জ্বলদর্চি

বিমোক্ষ/ (উৎসব ১৪২৮)/দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়

বিমোক্ষ
দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়


হলুদ ডালিয়া হেলে পড়ে হাসিমুখে। চন্দ্র মল্লিকার নিজেদের সাথে কানাকানি।জিনিয়ারা আপন আনন্দে খিলখিল।লাল হলুদ গাঁদা পালক পিতার দিকে আবেগভরা চোখে।গোলাপের বুকেও আজ মনকেমনের শিহরণ। বারান্দা বাগানের প্রতিটা  সবুজ প্রাণ ভালোবেসে বিহান সহায়।

           গতানুগতিকতার মোড়কে জীবন এখন বিহানের।ছেলেবেলায় বাবার হাত ধরে গড়ে ওঠা অভ্যাসে ভোরে প্রকৃতি সন্নিকর্ষে ওর দিন শুরু।বাবা বলতেন ' ভৈরো ' সময়। প্রাণের প্রথম প্রৈতি যেন এই মাহেন্দ্রক্ষণ। বাবার গলায় তখন গুনগুন করে না - জানা আলাহিয়া বা বিলাবল।সৌমনস্যভরা মন বাবার হাতের স্পর্শে তখন।

          ব্যাঙ্ক ম্যানেজার বিহানের অবসর জীবনে কষ্টজড়িমায় আবাহন যেন দিনের বাকি সময়ে।রিষ্টিনাশা সুখের দীধিতি উধাও কোন অজানায় !সকাল নাকি সবসময় বাকি দিনের ইঙ্গিত দেয়! মুচকি হেসে ফেলল বিহান।ভুল ভুল, বড়ো ভুল ।ওর জীবন তাহলে স্যন্দিত দুঃখের আলাপন হতো না।

        ব্যাঙ্কের চাকরির সিদ্ধান্তটা ওর নিজের। অঙ্কের শিক্ষক বাবা চেয়েছিলেন ছেলে উচ্চ শিক্ষা চালিয়ে যাক। গবেষণা করে নিজের সৌরভ ছড়াক। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকে ওর প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় হওয়া বাবা মার আগ্রহের সলতেতে আগুন দেবে স্বাভাবিক। কিন্তু বিহান চায়নি।বাবা অবসরের প্রায় মুখে। পেনশনের টাকায় সংসার চালানো যে কষ্টকর তা ক্ষুরধার বুদ্ধির বিহানের কাছে ছিল সহজবোধ। তাই স্নাতকের পরই চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু।ছ' মাসেই হীরক দ্যুতি। ডব্লিউ বি সি এসে গ্রুপ সি ও ষ্টেট ব্যাঙ্ক অফ্ ইন্ডিয়ার প্রবেশনারি অফিসার ।দোনো লাড্ডু ফুটা। আনন্দে আত্মহারা ও বেছে নেয় ব্যাঙ্কের চাকরি।ও জানত অঙ্কের মেধা ওর এগিয়ে চলা সহজগতি করবেই।

       চাকরির আর একটা কারণ সুমনা। পাশের পাড়ার মেয়ে।ওর বাবার প্রমোটারির ব্যবসা। অসাধারণ সুন্দরী। প্রথম প্রস্তাব আসে সুমনার কাছ থেকেই।ওর বন্ধু রেবার হাত দিয়ে চিঠি।বিহান তখন একাদশে। সুমনা দশমে। ভালো ছেলে হিসেবে বিহানের খ্যাতি এলাকার সব মেয়ের চোখেই জ্বেলেছে প্রেমের মশাল।মাধ্যমিকে জেলায় প্রথম। নিশ্চিত ভবিষ্যতের  বিনিয়োগ ও তো হবেই মেয়েদের চোখে।সতর্ক বিহান বোঝে সব। তাই এড়িয়ে চলা। আরো দু'বার আসে প্রেমের চিঠি সুমনার কাছ থেকে।অনড় বিহানের প্রতিক্রিয়ায় ব্যথিত সুমনা এবার ময়দানে নামে নিজেই। সৌন্দর্যের গর্বে উদ্ধত সুমনার কাছে এটা যেন পরাজয়।

        সেদিনটা ভুলতে পারে না আজ ও। স্কুল যাবার পথে বিহানের সাইকেল আটকায় সুমনা। সরাসরি প্রশ্ন :" এই যে ভালো ছেলে ! তিন বার চিঠি দিলাম। উত্তর নেই কেন? " সকলের অনুসন্ধিৎসু চোখের সামনে অসহায় বিহান রাগে বলে ওঠে : " প্রয়োজন বোধ করিনি। তাছাড়া আমার এখন নিজেকে তৈরি করার সময়। লেখাপড়াটা ভালো করে সকলেরই করা উচিত এই সময়।"

---আমাকে ভালোবাসলে তোমার পড়াশোনা নষ্ট হবে? আমি শুধু তোমার মুখে হ্যাঁ শুনতে চাইছি। অবলীলায় বলে গেল মেয়েটা। অপরের ইচ্ছা অনিচ্ছা যেন কোন বিচারের বিষয় নয় ওর কাছে।বিহান হতবাক। কোন মেয়ে এতো লোকের সামনে এভাবে কথা বলতে পারে ! এ বাত কুছ হজম নেহি হুয়ি। হিন্দী সিনেমায় এরকম হয়, জেনেছে ও। বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া মেয়েরা প্রেমটাকে খেলনা ভাবে। পার্থর কথায়, ইঁদুর ধরার খেলা।এরা নাকি জামা পাল্টানোর মতো প্রেম বদলায়। প্রেমের সংখ্যা বৃদ্ধি নাকি স্ট্যাটাস সিম্বল এদের কাছে। আশপাশের কৌতুহলী চোখের দৃষ্টি দৃশ্যটা চেটেপুটে খাচ্ছে ভেবে আরো অস্বস্তিকর পরিস্থিতি এড়াতে বলে উঠল :" স্কুল শেষে কথা হবে।এখন কথা বলার সময় নয়। "

---"ঠিক আছে। বিকেলে মাঠে আসবে। তোমার উত্তর শুনবো।" বলেই গটগট করে এগিয়ে গেল সুমনা।বিহানের চোখমুখে ঘোরলাগা ভাব। টলোমলো মন নিয়ে ও তখন স্কুলের পথে।

         মনে বিস্ফোরণ ওর ! একটা ভালোলাগা কেমন যেন মাঝে মাঝে ছুঁয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। ওর অমনোযোগিতা শিক্ষকদের দৃষ্টি এড়ায় নি।বার বার একজোড়া বিতত নেত্র ওর বিক্লবতার কারণ হচ্ছে। বুকের ভেতর একটা আগুন কষ্ট। পোড়াচ্ছে ওকে প্রতি মুহূর্তে। বাবা-মার মুখ মনে পড়ছে।না, বেড়িয়ে আসতে হবে ওকে। ওর আশায় বসে ওরা। বিকেলে মাঠে না গিয়ে ইংরাজি স্যারের কাছে পড়তে গেল। ফেরার পথে বন্ধু পার্থর মুখে শুনল, সুমনা বিকেলে ঠিক মাঠে এসে ওর খোঁজ করেছে।কাল স্কুলে ধরবেই ওকে। প্রচন্ড বেপরোয়া । সৌন্দর্য ও বাবার অর্থের অহঙ্কার ওকে মরিয়া করে তুলবেই ,বিহান জানে। ঠিক করল এড়িয়ে যেতে হবে। ঘুরতে ঘুরতে একসময় ক্লান্ত হয়ে অন্য শিকারের খোঁজে ঠিক চলে যাবে। এটা হয়তো ওর খেলা। রূপের আগুনে পোড়ানো।কাল স্কুলে না যাবার সিদ্ধান্ত নিল। বাড়িতে শরীর খারাপের কারণ দেখাবে। তবে মনে ভয়,বাবা কিছু জানতে পারে নি তো ! স্কুলের এখন ব্রেকিং নিউজ তো ওদের খবরটা। বাবাকে সরাসরি সব কথা বলবে। এতে ওর তো কোন দোষ নেই।সুমনাই গায়ে পড়ে.....!

           পরদিন যথারীতি স্কুলে না গিয়ে বাংলা প্রকল্পের কাজ নিয়ে বসল। কদিন ধরেই গড়িমসি করছে ও। পরের সপ্তাহে জমা দিতে হবে।তার ওপর বন্ধুদের তাড়া। ওরা তো ওর ওপরই নির্ভরশীল। মনোযোগ সহকারে কাজ করছে এমন সময় দরজায় অসহিষ্ণু কড়া নাড়া। কাজের দিদি বাসন মাজতে এসেছে বোধহয়।মা দরজা খুলতেই বিহানের চোখ ছানাবড়া।একি ! সুমনা !মূর্তিমান বিপদ সামনে দাঁড়িয়ে। স্কুলের জামাপড়া মেয়ে দেখে মার অনুমান  ছেলের সাথে একই ক্লাশে পড়ে। পড়াশোনার কারণে এসেছে বোধহয়।মা ওকে ভেতরে ডাকতেই হঠাৎ সুমনা কাঁদতে কাঁদতে বিহানের সামনে। চমকিত প্রশ্ন বান : "কাল বিকেলে তুমি এলে না কেন মাঠে? আমাকে বলেছিলে ,আসবে। ছেলেগুলো কেমন বিচ্ছিরি টিটকারি মারছিল।"

         বিহান যেন তলিয়ে যাচ্ছে অতলে। মায়ের বিস্ফারিত চোখে বিস্ময়। একটা মেয়ে বাড়িতে এসে এভাবে অনুযোগ করছে তা যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। এদিকে নাছোড় সুমনা।
----- তুমি এলে না কেন? আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইছো? আমি খারাপ মেয়ে?

একসাথে এতো প্রশ্নের ধাক্কায় বিহান কাত।মুখ তুলে তাকাতে পারছে না।কি লজ্জা,কি লজ্জা ! কিছু বলতে যাবার আগেই সুমনা কান্ডটা করে বসল। মায়ের সামনে জড়িয়ে ধরল বিহানকে।লতা যেমন জড়িয়ে ধরে গাছকে। ঝড়ঝড় কান্নায় বলে উঠল ----"বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে ভীষন ভীষণ ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না।" 

           এতক্ষণে মা বুঝতে পেরেছে বিষয়টা।বিহান কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে।মা পরিস্থিতি হালকা করতে সুমনাকে  নিয়ে চলল ঘরের ভিতর।বিহান ভয়ে কাঠ হয়ে নিজের ঘরে বসে রইল কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মনে বিপর্যাস অনুভব।সংরোহ প্রেমের রিঙ্গণ আবেশী শরীর জুড়ে।
কখন সুমনা চলে গেছে জানে না বিহান। বিকেলে বাবা স্কুল থেকে ফিরেই তলব। কেন এসেছিল সুমনা? বাবা চেনেন ওকে। ওনার ছাত্রী।সুমনার বাবাও পরিচিত। বাবাকে গুণী শিক্ষক হিসাবে সন্মান করেন,ও জানে।ও বাবা মার সামনে অকপট।মা বুঝেছেন সব।বাবা বকাবকি করেন নি। শুধু মন্তব্য করেছেন :"মনে রেখো,বিদ্যাই মানুষের সেবধি।সেটা শাশ্বতিক ।"

            এরপর সারা শরীর জুড়ে সুমনা।ও যেন এসেছিল" বিতর বিতর প্রেম পাষাণ হৃদয়ে"।বিক্লব হৃদয় যেন বাতাহত লতা। প্রেম এলো বিহানের জীবনে। সৌমনস্য প্রেমের আকুতি ঘাগর হয়ে কানে অহর্নিশ। তবে বাবার কড়া নজরদারি। মায়ের যেন কিছুটা প্রশ্রয় ভরা চাউনি।বিহান ও সুমনার প্রেম সকলের আলোচ্য। একটি ভালো ছেলের শেষের কবিতা লেখা শুরু অনেক মনে। সন্দিগ্ধ শিক্ষকদের অবশেষে আশ্বস্ত করেছে ওর উচ্চ মাধ্যমিকের ফল। আবার জেলায় প্রথম পাঁচে। খুশির হাওয়া সকলের মনে।এক পড়ন্ত বিকেলে হেলে পড়া সূর্যের আলো মেখে সুমনা জানিয়েছিল ভালোবাসার বিথার আবেগ।নরম হাতের স্পর্শে ছিল স্তনিত স্মের। ডাক্তারী বা ইঞ্জিনিয়ারিং এ না গিয়ে ভর্তি হয় স্নাতকে। আশ্চর্য শিক্ষকরা ভাবেন ভবিষ্যতে ওর গবেষণাই লক্ষ্য। গণিতের বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে সকলেই কিছুটা উল্লসিত। ভর্তি হয় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে । কলেজের নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধ ওকে টানে। ছাত্র রাজনীতির প্রকোপ নেই। রাজনীতি বিষয়টাই ওর না- পসন্দ। শুধু দেখে আদর্শহীন
স্বার্থবাদ ।

        বিহানের উচ্ছ্বাস কম।অন্য সকলের মতো
পরিরম্ভ প্রেম ওর নয়, সুমনা জেনে গেছে এতোদিনে।এতে পরিবাদ থাকে যা বিহানের অগ্র গমন স্তব্ধ করতে পারে।তাই ওপথে না গিয়ে নিজেকে বিহানের যোগ্য করে গড়ে তুলতে চেয়েছে। আশ্চর্যজনক পরিবর্তন হয়েছে ওর ব্যবহারে। পড়াশোনায় ওর উন্নতি সকলকে চমকে দিয়েছে।সকলে এর কারণ বুঝতে পেরে আনন্দ পেয়েছে। বিশেষতঃ ওর বাবা মা।মেয়ের নিশ্চিত ভবিষ্যতের ছবি আঁকতে থাকেন রামধনু রঙে। বিহানের স্নাতকে চোখ ধাঁধানো সাফল্য ওদের আরও আশাবাদী করেছে। প্রাণচঞ্চলা সুমনা বন্ধুদের নামী রেস্টুরেন্টে খাইয়েছে।বিহানের সাথে এক আবেশী বিকেলে দেখা হয়েছে কফিহাউসে। হাতে হাত, চোখে চোখ স্বপ্ন বুনেছে আগামীর। দুটো থরোথরো হৃদয় জানিয়েছে, আছে ও থাকবে এভাবেই নিশিদিন সুশোভন হয়ে।

         বছরখানেক পরেই প্রবেশনারি অফিসার।সুমনার বাড়ি থেকে ঘন ঘন আসা যাওয়া বিহানের বাবা মার সাথে বেয়াই -বেয়ানের সম্পর্ক মজবুত করেছে।বিহানের মনে রাতের মুহূর্তগুলোর ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ।আর দেরি করে নি সকলে।এক শীতের রাতে ফুলশয্যার নরম আবেশে দুটো শরীর এক হয়েছে একসময়। রাতজাগা পাখিদুটো কালবৈশাখীর দামাল ঝড়ে প্রেমের নীলাকাশ আরো সঞ্জীবিত করেছে।সাতত্য সুরতি জীবনের মার্দব বয়ে এনেছে।রিরয়ংসায় রমিত শরীর আগামীর অঙকুরীশায় মগ্ন তখন।

        সবই ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ সুখের আকাশে কালো মেঘ। জীবন হঠাৎ পারুষ্যে।আচমকাই হরজা।তারাপীঠে পুজো দিয়ে ফেরার পথে মারুতির অ্যাক্সিডেন্ট। হঠাৎ বেলাইন এক ট্রাকের সাথে মুখোমুখি ধাক্কা।বিহান ছুটে গিয়ে বাবা মার থ্যাতলানো নিথর দেহ দেখেছে। অসহনীয় মানসিক ধাক্কা। বাড়িতে দুই প্রিয় মানুষের অনুপস্থিতি আরও একা করে দিয়েছে বিহান-সুমনাকে।সময় প্রলেপ ফেলতে থাকে দুঃখের ওপর।জীবন একটু একটু করে আপন ছন্দে আবার। এরমধ্যে এক মুজদা।সুমনার শরীরে প্রাণের অঙ্কুর। ওদের ভালোবাসার সুকল্প।

         কিছুদিন পরেই এল প্রাণের দীপিকা সুহান। বাবা-মার নামের মিলনে নামাঙ্কন। আবার সংসারে আনন্দ ভৈরবী। স্যন্দিত দুঃখ জড়িমা কাটাতে দুটো কচি হাত আঁকড়ে ধরল ওরা দুজন। চলতে থাকল সুহান-যাপন। এদিকে বিহানের কাজমগ্নতা ও দায়বদ্ধতা ওর খ্যাতির পরিধি বাড়াতে থাকে। অচিরেই ম্যানেজার।সবই ছেলের আগমনের ফল যেন মনে হয় ওর।ছেলের হামাগুড়ি ও টলোমলো ছন্দ সারা বাড়িতে যেন আনন্দ ঝর্ণা। এদিকে অফিসের কর্মব্যস্ততায় বাড়ি ফেরার সময়ও বদলাতে থাকে। প্রথম দিকে মানিয়ে নিলেও অচিরেই বদল শুরু হয় সুমনার আচরণে। বিহান অফিস থেকে ফিরলেই শুরু হয় অভিযোগের বারমাস্যা। মাঝে মাঝে সারা বাড়ি মহানাদে তখন। শোনে ,দিনের অধিকাংশ সময়ই সুমনা চলে যায় ওদের বাড়ি।বিহান অফিস বের হলেই ও ছোটে ওর মায়ের কাছে। জিঞ্জাসা করলে বলে,বাবা মার মন কেমন করে নাতির জন্য ,তাই। তাবলে প্রতিদিন ! নিরুত্তর সুমনার বদল বিহানের মনে একরাশ প্রশ্ন চিহ্নের জন্ম দেয়।

        সুমনার বাবার ব্যবসার পরিধি বেড়েছে।একার পক্ষে সামলানো সম্ভব নয়।তাই ওর পিসির ছেলেকে নিয়ে আসা ওদের বাড়ি বাবার সহায়ক হিসাবে। পিসির ছেলের গাড়িতেই এবাড়ি ওবাড়ি করে ।মাঝে মাঝে নাকি বাজার - মন্দিরে ও যায়। বন্ধুদের মুখে খবর পায় সব। কোথায় যেন ধন্দ লাগে ওর। রবিবার বাজার গেলে তো কই ওর দরকারের কথা বলে না ওকে।ওর প্রশ্নের উত্তরে তখন তো সুমনা নঞর্থক। তাহলে? কোথায় যেন অঙ্কের গরমিল খুঁজে পায় ও। তীক্ষ্ণ অনুমান ওকে বোঝাতে থাকে, এখন আর সহজ নয় সবকিছু।

          বিহান প্রথমদিকে আপত্তি করে এসব নিয়ে। কিন্তু সুমনা তখন ভামিনী। ছোট্ট সুহানের ফ্যালফ্যাল দৃষ্টির সামনে ও তখন চূড়ান্ত অসহায়। ছেলেটা এক বিষাক্ত পরিবেশে বড়ো হচ্ছে ! সত্যের চেয়ে শান্তি বড়ো প্রয়োজনীয় মনে হয় ওর তখন।সুমনার পরকীয়ায় ধীরে ধীরে নীরব হতে থাকে। বাড়ি ফেরার আরো দেরি হতে থাকে। টেবিলে ঢেকে রাখা খাবার খেয়ে অন্য ঘরে রাতের বিছানায় তারাদের সাথে রাতজাগা।বাবার কথা মনে পড়ে ওর : কারো ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা দুঃখের কারণ হবেই। অন্ধকারে নিজের ছায়াও যে ছেড়ে পালায় আলিপ্ত শরীরকে। শুধু সঙ্গী হয় গালিব তখন---
" মুকদ্দরমে মেরে অগর দর্দই বস্ লিখা হ্যায়,মনজুর হ্যায় মুঝে/ ইলতে৺জা ইয়ে হ্যায়,সহনে কে লিয়ে সঙ্গ-এ জিগরভী মিলনা চাহিয়ে।"

ভাগ্যে যদি শুধু দুঃখই লেখা থাকে তাতেই দিলাম সম্মতি। শুধু এটুকু রইল আমার আবেদন,তাকে সইবার মত পাষাণ হৃদয় আমার চাই।
        কিন্তু পায় কোথায়? সুহানের ভবিষ্যৎ ওকে উতলা করে তোলে।নীরব হতে থাকে দাম্পত্যের ভাষা। মাঝে লক্ষ্য করে, বদলাতে শুরু করেছে সুহানের ব্যবহার ও। বাবার প্রতি একরাশ বিরক্তি ঝরে পড়ে ওর প্রতি কথায়। মায়ের যেন মুখপাত্র ও।বাবা যেন ওর কাছে উদ্বৃত্ত।বিহান কেন পড়ে আছে নিজেও জানে না। এতোদিন যারা পরিবার হয়ে ধমণীতে বইছিল,আজ তাদের ছেড়ে যাবেই বা কোথায় ! মৃত্যুর প্রতীক্ষায় সময় থমকে যেন !

          এভাবেই কেটে যাচ্ছিল বছরগুলো। সুহান এখন ডাক্তারিতে। ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে থাকে। মাঝে মাঝে আসে।বাবার সাথে ওর ব্যবহার এখন অনেক বদলেছে বয়সের সাথে সাথে। মাঝে মাঝেই লক্ষ্য করেছে মায়ের সাথে ওর রূঢ় ব্যবহার। হয়তো বড়ো হয়ে বুঝতে পেরেছে, এতোদিনে ওকে মিথ্যার দোসর করেছিল মা নিজের কার্যসিদ্ধিতে।যখনই বাড়িতে আসে বাবার স্বাস্থ্যের দেখভাল করে। সুস্থ থাকার উপদেশ দেয়। হয়তো প্রায়শ্চিত্ত করছে ! নিজের বুকে ডাক্তার ছেলের হাতের স্পর্শ ওকে বলে দেয় অনেক অনুচ্চারিত কথা।বিহান ভাবে, এটুকু পাওয়ার জন্যই বোধহয় ওর বেঁচে থাকা !

        কিছুদিন পর সুহান পূর্ণাঙ্গ ডাক্তার।বেলুড় হাসপাতালের চিকিৎসক।বাড়ির নীচের তলায় গ্যারেজের পাশে চেম্বার ও করেছে। সকাল সন্ধ্যা বসে।এর মধ্যেই বেশ পসার।ওর মা বিয়ের কথা বললেই জ্বলন্ত চোখে তাকায়।ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় পায় বিহান। দাম্পত্যের ছবিটা ওর কাছে প্রেমরাহিত্যের দ্যোতক।সমঙ্গা মায়ের পরকীয়ার লীঢ় দাম্পত্য ওর কাছে হয়তো জগ্ধসুখের নিস্বন। বাবার দুঃখ বিক্লবতায় ও যেন মনে মনে কাতর।ছেলের ব্যবহার পড়ন্ত যৌবনে সুমনাকেও যেন পরিবর্তিত করে চলেছে অহরহ।নীরব উপস্থিতির সরব অনুভব বিহানের মনে। অবসরের পর তাই এখন সবুজ প্রপন্ন।প্রকৃতি মায়ের কাছে ফিরেই যেন মুক্তি।ও বোঝে, শান্তি ওর সেখানেই। গাছেদের কাছেই ও নীরব হতে শিখেছে।তখনই কথা বলে যখন নীরবতার থেকে শব্দ প্রয়োজনীয় মনে হয়।

          জীবন এর মধ্যে অনেক ইতিহাস লিখে ফেলেছে সুমনার জন্য। চন্দ্রাতপ জীবন এখন বৈমনস্যময়।পিসতুতো দাদা ওর বাবার ব্যবসা লুটেপুটে পগার পার।ব্যবসায় সব হারানোর শোকে পাগলপ্রায় বাবার মৃত্যু শেষে।মাও বেশি দিন বাঁচলেন না।বিহান তখন সব কর্তব্য ই করেছে। জোড়া ধাক্কায় সুমনার বুকে মনখারাপের ঘাগর সুখহীন নিশিদিন। সঙ্গে অষ্টিও আর্থারাইটিসে শয্যাশায়ী । কাজের মেয়ে জবা এখন সারাদিনের সঙ্গী।বর মারা যাবার পর সন্তানহীনা জবার আশ্রয় এখন এ বাড়ি।ছেলেরই সিদ্ধান্ত মায়ের কথা ভেবে। চিকিৎসাও করছে ওর এক বন্ধুর পরামর্শে। এভাবেই চলছে বাড়ির মানুষগুলোর জীবন একই ছাদের নিচে,অথচ বন্ধনহীন সম্পর্ক স্থৌল্যে।

            প্রতিদিনের মতো আজও ভোরবেলা হাঁটতে বেড়িয়েছে বিহান। স্নিগ্ধ প্রকৃতির স্পর্শ  অনেক ভালোলাগা ভরে দেয় ওর বুকে এই সময়। তবে আজ আর হল না। পার্থর মুখে খবর পেল , বন্ধু অসীমের হার্ট অ্যাটাক।প্রাতঃভ্রমণকারী বন্ধুদের দল ছোটে অসীমের বাড়ি। অসীমের ছেলে থাকে সুইজারল্যান্ডে।টি সি এসে কর্মরত। বাড়ীতে ওরা দুই বুড়ো বুড়ি। পাড়ার ছেলেরা খবর পেয়ে ওকে ভর্তি করেছে দেবী শেঠী হাসপাতালে। উদ্বিগ্ন বিহানেরা সকলে গাড়ি করে ছোটে হাসপাতাল বন্ধুর খবর নিতে। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরতে হয়ে যায় বিকেল।বাড়ির কথা একদম মাথায় ছিল না।আর খবর দিলেই বা কি ! আলোড়নহীন অনুভব  !

         বেল বাজাতেই জবা দরজা খোলে। একরাশ প্রশ্ন ও উৎকন্ঠা চোখে মুখে। চিৎকার করতে করতে বাড়ির ভেতরে গেল যেন হারানো জিনিস ফিরে পেয়েছে। সুমনা খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘরের বাইরে এসে সোফার আশ্রয়ে। ছেলে ওর ঘরের দরজায় রাগী মুখে। সকলের মুখে অনুচ্চারিত প্রশ্নের আলপণা। ও টেবিলে রাখা একগ্লাস জল তুলে নিল হাতে। হঠাৎ মাথাটা গেল ঘুরে। চোখে অন্ধকার। পড়ে গেল সোফায়। আস্তে আস্তে জ্ঞান হারালো।

           জ্ঞান ফিরতে দেখল হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে।ডান পাশে টুলের ওপর সুমনা বসে।বাপাশে ছেলে সুহান। সুমনা ঝুঁকে পড়ে ওর স্যালাইন দেওয়া হাতটা তুলে নিল হাতে। ছিটকে বেরিয়ে এল একরাশ কান্না। সুহান মাকে শান্ত করতে এগিয়ে এল।ওর চোখেও জল চিকচিক। মুচকি হেসে বিহানের আশ্বস্ত করার চেষ্টা ওদের। বড়ো ভালো লাগছে ওর। কতোদিন বাদে সুমনার হাতের স্পর্শ ওর শরীরে। তবে সবকিছু শেষ হয়ে যায় নি। মনের কোণে কে যেন বলে উঠল, আছে আছে ! রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে। একরাশ প্রশান্তি যেন কোন অতল গহ্বরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।জঠর তমসা চারিদিকে।একা একা টলোমলো পায়ে চলেছে বিহান.....একাকী যখন একা !

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 
                        

Post a Comment

0 Comments