জ্বলদর্চি

কর্মতাপস আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় আদতে এক প্রফুল্ল স্মৃতি/ প্রসূন কাঞ্জিলাল

কর্মতাপস আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় আদতে এক প্রফুল্ল স্মৃতি
                       
প্রসূন কাঞ্জিলাল


১৮৮৮ সাল।  জাহাজটা এসে কলকাতা বন্দরে থামতেই  নেমেছিলেন এক যুবক যিনি  ছ’বছর ‘এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে’ অধ্যয়ন করে সেখানকার ‘ডি.এস.সি.’ উপাধি লাভ করেছিলেন, আর সেখানে তাঁর প্রবন্ধ সর্বোৎকৃষ্ট বিবেচিত হওয়ার জন্য পঞ্চাশ পাউন্ডের একটা পুরস্কারও পেয়েছিলেন। সেই পুরস্কারের টাকাটা পুরোই লেগে গিয়েছিল জাহাজ ভাড়া ও প্রভৃতি খরচায়। তাই কলকাতায় পৌঁছেছিলেন একেবারে কপর্দকহীন অবস্থায়। জাহাজের কোষাধ্যক্ষের কাছে নিজের জিনিষপত্র জমা রেখে  ধার করে নিয়েছিলেন আটটি টাকা৷ যুবকের  পরণে ছিল সাহেবী পোষাক, কিন্তু  সেই পোষাকে আত্মীয়স্বজনের কাছে যেতে তাঁর দ্বিধাবোধ হচ্ছিল।  তাই জাহাজ থেকে নেমেই  ছুটে গিয়েছিলেন   বন্ধু  ‘জগদীশচন্দ্র বসু’ র বাড়িতে। তাঁর কাছ থেকে ধুতি, পাঞ্জাবি প'রে  তারপরে গিয়েছিলেন নিজের বাড়িতে। যুবকের নাম আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়।

   তখনকার দিনে বিলেতে পরীক্ষায় যাঁরা কৃতিত্ব দেখাতেন, তাঁরা সেখান থেকেই একটা চাকরির যোগাড় করে দেশে ফিরতেন। কিন্তু প্রফুল্লচন্দ্র সে রকম কিছু করে আসেন নি। তাই তাঁকে গোটা একটা বছর নিজের দেশে বেকার থাকার পরে  পেয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে সরকারী অধ্যাপকের পদ। সেটাও আবার ‘আই. ই. এস.’ তো নয়ই, ‘বি.ই.এস’-ও নয়; শ্রেণীর বাইরে আড়াই শো’ টাকা বেতনের এক পদ। এরপরে তাঁর হাতে ‘Mercurous nitrite’ আবিষ্কৃত হয়েছিল, তিনি হিন্দু রসায়নবিদ্যার ইতিহাস লেখার মালমশলা সংগৃহীত করছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চেষ্টা চলছিল কি করে বক্তৃতার দ্বারা, বিভিন্ন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানকে ছাত্রদের কাছে মনোজ্ঞ করে তোলা যায়।

 প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের  সফলকাম হতে বিলম্ব হয়নি;  কলেজের ঠিক  পাশের ঘরেই ছিলেন তাঁর জুটি পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র বসু। সেই সময় অন্য কলেজের ছাত্রেরা দলে দলে এসে তাঁদের বক্তৃতা শুনে যেতেন। সে সময় প্রেসিডেন্সী কলেজ বললেই বোঝাত ‘জে.সি.বোস-পি.সি রায়’। তৎকালীন সময়ের স্মৃতিচারণ করে ১৯৬১ সালে একটি প্রবন্ধে ‘চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য’ মহাশয়  লিখেছিলেন, ‘‘কলকাতায় 5th Class থেকে পড়ছি। এই দুই মহাজ্ঞানীর নাম চারদিকে, কিন্তু কি দুদৈব! এফ-এ পাস করলুম, আজও এঁদের দর্শন লাভের সুযোগ ঘটল না। ১৯০১ সালের জুলাই মাসের প্রথম দিক। আজ থেকে ঠিক ষাট বছর আগের এক দিন। আর কে ঠেকায়, আজ তো প্রফুল্লচন্দ্রকে দেখব, খুব কাছ থেকেই দেখব, সপ্তাহে তিন-চার দিন করে দেখব। তিনি যে আমাদের ক্লাস নেবেন! প্রেসিডেন্সি কলেজে তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছি। ১১টা থেকে ১২টা অবধি একটা ক্লাস ছিল। ঘন্টা বাজল, আমরা বারাণ্ডা দিয়ে ছুটতে থাকলুম, কে সামনে গিয়ে বসতে পারে। সব গিয়ে হাজির হলুম। দ্বিতীয় ঘন্টা পড়ল, দরজা খুলে বেয়ারা ঢুকল, হাতে  রেজিষ্টারি। টেবিলের উপর সেটা  রেখে পাশে গিয়ে সে দাঁড়াল। উদ্‌গ্রীব হয়ে ওই দরজার দিকে সকলে তাকিয়ে আছি, স্মিতমুখে প্রবেশ করলেন অধ্যাপক মশাই। বিলেত ফেরৎ, অথচ টাই বাঁধা নেই, গলাবন্ধ একটা কোট পরা, কোটটা সুতির, সাদা-কালো চৌখুপিওয়ালা ছিটের। রেজিষ্টারি খুলে নাম ডাকলেন, ছাত্রদের একটু-আধটু পরিচয় নিতে থাকলেন। কিন্তু সে কথা থাক। যেটা বিশেষভাৰে চোখে পড়ল সেটা হলো এই - তাঁর গায়ে যে রকমের কোট অবিকল সেই রকমের কোট ওই বেয়ারার গায়ে । বিকালে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে কথাটা পাড়লুম গুপীবাবুর কাছে। 

‘স্যার, এটা কি রকম হলো, অধ্যাপকের গায়ে যে রকমের কোট ওই বেয়ারার গায়ে অবিকল সেই রকমের কোট!’ হাসতে হাসতে গুপিবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, হে, একটা থান কিনে চারটা কোট করিয়েছিলেন, দুটো বেয়ারাকে দিয়েছেন, দুটো নিজে পরেন।’ একটা কথা চলতি আছে, একজন লোকের চেহারা দেখে, তাঁর বেশভূষা দেখে, ভিতরের মানুষকে চেনা যায় না। কিন্তু এই তো প্রথম দিনেই চেনা গেল আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে। এর বহু বছর পরে এক দিনের এক ঘটনা - জ্যৈষ্ঠ মাস, ভীষণ গরম, সকাল থেকে গুমোট করে রয়েছে। বেলা ৮টা সাড়ে ৮টা হবে।  আমার এক ছাত্র,সতীশ মিত্র  এসে বলল পি.সি.রায়কে আমি কাছ থেকে দেখিনি, আমাকে নিয়ে চলুন তাঁর কাছে, আলাপ করিয়ে দিন। আচার্যদেব এখন থাকেন বিজ্ঞান কলেজের দোতলায় দক্ষিণ দিকের এক ঘরে। ঘর খোলা থাকে, অবারিত দ্বার, যাঁর যখন ইচ্ছে যাচ্ছে। আমরা ঘরে ঢুকলুম, দেখলুম তিনি শুয়ে শুয়ে পড়ছেন সেক্সপীয়র। বললেন, ‘বোস, শোন এই জায়গাটা’ - বলে কিছুটা পড়ে গেলেন। তারপর, ‘কি মনে করে, বল।’ আমি বললুম – ‘এই ছেলেটি স্যার রমেশচন্দ্র মিত্রের পৌত্র, - আমাদের কলেজ থেকে বি.এস.সি পাশ করেছে।’ অনেকক্ষণ ধরে নানা কথাবার্তা হবার পর যখন বাইরে বারাণ্ডায় বেরিয়ে এলুম তখন  সতীশ আমাকে বলল - ‘দেখলুম ওঁর ঘরে পাখা নেই, আমি আজ দুপুরে একখানা পাখা ও একজন মিস্ত্রী  সঙ্গে করে এসে ওঁর ঘরে পাখা টাঙিয়ে দিয়ে যাব।’ আমি বললুম, – ‘দাঁড়াও, ওঁকে একবার জিজ্ঞেস করে আসি।’ ‘এ আর - কি জিজ্ঞেস করবেন!’ ‘না, হে, না, জিজ্ঞেস করা ভালো!’ দু’জনে আবার ফিরে গেলুম তাঁর ঘরে। সতীশের প্রস্তাবের কথাটা তাঁকে জানালুম। দমাস্ করে একটা কিল পড়ল আমার পিঠে। দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন - ‘এটা কোন্ দিক?’ ‘কেন, স্যার, দক্ষিণ দিক।’ ‘তবে!’ আমি চুপ করে রইলুম। এই ‘তবে’ কথাটার মানে ঠিক বুঝতে পারছিলুম না।  ‘দরজা খুলে রাখলে প্রচুর হাওয়া আসে, পাখার কোন দরকার হয় না।’কথা গুলো  বলে তিনি আবার নিজের স্থানে ফিরে গেলেন। আমরা হতবাক্। ঘরের দক্ষিণ দিকে একটা দরজার থাকলে সে ঘরে পাখার দরকার হয় না, সেটা বুঝতে একটু দেরি হচ্ছিল। চুপচাপ যে যাঁর বাড়ির দিকে রওনা হলুম। একদিন দুপুর বেলা আচার্যদেবের কাছে গেলুম। সেদিন ছিল রবিবার, সুতরাং পরীক্ষাগারে থাকতেন না, তাঁর ঘরেই তাঁকে পেলুম। কাজ সেরে চলে আসছি। ওই ঘরের মধ্যেই ছোট একটু ঘেরা জায়গায় কুকারে তার রান্না চড়েছিল। সামনে বেয়ারা ছিল, তাঁকে জিজ্ঞেস করলুম – ‘আজ কি রান্না হচ্ছে?’ বললো - ‘ভাত, মুশুরির ডাল, আলুসিদ্ধ।’ আমাদের কথাবার্তা বোধ হয় আচার্যদেবের কানে পৌঁছেছিল। তিনি এগিয়ে এসে বললেন - ‘মাখন দিয়ে আলুসিদ্ধ খেয়েছ?
চমৎকার! একেবারে অমৃত! আমি মাঝে মাঝে খাই।’ বলে ফিরে গেলেন। ‘মাঝে মাঝে খাই।’ রোজ খাবার পয়সা কোথায়! সাতশ টাকা মাসে মাইনে, তার সবই তো প্রায় যায় ছাত্রদের দিতে। বেঙ্গল কেমিক্যালের ডিরেক্টর হিসেবে যা পান তাও তো সেখানকার কর্মীদের ক্লাবে দিয়ে আসেন, তাঁরা আমোদ-আহ্লাদ করবে। আর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষক হিসেবে যা আসে সেটাও  যায় অন্য এক প্রতিষ্ঠানে। বাড়তি টাকা আর কটা!’’ এই কারণেই তাঁর যখন সত্তর বছর বয়স পূর্ণ হয়েছিল তখন কারাবন্দী গান্ধীজি জেল থেকেই ‘চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য’কে একটা চিঠিতে লিখেছিলেন - ‘‘It took my breath away when I heard that out of his princely salary he kept only a few rupees for himself and the rest he devoted to public uses and particularly for helping poor students.’’ একজন উচ্চ প্রতিষ্ঠিত গবেষক, বৈজ্ঞানিক, শিক্ষক, লেখক ও একটা আস্ত প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর হয়ে এই ধরণের জীবন যাপন করা এখন কি কেউ কল্পনা করতে পারেন? এতো পুরোপুরি এক সাধকের জীবন! সম্ভবতঃ তাই নিজের জীবনের একেবারে শেষের দিকে পৌঁছে ‘চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য’ লিখেছিলেন, ‘‘পারের দিকে এক পা এগিয়ে দিয়েছি। দ্বিতীয় পদক্ষেপের আর বিলম্ব নেই। সেখানে পৌঁছলে সেখানকার অধিকর্তা যখন জিজ্ঞেস করবেন - পৃথিবীতে পাঠালুম, কি দেখে এলে? পৃথিবীর খুব বেশি কিছু দেখি নি, তবে দেখেছি - উত্তরে বলব - একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশির বিন্দু। আর মানুষ দেখেছি খুব বেশি নয়। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন - প্রফুল্লচন্দ্র রায়।’’ প্রফুল্লচন্দ্রের একটি প্রধান বিশেষত্ব ছিল ছাত্রদের কৃতিত্বে তিনি যে রকম আনন্দ ও গৌরব অনুভব করতেন নিজের কৃতকার্যতাতেও বোধ হয় সেটা করতেন না। এতেই বোঝা যায় ছাত্রদের প্রতি তাঁর স্নেহ কতটা আন্তরিক ছিল এবং গবেষণার কাজের প্রতি তাঁর কত প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল। কাজকে বড় করে তিনি নিজেকে সব সময় আড়ালে রাখতেন। যদিও তিনি জীবনব্যাপী রসায়ন শাস্ত্রের সেবা করে গিয়েছিলেন এবং সেটাই ছিল তাঁর অতিপ্রিয় শাস্ত্র তবু অন্যান্য বিষয়ে বিশেষতঃ সাহিত্য, ইতিহাস, রাজনীতি ও অর্থনীতি তাঁর অবসরের সঙ্গী ছিল। তাঁর পুস্তকাগার দেখলেই বোঝা যেত যে তাঁর অনুসন্ধিৎসা কত সৰ্ব্বতোমুখী ছিল। 

তবে নিজেকে কেবল গবেষণাগারে আবদ্ধ রাখেননি দেশের সকল অবস্থার সঙ্গেই তাঁর গভীর সংযোগ ছিল। এখন কেউ বই বিশেষ মনোযোগ দিয়ে পড়তে চান না। কোন মতে পড়ে, পরীক্ষায় ভালো নম্বর নিয়ে পাশ করে যাওয়াই সকলের লক্ষ্য থাকে। এই বিষয়ে তাঁরও আক্ষেপ ছিল। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমরা যে বিদেশী ডিগ্রীর জন্য ব্যস্ত হই, সেটাও আমাদের দাস মনোভাবের ফল। আসল জিনিস হচ্ছে জ্ঞান-স্পৃহা। পড়াশুনা করতে চাইলে আমাদের যে সব লাইব্রেরী আছে তাতেও যথেষ্ট বই পাওয়া যায়। কলিকাতার Imperial Library ও University Library থেকে আমি বছরে অন্ততঃ এক হাজার বই নিয়ে পড়ি। পড়ি, নোট করি - যেন রাত পোহালে আমার এম.এ.এগ্‌জামিন। দেশে যে সব লাইব্রেরী আছে তারও সদ্ব্যবহার দেশের লোক করে না। সারবান বই খুব কম লোকেই পড়ে।’’

এবারে চলে যাওয়া যাক ইংরাজী ১৯১৯ সালে। কলকাতা মহানগরীর বুকে আপার সার্কুলার রোডের উপরে ছিল এক বিশাল অট্টালিকা। সেটার ছোট্ট একটা কামরায় বাস করতেন শীর্ণকায় এক বৃদ্ধ। তাঁর মাথার চুলগুলো ছিল ছোট ছোট করে ছাঁটা। তাঁর মুখমণ্ডল ছিল কাঁচা পাকা দাড়ি গোঁফে ভর্তি। যেমন সাধাসিধে ছিল তাঁর বেশভূষা, তেমনি ছিল তাঁর চেহারা, আর ঠিক তেমনি ছিল তাঁর স্বভাব। বাহ্যিক আড়ম্বর বা জাঁকজমক তাঁর জীবনে কখনও স্থান পায়নি। তাঁর ঘরের আসবাবপত্র ছিল আরও সাধারণ। একখানা হোট চৌকি (দড়ির খাটিয়া) আর দুটো ছোট ছোট কাঠের আলমারি; তাও সেগুলো একেবারে আজে বাজে কেরোসিন কাঠের তৈরী ছিল। সেই বৃদ্ধের জীবন-ইতিহাসে বিশ্রাম ও বাবুগিরি বলে কোন কথা লেখা ছিল না। তবুও দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে যে পাঁচ কি ছয় ঘন্টা অবসর পেতেন সেটাও তিনি কাটাতেন সেই দড়ির খাটিয়ায়। কাঠের দুটো আলমারিতে থাকতো সারা সপ্তাহের খোরাক। চিঁড়ে, মুড়ি, গুড়, নারকেলের সন্দেশ অথবা ওরকম ধরণের ঘরে তৈরী একেবারে আটপৌরে কোন খাবার। সপ্তাহের শেষের দিকে, শনি-রবিবারের মধ্যে, ডাক বিভাগ ও লোক মারফত বর্মা থেকে শুরু করে পাঠান অঞ্চল, নানা জায়গা থেকে খাবার তাঁর কাছে এসে যেত। তাছাড়া অনেক সময় ভারতের বাইরে থেকেও তাঁর কাছে খাবার আসতো। যেই নানাপ্রকার খাবারে ভরে উঠতো তাঁর ছোট্ট কাঠের দুটো আলমারি অমনি বৃদ্ধের মনও ভরে উঠতো খুশীতে। তবে তাঁর সেই খুশি বেশিদিন থাকত না। কারণ, রবিবার হলেই তাঁর কাছে এসে উপস্থিত হতেন একজোড়া বিরাট গোঁফের অধিকারী - তাঁর গোঁফজোড়ার অনুপাতে দেহটাও ছিল তেমনি। তিনি শুধু জবরদস্ত গোঁফের মালিক ছিলেন না। যেমনি ছিল তাঁর গোঁফ জোড়া, তেমনি ছিল তাঁর দেহ, তেমনি ছিল তাঁর বিদ্যা আর ঠিক তেমনি ছিল তাঁর মনের বিরাটত্ব। 

তাছাড়া সবচেয়ে মজার জিনিস ছিল তাঁর খাবার বহর। দু’তিন ঘন্টার মধ্যে তিনি একাই সাবাড় করে দিতে পারতেন পুরো দুটো আলমারির চিঁড়ে, গুড়, মুড়ি, সন্দেশ। সেই বিশাল বপু ও গোঁফের মালিককে সারা ভারত চিনত ‘বাংলার বাঘ’ নামে। তবে তাঁর আসল নাম ছিল ‘স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়’। বৃদ্ধের ঘরের পাশে ছিল আরও দুটি স্বল্প পরিসর কামরা। সেখানে থাকতেন কয়েকটি ছাত্র। তাঁরা দরিদ্র ছিলেন এবং ঐ বৃদ্ধের সরাসরি তত্ত্বাবধানে থেকে তাঁরই কাছে লেখাপড়া শিখতেন। বৃদ্ধের কাছে লক্ষ্মী-সরস্বতী দু’জনেই বাঁধা পড়েছিলেন। অবশ্য একথা বললে একটুকুও বাড়িয়ে বলা হবে না যে, বৃদ্ধের আজীবন সাধনা ছিল এক হাতে লক্ষ্মী আর অন্য হাতে সরস্বতী বিলিয়ে যাওয়া - যে যত পারো কুড়িয়ে নাও। একদিন একটা বড় মজার ব্যাপার ঘটেছিল বৃদ্ধের পাশের কামরায়। ছাত্ররা কলেজ থেকে ফিরে এসে যে যাঁর জামাকাপড় ছাড়তে ব্যস্ত  হঠাৎ  ঘরের মধ্যে কোন মানুষের একটা গোঁ গোঁ শব্দে সবাই চমকে উঠেছিলেন। ব্যাপার কি? মনে হচ্ছে কে যেন একটা বিপদে পড়ে বেশ কষ্ট পাচ্ছে। হয়তো কিছুতেই বিপদ মুক্ত হতে পারছে না। তাই এই কাতরানি! সবাই উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে দেখেছিলেন তাঁদেরই একজনের গায়ের জামা কেন জানি আর খুলতে চাইছে না! সেই দৃশ্য দেখে বাকী ছাত্ররা বেশ কৌতুক অনুভব করেছিলেন। তাঁরা বিনাপয়সায় ঘরে বসে বহুদিন বাদে অমন সুন্দর সার্কাস দেখছিলেন! সেই ছাত্রের দুঃখে সমবেদনা জানানো তো দূরের কথা, বাকিরা আনন্দে হেসেই কুটিপাটি হচ্ছিলেন। এমনি সময় কী ব্যাপার দেখতে, বিপদ থেকে সেই ছাত্রকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এসেছিলেন বৃদ্ধ। ছাত্রটির অবস্থা দেখেই বৃদ্ধ বুঝতে পেরেছিলেন যে, ব্যাপারটা অত্যন্ত ঘোরালো! এখন কি উপায়ে সেই ছাত্রের গায়ের জামা খোলা যাবে? যে দর্জি জামা তৈরী করেছিলেন তিনি কি বোকা ছিলেন! তিনি জামার সামনের দিকে কয়েকটি বোতাম লাগিয়ে দিয়েছিলেন। যতবার জামা খোলো আর পরো ততবার বোতাম খোলো আর লাগাও। এত কি সব কাজের কথা মনে রাখা সম্ভব। আর সময়ই বা কোথায় অত। তাও আবার ওই কাঁচা বয়সে! বয়স বাড়লে হয়ত সেই ছাত্রটি চিন্তা করতে পারত ওসব কথা। আসলে কোন চিন্তায় মগ্ন থাকা অবস্থায় সেই ছাত্রটি জামা খুলতে গিয়েছিলেন। বোতামের কথা তাঁর মাথাতেই ছিল না। ফলে যা হওয়ার সেটাই হয়েছিল। শেষে সেই বৃদ্ধ ছাত্রটির শার্টের সামনের দিকের বোতাম কয়টি খুলে দিয়ে তাঁর পিঠ চাপড়ে সহাস্যে বলেছিলেন, ‘‘আস্ত একটি দার্শনিক নিয়ে মুস্কিলে পড়েছি।’’ সেই শীর্ণকায় বৃদ্ধ ছিলেন বিজ্ঞানাচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। সেই ‘দার্শনিক’ ছাত্রটি ছিলেন মানিকগঞ্জের অধিবাসী, ঢাকার জুবিলী স্কুলের ছাত্র বিজ্ঞানবিদ ‘ডক্টর মেঘনাদ সাহা’। সেখানে উপস্থিত বাকী ছাত্ররা ছিলেন - ‘ডক্টর জ্ঞান ঘোষ’, ‘ডক্টর জ্ঞান মুখার্জী’, ‘শ্রীচারু মুখার্জী’ ও ‘শ্রীরাসবিহারী দাস’। ভারতের বিজ্ঞানক্ষেত্রে তাঁদের অবদানের কথা সর্বজনবিদিত। ‘মহম্মদ শহীদুল্লাহ’ তাঁর এক স্মৃতিচারণে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় কে প্রথমবার দেখার অভিজ্ঞতা জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘‘ছেলেবেলায় লোকমুখে শুনেছিলাম ‘লক্ষ মুদ্রা মূল্যে ডাঃ পি.সি রায়ের মাথা বিক্রী হয়ে গেছে।’ এই ছোট্ট গ্রাম্য কথাটির তাৎপর্য ঠিক তখন বুঝতে পারিনি। সেবার বৈশাখে যখন শুনতে পেলাম প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ডাঃ রায় কিছুদিনের অবকাশ যাপনের উদ্দেশ্যে স্বগ্রামে আসছেন, তখন আগে থেকেই তৈরী হতে শুরু করলাম তাঁকে দেখবার জন্য৷ বিশেষভাবে, তাঁর মাথা দেখতে হবে। কি ধরণের তৈরী, না জানি কতবড় সে মাথা, যা’ দু’দশ টাকা নয় একেবারে লক্ষ টাকায় বিক্ৰী হ’ল! ডাঃ রায়ের চেহারা-ছবি, আচার-ব্যবহার, চাল-চলন, পোষাক-পরিচ্ছদ সম্বন্ধে পূর্বাহ্নে একটা কল্পনা করে রেখেছিলাম। যদি আমার সে কল্পনা শেষ পর্যন্ত একবিন্দুও সত্য হয়নি। তাই, প্রথমে বিশ্বাস করতে পারি নাই নিজের চোখ নিজের কানকে। কল্পনার আংশিক সত্য হওয়া ত’ দূরের কথা - একেবারে বিপরীত। ভেবেছিলাম হয়ত দেখতে পাব হ্যাট, কোট, প্যান্ট পরা এক সাহেব। তার পরিবর্তে দেখতে পেলাম এক অতি শীর্ণ, দীর্ঘকায়, শান্ত-শিষ্ট প্রশান্ত বৃদ্ধকে। মুখময় কাঁচা-পাকা দাড়ি-গোঁফে ভর্তি, গায়ে খদ্দরের ফতুয়া, পরণে মোটা সূতার একখানা ধুতী, তাও হাঁটু ঢেকেছে মাত্র। পায়ে তালতলার চটি। চেহারা থেকে শুরু করে অশন-বসন, আহার-বিহার, চাল-চলন, কথা-বার্তা কিছুতেই তাঁর সাহেবিয়ানার বা বাবুগিরির চিহ্ন নাই। খটখট করে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছেন বৃদ্ধ তাঁরই প্রিয় শিষ্য তৎকালীন কপিলমুনি উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্রীযুক্ত রাসবিহারী দাস মহাশয়ের কাঁধে ভর দিয়ে। বিদ্যা, বুদ্ধি, সামর্থ্যে যাঁর দেহের প্রতি অণু-পরমাণু উজ্জ্বল, তাঁর আবার কিসের প্রয়োজন বাহ্যিক অলঙ্কারের?’’ আসলে প্রফুল্লচন্দ্রের কাছে জাতি, ধর্ম, ইতর, ভদ্র, দেশ কাল বা পাত্রের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। দরিদ্রের জন্য তাঁর লক্ষ্মী-ভাণ্ডারের দ্বার সব সময়ে উন্মুক্ত ছিল।

হরিশ্চন্দ্র রায়। ভদ্রলোকের জমিদারি তখন পড়তির দিকে। বাড়িতে পাওনাদারদের নিয়মিত কড়া নাড়া। স্ত্রী ভুবনমোহিনীদেবী অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে নিজের গয়নার টাকায় কেনা জমিদারির তালুক বিক্রির কাগজে সই করছেন। তাঁদের কলকাতার বাসা উঠিয়ে দিয়ে  ফিরলেন খুলনার গাঁয়ে। ছেলেরা উঠলেন হস্টেলে।

সেজো ছেলের (জন্ম, ২ অগস্ট, ১৮৬১) জীবনে এই দৃশ্যটি মনে থেকে গেল। কিছু দিন পরে সেই ছেলেই উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেতের পথে রওনা দিতে উদ্যোগী হলেন। যাওয়ার আগে মা’কে বললেন, ‘জীবনে সাফল্য লাভ করলে, প্রথমেই সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও বাড়ির সংস্কার করব।’

সে কাজ বেশ কিছুটা করেওছিলেন। কিন্তু বাড়ির তুলনায় বাইরের জগৎ তাঁকে যে বেশি টানে। সেই টান আর দেশের কাজের জন্যই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় ‘আচার্য’। তিনিই প্রফুল্লচন্দ্র রায়।

তাঁর বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম বিশ্লেষণের ধৃষ্টতা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। শুধু একটি বিষয়ই বলা যেতে পারে, তা হল— মারকিউরাস নাইট্রাইটের আবিষ্কারকে প্রফুল্লচন্দ্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্ব হিসেবে ধরা হলেও যৌগটির ‘অস্তিত্ব’ এখনও অধরা, দাবি বিজ্ঞানীদের একাংশের। বরং তাঁর বৈজ্ঞানিক কৃতিত্ব, ‘জৈব নাইট্রাইট, গন্ধকযুক্ত বিবিধ জৈব যৌগ এবং ধাতব লবণের সঙ্গে তাদের বিক্রিয়া, জৈব হ্যালোজেন যৌগ বিশেষত ফ্লোরিনযুক্ত এবং পারদের ধাতু যুক্ত জৈব যৌগ— এ সবের প্রস্তুতি ও পরীক্ষণের সূচনা’ করা। কিন্তু এ বিষয়গুলি বহুল চর্চিত। তাই জীবনভর নানা কাজ, জেদের মধ্য দিয়ে কী ভাবে প্রফুল্ল-চরিত্র তৈরি হয়েছিল, তা সন্ধানেরই চেষ্টা করব আমরা।

জন্মস্থান রাড়ুলি গ্রামেই স্কুলছাত্র তখন প্রফুল্লচন্দ্র। ইতিহাস, ভূগোলের নানা বইয়ে মুখ গুঁজে থাকেন। একদিন মনে হল, বাবার ভূগোলের জ্ঞান পরীক্ষা করলে কেমন হয়! শিশু প্রফুল্লচন্দ্রের প্রশ্ন, ‘আচ্ছা, সিবাস্টোপল কোথায়?’ মুহূর্তে বাবা হরিশ্চন্দ্রের উত্তর, ‘কী সিবাস্টোপলের কথা বলছ? ইংরেজরা ওই শহর কী ভাবে অবরোধ করল, তা যেন চোখে ভাসে!’ (‘সিজ় অব সিবাস্টোপল’, ১৮৫৪-৫৫) — প্রফুল্লচন্দ্রের মানসিক গঠনের প্রস্তুতি-পর্বে তাঁর বাবার ভূমিকা বিশেষ ভাবে স্মরণীয়। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। বাড়িতে ডিএল রিচার্ডসনের ‘সিলেকশনস ফ্রম দ্য ব্রিটিশ পোয়েটস’-সহ দেশ-বিদেশের নানা বই, ‘তত্ত্ববোধিনী’, ‘অমৃতবাজার’, ‘সোমপ্রকাশ’, ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’-সহ নানা পত্রিকার বিপুল সম্ভার তাঁর। গ্রামে একটি ইংরেজি-বাংলা স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

এমনকি, তাঁরই উদ্যোগে এক বার গ্রামের স্কুলের পণ্ডিত পৈতেত্যাগী মোহনলাল বিদ্যাবাগীশ বিধবা বিবাহেও সম্মত হলেন। লোকজনের বাধায় তা সম্পন্ন হল না। এমন প্রগতিবাদী হরিশ্চন্দ্র ও টাকীর কালীনাথ মুন্সিকে নিয়ে ছড়া কাটল গোঁড়ার দল: ‘‘হা কৃষ্ণ, হা হরি, এ কি ঘটাইল,/ রাড়ুলি টাকীর ন্যায় দেশ মজাইল।’’

বাবার পরিকল্পনাতেই কলকাতায় পড়তে আসা, ওঠা ১৩২ নম্বর আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাসা, চাঁপাতলায়। হেয়ার স্কুলে ভর্তি হলেন। ১৮৭০-এর কলকাতায় তখন কলে জল সরবরাহ শুরু হয়েছে। বিজ্ঞান-মনের অধিকারী বালক প্রফুল্লচন্দ্র বিষয়টি অবাক বিস্ময়ে দেখতে থাকলেন। বারবার ছুটে যেতেন ময়দানে, অ্যালবার্ট হলে কেশবচন্দ্র সেনের ওজস্বী বক্তৃতা শুনতে। ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতি অনুরাগ এই সময় থেকেই তৈরি হল। পাশাপাশি, ভোর তিনটে-চারটে থেকে উঠে পাঠ্যক্রমের বাইরের বই পড়াও চলতে থাকল নিয়মিত।

এর ফল হল মারাত্মক, কৈশোরে কঠিন রোগে পড়লেন প্রফুল্লচন্দ্র। স্কুলের পাঠে প্রায় দু’বছরের জন্য ইতি। ওই পর্বে ল্যাটিন ‘সামান্য কিছু’ শিখে ফেললেন। মোটামুটি সুস্থ হওয়ার পরে ভর্তি হলেন মূলত ব্রাহ্মদের দ্বারা পরিচালিত অ্যালবার্ট স্কুলে। এখানে যেন প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। ‘রেক্টর’ কেশবচন্দ্রের ভাই কৃষ্ণবিহারী সেনের ইং‌রেজি সাহিত্য পড়ানোর প্রতি তৈরি হল বিশেষ মুগ্ধতা।

প্রবেশিকা পরীক্ষায় শিক্ষকদের ‘আশানুরূপ’ ফল কিন্তু তাঁর হল না। এর পরে, বিদ্যাসাগরের কলেজ মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হওয়া। সেখানে ইংরেজি সাহিত্য পাঠ শুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রসন্নকুমার লাহিড়ীর কাছে। চলল কালিদাসের কাব্য-পাঠও। কিন্তু এই পর্বেই প্রেসিডেন্সি কলেজের ‘বাহিরের ছাত্র হিসেবে’ স্যর আলেকজ়ান্ডার পেডলারের প্রেরণায় রসায়নের প্রতি বিশেষ টান শুরু।

জীবনের মোড় ঘোরাও তখনই। পরিবারের আর্থিক অবস্থা পড়তির দিকে। বাবার ইচ্ছে ছিল, ছেলেরা বিলেত যাক। সে জন্য এবং পরিবারের আর্থিক অবস্থার কথা ভেবে গোপনে ‘গিলক্রাইস্ট’ বৃত্তির জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করলেন প্রফুল্লচন্দ্র। কিন্তু তা জানতে পেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ‘কৃতী’ ছাত্রের বিদ্রুপ, ‘ওর (প্রফুল্লচন্দ্রের) নাম লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যালেন্ডারের বিশেষ সংস্করণে বার হবে।’ প্রফুল্লচন্দ্রও আশা ছাড়লেন। কিন্তু একদিন কলেজে ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য স্টেটসম্যান’-এর একটি সংবাদে দৃষ্টি পড়ল। গোটা দেশ থেকে সে বছর বৃত্তি পেয়েছেন বোম্বাইয়ের বাহাদুরজি আর বাংলার প্রফুল্লচন্দ্র!

বৃত্তি নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া জাহাজে চড়ে লন্ডন গেলেন প্রফুল্লচন্দ্র। কিছু দিন থাকার পরে গেলেন এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু গোল বাধল পোশাক নিয়ে। বিলিতি ওভারকোট, ‘টেইল-কোট’ তাঁর অপছন্দ। পছন্দ ছিল রাজা রামমোহন রায়ের চোগাচাপকান। তা-ই বানানো হল। কিন্তু দর্জির ভাষায় ‘সরু ও পাতলা’ হওয়ায় এ জিনিসও খুব একটা গায়ে আঁটল না।

এই পর্বে প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর যৌবনে নারীর ভূমিকা নিয়ে একটি ছোট্ট অনুচ্ছেদ লিখেছেন ‘আত্মচরিত’-এ। নারীর মাধুর্য ও সৌন্দর্যকে অনুভব করার ক্ষমতা থাকলেও কোনও তরুণীর সঙ্গে পরিচয় ঘটলেই তিনি যেন গুটিয়ে যান। আবহাওয়া, জলবায়ু ইত্যাদি কয়েকটি কথা ছাড়া আর যেন রা সরে না তাঁর! বয়স্ক পুরুষদের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনাতেই তাঁর তৃপ্তি!

আর তৃপ্তি রসায়ন গবেষণায়। কিন্তু এর মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটল। আচমকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের লর্ড রেক্টর স্ট্যাফোর্ড হেনরি নর্থকোট ঘোষণা করলেন, ‘সিপাহী বিদ্রোহের আগে ও পরে ভারতের অবস্থা’ শীর্ষক বিষয়ে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা হবে। রসায়নের পাঠ কিছু দিনের জন্য তুলে রেখে ইংরেজি ও ফরাসিতে লেখা বিভিন্ন বইপত্র, অর্থনৈতিক ইতিহাস প্রভৃতি পাঠ শুরু করলেন। ফলস্বরূপ, মোট সাতটি অধ্যায়ে ভাগ করা প্রবন্ধ জমা দিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। পুরস্কার না মিললেও এর মূল্যায়নে উইলিয়ম মুয়র ও অধ্যাপক ম্যাসন লিখলেন, ‘আর একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ, যেটিতে মোটো আছে।...ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এটি শ্লেষপূর্ণ আক্রমণে পূর্ণ।’ কিন্তু এই প্রবন্ধের জন্য প্রফুল্লচন্দ্র রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন। তবে ইতিহাসের পাঠ আপাতত মুলতুবি রেখে ১৮৮৭-তে রসায়নে মৌলিক গবেষণার জন্য ডিএসসি উপাধি পান তিনি।

তবে তার পরেও কিছু দিন বৃত্তির টাকায় বিলেতে থাকলেন বিজ্ঞানী। উদ্দেশ্য, ‘হাইল্যান্ড’ ভ্রমণ। লক ক্যাটরিনে সাঁতার কাটেন, রাত্রিবাস করেন লক লোমন্ডের তীরের হোটেলে। আর মনে মনে হয়তো আওড়ান ছেলেবেলায় পড়া উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘টু এ হাইল্যান্ড গার্ল’।

কিন্তু এ বার দেশে ফেরার পালা। দেশে ফিরে ভারতীয় শিক্ষা বিভাগে যোগ দেবেন, ইচ্ছে তেমনই। আলেকজ়ান্ডার ক্রাম ব্রাউন, উইলিয়ম মুয়রের সুপারিশ, চার্লস বার্নার্ডের চেষ্টা সত্ত্বেও তা সম্ভব হল না। শেষমেশ সেই সময়ে বিলেতে থাকা প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ চার্লস হেনরি টনি বাংলা শিক্ষা বিভাগে প্রফুল্লচন্দ্রকে নিয়োগের একটি সুপারিশপত্র পাঠালেন ডিরেক্টর আলফ্রেড ক্রফটের কাছে।

সেই চিঠির ভরসায়, কার্যত কপর্দকশূন্য অবস্থায় দেশে ফিরলেন প্রফুল্লচন্দ্র। প্রথম কাজই হল, বিলিতি পোশাক ছেড়ে বন্ধুর কাছে ধুতি আর চাদর ধার নেওয়া!

দেশে ফিরে কার্যত ১১ মাস কর্মহীন ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র! এই পর্বে বিশেষ ভাবে তাঁর পাশে দাঁড়ালেন জগদীশচন্দ্র বসু ও বন্ধুরা। শেষমেশ ১৮৮৯-র মাঝামাঝি প্রেসিডেন্সি কলেজে আড়াইশো টাকা বেতনের ‘সহকারী অধ্যাপক’-এর কাজ জুটল প্রফুল্লচন্দ্রের। তত দিনে তাঁর যোগ্যতার প্রতি সরকার অবিচার করেছে, ক্রফট সাহেবের কাছে সে কথা বলতে অপমানও হজম করতে হল তাঁকে। ক্রফট উদ্ধত ভাবে তাঁকে বললেন, ‘আপনার জন্য জীবনে অনেক পথ খোলা আছে। কেউ আপনাকে এই পদ গ্রহণ করতে বাধ্য করছে না!’ পাশাপাশি, বাংলার শাসনকর্তা চার্লস ইলিয়ট ‘ইম্পিরিয়াল সার্ভিসে’ ভারতীয়দের নিয়োগের পথ রুদ্ধ করে দিলেন।

তবে প্রেসিডেন্সির গবেষণাগারটি হয়ে উঠল প্রফুল্লচন্দ্রের আত্মার সঙ্গী। ভারতীয় নানা খাদ্যদ্রব্য ও তার ভেজাল নিয়ে এই পর্বেই গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণটি করলেন তিনি।

পাশাপাশি, তাঁর অধ্যাপক-সত্তাও ক্রমে বিকশিত হতে শুরু করল। ১৯০৯ সাল ভারতের রসায়ন তথা বৈজ্ঞানিক গবেষণার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বছর। জ্ঞানেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, মানিকলাল দে, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, পুলিনবিহারী সরকার, নীলরতন ধর, মেঘনাদ সাহা, রসিকলাল দত্ত-সহ একঝাঁক কৃতী ছাত্র পেল প্রেসিডেন্সি। ছাত্রেরা পেলেন প্রফুল্লচন্দ্রকে। এঁদের অনেককে নিয়েই প্রফুল্লচন্দ্রের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে পরবর্তী সময়ে তৈরি হবে ‘ইন্ডিয়ান স্কুল অব কেমিস্ট্রি’।

এই ছাত্রদের দিকে তাকিয়েই প্রেসিডেন্সি থেকে অবসর গ্রহণের সময়ে প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর বক্তব্যে কর্নেলিয়ার গল্প শোনালেন। গল্পটা এমন— এক ধনী গৃহিণী নিজের নানা দামি অলঙ্কার দেখিয়ে কর্নেলিয়ার কাছে তাঁর রত্ন-অলঙ্কার দেখানোর অনুরোধ করলেন। কর্নেলিয়া বললেন, ‘একটু অপেক্ষা করুন’। কিছুক্ষণ পরে তাঁর দুই সন্তান স্কুল থেকে ফিরলে, তাদের উদ্দেশ্য করে কর্নেলিয়া বললেন, ‘এরাই আমার অলঙ্কার।’ প্রফুল্লচন্দ্রও তাঁর ওই কৃতী ছাত্রদের কথা বলে বিদায়-ভাষণে বললেন, ‘এরাই আমার রত্ন’। এই রত্নদের টানেই হয়তো জানালেন তাঁর শেষ ইচ্ছের কথাও। ‘আমার বড় সাধ, মৃত্যুর পরে আমার এক মুঠো চিতাভস্ম যেন এই কলেজের পবিত্রভূমির কোথাও রক্ষিত থাকে।’

আসলে ছাত্র-রত্নদের চিনতে পারাটাই মাস্টারমশাইয়ের আসল কৃতিত্ব। এ প্রসঙ্গে জিতেন্দ্রনাথ রক্ষিতের কথা বলতে হয়। তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএসসি পরীক্ষা দিয়েও পাশ করতে পারেননি। কিন্তু ‘ব্যবহারিক রসায়ন’-এ তাঁর অসাধারণ দক্ষতা। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের পরীক্ষাগারে কিছু দিন কাজ করেই তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দিলেন। প্রফুল্লচন্দ্র তাঁকে নিজের গবেষণা কাজে সহায়তার জন্যও ডেকে নিলেন। কালক্রমে, জিতেন্দ্রনাথ সরকারি আফিম বিভাগে বিশ্লেষকের চাকরি পান।

প্রেসিডেন্সির পরে  স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে ১৯১৬-এ সায়েন্স কলেজে যোগ দিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। আইনজীবী তারকনাথ পালিত ও রাসবিহারী ঘোষের দানে তৈরি এই কলেজ। কিন্তু সরকার এই কলেজ থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকল। দ্বিধাহীন ভাবে বিলেতের মাটিতে দাঁড়িয়েই প্রফুল্লচন্দ্র বললেন, তাঁরা কলেজের জন্য অনুদান চাইলেই সরকার বলে ‘অর্থাভাব’। উল্টো দিকে, দেশের ধনী ব্যক্তিদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে মুখ ফিরিয়ে থাকারও সমালোচনা করলেন।

অথচ নিজে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দশ হাজার টাকা দান, মাদ্রাজ, নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে গিয়ে প্রাপ্য অর্থ সেখানেই দিয়ে আসা, কলকাতার সিটি কলেজ, এমনকি গ্রামে তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠিত স্কুলটির পাশে দাঁড়ানো— এমন নানা কাজ আজীবন করেছেন প্রফুল্লচন্দ্র।

আসলে শিক্ষার জগতে প্রফুল্লচন্দ্র একটি ‘লেগাসি’। বিষয়টি তাঁর ছাত্র নয়, বরং তাঁর ‘ছাত্রের ছাত্র’র মুখে শোনা যাক। এই ছাত্রটি বলছেন, ‘আমি একটা গুরুতর অপরাধ করেছি যে, স্যর পিসি রায়ের ছাত্র হতে পারিনি। সে জন্য হয়তো তিনি আমাকে ক্ষমা করেননি।...আমি তাঁর রাসায়নিক ‘প্রশিষ্য’ হয়েছি। পিসি রায়ের ছাত্র অতুলচন্দ্র ঘোষের কাছে আমি রসায়ন শিখেছি।’ বক্তব্যটি, ভারতের সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পুরস্কার যাঁর নামে, সেই শান্তিস্বরূপ ভাটনগরের!

কলেজকে ক্লাসের চৌহদ্দির মধ্যে আটকে রাখতে চান না প্রফুল্লচন্দ্র। ১৯২১-এ খুলনায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা গেল। কিন্তু সরকার তা মানতে নারাজ। এমনকি, সরকারি প্রতিনিধি রূপে বর্ধমানের মহারাজা খুলনা পরিদর্শন করে এসে বললেন, ‘দুর্ভিক্ষের চিহ্ন নেই।’ স্থির থাকলেন না প্রফুল্লচন্দ্র। দ্বারে-দ্বারে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। সংগ্রহ করলেন কয়েক লক্ষ টাকা। ১৯২১-এর খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমায় ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, সংবাদ পেয়েই আচার্য প্রণবানন্দজি মহারাজ তাঁর অনুগত ছাত্র ও তরুণদের নিয়ে সেই অঞ্চলে ছুটে গিয়ে সেবাকার্য আরম্ভ করেন। কিন্তু এই বিরাট সেবাকার্যে বহুলোক ও বহু অর্থের প্রয়োজন। খুলনা জেলার অন্যতম সুসন্তান ভারত বিখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় মহাশয় ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অর্থ সংগ্রহ করে আচার্য দেবের পাশে দাঁড়ালেন। শ্রী প্রণবানন্দ গুরুমহারাজও বিভিন্ন স্কুলে-কলেজে ঘুরে ঘুরে প্রায় ৫০০ জন তরুণ কর্মী সংগ্রহ করলেন। তাদেরকে দিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রায় আটমাস যাবৎ অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে সেবাকার্য পরিচালনা করলেন। এই ঘটনার পর প্রণবানন্দজির সুখ্যাতি আরো ছড়িয়ে পড়ে।

১৯২২-এ বগুড়া, রাজশাহী, পাবনা-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় বিপুল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হল জনজীবন। সরকারি হিসেবেই প্রায় ১,৮০০ বর্গ মাইল এলাকা প্লাবিত। ১২ হাজার গবাদি পশু নিখোঁজ। শস্য নষ্ট, প্রায় ৫০ জনের প্রাণহানি হয়েছে। ২১ নভেম্বর, ১৯২২-এর আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে জানা যায়, আমনদিঘি, নসরতপুরের গ্রামবাসী রেললাইনের কালভার্টের পরিবর্তে সেতুর দাবি জানিয়েছিলেন। তা মঞ্জুর করেনি রেলওয়ে। ঘটনাচক্রে, প্রফুল্লচন্দ্রও বন্যার জন্য এটিকেই কারণ বললেন।

শুধু কারণ চিহ্নিত করা নয়, ‘বেঙ্গল রিলিফ কমিটি’র ছাতার তলায় শুরু করলেন কাজ। সায়েন্স কলেজই হল তাঁর হেড কোয়ার্টার। কমিটির আর একজন সেনানি সুভাষচন্দ্র বসু। প্রফুল্লচন্দ্রের আহ্বানে অন্তত ৭০ জন স্বেচ্ছাসেবক প্রাথমিক কাজ শুরু করলেন। তাঁর আহ্বানে বোম্বাই, মাদ্রাজ-সহ দেশের নানা প্রান্ত, এমনকি জাপান থেকেও সাহায্য এল। সঙ্গে-সঙ্গে দেশবাসী ত্রাণের জন্য সায়েন্স কলেজে পাঠাতে থাকলেন রাশি-রাশি জামাকাপড়।১৯২১ সালে দক্ষিণ খুলনার দুর্ভিক্ষ ও ১৯২২ সালে মধ্য ও উত্তরবঙ্গের বন্যায় তাঁর সাহায্য বা দানের ফিরিস্তি দেওয়া এখানে সম্ভব নয়। বাঙালি জাতির কিসে উন্নতি হবে, কেমন করে তাঁরা স্বাধীন হবে, শিক্ষিত হবে এই ছিল তাঁর আজীবন সাধনা। প্রতি বছর বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসাধিককাল অবকাশ যাপনের উদ্দেশ্যে তিনি নিজের গ্রাম ‘রাড়ুলী’তে যেতেন। সেখানে তাঁর সখের মধ্যে ছিল - প্রতিদিন বৈকালে নৌকা ভ্রমণে যাওয়া। তবে জনসাধারণ ও তাঁর নৌকা ভ্রমণের মধ্যে একটু পার্থক্য ছিল। নৌকায় চড়ে তিনি নিজেই সেটার দাঁড় টানতেন৷ তখনও জরাজীর্ণ সেই বৃদ্ধের দেহে ছিল বল; তবে দেহের বল অপেক্ষা মনের বলই ছিল তাঁর বেশী। আর সেই মনের বলের জোরেই তিনি যে কোন ধরণের কঠিন কাজ সমাধা করতে পারতেন। প্রতিদিন অমন করে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘কপোতাক্ষ’ নদীতে নিজে দাঁড় টেনে তিনি নৌকাবিহারে বের হতেন৷ তবে সেটা করতে গিয়ে একদিন তিনি বিপদেও পড়েছিলেন। একদিন হঠাৎ কালবৈশাখীর ঝড় উঠেছিল সালকিয়ার কাছে। ঝড়ের বেগ সামলাতে না পেরে নৌকা ডুবেছিল। নৌকার সঙ্গে প্রফুল্লচন্দ্রও জলে পড়েছিলেন। 

শেষে, সেই যাত্রায় ‘অনাথনাথ রায়’ নামে একটি যুবক আচার্য রায়ের একখানা পা ধরে তাড়াতাড়ি তাঁকে ডাঙায় তুলে তাঁর প্রাণ রক্ষা করেছিলেন। ১৯২১ সালের দক্ষিণ খুলনার দুর্ভিক্ষের কথা ইতিহাসে সর্বজনবিদিত। দেশময় হাহাকার পড়ে গিয়েছিল। লোকের পেটে ভাত ছিল না, পরণে কাপড় ছিল না, দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের দেহ হয়ে উঠেছিল কঙ্কালসার। অনাহারে অর্ধাহারে মানুষ তিলে তিলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছিল। গাছে ফল ছিল না, এমনকি অনেক গাছের পাতাও ছিল না। খাল-বিল হয়ে গিয়েছিল শুষ্ক। মাছ সিদ্ধ করে যে খাবে লোকে, সেটারও উপায় ছিল না। এমন দিনে জনসাধারণ তৎকালীন সরকারের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করাতে, ব্রিটিশ সরকার অত্যন্ত দয়াপরবশ হয়ে ‘খুলনার কালেক্টর’ ‘ফকাস’ (L. R. Faucas) নামের একজন ইংরেজ আই.সি.এস.কে তদন্তের রিপোর্ট কি হবে সেটা আগেই শিখিয়ে পড়িয়ে তদন্ত করতে পাঠিয়েছিল। তিনি নদীপথে যেতে যেতে ‘কেওড়া’ নামক একপ্রকার জংলী ফলভর্তি গাছ দেখে পূর্ব চুক্তি অনুযায়ী তদন্তের ফলাফলে সরকারকে জানিয়েছিলেন, ‘‘গাছে ফল, ফুল ও পাতা ভর্তি, অতএব দুর্ভিক্ষের প্রশ্ন ওঠে না।’’ এর ফলে বৃদ্ধ বয়সে প্রফুল্লচন্দ্রকে ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে বের হতে হয়েছিল। যখন তিনি ‘আশাশুনি’ নামক জায়গায় দুঃস্থ মানুষদের চাল, ডাল, কাপড় বিতরণ করছিলেন সেই সময় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ফকাসের। সেখানে সবার সামনে তীব্রকণ্ঠে তিনি রিপোর্টের বিরোধিতা করাতে ফকাস তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘What can I do sir, if it is the policy of the Govt.’’ ব্রিটিশ সরকার কিভাবে ভারতবাসীদের হত্যা করত - এই ঘটনা তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রাজনীতিক ছিলেন না। কিন্তু দেশ যখনই কোনও সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছিল, তখনই তিনি জনস্বার্থ রক্ষাকল্পে নির্ভীকচিত্তে দাঁড়িয়েছিলেন এবং পরিস্থিতির সমাধানে এগিয়ে এসেছিলেন। যখন ইংলণ্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ‘রেমজে’ ‘ম্যাকডোনাল্ড সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’র সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন, তখন ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ সেটা না গ্রহণ না বর্জন নীতি গ্রহণ করায় আচার্য রায় মুক্তকণ্ঠে সেই নীতিকে ভ্রান্ত বলে প্রকাশ করেছিলেন। এমনকি রাজনীতির লোক না হয়েও সেই উপলক্ষে আচার্য রায় দেশের বিভিন্ন জায়গার নেতৃস্থানীয় প্রতিনিধিগণের এক সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন। ১৯৩৪ সালের ১৮ই ও ১৯শে আগষ্ট কলকাতার ‘রামমোহন লাইব্রেরী’তে সেই সম্মেলনের অধিবেশন হয়েছিল। তাতে ‘অর্গানাইজিং কমিটি’র সভাপতিরূপে আচার্য রায় তাঁর অভিভাষণে মন্তব্য করেছিলেন যে – ‘‘হোয়াইট পেপার বর্ণিত প্রতিক্রিয়াপন্থী শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি সংগ্রাম-ধ্বনি তুলিয়া থাকেন; কিন্তু সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁহারা নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করিতেছেন। এই সাম্প্রদায়িক সিদ্ধান্ত চিরদিনের জন্য ভারতবাসীকে বিরামহীন সংগ্রামরত দুইটি দলে বিভক্ত করিবে।’’ সেই সম্মেলনের ফলে কংগ্রেস ভেঙে ‘কংগ্রেস জাতীয় দল’ গঠিত হয়েছিল; সেই দল সাফল্যের সঙ্গে কেন্দ্রীয় পরিষদের নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করেছিল এবং বাংলার সমস্ত আসন দখল করতে সমর্থ হয়েছিল। রাজনীতির লোক না হয়েও প্রফুল্লচন্দ্র কিন্তু বাংলার মানুষের মন বুঝতে কোন ভুল করেননি। বাংলার জনসাধারণ যে তথাকথিত সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা গ্রহণ করতে রাজি ছিল না, ‘কংগ্রেস জাতীয় দলের’ বিপুল সাফল্য সেই কথাই প্রমান করে। নিজের মৃত্যু পর্যন্ত আচার্য রায় কংগ্রেস জাতীর দলের বন্ধু ও পরিচালক পদে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৩৯ সালের ২৭শে আগষ্ট আর একটা ‘নিখিল ভারত বাঁটোয়ারা বিরোধী সম্মেলনের’ অধিবেশন হয়েছিল। আচার্য রায় সেই অধিবেশনের উদ্বোধন করেছিলেন।
 সেই উপলক্ষে তিনি যে বক্তৃতা করেছিলেন সেটা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বক্তৃতা প্রসঙ্গে আচার্য রায় বলেছিলেন, ‘‘দুঃখ ও বিরক্তির মিশ্র মনোভাব লইয়া আজ আমি এই সম্মেলনে বক্তৃতা করিতেছি। আমার দুঃখের বিষয় এই যে, ভারতের রাজনৈতিক জীবনের এক দিকে সাম্প্রদায়িক কোলাহল ও অত্যধিক স্বার্থপূর্ণ মনোভাব প্রকট হইতেছে; আমার বিরক্তির কারণ এই যে, আমাদের রাজনৈতিক জীবনের ঘৃণিত সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা ব্যাধি সম্পর্কে ভারতের প্রতি কর্তব্য পালন সম্বন্ধে দিল্লীর ও হোয়াইট হলের কর্তৃপক্ষের মতিগতি আছে বলিয়া মনে হইতেছে না। আমি বিশেষ করিয়া আমার সেই সকল স্বদেশবাসীর জন্য দুঃখিত যাঁহারা স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সম্মিলিত ফ্রন্ট গঠনের আপাত মনোহর যুক্তি প্রদর্শন করিয়া ঐ সকল বিরোধী নীতির সহিত আপোষ রফা করিতে অগ্রসর হন। কারণ ভারতের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে সাম্প্রদায়িক নীতি প্রবিষ্ট হওয়ায় মীমাংসার যাবতীয় সম্ভাবনা ক্রমশঃ লোপ পাইতেছে। তাঁহাদের ‘না-গ্রহণ না-বর্জন’ নীতি নিঃসংশয়ে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের কূটনীতির সহিত সহযোগিতা করিয়া বিভেদ, মনোমালিন্য এবং বিদ্বেষের বিভীষণ দৃশ্য প্রকট করিতেছে। জগতের চক্ষে ভারতের মর্যাদাহানির জন্যই সুকৌশলে উহা উদ্ভাবিত হইয়াছে।’’ সেই অভিভাষণের উপসংহারে আচার্য রায় বলেছিলেন, ‘‘গত আড়াই বৎসর সাম্প্রদায়িক সিদ্ধান্ত কার্যকরী হইয়াছে। উহা যে যথার্থই অনৈক্যের বীজ তাহা প্রমাণিত হইয়াছে। ইহার ফলে আইন সভায় বিভিন্ন প্রকারের আইন এবং এই প্রদেশের স্বার্থহানিকর ও বিপদজনক মৌলিক শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন সাধিত হইতেছে। কিন্তু তথাপি আমি হতাশ হই নাই। কারণ, আমি বিশ্বাস করি, পরিশেষে ন্যায়েরই জয় হইবে।’’ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের জনসেবায় যোগদানের এটাই একমাত্র দৃষ্টান্ত নয়।

 ১৯৩৬ সালে প্রাথমিক শিক্ষা পদ্ধতি পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে বাংলা সরকার যখন একটি প্রস্তাব উত্থাপিত করেছিল, তখন সেই শিক্ষা পদ্ধতির জন্য বঙ্গপ্রদেশে শিক্ষা বিস্তারের পক্ষে সমূহ অসুবিধা সৃষ্টির আশঙ্কা করে আচার্য রায় সেটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এবং সেই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার জন্য ‘এলবার্ট হলে’ যে জনসভায় আয়োজন হয়েছিল তাতে তিনি সভাপতিত্ব করেছিলেন। তারপরে উক্ত প্রস্তাবের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তিনি সেটারও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাতে আকাঙ্খিত ফল হয়েছিল ও সেই প্রস্তাব আর বেশীদূর এগোতে পারেনি। ১৯৪০ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদে উত্থাপিত কুখ্যাত মাধ্যমিক শিক্ষা বিলের প্রতিবাদেও তিনি এগিয়ে এসেছিলেন এবং ১৯৪০ সালের ২১শে ও ২২শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বঙ্গীর মাধ্যমিক শিক্ষা বিলের প্রতিবাদ সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে তিনি সেই বিলের সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল বিষয়সমূহের স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছিলেন। তাঁর বক্তৃতার উপসংহারে তিনি বলেছিলেন--

 ‘‘এই বিল রচনায় বাঙ্গলার শিক্ষা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় বিষয় সমূহের প্রতি আদৌ দৃষ্টিপাত করা হয় নাই: বস্তুতঃ এই বিলটি রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য লইয়া রচিত হইয়াছে। ইহার সহিত শিক্ষার কোন সম্পর্ক নাই। এই বিলের ব্যবস্থাসমূহও অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল। বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদ বিলটিকে সিলেক্ট কমিটির নিকট প্রেরণ করিয়াছেন। কিন্তু এই সিলেক্ট কমিটির পক্ষে ঐ সকল প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থার বিশেষ কোন উন্নতি সাধন সম্ভব নহে। সুতরাং ঐ বিলটি প্রত্যাহার করাই উচিত, অন্যথা এই প্রদেশে অভ্রান্ত বিক্ষোভের সৃষ্টি হইবে। শিক্ষাক্ষেত্রে কর্মী হিসাবে আমার যে অভিজ্ঞতা যাছে তাহা হইতে আমি বলিতে পারি এই বিলটি দুরভিসন্ধিমূলক ও অনিষ্টকর। এই বিলটির দ্বারা কাহারও কোন উপকার হইবে না, এমন কি ইহা সাম্প্রদায়িকতাবাদীদেরও কোন কাজে আসিবে না। স্পর্শকাতর চারাগাছের ন্যায় মৈত্রীর মুক্ত আবহাওয়াতেই শিক্ষার বিস্তার হইয়া থাকে এবং জাতীয় ঐক্যই শিক্ষার মূল।’’ ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে সিলেক্ট কমিটি কর্তৃর্ক মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পর্কে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। আচার্য রায় সংবাদপত্রে প্রদত্ত বিবৃতিতে সেই রিপোর্টের তীক্ষ্ম সমালোচনা করেছিলেন ও সেটার প্রতিক্রিয়াশীল বিষয়সমূহের প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন - ‘‘বঙ্গীয় শিক্ষা পরিষদের সুনির্দিষ্ট অভিমত সিলেক্ট কমিটির রিপোর্টের দ্বারা মাধ্যমিক শিক্ষা বিলের আদৌ উন্নতি হয় নাই। এবং বহু বিষয়ে উক্ত বিল পর্বের চেয়ে ক্ষতিকারক হইয়াছে। আপাতদৃষ্টিতে কমিটি কর্তৃক উক্ত বিলের সামান্য উন্নতি হইলেও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করিলে দেখা যাইবে যে, ইহাতে কোন সারবত্তা নাই। সুতরাং পরিষদ পুর্নবার উক্ত বিলটি প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করিতেছে ইহা প্রত্যাহৃত না হইলে এই প্রদেশের জনবিক্ষোভ বৃদ্ধি পাইবে এবং দেশের অবস্থা সঙ্কটজনক হইয় পড়িবে।’’ তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন ভ্রান্ত নীতির বিরোধিতা করতে প্রফুল্লচন্দ্র কখনও পিছপা হননি, যেমন একবার সরকারের পক্ষ থেকে ছাত্রদের প্রদেয় বৃত্তির সমালোচনা করে লিখেছিলেন, ‘‘স্যার অ্যাসলি ইডেন যখন বাংলার ছোটলাট ছিলেন, তখন তিনি বৎসরে ৫০০ পাউণ্ড খরচ করিয়া দুইটি কৃষিবৃত্তির প্রবর্তন করেন। এই বৃত্তিদ্বারা প্রতি বৎসর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন সর্ব্বোচ্চ উপাধিপ্রাপ্ত ছাত্রকে বৈজ্ঞানিক কৃষিবিদ্যা শিক্ষার জন্য বিলাতে পাঠান হইত। এক একজন ছাত্রের পিছনে ২৫০ পাউণ্ড খরচ হইত।

 তখনকার দিনে একশত পাউণ্ডের মূল্য এখনকার তিনশত পাউণ্ডের সমান। প্রথম বারে যান একজন মুসলমান ও একজন হিন্দু। মুসলমান ভদ্রলোকটি বিহারের সৈয়দ সহকৎ হোসেন। হিন্দু ভদ্রলোকটির নাম অম্বিকাচরণ সেন। তাঁহারা শিক্ষালাড করিয়া যখন দেশে ফিরিয়া আসিলেন, তখন তাঁহাদের অর্জ্জিত কৃষিবিদ্যা কোন কাজে লাগাইবার সুযোগ হইল না। তাঁহারা হইলেন ষ্ট্যাটুটারি সিভিলিয়ান - জেলার ম্যাজিষ্টেট্ বা জর্জ। তারপর ক্রমে ক্রমে গেলেন অধ্যক্ষ গিরীশচন্দ্র বসু, ব্যোমকেশ চক্রবর্ত্তী, কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুল রায়, নৃত্যগোপাল মুখার্জি ও ভূপালচন্দ্র বসু প্রভৃতি। ইঁহারা আমার সমসাময়িক। ফিরিয়া আসিয়া ইঁহাদের অধিকাংশেরই করিতে হইল ডেপুটিগিরি। ব্যোমকেশ বাবু হইলেন ব্যারিষ্টার। আর গিরীশবাবু স্কুলমাষ্টারির দ্বারা জীবিকা অর্জন করিতে লাগিলেন। ইঁহাদের কৃষিশিক্ষা দেশের কোন কাজেই লাগিল না। এই প্রকারে দেশের কয়েক লক্ষ টাকা অকারণ অপচয় হল।’’ ভারতের কল্যাণ ও উন্নতি জন্য আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় যে ধরণের তাগিদ অনুভব করেছিলেন, স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তিই সেই ধরনের অনুভব করিতে পেরেছিলেন এবং নিজের অনুভূতিকে তিনি যেমন সাহসের সঙ্গে প্রকাশ করেছিলেন, সেই সময় সেই ধরনের সাহসী ব্যক্তির সংখ্যা ছিল আরও স্বল্প। রাজনীতির ক্ষেত্রে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ ও প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মধ্যে মতভেদ ছিল গভীর। প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলতেন - ‘‘Researches can wait, industries can wait, but Swaraj cannot wait.’’ আর ‘রবীন্দ্রনাথের’ কথা ছিল, ‘‘The complete man must not be sacrificed to the patriotic man, or even to the merely moral man.’’ কোন কথাটা ঠিক, সেটা অভিজ্ঞরা বলতে পারবেন। কিন্তু এই দুই মহাজ্ঞানীর মধ্যে একটা বিষয়ে মিল ছিল, সেটা হলো গঠন কর্ম। তাই একজন গড়েছিলেন ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’, অপরজন প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ‘শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন’।

 ১৯১৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করে যখন তিনি বিজ্ঞান কলেজে পালিত অধ্যাপকের পদ গ্রহণ করেছিলেন তখন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তাঁকে যে বিদায়-সম্বর্ধনা জানানো হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল - ‘‘বিজ্ঞান কলেজ এবং রাসায়নিক গবেষণা যেন দীর্ঘকাল ধরিয়া আপনার অক্লান্ত সেবায় ও উৎসাহে শক্তি লাভ করে।’’ উত্তরে আচার্যদেব বলেছিলেন, ‘‘যদি কেহ আমাকে জিজ্ঞাসা করেন যে প্রেসিডেন্সি কলেজে আমার কার্যকাল শেষ হইবার সময় আমি কি মূল্যবান সম্পত্তি সঞ্চয় করিয়াছি, তাহা হইলে প্রাচীনকালের কর্নেলিয়ার কথায় আমার ছাত্রদিগকে দেখাইয়া আমি উত্তর দিব - এঁরাই আমার রত্ন।’’ তাইতো তাঁর সত্তর বছর বয়সের জয়ন্তী উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘উপনিষদে কথিত আছে, যিনি এক তিনি বললেন, আমি বহু হব। সৃষ্টির মূলে এই আত্মবিসর্জনের ইচ্ছা। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের সৃষ্টিও সেই ইচ্ছার নিয়মে। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে তিনি বহু হয়েছেন, নিজের চিত্তকে সঞ্জীবিত করেছেন বহু চিত্তের মধ্যে। নিজেকে অকৃপণভাবে সম্পূর্ণ দান না করলে এ কখনো সম্ভপর হোত না। এই যে আৱদানমূলক সৃষ্টিশক্তি এ দৈবশক্তি। আচার্যের এই শক্তির মহিমা জরাগ্রস্ত হবে না। তরুণের হৃদয়ে হৃদয়ে নবনবোন্বেষশালিনী বুদ্ধির মধ্য দিয়ে তা দূরকালে প্রসারিত হবে।

এই সময়পর্বেই মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর ‘চরকা-মন্ত্র’র প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন আচার্য। প্রথম দিকে, বিষয়টি নিয়ে খুব একটা ইতিবাচক ধারণা ছিল না তাঁর। কিন্তু পরে নিজেই হিসেব করে দেখলেন, বাংলাদেশের সাড়ে চার কোটি লোকের দেড় কোটি মানুষও যদি চরকা কাটেন, তবে মাসে এঁদের সামগ্রিক আয় হবে দেড় কোটি টাকা!

গান্ধীর সঙ্গে সখ্যতা আসলে বেশ কিছু দিন আগেই তৈরি হয়েছিল প্রফুল্লচন্দ্রের। তাঁরই উদ্যোগে অ্যালবার্ট হলে গাঁধীর জন্য এক সভা আয়োজিত হয়। সভার উদ্দেশ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা ফেরত গাঁধীর কাছ থেকে ব্রিটিশ উপনিবেশে ভারতীয়দের অবস্থা কলকাতাবাসীর কাছে তুলে ধরা। কিন্তু রাজনৈতিক দর্শনে আচার্যকে পুরোপুরি গাঁধীবাদী বলা যায় কি না, তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। তাঁকে হিন্দু মহাসভায় বক্তব্য রাখতে দেখা যায়। আবার আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ভারত-সভ্যতায় ইসলামের অবদানও তুলে ধরেন তিনি। আসলে গাঁধী-দর্শনের সারল্যের প্রতি একটা আকর্ষণ অনুভব করেন প্রফুল্লচন্দ্র। সে অনুভব তাঁর স্বদেশচিন্তার ফসল। এই একই কারণে তাঁর সঙ্গে সখ্য গোপালকৃষ্ণ গোখলেরও।

এই স্বদেশ-ভাবনা থেকেই প্রফুল্লচন্দ্রের বিখ্যাত বই ‘এ হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমিস্ট্রি’ ও ৮০০ টাকা পুঁজি নিয়ে তৈরি শিল্প প্রতিষ্ঠান ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস’। ৯১ নম্বর আপার সার্কুলার রোডে আচার্যের ভাড়াবাড়িটিই এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটির আঁতুড়ঘর। এর নেপথ্যে ছিল বিদেশ থেকে নানা দ্রব্যের আমদানিতে লাগাম পরানো এবং বাঙালি তথা ভারতীয়কে কেরানি থেকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর ইচ্ছে।

তবে এর জন্য সবার আগে দরকার বিজ্ঞান-মানসটি তৈরি করা। প্রেসিডেন্সির রসায়নের ক্লাসে ছাত্রদের সামনে বার্নারে পোড়ানো হাড়ের গুঁড়ো রাখলেন প্রফুল্লচন্দ্র। তা মুখেও দিয়ে বোঝালেন, এই হাড়ভস্ম যে প্রাণীরই হোক, এটি একজন রসায়নবিদের কাছে ‘বিশুদ্ধ মিশ্রপদার্থ’, ক্যালসিয়াম ফসফেট।

এ ভাবে এক দিকে, বিজ্ঞান চেতনা তৈরি, অন্য দিকে কসাই মহল্লায় গিয়ে হাড় সংগ্রহের মতো নানা কাজ করতে করতেই শিল্প প্রতিষ্ঠানটি শুরু করে দিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। ওষুধ ও রাসায়নিক দ্রব্য প্রস্তুতের পাশাপাশি, প্রফুল্লচন্দ্র বিশেষ জোর দিলেন বিপণনেও। কালক্রমে নানা বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ডালপালা ছড়িয়ে দেশের বাজারে সমাদৃত তো হলই, সঙ্গে বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইংরেজ সরকারকেও সহযোগিতা করল। এর কৃতজ্ঞতায় ইংরেজ সরকার তাঁকে ‘নাইট’ উপাধি দেয়। যদিও, এ নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখা যায়নি। কারণ, পরক্ষণেই দেখা গিয়েছে তিনি রাওলাট আইনের বিরোধিতায় সরব।

পাশাপাশি, রসায়ন-শাস্ত্রের ইতিহাস অধ্যয়ন করতে করতেই এক দিন হাতে এল ফরাসি রসায়নবিদ মার্সিলিন বের্তেলোর একটি বই। তাঁর সঙ্গে পত্রালাপও শুরু হল। কালক্রমে, বের্তেলো তাঁর লেখা সিরিয়া, আরব প্রভৃতি দেশের রসায়ন সম্পর্কিত তিন খণ্ডের বইটিও পাঠালেন। এটি পড়েই প্রফুল্লচন্দ্রের পরিকল্পনা হিন্দু রসায়নের ইতিহাস লেখার। ভারতবর্ষের নানা গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাগার, লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস, বারাণসী-সহ নানা প্রান্ত থেকে সংস্কৃত পুঁথি সংগ্রহ ও পাঠ করলেন প্রফুল্লচন্দ্র। সাহায্য করলেন পণ্ডিত নবকান্ত কবিভূষণ। এরই ফল, দু’খণ্ডে ‘হিন্দু রসায়নের ইতিহাস’।

প্রফুল্লচন্দ্রের বিজ্ঞান ভাবনা যা-ই হোক না কেন, তাঁর সব কিছু জুড়ে ছিল দেশ আর দেশের প্রকৃতি। তাই ১৮৯০-এ তৈরি করেন ‘নেচার ক্লাব’। নীলরতন সরকার, প্রাণকৃষ্ণ আচার্য, রামব্রহ্ম সান্যাল, হেরম্বচন্দ্র মৈত্র, বিপিনবিহারী সরকার ছিলেন এর সদস্য। পাশাপাশি, ‘কলকাতার ফুসফুস’ ময়দানে ঘুরতে যাওয়া, তা-ও করেছেন সমান ভাবে।

পরিবেশের সূত্রেই প্রাণী ও উদ্ভিদ-বিজ্ঞানেও প্রফুল্লচন্দ্রের বিশেষ আকর্ষণ। সেই আকর্ষণেই কখনও দেওঘরে গিয়ে ‘অনিষ্টকর’ ভেলার ফল খেয়ে বিপত্তিও বাধান। আবার কখনও গ্রীষ্মে গ্রাম রাড়ুলিতে গিয়ে গোখরো সাপ ধরিয়ে তার বিষদাঁতের পরীক্ষা করেন! কখনও বা শহর কলকাতায় প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা ভামের দেহ এনে তার ব্যবচ্ছেদের ব্যবস্থা করেন।

আসলে প্রকৃতির উপরে মানুষের কেরদানিটা সহ্য হয়নি প্রফুল্লচন্দ্রের। তাই রবীন্দ্র সরোবরে ছট করতে চাওয়া, জলাভূমি বুজিয়ে ইমারত তৈরি করার বর্তমান দেশে প্রফুল্লচন্দ্রের একটা কথা বিশেষ ভাবে মনে করা যায়— ‘‘পশ্চিমবঙ্গে পুকুর বাঁধ প্রভৃতি জলসেচ প্রণালীর ধ্বংসের সহিত তাহার পল্লীধ্বংসের কাহিনী ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।’’ এই জন-বিজ্ঞানকে বোঝাতে বাংলা ভাষায় সাধারণের উপযোগী বইও লিখেছেন প্রফুল্লচন্দ্র। আদতে তিনি চেয়েছিলেন স্থিতিশীল উন্নয়ন।

১৯৪৪, ১৬ জুন। প্রয়াত হন অকৃতদার এই মনীষী। কিন্তু তাঁর প্রয়াণের পরে, এমনকি তাঁর জীবিত অবস্থাতেও বাঙালি, ভারতীয়রা কতটা রক্ষা করতে পেরেছে প্রফুল্ল-ঐতিহ্য? জীবিত অবস্থায় তাঁর শেষ জন্মদিন পালিত হয় মেঘনাদ সাহার উদ্যোগে। কিন্তু এ জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি সমস্যায় পড়েছিলেন। আর প্রফুল্লচন্দ্রের মৃত্যুর পরে সমসময়ে তাঁর সাধের শিল্প প্রতিষ্ঠানটি নিয়েও নানা প্রশ্ন সামনে আসে! দুঃসাধ্য অধ্যবসায়ে জয় করবে নব নব জ্ঞানের সম্পদ। আচার্য নিজের জয়কীর্তি নিজে স্থাপন করেছেন উদ্যমশীল জীবনের ক্ষেত্রে, পাথর দিয়ে নয়, প্রেম দিয়ে। আমরাও তার জয়ধ্বনি করি।’’ সেদিন প্রফুল্লচন্দ্রকে পাশে বসিয়ে ‘রবীন্দ্রনাথ’ কথাগুলি বলেছিলেন। আজ তাঁদের কেউই নেই। রয়ে গেছে তাঁদের স্মৃতিগুলো।
                           
তথ্যসূত্র ও গ্রন্থঋণ :---- 

১- অধ্যায়ন ও সাধনা, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সুত্রধর (২০১০)।
২- দেশপ্রেমী বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, অচিন্ত্যকুমার মুখোপাধ্যায়, টিচার্স বুক এজেন্সী (২০১১)।
৩- আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের পল্লি মঙ্গল, ড. তপন বাগচী, কলি প্রকাশনী (২০১১)।
৪- আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়: জীবন, কর্ম, রচনাসংগ্রহ; ড. সন্তোষকুমার ঘোড়ই, পারুল প্রকাশনী (২০১০)।
৫- আত্মচরিত (প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড), আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।
৬- স্মৃতিসত্তায় আচার্য  প্রফুল্লচন্দ্র, বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত।
৭.‘আত্মচরিত’ (দে’জ): প্রফুল্লচন্দ্র রায়, 
৮.‘আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র' (চর্চাপদ) : রবীন মজুমদার,
৯.‘অন্বেষা’ (প্রফুল্লচন্দ্র রায় বিশেষ সংখ্যা), 
১০.‘প্রফুল্লচন্দ্র রে’ (এনবিটি): জে সেনগুপ্ত, 
১১.‘জার্নাল অব দি ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি’ 
১২. ইন্টারনেট প্রভৃতি।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments