জ্বলদর্চি

ওয়েবিনার (Webinar): কিছু অভিজ্ঞতা কিছু প্রশ্ন/সজল কুমার মাইতি

ওয়েবিনার (Webinar): কিছু অভিজ্ঞতা কিছু প্রশ্ন
সজল কুমার মাইতি

কোভিড -19 এর প্রাদুর্ভাবে আজ সারা দেশে সঙ্গে আমাদের রাজ্যে ও স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় মাসের পর মাস বন্ধ। পড়াশোনা প্রায় লাটে উঠতে বসেছে। এরকম পরিস্থিতিতে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনলাইন ক্লাস নেওয়ার হিড়িক পড়ে গেছে। যে যার মতো করে হোটাসআপ, জুম, গুগল ক্লাসরুম, গুগল মিট, ইমেল প্রভৃতির মাধ্যমে অনলাইন পড়াশোনা চালানোর একটা প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অনেক সমস্যা থাকলে ও মোটামুটি চলছিল। তবে তীব্র অনিশ্চয়তার মধ্যে তাতে ও ভাঁটা পড়তে শুরু করেছিল। এখন আবার  কলেজে কলেজে ওয়েবিনার (Webinar) এর হিড়িক পড়েছে। 'চল কিছু করে দেখাই' এর কিছুটা তাগিদ আর ন্যাক (NAAC) এর পয়েন্টের 'খুড়োর কল' এর হাতছানি। কলেজে কলেজে প্রশাসকরা হঠাৎ করে উদ্যোগী হয়ে উঠেছেন। হাজার হাজার টাকা খরচ করে সফটওয়্যার কেনা হচ্ছে ওয়েবিনার এর প্ল্যাটফর্মের জন্য। স্বাভাবিক সময়ে যেসব প্রশাসকরা প্রায়শই কলেজ ফাঁকি দিতেন তারা কোন এক অজ্ঞাত কারনে হঠাৎ যেন জেগে উঠেছেন। তৎপর হওয়ার একটা ভান দেখা যাচ্ছে। টিচার স্টুডেন্ট সবাই প্রায় হামলে পড়ছে রেজিস্ট্রেশন করার জন্য। এমনকি ভিন রাজ্যেরও। 

কারন কি?

 প্রথমত, এই ওয়েবিনারগুলোর বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই কোন রেজিস্ট্রেশন ফি নেই। দ্বিতীয়ত, এদের অধিকাংশেরই গৃহবন্দি অবস্থায় টাইম পাসের কোন মিনিংফুল অল্টারনেটিভ নেই। তৃতীয়ত, ক্যারিয়ার অ্যাডভান্সমেন্ট স্কীমে (CAS) বাড়িতে বসে  যদি কিছু পয়েন্ট যোগাড় হয়ে যায় তো তাহলে তা 'পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা'। চতুর্থত, কিছু জন আছেন সত্যিই সিরিয়াস। তাদের ঘরবন্দি অবস্থায় কিছু জানার কিছু শেখার সুযোগ এসে গেছে। তারা এর যথেষ্ট সদ্ব্যবহার করতে পারছেন। ওয়েবিনার তাদের এই সুযোগ করে দিয়েছে। বাকি ক্ষেত্রে যত কম বলা যায় তত ভাল।
আবার এর কিছু  সাংঘাতিক সুবিধে ও আছে। লাঞ্চ টিফিনের ব্যাপার নেই। ফুল মালা বোকের (Bouquet) ব্যবস্থা করার দরকার নেই। তিন চারবার চায়ের বন্দোবস্ত করার দরকার নেই। এক্সপার্ট বা রিসোর্স পারসনদের আসা যাওয়ার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করার প্রয়োজন নেই। সেমিনার হলের কোন প্রয়োজন নেই। সাউন্ড সিস্টেম, ফুড কুপন, ব্রোসিওর এবং এ্যাবস্ট্রাক্ট ছাপানোর আদৌ কোন দরকার নেই। রেজিস্ট্রেশন ফর্ম থেকে শুরু করে প্রোগ্রামের সব ব্যবস্থা করা এমনকি সার্টিফিকেট জেনারেট করা অব্দি সব কাজই সফটওয়্যারই করে দেয় এখানে। ফিডব্যাক নেওয়ার কাজটা ও সফটওয়্যার করে দেয়। শুধু নিয়মিত মনিটরিং এর দরকার আছে। আর দরকার আছে একটা স্মার্টফোন কিংবা একটা ল্যাপটপ অথবা কম্পিউটার। ব্যাস তাহলেই ওয়েবিনারে অংশগ্রহন সম্ভব। 

  হ্যাঁ  অবশ্যই দরকার আছে যথেষ্ট ক্ষমতাপ্রাপ্ত ইন্টারনেটের বাধাহীন সংযোগ। বাড়িতে বসে মনের সুখে জ্ঞানার্জনের এমন সুযোগ সহজে খুব কমই পাওয়া যায়। ওয়েবিনার এই সুযোগ এনে দিয়েছে আমাদের সামনে।

  কিছু অভিজ্ঞতা - ওয়েবিনারে সাধারণত নিবন্ধীকরণের ঢেউ লেগে যায়। গৃহবন্দি অবস্থা ও ফি হীন নিবন্ধীকরণই মূলত এর জন্য দায়ী। সেজন্য অনেক ক্ষেত্রে অতিনিবন্ধীকলনের বা ওভাররেজিস্ট্রেশনের সমস্যা দেখা দেয়। কোন কোন ক্ষেত্রে স্পিকার যদি দূর্বল ইন্টারনেট কানেকশনের জন্য ডিসকানেক্ট হয়ে যান তবে তার পক্ষে আর ওয়েবিনারে ঢোকা আদৌ সম্ভব নাও হতে পারে। এমনটাই ঘটেছে কলকাতা সংলগ্ন একটি কলেজে। স্পিকারকে ছাড়াই অন্য এক ব্যক্তিকে দিয়ে ওয়েবিনার শেষ করতে হয়েছে। কি কেলেঙ্কারির কথা চিন্তা করুন। এভাবে অনেকেই দূর্বল ইন্টারনেট এর জন্য একবার বেরিয়ে আর ওয়েবিনারে ঢুকতে পারেন নি। কারন অতিনিবন্ধীকরনের জন্য বাকিরা কিউতে (Queue) ওপরে এসে যাচ্ছে। একবার বেরিয়ে আবার ঢোকার চেষ্টা করলে তখন কিউতে পরের দিকে স্বাভাবিক নিয়মে চলে আসছেন। যার জন্য আর তার পক্ষে ওয়েবিনারে ঢোকা সম্ভব হচ্ছে না। 

  যেহেতু ইন্টারনেটের হাল  অনেকাংশে দূর্বল বা ঘন ঘন ডিসকানেক্ট হয়, সেজন্য অনেকের পক্ষেই দ্বিতীয়বার বহু চেষ্টা সত্ত্বেও ওয়েবিনারে ঢোকা সম্ভব হয় না। জ্ঞানার্জনের আশা ত্যাগ করে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। এটা ও বহু কলেজের অভিজ্ঞতা। এছাড়া অডিও প্রবলেম তো প্রায়শই ঘটে থাকে। দূর্বলভাবে শোনা বা না শোনা দিয়ে ও কাজ চালাতে হয়। কোন ও এক কলেজের অভিজ্ঞতা কেউ কেউ বারমুডা পরে বা লুঙ্গি পরে বসে ওয়েবিনারে অংশগ্রহণ করছেন। কেউ কেউ আবার বাড়ির বাথরুমের ছবি শেয়ার করছেন ওয়েবিনার চলাকালীন। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ছবি শেয়ার তো আকছার ঘটছে। অ্যাডমিনের এসব সমস্যা ম্যানেজ করতে করতেই প্রাণ ওষ্ঠাগত। এছাড়া গ্যাজেটের সমস্যা থাকাটা তো স্বাভাবিক। অনেকেই আবার লাইন কানেক্ট করে রেখে সারাক্ষণই অন্য কাজে বা গৃহকর্মে ব্যস্ত থাকেন। লাইন কিন্তু যথারীতি কানেক্ট হয়ে বসে থাকে। এর ফলস্বরূপ অনেকেই যারা উৎসাহী বা সিরিয়াস জ্ঞানচর্চা করতে চান তারা বঞ্চিত হন। 

  আর ফিডব্যাকের কথা যত কম বলা যায় তত ভাল। আবার সার্টিফিকেট নেওয়ায় খুব একটা অনাগ্রহ দেখা যায় না। অনেক কলেজ এ বিষয়ে গুগল মিট, জোহো প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার করছেন। এদের ফ্রি ভার্সন দিয়ে ছোট্টখাটো প্রোগ্রাম করা যেতে পারে কিন্তু একটু বড় আকারে করতে হলে পেড (Paid) ভার্সন ছাড়া গতি নেই। সেক্ষেত্রে খরচ অনেকটাই।

  কিছু প্রশ্ন - এই ওয়েবিনারগুলোতে শুধু শিক্ষকদের নিবন্ধীকরণ করলেই কি চলবে? ছাত্রছাত্রীদেরকে কি সম্পূর্ণরূপে বাদ রাখাটা যুক্তিযুক্ত হবে? ছাত্রছাত্রী যোগ করলেই আবার অতিনিবন্ধীকরনের সমস্যা। তার মানে ওপরের অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা নয় কি? ছাত্রছাত্রীদের কথা যদি ধরি তবে কত জনের কাছে স্মার্টফোন আছে? যথেষ্ট ক্ষমতাসম্পন্ন  ইন্টারনেট সংযোগ সে কথা তো বলাই বাহুল্য। ছাত্র শিক্ষক সবার ক্ষেত্রেই এই সমস্যা অতীব তীব্র। বিশেষকরে আম্ফান ঝড়ের পরে। সংযোগ ছিন্ন হওয়াটাই এখন নিয়ম। না হওয়া ব্যতিক্রম। এর ফলস্বরূপ স্পিকারই ওয়েবিনার থেকে সংযোগহীন হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নয় কি? আর সফটওয়্যারের এত বিপুল খরচ যোগাবে কে? 

  সফটওয়্যারে দক্ষ অ্যাডমিন কলেজে কলেজে কজন পাওয়া যাবে? এখন ও তো বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরি আয়োগ (UGC) এর মান্যতা দেয় নি। নমুনা অভিজ্ঞতা বাস্তব হয়ে দাঁড়ালে এর প্রয়োজনীয়তা নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাবে। শিক্ষাগত উদ্দেশ্য কতটুকু পূর্ণ হবে তা ও প্রশ্নচিহ্নের মধ্যে এসে পড়বে। এটা যেন আর একটা নতুন হুজুগে পর্যবসিত না হয়। ওয়েবিনারের সংখ্যাধিক্য (কারণ কোমর বেঁধে বহু কলেজই একসঙ্গে নেমে পড়েছে ) একে গুরুত্বহীন করে দেবে না তো? অদূর ভবিষ্যৎ এর উত্তর দেবে।
-----------------------------

সজল কুমার মাইতি।
প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, বানিজ্য বিভাগ, হুগলী মহসীন কলেজ। পূর্বতন অধ্যাপক, গোয়েঙ্কা কলেজ অফ কমার্স এ্যান্ড বিজনেস অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন, কলকাতা। চৌত্রিশ বছরের অধিক কাল ইউ জি ও পি জি শিক্ষা দানের অভিজ্ঞতা। বতর্মানে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কলেজের বানিজ্য বিষয়ে সিনিয়র সার্ভিসের একমাত্র অধ্যাপক।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments