত এবং প্রভাবশালী। বিশ্বজুড়ে তাঁর খ্যাতি। লন্ডন সফরে এলে দেশ-বিদেশের রাষ্ট্রনায়কেরা পর্যন্ত তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী হতে চাইতেন। এতটাই তাঁর ক্রেজ, ব্যক্তিত্ব। ওই একই বছরে তিনি প্রকাশ করলেন আলোকবিদ্যা সম্পর্কে তাঁর বই 'অপটিকস্'। তাঁর নিজের গবেষণা-সংবলিত এ হেন বইয়ের শেষ ছত্রে এমন গুরুতর অভিযোগ করে বসলেন তিনি। অভিযোগের তীর আরেক বৈজ্ঞানিকের দিকে। তিনি ক্যালকুলাসের আরেক আবিষ্কারক গটফ্রিয়েড উইলহেল্ম ভন লিবনিৎজ (১৬৪৬―১৭১৬)। জাতে জার্মান। দর্শন আর গণিতের কিংবদন্তি পুরুষ। নিউটনের তুলনায় চার বছরের ছোট। 

কোন পাণ্ডুলিপির কথা বলছেন নিউটন? কাকে ধার দিয়েছিলেন সেটি? কেনই বা ধার দিলেন? কতখানি সত্য তাঁর এই অভিযোগ? সব আষাঢ়ে গল্প নয় তো!
এদিকে 'অপটিকস্'-এর পরিশিষ্ট পড়ে খেপে লাল লিবনিৎজ। বেজায় চটে গেলেন। ১৭০৫ সালে তিনি বেনামে সমালোচনা করলেন বইখানার। 'অ্যাকটা এরুডিটোরাম' জার্নালে মন্তব্য করলেন―
'ক্যালকুলাসের কায়দাগুলো তার আবিষ্কর্তা ড. উইলহেল্ম লিবনিৎজ অবশ্য প্রথম এই পত্রিকাতেই জনগণকে জানিয়েছেন।'

সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নন নিউটনও। ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস সংক্রান্ত বিবাদের সূত্রপাত ঘটল এখান থেকেই। ক্যালকুলাসের সেই যুদ্ধে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল ইংলিশ চ্যানেল। লড়াই অবধারিতভাবে ছড়িয়ে পড়ল ইউরোপ ভূখণ্ডে। দুভাগে ভাগ হয়ে গেল ইউরোপের পণ্ডিতকুল। নিউটনের পক্ষে ইংল্যান্ডের সমস্ত পণ্ডিত। আর লিবনিৎজ-এর সমর্থনে গোটা ইউরোপ। দুই কিংবদন্তি বৈজ্ঞানিকের ঝগড়ার পুরো ব্যাপারটার মধ্যে অবধারিতভাবে এসে গেল ইংরেজদের চিরাচরিত জাত্যাভিমানের প্রশ্ন! ব্যক্তির দ্বৈরথে মুখ্য হয়ে দাঁড়াল, কে সেরা― ব্রিটিশ, না জার্মান?

ব্যাপারটা কী? কী এমন ঘটনা, যার জন্য গোটা ইউরোপ দ্বিধাবিভক্ত, জড়িয়ে গেল দ্বন্দ্বে?
সমালোচনা আর বিতর্কে তিতিবিরক্ত নিউটনের এক গুরুতর মুদ্রা দোষ ছিল। নিজের আবিষ্কৃত সূত্রগুলো জনসমক্ষে আনতে বড্ড অনীহা তাঁর। আবিষ্কারের সব ব্যাপারে চরম গোপনীয়তা রক্ষা করতেন। ছাড়বার পাত্র নন এক প্রকাশনা সংস্থার প্রধান জন কলিনস আর রয়্যাল সোসাইটির সম্পাদক হেনরি ওল্ডেনবার্গও। জোরালো পীড়াপীড়ি শুরু করলেন তাঁরা। ছাত্র ও শিক্ষকদের সার্থে বই আকারে ছাপতে হবে যক্ষের ধন তাঁর আবিষ্কারগুলি। এমনটাই তাঁদের দাবি। অবশেষে সম্মত হলেন বৈজ্ঞানিক। পূর্ণাঙ্গ বই আকারে নয়, ছোট্ট পুস্তিকার আকারে প্রকাশিত হল তাঁর সৃষ্টির সম্ভার। শিরোনাম 'দি অ্যানালাইজি পার ইকুয়েশনেস নুমেরো টারমিনোরাম ইনফিনিটাস'। সেটা ১৬৬৯ সাল। এই পুস্তিকায় ক্যালকুলাসের সামান্য আভাস দিলেন তিনি। তারপর সব চুপচাপ।

পনেরো বছর পার হয়ে গেল। ১৬৮৪ সালের অক্টোবর মাস। লাইপৎজিগ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তখন নিয়মিত বের হয় 'অ্যাকটা এরুডিটোরাম' জার্নালখানি। সে-বছর অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত হল একটি প্রবন্ধ। গণিতের এক দুরূহ নব্য শাখা 'ক্যালকুলাস' সংক্রান্ত লিবনিৎজ-এর আবিষ্কার নিয়ে একটি আর্টিকেল। পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা করে। ক্যালকুলাস বিষয়ে বিশ্বের প্রথম মুদ্রিত আর্টিকেল সেটি। প্রবন্ধের বক্তা লিবনিৎজ তাঁর প্যারিস-বাসের সময় ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কার করেছিলেন ক্যালকুলাসের সে-সব দুরূহ তত্ত্ব।
      

আতঙ্কিত নিউটন এবার মনে মনে প্রমাদ গুনলেন। তিনি তড়িঘড়ি ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে ছাপতে দিলেন বস্তুর গতি ও মহাকর্ষ সংক্রান্ত এক জগদ্বিখ্যাত আকর গ্রন্থ 'ফিলোজফায়ে ন্যাচুরালিস প্রিনখিপিয়া ম্যাথমেটিকা'। নন্-রিলেটিভিস্টিক পদার্থবিজ্ঞানের আস্ত একখানা বাইবেল যেন এ হেন গ্রন্থটি। গ্রন্থটিতে তিনি জানালেন এক হাড়-হিম-করা গোপন তথ্য। লিবনিৎজ তখন ইংল্যান্ডে। কলিনস এবং ওল্ডেনবার্গ মারফৎ তিনি নিউটনের কাছে আর্জি জানালেন― ক্যালকুলাস সংক্রান্ত গবেষণার অগ্রগতির টাটকা খবর জানাতে। ১৬৭৬ সালের অক্টোবর মাস। লিবনিৎজকে চিঠি লিখলেন নিউটন। সে-চিঠি ওল্ডেনবার্গ-এর হাত দিয়ে প্রাপকের কাছে পৌঁছল ১৬৭৭ সালের গ্রীষ্মে। ল্যাটিন ভাষায় লেখা চিঠিখানা হাতে ধরে হতবাক লিবনিৎজ। চিঠির জরুরি অংশখানি সাংকেতিক পদ্ধতিতে লেখা। তার পাঠোদ্ধার আপাত কঠিন চ্যালেঞ্জ। দুরূহ কাজ। ধরা যাক, ল্যাটিন হরফে লেখা একটি বাক্য; কিন্তু মজার বিষয় হল―তার অক্ষরগুলো ওলটপালট করে সাজানো। ফলে অদ্ভুত ঠেকল বাক্যগুলি। না পারল পাঠ করতে; ভাবার্থ উদ্ধার অনেক পরের কথা। ল্যাটিন ভাষায় ভালোমতন দক্ষ না-হলে অক্ষরগুলোর সঠিক বিন্যাস করে এর মর্মার্থ উদ্ভাবন আপাতত জটিল ব্যাপার। তবুও চিঠির প্রাপ্তি সংবাদ জানিয়ে রিটার্ন চিঠিতে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন লিবনিৎজ। সে-খবরও ফলাও করে ছাপলেন নিউটন, তাঁর 'প্রিনখিপিয়া' গ্রন্থে। ভাবখানা এমন, যেন তাঁর বুদ্ধি ধার করে ক্যালকুলাস সংক্রান্ত তত্ত্বগুলি আবিষ্কার করেছেন লিবনিৎজ। বই প্রকাশ করে নিউটনের মন্তব্য―
'নামে বা চিহ্ন ব্যবহারে ফারাক বাদ দিলে, আমাদের দুজনের কাজ হুবহু এক।'
আবার চুপচাপ দু-পক্ষ। সতেরো বছর ধরে মৌন থাকলেন নিউটন। ততদিনে লিবনিৎজ প্রবর্তিত চিহ্ন এবং  তত্ত্ব সংবলিত ক্যালকুলাস যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করছে ইউরোপে। আর যেন সহ্য হয় না। ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে মৌনব্রত ভেঙে মাঠে নেমে পড়লেন নিউটন। ফের আরম্ভ হল ক্যালকুলাসের লড়াই। এবার আরও নোংরা খেলা। প্রতিপক্ষকে ছোট প্রমাণ করতে গবেষণা চুরির অপবাদ দিলেন নিজের 'অপটিকস' গ্রন্থের পরিশিষ্টে। যদিও সর্বৈব সত্য নয় নিউটনের এই অভিযোগ। এ যেন পাঁচ হাজার বছরের পুরাতন ধর্মগ্রন্থ 'মহাভারত'-এর '...ইতি গজ' ঘটনার ঐতিহাসিক পুনরাবৃত্তি ও সমাপতন। আংশিক সত্য। বেশির ভাগটাই মিথ্যে। মোটেও টোকাটুকি করেননি লিবনিৎজ। কেননা, তিনি প্যারিস থেকে লন্ডন আসেন ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দে এবং দেখাও করেছিলেন কলিনস-এর সঙ্গে, একথা যেমন ঠিক; তেমনি এ বাক্যও ধ্রুব সত্যি যে এক বছর পূর্বে ১৬৭৫-এ সম্পূর্ণ মৌলিক উপায়ে স্বতন্ত্রভাবে তিনি ক্যালকুলাস আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। সেজন্য নিউটনের আইডিয়া খুব একটা প্রয়োজন হয়নি তাঁর। ক্যালকুলাসের প্রাথমিক রীতিনীতি নিউটন সবার প্রথম আবিষ্কার করলেও তিনি তা সচেতনভাবে প্রচারের আলোক থেকে বঞ্চিত রাখেন দীর্ঘদিন। রিসার্চ গোপন রাখা রিসার্চ না-করার সামিল। সেজন্য ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস অ্যাক্ট-এর আধুনিক নিয়মে ক্যালকুলাসের আবিষ্কারক লিবনিৎজ, মোটেও নিউটন নন। এবার সচেতন পাঠক বিচার করবেন, ক্যালকুলাসের প্রকৃত আবিষ্কর্তা কে? কে পাবে সেরার তকমা?
      
যার জন্য এত দ্বন্দ্ব, ঝগড়া, মনোমালিন্য, স্বাভিমানের প্রশ্ন জড়িয়ে; সেই 'ক্যালকুলাস' কী? খায়, না মাথায় মাখে?

সরলরেখার দৈর্ঘ্য, আয়তক্ষেত্র-রম্বস-বৃত্তের সীমানা অথবা ক্ষেত্রফল, ঘনক কিংবা গোলকের আয়তন মাপা যায় জ্যামিতি বা বীজগণিতের সাধারণ নিয়মে। অথচ যে কোনও বক্ররেখার দৈর্ঘ্য মাপা, বক্ররেখা দিয়ে বদ্ধ জায়গার ক্ষেত্রফল নির্ধারণ অথবা বক্রতল দিয়ে ঘেরা স্থানের আয়তন নির্ণয় করা সাধারণ জ্যামিতি বা বীজগণিতের সূত্র দিয়ে হয় না। তার জন্য প্রয়োজন গণিতের বিশেষ কায়দাকানুন। আর সেই নতুন রীতিনীতি সংবলিত গণিতের বিশেষ শাখার নাম হল 'ক্যালকুলাস'। ধরা যাক, সূর্যের চারদিকে পৃথিবী ঘুরছে, উপবৃত্তাকার পথে। সে-পথে সূর্য থেকে পৃথিবীর অবস্থান বদলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সবসময় দূরত্ব একই থাকছে না। বাড়ছে-কমছে। তার ফলে গতিও উঠা-নামা করছে। কাছে এলে গতি বাড়ে, দূরে গেলে বেগ কমে যায়। এখন পথের কোনও একটি বিন্দুতে পৃথিবীর গতিবেগ মাপা কিংবা অতি ক্ষুদ্র সময়াবকাশে বেগের পরিবর্তন গণনা সহজ হয়েছে ক্যালকুলাসের সাহায্যে। শুধু গণিত নয়, বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এ হেন ক্যালকুলাসের গুরুত্ব অপরিসীম।

তো, এরপরও থামল না ক্যালকুলাস-যুদ্ধ। জল গড়াল আরও বহুদূর পর্যন্ত। লড়াই জারি থাকল আরও কিছুদিন। রয়্যাল সোসাইটির নির্বাচিত বিদেশি ফেলো লিবনিৎজ। ১৭১২ সালে সোসাইটিকে অনুরোধ করলেন আইডিয়া চুরির অভিযোগ থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হোক। নিউটন তখন রয়্যাল সোসাইটির প্রধান। পুরো ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখতে তিনি একটা কমিটি গড়ে দিলেন। আর সেই কমিটির সভ্য নির্বাচিত করলেন নিজের পছন্দের সব মানুষজনকে। যেমন জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডমন্ড হ্যালি। এই হ্যালি-ই তাগাদা দিয়ে 'প্রিনখিপিয়া' ছাপতে বাধ্য করেছিলেন নিউটনকে। এ হেন কমিটি তদন্তের পর পূর্ণাঙ্গ রায় দিল ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে। নিউটনের অনুকূলে। অর্থাৎ লিবনিৎজ বনে গেলেন আইডিয়া-তস্কর। 

হিরো বনে গেলেন নিউটন আর লিবনিৎজ ভিলেন! বস্তুত, নিউটন তখন ইংল্যান্ডের জাতীয় বীর! গোটা ইউরোপের আক্রমণ থেকে দেশের সম্মান বাঁচিয়ে তিনি জাতীয় নায়কের শিরোপা জিতে নিলেন। অন্যদিকে, অপমানের পাহাড় প্রমাণ চাপ মাথায় নিয়ে ১৭১৬ সালের নভেম্বর মাসের চোদ্দো তারিখে সত্তর বছরে না-ফেরার দেশে চলে গেলেন লিবনিৎজ। তারপরে শেষ হয়েও শেষ হল না ক্যালকুলাস-যুদ্ধ। লিবনিৎজ-এর মৃত্যুর পরেও জারি থাকল সে-লড়াই। ছাড়নেবালা পাত্র নন নিউটন। প্রতিদ্বন্দ্বীর মৃত্যুর ছয় বছর পর আশি বছরের নিউটন নিজ উদ্যোগে দ্বিতীয় বার ছাপলেন রয়্যাল সোসাইটির সেই রিপোর্ট। বদলে দিলেন অনেক বাক্য। প্রতিদ্বন্দ্বীকে হেয় প্রতিপন্ন করতে। এতেও ক্ষান্ত হলেন না। ১৭২৬ খ্রিস্টাব্দে, নিজের মৃত্যুর এক বছর আগে, 'প্রিনখিপিয়া' গ্রন্থের তৃতীয় সংস্করণ থেকে মুছে বাদ দিলেন লিবনিৎজ-এর নাম। হা ঈশ্বর! এ আপনার কেমন বিচার। মৃত্যুর পরেও টানাহেঁচড়া চলে এক প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিয়ে! এ লড়াইয়ে শেষ কোথায়? 

দীর্ঘ চার দশকের লড়াইয়ে যবনিকা পতন ঘটল, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মতে, ১৭২৭ সালের ৩১ মার্চ (জুলিয়ান ক্যালেন্ডার মতে, ২০ মার্চ ১৭২৬)। ওই দিন পঁচাশি বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন নিউটন। লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে-তে সমাধিস্থ করা হল তাঁর মরদেহ। পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। খটকা লাগে, বিশ্ববন্দিত যে বৈজ্ঞানিক আমার-আপনার সকলের প্রিয়, শ্রদ্ধার পাত্র; তিনি এমন কাজ করলেন কেমন করে?

এ প্রসঙ্গে এক নোবেল জয়ী পদার্থবিজ্ঞানীর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিওন লেডারম্যান (১৯২২―২০১৮)। কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন―
'অনেকের ধারণা বিজ্ঞানীরা অসহ্য রকমের সাধুসন্ত। ব্যাপারটা মোটেও সেরকম নয়। উদাসীনতা তাঁদের কাছে নেহাতই বিলাসিতা। কারণ প্রতিযোগিতা ঘিরে থাকে তাঁদের জীবন। প্রতিদ্বন্দ্বিতা লেগে থাকে নানা পর্যায়ে। দেশে-দেশে, দেশের মধ্যে, প্রতিষ্ঠানে-প্রতিষ্ঠানে, এমনকি একই ছাদের তলায় পাশের ল্যাবরেটরির গবেষকের সঙ্গেও চলে প্রতিযোগিতা, অদৃশ্য টানাপোড়েন-লড়াই।'

এখন প্রশ্ন জাগে, শৈশবে কেমন ছিলেন নিউটন? তাঁর একরোখা, জেদি, হার-না-মানা বিকৃত মানসিকতার উৎস কি তিনি নিজে? না-কি, প্রতিকূল পরিবেশ পরিস্থিতি তাঁকে এ পথে ঠেলে দিয়েছে? হয়তো তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। বিরূপ পরিস্থিতির শিকার তিনি। সমাজের বিরুদ্ধে যুঝতে যুঝতে আপাত ইস্পাত-কঠিন মানুষ বনে গেছেন তিনিও।

ইংল্যান্ডে তখন ভয়ানক গৃহযুদ্ধ। অস্থিরতার গ্রাসে সমগ্র সমাজ সংসার। দম বন্ধ করা পরিবেশ। এমন উত্তপ্ত আবহে নিউটনের জন্ম নির্ধারিত সময়ের তিন মাস আগে; ১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৪-ঠা জানুয়ারি। অন্য এক ক্যালেন্ডার (পুরাতন জুলিয়ান ক্যালেন্ডার) মতে, ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনে। ওই দ্বিতীয় বছরে মারা যান আধুনিক বিজ্ঞানের জনক গ্যালিলিও গ্যালিলেই। সেজন্য তাঁর জীবনীকারেরা দ্বিতীয় তারিখটাকে বেশি গুরুত্ব দেন। ইংল্যান্ডের উলসথ্রোপে গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর বেড়ে ওঠা। জন্মের সময় তাঁর ওজন এতটাই কম ছিল যে বাঁচার সম্ভাবনা ছিল না বললেই চলে। বিস্ময়ের ব্যাপার, কৃশানু সে-শিশু জীবিত রইল আশি বছরেরও বেশি সময় ধরে! তাঁর পিতার নামও আইজাক নিউটন। জন্মের তিন মাস পূর্বে হারাল জন্মদাতা পিতাকে। তিন বছর পর তার স্নেহময়ী মা হানা আইসকাফ পুনরায় বিবাহ করলেন। দ্বিতীয় স্বামী রেভারেন্ড বারনাবাস স্মিথের বয়েস তেষট্টি; হানা'র চেয়ে তিরিশ বছরের বড়।
     
শিশু নিউটনকে ঠাকুরমার জিম্মায় রেখে দ্বিতীয় স্বামীর সংসার করতে চলে গেলেন তাঁর জন্মদাত্রী মা। ঠাকুরমা কোলেপিঠে করে বড় করে তোলেন মাতৃস্নেহ বঞ্চিত ছোট্ট নিউটনকে। শৈশবে এই নিদারুণ বেদনার শিকার হয়ে তাঁর জীবনটা গড়ে ওঠে বিচিত্রভাবে। সহ্য করতে পারে না সৎ বাবাকে, এমনকি মা অ্যানা ও তাঁর গর্ভজাত তিন সৎ ভাই-বোনও তাঁর রোষানলে পড়ে। ডায়েরিতে প্রতিনিয়ত ওদের মৃত্যু কামনায় পৃষ্ঠা ভরাত সে। অবিচলিত, গোঁয়ার, বিকৃত মানসিকতায় পরিপূর্ণ তখন থেকেই। সমাজ-সংসারের প্রতি এই বৈরী মানসিকতা তাঁর দূষিত রক্ত সঞ্চালনের গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল অনেকটা, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

বারো বছর বয়সে ভর্তি হন কিংস স্কুলে। ঔষধ বিক্রেতা ক্লার্ক তাঁর অভিভাবক। ক্লার্কের স্ত্রী নিউটনের মায়ের বান্ধবী। কিশোর নিউটন থাকত ক্লার্কের বাড়িতে। স্কুলে প্রথম দিকে পড়াশুনায় নিতান্ত সাধারণ মানের ছেলে ছিল সে। ঔষধের দোকান থেকে নানা রাসায়নিক সামগ্রী এনে খেলা করত। অল্পদিনে কারখানা, বাড়ি আর বিভিন্ন মডেল বানাতে সে পারদর্শী হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানে তার প্রচণ্ড উৎসাহ। ইতিমধ্যে স্কুলে মাথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর নেপথ্য কাহিনী একটু ভিন্ন। নেহাতই গোবেচারা ছেলে ছিল সে। ক্লাসের সবাই তাকে দেখে ঠাট্টা করে। পড়াশোনায় একদম মন নেই। অন্যরা যখন তীব্র হৈচৈ করে, ক্লাসের এক কোণায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখে সে। একদিন এক ডানপিটে ছেলে অহেতুক তাকে মারধর করে। হঠাৎ তার অন্তরাত্মা জেগে ওঠে। ঘুসি মেরে তার নাক ফাটিয়ে দেয়। ছেলেটি মাটিতে শুয়ে কাঁদতে থাকে। এই ঘটনায় হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল সে। নতুন করে নিজেকে চিনতে শুরু করল। সেদিন ঘুসি মেরেই ক্ষান্ত হয়নি সে, আরও ঘোষণা করল― এরপর থেকে পড়াশুনায় ভালো হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে। অল্পদিনের অধ্যবসায়ে ক্লাসের সেরা ছাত্র হয়ে উঠল। হেডমাস্টার হেনরি স্টোকস-এর প্রিয় পাত্র বনে গেল সে, তুখোড় রেজাল্ট করে।

দুঃস্বপ্নও যেন সমানে তাড়া করে বেড়াল তাঁকে। দুঃসময় তাঁর পিছু ছাড়ল না। যখন তাঁর বয়েস চোদ্দো, সেসময় তাঁর সৎ বাবা মারা যায়। অসহায় তাঁর মা। ঘরে তীব্র অভাব। জ্যেষ্ঠ সন্তান হওয়ার সুবাদে সংসারের হাল তাঁর অপরিণত নরম ঘাড়ে এসে পড়ে। ১৬৫৯-এর অক্টোবরে স্কুল ছাড়িয়ে চাষাবাদের কাজে লাগিয়ে দেয় মা। অথচ চাষবাসে মন নেই কিশোরটির। পড়াশোনার জগতে থাকার নিউটনের তীব্র ইচ্ছে। এমন সময় আশীর্বাদ হিসাবে আবির্ভূত হলেন তার মামা উইলিয়াম আইসকাফ, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। তিনি বোন অ্যানাকে বোঝাতে সক্ষম হলেন। মূলত তিনি আর হেডমাস্টার স্কোটস-এর মধ্যস্থতায় কিংস স্কুল থেকে ১৬৬১ সালে মেট্রিক পাশ করেন। সেবছরই ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন আইজাক। সহকারী সাইজার বৃত্তি নিয়ে। কলেজের কিছু কাজের বিনিময়ে দুঃস্থ ছাত্রদের ভাতা প্রদান করা হত। এই সব ছাত্রদের বলা হত সাইজার। তীক্ষ্ণ মেধার জন্য গণিতের খ্যাতনামা অধ্যাপক ব্যারো'র নজরে পড়ে যান তিনি। প্রফেসরের সুনজরে অল্প সময়ের মধ্যেই জ্যামিতি আর আলোকবিদ্যায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। ১৬৬৪ সালে তিনি অঙ্কে বৃত্তির জন্য নিউটনের নাম সুপারিশ করেন। ফলে তাঁর কাছে বিজ্ঞানের রাস্তা আরও প্রশস্ত হয়। ১৬৬৫ সালে বিএ পাশ করেন।

এমন সময় দুরারোগ্য প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইংল্যান্ডে। বহু লোকের প্রাণহানি হয়। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। সাময়িক বন্ধ রাখা হয় ট্রিনিটি কলেজ। হোস্টেল ছেড়ে অগত্যা উলসথ্রোপে গ্রামের বাড়ি ফিরতে হল। মহামারি দু'বছর স্থায়ী হল। গ্রামের বাড়িতে ওই দু'বছর (১৬৬৫ থেকে ১৬৬৬) নিউটনের জীবনে 'অ্যানাই মিরাবিলিস'― বিস্ময়ের বছরগুলি। গ্র্যাভিটির সূত্র আবিষ্কার, বস্তুর গতির নিয়ম অনুধাবন, আলোর চরিত্র ব্যাখ্যা আর ক্যালকুলাস উদ্ভাবন― ফিজিক্সের দুরূহ সব তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন এসময়। তাঁর এক একটি আবিষ্কার একেকটা মাস্টারপিস। সাক্ষাৎ দৈব যেন ভর করে ছিল তাঁর উপর। তাঁর চেতনায় যেন সরস্বতীর বাস। দার্শনিক অন্বেষা ও এষণা'র যুগপৎ অধিষ্ঠান তাঁর চিন্তায় আর মননে।
       
মহামারী জয় করে ১৬৬৭ সালের এপ্রিলে কেমব্রিজে ফিরলেন নিউটন। পেয়েছেন ট্রিনিটি কলেজের ফেলোশিপ। ১৬৬৯ সালে এম এ পাশ করলেন। ওই বছর প্রফেসর আইজাক ব্যারো গণিতের লিউকাস অধ্যাপকের পদ থেকে অবসর নিলে নিউটন অঙ্কের পূর্ণ সময়ের অধ্যাপক নিযুক্ত হলেন। এবার তাঁর ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল, ১৮০ ডিগ্রি। চরম তাচ্ছিল্যের পথ থেকে অভিজাত সরণিতে উত্তরণ ঘটল তাঁর। ১৬৭২-এ হলেন রয়্যাল সোসাইটির ফেলো। এত কিছুর বাইরেও অনেক ক্ষোভ ও অভিমান জমে তাঁর হৃদয়ে। একবার রয়্যাল সোসাইটিকে নিজের একটি দূরবীন উপহার দিলেন। সোসাইটির সভাপতি তখন বিজ্ঞানী রবার্ট হুক। প্রশংসার বদলে তিনি সমালোচনায় ভরিয়ে দিলেন নিউটনের অস্থির হৃদয়। মানসিক নির্যাতনের এখানে শেষ নয়। আলোর তরঙ্গ তত্ত্বের প্রবক্তা ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস ও অন্যান্যরাও বিরূপ মন্তব্য ছুড়ে দিলেন তাঁর পরীক্ষা নিয়ে। সেজন্য তিনি ঠিক করেছেন― ভবিষ্যতে যা আবিষ্কার করবেন, তিনি তা কখনও প্রকাশ করবেন না। আর সেটাই কাল হল তাঁর। লিবনিৎজ-এর সঙ্গে আমৃত্যু জড়িয়ে পড়লেন বৈরিতার ঘেরাটোপে।

আরও একবার, একটি সোনার হরিণ ধরতে তার পিছনে ধাওয়া করেছিলেন নিউটন। দীর্ঘদিন। তা হল অ্যালকেমি চর্চা। অ্যালকেমি হল প্রাচীন সেই জাদু গবেষণা, যার লক্ষ্য ছিল সাধারণ ধাতু গলিয়ে সোনা বানানো। বিদ্রুপের হাত থেকে বা‌ঁচতে অত্যন্ত গোপনে অ্যালকেমি চর্চা করতেন নিউটন। অলীক সেই স্বপ্নের পেছনে ছুটে জীবনের অধিকাংশ সময় নষ্ট হয়েছে। অ্যালকেমি সংক্রান্ত প্রাচীন পুথিপত্রের বিশাল এক ভাণ্ডার ছিল তাঁর সংগ্রহশালায়।

এসব অবাস্তব কাণ্ডকারখানা নতুন করে চেনায় রক্ত-মাংসের বৈজ্ঞানিককে। আরও একটি ঘটনা। বার্ধক্যের বারাণসীতে পৌঁছে জুটে গেল টাঁকশালের চাকরি। সরকারি টাঁকশালের প্রধান। জাল নোটের তদন্ত, দোষী ব্যক্তির গ্রেপ্তার, মায় শাস্তিবিধান পর্যন্ত সমস্ত প্রক্রিয়া নিজে উপস্থিত থেকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতেন। এক্ষেত্রে সাজা ছিল ফাঁসি। দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করতেন অপরাধীর শাস্তি―ফাঁসি।
          

বিস্ময় জাগে, একজন সফল বৈজ্ঞানিক হয়ে কোন অসীম ক্ষমতাবলে কূটনীতির এসব ঘৃণ্য কাজে নিজেকে জড়ালেন তিনি! তিনি বলেছিলেন― বাইরে থেকে বল প্রযুক্ত না-হলে স্থির বস্তু চিরকাল স্থির থাকবে আর গতিশীল বস্তু সর্বদা সমবেগে সরল‍রেখায় চলতে থাকবে। অথচ বাহ্যিক বল প্রযুক্ত হলে তার না-কি গতির পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু তিনি বলে যাননি, বাহ্যিক কোন অলীক প্রবৃত্তি-বলে রক্ত- মাংসের একজন মানুষ এমন দ্বৈত আচরণ করতে পারে― একাধারে উচ্চ পর্যায়ের বৈজ্ঞানিক গবেষণা আর অন্যদিকে ক্ষুদ্র পার্থিব স্বার্থ অন্বেষণ! সাধারণের চোখে তিনি একজন বিজ্ঞান–তপস্বী; সংকীর্ণ স্বার্থের ঊর্ধ্বে মহাজ্ঞানী নমস্য ব্যক্তি। পরম শ্রদ্ধার পাত্র। তাই, আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবর না-ই বা রাখলাম। মাতা গান্ধারীর মতো অনিন্দ্যসুন্দর চক্ষুর উপর কালো রিবন বেঁধে আমরা বিস্মৃত হব তাঁর নাম-যশের আকাঙ্ক্ষা, ঐতিহাসিক ক্যালকুলাসের লড়াই। বরং স্মরণে থাকবে একটি আপেলের চিরায়ত গল্প। পোষ্য ডায়মন্ডের কারণে ল্যাবরেটরিতে আগুন; তাঁর বিশ বছরের অধ্যবসায়ের ফসল ভস্মীভূত হওয়ার রোমহর্ষক কাহিনী। বস্তুর গতি সম্বন্ধীয় নিউটনের তিনটি গতিসূত্র। দূর আকাশের মহাকর্ষ সূত্র। আলোকবিদ্যা আর অবশ্যই ক্যালকুলাসের উদ্ভাবন। 

শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের বিজ্ঞানী-সত্তার বহিঃপ্রকাশটুকুই আমাদের পাথেয় হোক, অন্য কিছু নয়। এ হেন প্রিয় বিজ্ঞানীকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম এবং অন্তরের অন্তহীন ভালোবাসা জানাই।

তথ্য সহায়তা :
ঈশ্বরকণা মানুষ ইত্যাদি ― পথিক গুহ
বিজ্ঞানে স্মরণীয় যাঁরা ― মৃদুল দে
আকাশভরা সূর্য তারা ― দেবব্রত দাশগুপ্ত
বিশ্ব মনীষী শতক ―পৃথ্বীরাজ সেন
উইকিপিডিয়া সহ বিভিন্ন ওয়েবসাইট

পেজ-এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments