জ্বলদর্চি

গুচ্ছ কবিতা /(উৎসব ১৪২৮)/দেবাশিস তেওয়ারী

গুচ্ছ কবিতা 
দেবাশিস তেওয়ারী 


ক্ষমা করো প্রভু

[ 'মশাল হাতে খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছেন এক মহামানুষ।
আর সেই আগুনে পুড়ে যাচ্ছে হাজার হাজার বছরের জমে থাকা মোম।'— চিন্ময় গুহ ]

গো-এর কি চালা হয় ? গো-এর কি শালা হয় কোনও ?  এসব সাল-তামাম ঠিক হয় না। অথচ খ্রিস্টিয় সম্প্রদায় কত যত্নে নির্মান করেন গোশালা, তাও বড়দিনের দিন। দিন যদি ছোটো হত, তাহলে হয়তো গোশালার কোনও প্রশ্নই আসত না। কিন্তু যেহেতু বড়দিন, যেহেতু গোশালা, সেহেতু খোঁয়াড়ে গরু থাকবেই। আর গরু তো গরুই হয়। তার কোনও আগে-পরে নেই। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে গোশালা কিংবা গোচালা নির্মানের ক্ষেত্রে। বড়দিন উপলক্ষে এই নির্মান যতটা বিধিসম্মত ততটা শাস্ত্রসম্মত নয়। বিধিকেই আমরা সবথেকে বেশি গুরুত্ব দিই, আর দিই বলেই তো গোশালা, দিই বলেই তো পুনরুত্থান, দিই বলেই তো জিশু এখনও বলেন "হে ঈশ্বর এদের তুমি ক্ষমা করো"! 



ঈশ্বর ও শয়তান

গুড়ুম আওয়াজ। আত্মরতি মিলিয়ে যায়। পায়ে হেঁটে, পিছলে পিছলে ঘষটে যাওয়া বেদনাবোধ সহাস্য মিলায়। যেভাবে তোমার আশিরনখ, বৃদ্ধ হাওয়া ধুলো উড়িয়ে নিয়ে যায় বসন্তের রাস্তায় । রাঙাবৌদি ঝাঁট দিচ্ছিলেন । সশব্দে তিনিও থমকে যাবেন এমন ভাবার কোনও কারণ ছিল না । কারণ একটাই ছিল পুনরুদ্ধারের । আত্মরতি মিলিয়ে যাওয়ার । যে-দিন ডুমস্ ডে আসবে, বা ডে অব রেজারেকশান হবে, কোরানে যাকে বলে রোজ কিয়ামত । বেজে উঠবে আরেকবার ইস্রাফিলের শিঙা । তারপর কি হবে ? তোমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গই তোমার সাক্ষী দেবে, রাজসাক্ষী । তুমি রেহাই পেতে পেতে বিষোদ্গার করবে । ভয়ংকর একটা মেঘ তোমাকে তাড়া করবে । তুমি পালিয়ে যেতে যেতে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পড়বে সবুজ মাঠের কিনারে । সামনে দেখবে দুটো বডি ঝুলছে গাছে, একটাতে ঈশ্বর ও অন্যটাতে শয়তান ঝুলছেন । 


এ-জীবনে...

ফ্রানজ কাফকার মতো আমিও হতাশগ্রস্ত হয়ে পড়ি কোনও কোনও সময়।  বুঝতে পারি না, নিতে পারি না বেঁচে থাকার স্বাদ। ইচ্ছে হল মেটামরফোসিস পড়ব।পুরো গল্পসমগ্র প্রথম খন্ড ডাউনলোড করে নিয়েছি । একসময় ফ্রানজ কাফকা, বিনয় মজুমদারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। আজ আমার । পার্থক্য একটাই বিনয় মজুমদার কবি ছিলেন ।  এর মধ্যে কী-করে হিমাদ্রিকিশোর পড়ব। হিমাদ্রি আমার ভীষণ প্রিয়, ওঁর ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলো তো বটেই, ওসব পড়লে স্বাদ পাই। কবিতা পড়তে আর ইচ্ছে করে না, একথা বললে ভুল হবে, সবই পড়ি, যখন যা মনে হয় তাই । লিখি কম, পড়ি বেশি। কী-হবে লিখে ? লেখা মাঝেমাঝেই আমার সঙ্গে প্রতারণা করে । এ-জীবনে হয়তো আর আমার কবি হয়ে ওঠা হল না ! 


তাই, অকারণে... 

শরম আমার সামনে দিয়ে চলে যায়। শরম আমার পিছন দিয়ে চলে যায়। শরম আমার লালগেট। শরম আমার শরণার্থী। শরম আমার ক্ষুধাতুর শিশু। সে চায় দুটো ভাত একটু নুন। আমার শরীর আজ নৈবেদ্যর ডালি নিয়ে বসে আছে। প্রতিস্পৃহ। হাতে অষ্টাদশী চাঁদ। তিলধারণের আর জায়গা নেই। আমার দেবতা এখন গান্ডেপিন্ডে গিলবে, আর জীবনদেবতা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে। আমার সামনে কোনও বাধা নেই, মৃত্যু নেই, দেশ নেই। কেনো নেই? কেনো?  কেনো? শরম আমার শরীর ছেড়ে চলে গেছে বহুদিন। চলে গেছে ঝাউবনে। মন্দারমনি শংকরপুর হয়ে ঝাউবনে। ম্যারিনাবিচ পার হয়ে ঝাউবনে। রাত্রির জোছনা পার হয়ে ঝাউবনে। তোমার আত্মধিকৃত উপলখন্ড পার হয়ে ঝাউবনে। কারণ তোমরা আত্মিকবাদী। জড়ত্বের ঘনত্ব। পরিণামের অপরিণামদর্শী। অন্ধত্বের কড়া বন্ধন। শক্তের ভক্ত, নরমের যম। তাই, অকারণে গান গাই ! 


নারদের ভেলা

['একটি চিত্রের শরীরে এসে মিশে যাচ্ছে অন্য চিত্রের শরীর অবিশ্বাস্য দ্রুততায় । আমরা নিঃশ্বাস নিতে পারছি না যেন কবিতার গতির আঘাতে।'— জয় গোস্বামী ]

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে আমার 'হৃদে বিষ মুখে মধু' মহাশয়, তোমার জন্যই আজ আমার রাত্রিযাপন নষ্ট হইল। তোমার ত্যাগের বদান্যতা আমাকে হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে চেষ্টা করিবেক লাই। নাট্যকার মন্মথ রায়কে দেখো, উনিও সভাসিন। ফিরোজ শাহ তুঘলককে দেখো উনিও সভাসিন। কেবল ভেঙ্কটেশ আমার শরণাপন্ন হইয়া আমার বুকে ছুরি বসাইল। যদুবংশ ধ্বংস হইবার কাহিনি আরও একবার পুনরুদ্ধার করিয়া দেখাও লাইট অ্যান্ড সাউন্ডে। নলখাগড়া হইতে কীভাবে হিংসার বীজ উপ্ত হইল। কীভাবে মাটি তাহার কার্যসাধন করিলেন। কীভাবে মাটি-মানুষের জয়গাথা লেখা হইল। কীভাবেই-বা শরণার্থী শিবিরে আগুন ধরাইল ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। আমি এই ছাড়িয়া দিলাম গণ্ডুষের জল। জল উদক হইয়া পদক পরাইল দেবব্রতের গলায়। আসমানী কিতাব হইয়া সৃষ্টি করিল ধর্মশাস্ত্র। রতিগাথা নিয়ে চর্চা বাড়িয়া গেল। পদমর্যাদা সংহার করা হইল নেপোলিয়ানের। সেন্ট হেলেনা দ্বূীপ হইল স্বর্ণকাটার। চৈতক তোমাকে পিঠ হইতে ফেলিয়া দিল, মহারাজ। তুমিই সেই মহারাজ, পোলো খেলিতে খেলিতে প্রাণত্যাগ করিয়াছিলে। ওষ্ঠে চেপে ধরেছিলে করযুগল। তার আগের জন্মে তুমিই তো লিখেছিলে 'ডিভাইন কমেডি'। দাঁতে হাসিয়া উঠিলেন। নারদের ভেলা তখন আসিয়া থামিল নেতুধোপানীর ঘাটে।


ঘনিষ্ঠ তাপের তরবারি 

['যে বিশ্বাসে গাছ বাড়ে, ফুল ফোটে গাছে
  পাখি গান গায়
  যে বিশ্বাসে হৃদয় হারাতে চায় হৃদয়েরই কাছে
  আমি সে নিঃশ্বাসে বিদ্ধ প্রতিদিন প্রতিদণ্ড বাঁচি'— কবিরুল ইসলাম ]

ঘনিষ্ঠ তাপের ভার্যা স্নান করতে নেমে যাবে। পিছনে অরুণ মিত্র। কবি। সন্দেশখালির গাঙ। জাবনার জল নেমে গেছে। চিটাগাঙ থেকে এসে, টিটকারি ভালোবেসে, পিছনে রোদ্দুর পরে কাছা নিঙড়াতে নিঙড়াতে উঠল তরুণ কবির ভার্যা। যাপনে চলচ্চিত্রায়িত ঢঙ। বিমুর্ত বিবেক। উদ্ভাসনের দৃষ্টি খোলা পথে চলে গেছে প্রসারিত বাহুর আড়ালে। কবি ফ্রান্সে যাবেন। ভাবনার জল নেমে গেছে। অগোছাল সাঁতারের উন্মত্ততা কবিকে বাঁচিয়ে রাখবেন। সঙ্গে থাকবেন চিন্ময় গুহ। কখন যেন বাংলা অ্যাকাডেমি মোঁমার্ত হয়ে গেল। স্নানশালা হয়ে গেল জাবনার জল। সীমায়িত ভাবনার খাপে ঢাকা, আঁধারে মলিন, ঘনিষ্ঠ তাপের তরবারি মেলে ধরলেন কবি — সূর্যের উজ্জ্বল দিকে।


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments