জ্বলদর্চি

বাংলা ভাষায় বাঙালি মেয়ের লেখা প্রথম মৌলিক উপন্যাস ‘মনোত্তমা/'প্রসূন কাঞ্জিলাল

বাংলা ভাষায় বাঙালি মেয়ের লেখা প্রথম মৌলিক উপন্যাস ‘মনোত্তমা'

প্রসূন কাঞ্জিলাল


একটা বই নিয়ে আজ একটু জানার চেষ্টা করছি। বইটি "মনোত্তমা"। ১৮৬৫ সালে দুর্গেশনন্দিনী প্রকাশ পাবার তিন বছর বাদে মানে ১৮৬৮ সালে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বাঙালী মহিলার লেখা প্রথম মৌলিক উপন্যাস। লেখিকা হিন্দু কুল কামিনী।  বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক স্বর্গত শ্রী অদ্রীশ বিশ্বাস মহাশয় ব্রিটিশ লাইব্রেরী থেকে এই বইটার প্রথম প্রকাশিত সংস্করণ খুঁজে বার করেন। দেশে ফিরে এসে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে বইটি প্রকাশ করেন। উনি দেশে ফিরে এসে অনেক খোঁজ খবর করে দেখেন ১৮৬৭ সালে "নবপ্রবন্ধ" পত্রিকাতে এক বছর ধরে ধারাবাহিক বার হয়েছিল। মূল বইতে উনি প্রকাশকের নাম পাননি, একমাত্র মুদ্রক ছাড়া।

কাহিনী আলাদা এই উপন্যাসের।  এক শিক্ষিত  নারীর গল্প। যে বিয়ের পরে তার অশিক্ষিত স্বামীকে পড়াতে শুরু করে। স্বামী তাকে জব্দ করতে আর একটা বিয়ে করে। মনোত্তমা স্বামীর ঘর না ছেড়ে তার নতুন সমস্যাকে শিক্ষা দিয়ে মোকাবিলা করে। চমকপ্রদ উপন্যাস। অদ্রীশ বাবু জানিয়েছেন যে লেখিকার নাম কামিনী দেবী, হুগলীতে বাড়ি। পাঁচশো কপি ছাপা হয়েছিলো। বাংলাভাষায় লেখা বাঙালি মেয়ের প্রথম উপন্যাস মনোত্তমা।
 
স্বয়ং শ্রী অদ্রীশ বিশ্বাস মহাশয় যা লিখেছিলেন তা হোলো-----

" " বাংলা ভাষায় বাঙালি মেয়ের লেখা প্রথম মৌলিক উপন্যাস ‘মনোত্তমা’। প্রকাশিত হয় ১৮৬৮ সালে, যার তিন বছর আগে ১৮৬৫ সালে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর প্রথম বাংলা উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রকাশ করেন। মানে প্রায় একই সময়ে এক জন মহিলা ‘মনোত্তমা’ লিখছেন। কিন্তু এই তথ্যটা আমরা সম্পূর্ণ না জেনে একটা অন্ধকার অবস্থায় ছিলাম। কে প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক, তাঁর নাম ও বইয়ের কোনও হদিশ দিতে পারেননি স্বয়ং সুকুমার সেনও!
বছর কয়েক আগে একটা ফেলোশিপ পেয়ে লন্ডনে যাই ও ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে কাজ করতে থাকি। শুনেছিলাম ‘মনোত্তমা’র একটাই মাত্র কপি নাকি সেখানে আছে। ক্যাটালগ ঘেঁটে দেখি, ওই নামে কোনও বই নেই। যিনি দায়িত্বে ছিলেন তাঁকে বললাম, বাংলায় লেখা প্রথম মেয়ের উপন্যাসটা শুনেছি এখানেই আছে, কিন্তু ক্যাটালগে তো নেই। আমি সেটা উদ্ধার করে দেশে নিয়ে যেতে চাই। এটা আমাদের ইতিহাস, আমাদের সম্পদ। যাঁকে বলছি, তিনি কিন্তু বাঙালি নন। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর কোনও দায়বদ্ধতা থাকার কথা নয়। কিন্তু সহযোগিতা আর সংরক্ষণ কী, সেটা ওঁদের কাছে শেখার। উনি আমায় বললেন, কিছু ‘রেয়ার’ বইয়ের চব্বিশটা ভলিউম আছে, যার ভেতরে কী আছে তার নাম জানি না, আপনি সেগুলো দেখুন।
রাজি আমি। কিন্তু সেগুলো খুবই রেয়ার বই বলে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা আছে। আজ বললে কাল আসবে। আমি চব্বিশটা ভলিউমের অ্যাপ্লিকেশন করলাম। যেহেতু তার ভিতরে কী আছে কেউ জানে না, সেটার ক্যাটালগ নেই। এটাই বলার ও দেখার যে, ওঁরা ভাষা না জেনেই বইকে এত সুন্দর ভাবে সংরক্ষণ করেন; তার ফলে বইয়ের ভাগ্যেও জোটে মহারানির মতো জেড প্লাস নিরাপত্তা। পর দিন তাই বইগুলো এল বড় ভ্যানে চড়ে, সেখানে রাইফেল সহ পুলিশ ও সামনে-পিছনে পাইলট কার। আমি হতবাক হই এই মহৎ দৃশ্যে। ওঁরা আমাকে চব্বিশটা ভলিউমই এনে দিলেন। এক-একটা ভলিউমে কুড়িটা করে বই, কোনওটারই ক্যাটালগ নেই। কেন? তা হলে বইগুলো চুরি হয়ে যেতে পারে, লুঠ হতে পারে। তাই রেয়ার বুক কিন্তু ক্যাটালগহীন। আমি এক-একটা করে ভলিউম ওলটাই, কিন্তু ‘মনোত্তমা’ পাই না। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ একটায় সেই উনিশ শতকের ভাঙা সিসার হরফে দেখি লেখা ‘মনোত্তমা’। মুহূর্তে আমার শিরা জুড়ে আনন্দের রক্তপ্লাবন হয়। গোটা বইটা ফোটোকপি করি। তার পর ফের জেড প্লাস নিরাপত্তায় ফিরে যায় বইগুলো, ব্রিটিশ লাইব্রেরি থেকে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে।

দেশে ফিরে গবেষণার কাজ শুরু করি। লেখাটা ছদ্মনামে, ‘হিন্দুকুল-কামিনী প্রণীত’। সাল ১৮৬৮। কে এই হিন্দুকুল-কামিনী? জানি না। কোথাও কি আগে বেরিয়েছিল? জানি না। কোনও প্রকাশক নেই, মুদ্রকের নাম আছে। অনেকগুলো বাধা পেরোতে হবে আমায়। শুরু হল উনিশ শতকের বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখা। ‘নবপ্রবন্ধ’ পত্রিকায় খোঁজ মিলল। ১৮৬৭-তে প্রায় এক বছর ধরে এই মাসিক পত্রিকায় ‘মনোত্তমা’ ধারাবাহিক বের হয়।
উপন্যাসের কাহিনিটা একদম আলাদা। উপন্যাসের যা নাম ‘মনোত্তমা’, কাহিনির নায়িকাও সে। বলা যায়, এই বই একই সঙ্গে এক নারীর লেখা ও এক জন নারীর কাহিনি। সেই মেয়ে, মনোত্তমার বাবা তাঁকে পড়াশোনা শিখিয়ে বড় করেন। পড়াশোনার দাম অনেক, সেই বার্তাই  বাঙালি নারীর প্রথম উপন্যাসে দিয়ে যাওয়া হয়েছে।

শিক্ষিত মনোত্তমার সঙ্গে বিয়ে হয় অশিক্ষিত একটা ছেলের। এটা নতুন ঘটনা। কী সমাজে, কী সাহিত্যে উনিশ শতকে প্রথম শিক্ষিত হত ছেলেরা, তার পর তারা অশিক্ষিত মেয়েদের বিয়ে করে শিক্ষিত করে তুলত। কৈলাসবাসিনী দেবী থেকে ঠাকুরবাড়ির একাধিক বিয়েতে সেই উদাহরণ আছে। আর সাহিত্যেও তা-ই।
মনোত্তমা কিন্তু অন্য গল্প শোনাচ্ছে আমাদের। কী সেটা? মনোত্তমা তার স্বামীকে পড়াতে শুরু করে। স্বামীর সম্মানে লাগে। স্বামী তখন আর একটা বিয়ে করে বউকে জব্দ করতে। মনোত্তমা কোনও বিদ্রোহ করে চলে যায় না। মনোত্তমা শ্বশুরবাড়িতে থেকে তার নতুন সমস্যাকে শিক্ষা দিয়ে মোকাবিলা করে। সে পড়াতে শুরু করে, নতুন বউয়ের বাচ্চাদের। সঙ্গে পাড়ার বাচ্চাদের। তার ‘আলোকিত’ হয়ে ওঠার সেই অস্ত্র কাজ দেয়। সংসারে ঝগড়ার বদলে প্রশংসা লাভ করে। এই মন জয় করার ভারতীয় শ্রদ্ধাভক্তির পদ্ধতিটা একদম নতুন ঘটনা। অথচ এই সামাজিক রূপটা আমরা জানতাম না। অনেক পরে আলোকপ্রাপ্ত নায়িকাদের গল্প-উপন্যাস লেখা হয়। কিন্তু সেটা যে প্রথম উপন্যাসেই ঘটে গিয়েছে, তার হদিশ ছিল না আমাদের। ফলে ‘মনোত্তমা’ চমকে দেয় অনেক দিক থেকেই।
ছদ্মনামে লেখা এই হিন্দুকুল-কামিনীর খোঁজ পেতে কালঘাম ছুটে গিয়েছে। কারণ, যে সমস্ত গ্রন্থপঞ্জিতে খোঁজ পাওয়া যেতে পারে, তাতে নেই। শেষে পুলিশের কাছে গিয়ে একটা ক্যাটালগ পাই, তাতে দেখি ‘মনোত্তমা’র নাম, লেখিকা কামিনী দেবী, হুগলিতে বাড়ি। পাঁচশো কপি ছাপা হয়েছিল, সেই তথ্যও লেখা আছে। এখন পুলিশ কেন এমন ক্যাটালগ পেল, এটা প্রশ্ন। যখন ইংরেজরা শাসন করছে তখন মহাবিদ্রোহ হয়। বহু বাঙালি বুদ্ধিজীবীর তাতে সমর্থন ছিল, অথচ ব্রিটিশ গোয়েন্দা পুলিশ তার খোঁজ পায়নি। গোয়েন্দাদের নজরে যাতে সব থাকে, সে জন্য তখন ওরা একটা আইন করে, সমস্ত প্রকাশিত বই দু’কপি করে জমা দিতে হবে। তারা পড়ে দেখবে, তার মধ্যে বিদ্রোহের কোনও বারুদ আছে কি না। আর সেই প্রকাশিত বইগুলোর একটা ক্যাটালগ বানায়। দু’কপি বইয়ের মধ্যে এক কপি এ দেশে রাখে, আর এক কপি ওদের দেশে নিয়ে যায়। সেই বইটাই এক কপি ‘মনোত্তমা’, যা দিয়ে ওঁরা ব্রিটিশ লাইব্রেরি ও মিউজিয়াম সাজিয়েছেন। আশ্চর্য সেই সংগ্রহ আর সংরক্ষণ মহিমা। তার বলেই দেশে ফিরে ‘আনন্দ’ থেকে পুর্নমুদ্রণ করা গিয়েছিল সেই বই। বাংলা ভাষায় লেখা বাঙালি মেয়ের প্রথম উপন্যাস ‘মনোত্তমা’।" " 

 ‘হিন্দুকুল-কামিনী মনোত্তমা। দুঃখিনী সতী চরিত, প্রথম খণ্ড। কলিকাতা, কাব্য প্রকাশ যন্ত্রে কালীকিঙ্কর চক্রবর্তী কর্তৃক মুদ্রিত, ১৮৬৮ (১২৭৫)।  ‘নবপ্রবন্ধ’ মাসিক পত্রিকায় ১২৭৪ আশ্বিন থেকে মাঘ (১৮৬৭-৬৮) খ্রিস্টাব্দে পুস্তকাকারে প্রকাশিত। বঙ্গমহিলা রচিত প্রথম উপন্যাস’। উক্ত গ্রন্থের পৃ: ৩০-৩১, ৪১, ৮৯, ৮১৫-১৭ এবং ৮৪৮ পৃষ্ঠায় চিত্র নং ২০-তে ‘মনোত্তমা’ গ্রন্থটির আখ্যাপত্রটিও প্রদত্ত হয়েছিল যা তৎকালীন ‘দ্য ব্রিটিশ লাইব্রেরি’র ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড ইন্ডিয়া অফিস কালেকশন্স, লন্ডন-এর গ্রন্থাগারিকের সৌজন্যে প্রাপ্ত হয়। এ ছাড়া বঙ্গমহিলা রচিত প্রথম উপন্যাস ‘মনোত্তমা’ গ্রন্থের সমালোচনাটিতেও যেমন এর অবান্তর নাম (সাবটাইটল): ‘দুঃখিনী সতী চরিত, ১ম খণ্ড’-এর নির্দেশ পাওয়া যায় (নবপ্রবন্ধ, আষাঢ় ১৩৭৪/১৮৬৮)। তেমনই, ৫৫ পৃষ্ঠা সংবলিত ‘মনোত্তমা’-র প্রথম খণ্ডের উল্লেখ পাওয়া যায় ‘বেঙ্গল লাইব্রেরি ক্যাটালগ’ ও ‘ব্রিটিশ মিউজিয়াম’-এর সংগৃহীত লুপ্ত তালিকায়। কিন্তু এর পরবর্তী কোনও খণ্ডের উল্লেখ নেই। তাই প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখে পুর্নমুদ্রিত ‘মনোত্তমা’ গ্রন্থটিকে কেন্দ্র করে আর একটি প্রশ্ন মনকে নাড়া দেয় তা হল: বর্তমান গ্রন্থটি কী কেবল মাত্র প্রথম খণ্ডেরই ফটোকপি?

স্বর্গত শ্রীৎঅদ্রীশ বিশ্বাস, কামিনী দেবীর ‘মনোত্তমা’ গ্রন্থটিকে ‘বাংলা ভাষায় বাঙালি মেয়ের লেখা প্রথম মৌলিক উপন্যাস’ বলেছেন, কিন্তু বাংলার প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক হলেন, শ্রীমতী হেমাঙ্গিনী। তাঁর গ্রন্থের নাম ‘মনোরমা’। হেমাঙ্গিনীর দুটি উপন্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়: ‘মনোরমা’ ও ‘প্রণয়প্রতিমা’। ‘মনোরমা’র রচনাকাল ১২৭২ বঙ্গাব্দ (১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দ)। প্রকাশকাল ১২৮১ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দ। পৃষ্ঠাসংখ্যা ৮১। বইটির ‘উৎসর্গপত্র’ জানায়, ১২৭২ সালে ‘মনোরমা লিখিত হলেও ‘ইহা মুদ্রাঙ্কনের নিতান্ত অযোগ্য জানিয়া এ পর্যন্ত কাহাকেও না দেখাইয়া ফেলিয়া রাখিয়াছিলাম।’ ‘ভূমিকা’য় প্রকাশক লিখেছেন, ‘এই মনোরমা তাঁহার নবোদিত সুকুমার ও অপরিস্ফুট সদ্ভাব বৃক্ষেরপ্রথম মঞ্জরী।’

প্রবন্ধে লেখা হয়েছে, ‘কে প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক তার নাম ও বইয়ের কোনও হদিশ দিতে পারেননি স্বয়ং সুকুমার সেনও।’ এই উক্তিটিও ঠিক নয়। ড. সেন অবশ্যই হদিশ দিয়েছেন। ‘মনোরমা’কেই তিনি ‘বাঙালী মহিলার লেখা প্রথম উপন্যাস’ বলেছেন। ‘সুতরাং বইটি (মনোরমা) বাঙালী মহিলার লেখা প্রথম উপন্যাস। প্রাচীন রীতি অনুযায়ী আখ্যায়িকার ধরনে লেখা হইলেও মনোরমায় উপন্যাসোচিত লক্ষণের অভাব নাই।’ (বাংলা সাহিত্যে গদ্য, চতুর্থ সং, ১৩৭৩, পৃ: ৯৫)।

হেমাঙ্গিনীর পরিচয় আমার জানা নেই। শুধু জানি, তিনি কলকাতার গোয়াবাগানের রাধানাথ বসু লেনের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। প্রসঙ্গত, বাংলা সাহিত্যে প্রথম মুসলমান মহিলা ঔপন্যাসিক হলেন, ফৈজুন্নেসা চৌধুরানী (রূপজালাল, প্রণয়মূলক আখ্যায়িকা, ঢাকা, ১৮৭৬)।

 সুকুমার সেনের ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ ঘাঁটলে অবশ্যই পাঁচ লাইন মনোরমার উল্লেখ পাওয়া যায়, ‘সমসাময়িক আখ্যায়িকার মতো মধ্যে মধ্যে অল্পস্বল্প পয়ার ছত্র থাকলেও বইটি উপন্যাসের লক্ষণহীন নয়।’ বঙ্কিম-প্রভাবিত রোমান্টিক আখ্যায়িকা বলতে গিয়ে তিনি নবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রত্নোত্তমা’, অজ্ঞাতনামার ‘মনোত্তমা’ ইত্যাদি উল্লেখ করেছিলেন। মনোত্তমা যে মহিলার লেখা, এটাই হয়তো সে সময়ে সুকুমারবাবুর গোচরেই ছিল না। প্রসঙ্গত বলা যায় মনোরমা উপন্যাসটি বেরিয়েছিল ১৮৭৪ সালে। তার আগের বছরই কিন্তু পাথুরিয়াঘাটার হরকুমার ঠাকুরের পত্নী শিবসুন্দরী দেবীর ‘তারাবতী’ বেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এটিকে অনেকে মৌলিক উপন্যাস হিসেবে গণ্য করেন না। আর ‘মনোত্তমা’ পুস্তকাকারে বেরোয় ১৮৬৮ সালে। সঙ্ঘমিত্রা চৌধুরী তাঁর ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মহিলা রচনার ক্রমবিকাশ’ (১৮৫০-১৯০০) বইয়েও সিদ্ধান্ত করেছেন, ‘মনোত্তমা হল বঙ্গমহিলা রচিত প্রথম উপন্যাস।’

Women of the Tagore household by Chitra Deb (PhD)(Penguin) ব‌ইতে উল্লেখ করেছেন যে শিবসুন্দরী দেবী প্রণীত তারাবতী উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৮৬৩ সনে। সেক্ষেত্রে পরম্পরা হয়- 
১) তারাবতী- শিবসুন্দরী দেবী (১৮৬৩)
২)দুর্গেশনন্দিনী- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৬৫)
৩)মনোত্তমা- কামিনী দেবী (১৮৬৮)। 

উল্লিখিত তারাবতী উপন্যাস আমি পড়িনি, এমনকি চোখেও দেখিনি। মনোত্তমা উপন্যাস আনন্দ পাবলিশার্স থেকে পুনর্মুদ্রিত।
প্রসঙ্গত জানাই শিবসুন্দরী দেবী পাথুরিয়াঘাটার হরকুমার ঠাকুরের সহধর্মিণী।

যদি যাবতীয় তথ্য সঠিক হয়, সেক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম বাংলা ঔপন্যাসিক হ‌ওয়ার শিরোপা থাকবে না।

শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায়ও ‘বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা’ বইয়ে সুকুমার সেনের সঙ্গে একমত নন। তাঁর কথায়, ‘মহিলা ঔপন্যাসিকদের মধ্যে প্রথম পথ-নির্দেশের কৃতিত্ব কাহার, তাহার সন্তোষজনক প্রমাণ পাওয়া কঠিন।’ শিশিরকুমার দাশও লিখছেন: অনেকেই মনোরমা গ্রন্থটিকে বাঙালি মহিলা রচিত প্রথম উপন্যাস মনে করেন। মানে, ওই উপন্যাস নিয়ে তাঁরও সংশয় রয়েছে।

অনেকে মনে করেন যে চন্দ্রাবতী দেবী প্রথম বাঙালি নারীলেখক। তবে প্রায় বঙ্কিমচন্দ্রের কালেই আবির্ভাব ঘটেছিল দুজন নারী ঔপন্যাসিকের। তাঁদের একজন লিখেছিলেন মনোত্তমা শীর্ষক একটি উপন্যাস। কিন্তু ‘হিন্দুকুল-কামিনী প্রণীত’ কথাগুলো ছাড়া সেই উপন্যাসে লেখকের কোনো নাম ছিল না। এর বিষয়বস্তুও বেশ আকর্ষণীয় ছিল। শিক্ষিত আলোকিত নারী মনোত্তমা তার জীবনের গতিপথ কী হবে, তাই নিয়ে বোঝাপড়া করছে। দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য উপন্যাসটি হেমাঙ্গিনী দেবী রচিত "মনোরমা" (১৮৭৪)। সম্ভবত ফুলমনি ও করুণার বিবরণ (১৮৫২ সালে এক ইংরেজের লেখা উপন্যাস), মনোত্তমা এবং নবীনকালী দেবীর "কামিনীকলঙ্ক"-এর (১৮৭০) পর এটি নারীর লেখা চতুর্থ উপন্যাস। ঐতিহাসিক দিক থেকে এসব উপন্যাসের গুরুত্ব নিঃসন্দেহে অনস্বীকার্য। বাঙালি মুসলমান নারীদের মধ্যে রূপজালাল (১৮৭৬) নামে প্রথম পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যগ্রন্থ রচনা করেন ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী। আনিসুজ্জামান বলছেন, ফয়জুন্নেসাই প্রথম মিশ্রভাষা বর্জন করে খাঁটি বাংলায় সাহিত্য রচনা করেন। ওই একই বছরে প্রকাশিত হয় স্বর্ণকুমারী দেবীর "দীপ নির্বাণ"।

 রবীন্দ্রনাথের বোন স্বর্ণকুমারীই ছিলেন সূচনাকালের সবচেয়ে খ্যাতিমান নারী লেখক। কিন্তু বিস্ময়কর হচ্ছে, এই বোনটির লেখালেখি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ অনেকটাই নিস্পৃহ ছিলেন। তবে মুসলমান নারীদের মধ্যে প্রথম গদ্যরচনার কৃতিত্ব যাঁর, তিনি হচ্ছেন তাহেরুন্নেসা। ১৮৬৫ সালে ‘বামাগণের রচনা’ নামে বামাবোধিনী পত্রিকায় তাঁর একটি গদ্য ছাপা হয়। ওই একই পত্রিকায় ১৮৯৭ সালে লুৎফুন্নেসা নামের আরেক মুসলমান নারীর কবিতা প্রকাশিত হয়। সেদিন থেকে বিবেচনা করলে তিনিই হচ্ছেন সাময়িকপত্রে প্রকাশিত প্রথম মুসলমান নারী কবি। নারী জীবনের অনগ্রসরতা আর এগিয়ে আসার আহ্বানই তাঁদের লেখায় বিষয় হয়ে উঠেছে।

তবে ঠিক উনিশ শতক নয়, বাঙালি মুসলমান নারীর লেখালেখিতে ব্যাপক আত্মপ্রকাশ ঘটে বিশ শতকে। আজিজুন্নেসা সম্ভবত প্রথম মুসলমান নারী, যাঁর লেখা মুসলমান সম্পাদিত ইসলাম প্রচারক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এর পরে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে খায়রুন্নেসার। প্রবন্ধ লিখতেন তিনি। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনেরও সাহিত্যক্ষেত্রে আবির্ভাব ঘটে বিশ শতকের সূচনাবর্ষ ১৯০১ সালে, নবপ্রভা পত্রিকায় ‘পিপাসা’ নামের একটি লেখার মাধ্যমে। রোকেয়া হচ্ছেন সেই সব বিরল লেখকের একজন, যিনি একাধারে সমাজসংস্কারের কথা বলেছেন, আবার সৃজনশীল রচনায়ও ছিলেন সমান সক্রিয়। ব্যঙ্গ রচনা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, কবিতা, ছোটগল্প ইত্যাদি সব ধরনের লেখাই তিনি লিখেছেন। তাঁর রচনা ক্ষুরধার যুক্তি, তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ আর প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা। নারীর অধস্তনতা, অবদমন আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারীর প্রতি নির্যাতনের যে ছবি তাঁর লেখায় পাওয়া যায়, বিস্ময়কর শোনালেও এত বৈচিত্র্যপূর্ণ লেখা বিশ্বসাহিত্যেই বিরল। রোকেয়ার অনুসারী হিসেবে এর পরেই আবির্ভাব ঘটে শামসুন্নাহার মাহমুদ ও রাজিয়া খাতুন চৌধুরানীর।।

উপরিউক্ত বিষয়ে কেউ উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ সহ বিস্তারিত জানালে অনেক অনেক ঋদ্ধ, সমৃদ্ধ হবো।।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

4 Comments

  1. এই কাহিনী পড়ে নারী হয়ে গর্বিত হলাম, নারীরা কি না পারে মনে অসম্ভব জোড় থাকলে। শ্রী প্রসূন কাঞ্জিলাল মহাশয়কে আমার ধন্যবাদ এমন সুন্দর একটি বিষয় লেখার জন্য।

    ReplyDelete
  2. বিশেষ ভাবে সমৃদ্ধ হলাম আপনি লিখে যান ,আমরা

    ReplyDelete
  3. আমি পড়ে ঋদ্ধ হই

    ReplyDelete