উপন্যাস।। অন্ত্যেষ্টি।। সন্দীপ দত্ত
পর্ব- ১
রাত আটটার ফ্লাইটে দমদমে এসে ঋষভ যখন নামল,কলকাতার আকাশ জুড়ে ততক্ষণে ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। বুঝতে পারল না,প্রথমে কোথায় যাবে সে। আহিরীটোলার বাড়ি,নাকি একেবারে সোজা হাসপাতাল? শেষ ফোনটা সে পেয়েছিল বিকেল তিনটেয়। তখনের খবরটা মোটামুটি ভাল। সুখেন আশ্বস্তর ভঙ্গিতে বলেছিল,"সাবধানে আসিস। তাড়াহুড়ো করবার কোনও দরকার নেই। আমরা তো আছি। সব সামলে নেব। ডাক্তার বলেছে,তেমন কিছু না। সোডিয়াম ফল করেছিল। আজ সন্ধের দিকে রীলিজ করে দিতে পারে। তুই চিন্তা করিস না। ধীরেসুস্থে আয়।"
খবরটা শোনার পর ধীরেসুস্থে আসার মতো মানসিকতা ঋষভের ছিল না। থাকে নাকি? যে মানুষটার সাথে গতকাল সন্ধেবেলা ঘন্টাখানেকের ওপর ফোনে কথা বলেছে সে,তার হঠাৎ এরকম কী করে হয়?
লাগেজ সামলে ট্যাক্সি ধরবার জন্য অস্থির হয় ঋষভ। তার আগে ঐশীকে একবার ফোন করবে ভাবল। কিন্তু সুখেন কল করল আবার।
"কী রে, কতদূর?"
"এইমাত্র দমদমে নামলাম। এবার ট্যাক্সি নেব। তোমরা এখন কোথায়?"
"আমরা বেলভিউয়ের সামনে।"
"বেলভিউয়ের সামনে! রীলিজ এখনও করেনি?"
"না রে,বিকেলের পর থেকে আবার খানিকটা গোলমেলে ঠেকেছে। ডাক্তার তাই আজ ছাড়বে না।"
"সেকি!"
"হ্যাঁ। তুই আয়।"
"কী করে হল এসব? সুগারের ওষুধগুলো ঠিকঠাক খায়নি?"
"বৈশাখী তো বলল,ওষুধে কোনও বেনিয়ম করেনি। কাল রাতের ওষুধটাও খেয়েছে। তুই আয় না,এলে সব বলব।"
"ঐশী কখন এসেছে?"
"ওকে তো সকালে আমিই নিয়ে এলাম। এসে অব্দি শুধু কাঁদছেই। দুপুরে ভাতও ঠিকমতো খায়নি। বৈশাখীও একই।"
"মা আর ঐশী এখন কোথায়? তোমার কাছেই আছে তো,নাকি বাড়িতে?"
"বাড়িতে চায় নাকি? পাঠিয়েছিলাম,আবার চলে এসেছে। এই তো সামনাসামনিই বসে আছে। কথা বলবি নাকি? নাহ্,এখন থাক। একটা ট্যাক্সি ধরে চলে আয়। সোজা বেলভিউতেই আসিস। বাড়িতে এখন তালা।"
ফোন ছেড়ে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বেলভিউ যেতে বলল ঋষভ। একটু তাড়াতাড়ি। কিন্তু রাস্তায় নামতেই যানজটের নাকালে পড়তে হল।
যেতে যেতে ঋষভের কেবলই মনে পড়ছিল পুরোনো বেশ কিছু স্মৃতি। যা রাতের এই আলোকমালার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। এ রাস্তার ওপর দিয়ে সে বহুবার গেছে। বাবা মার সাথে ঐশী আর সে। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে সোজা গাড়ি ধরেছে বাড়ির উদ্দেশ্যে। শেষবার ঋষভের ওখানে বাবা মা আর ঐশী গিয়েছিল বছরখানেক আগে।মহালয়ার ঠিক পর পর। ঋষভ পুজোর ছুটি কাটাতে কলকাতায় আসবে। তাই নিতে গিয়েছিল ওরা। সেকি আনন্দ! আজ সেই পথের ওপর দিয়েই ভাড়া করা গাড়ি ছুটছে তার। কিন্তু আজ এই মূহুর্তে সে আহিরীটোলার বাড়িতে ফিরছে না। যেতে হচ্ছে বেলভিউ। বাবার শরীর ভাল নেই। গতকাল রাত দুটোয় ভর্তি করা হয়েছে।
অবশেষে পৌঁছতে পারল ঋষভ। বৈশাখী আর ঐশী ওকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল সামনে। শত চেষ্টা করেও চোখের জল লুকোতে পারলেন না বৈশাখী। ছেলের দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে ডুকরে উঠলেন। মুখে কোনওরকমে বললেন,"কাল রাত দুটোয় ভর্তি করেছি তোর বাবাকে। ভাল নেই রে!"
বোন ঐশীও দাদাকে কাছে পেয়ে কেঁদে আকুল। "কী হবে রে দাদা!"
"কিচ্ছু হবেনা। সব ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তার তো বলেছে। এখন অত অধৈর্য হলে চলে?" বৈশাখী আর ঐশীকে সান্ত্বনা দিতে তালুকদারগিন্নী এগিয়ে এলেন। ওদের বাড়ির পাশের প্রতিবেশী। গতকাল রাত থেকেই একাকী বৈশাখীর পাশে আছেন। মিস্টার শোভন তালুকদারই নিজে গাড়ি চালিয়ে বেলভিউতে নিয়ে এসে দ্রুত ভর্তি করে দেন ঋষভের বাবাকে। তখন সুখেন ছিল না। সুখেনকে খবর দেওয়া হয় সকাল ছ'টার পর।
তালুকদার দম্পতির আন্তরিক সহযোগিতাই এখনও পর্যন্ত বৈশাখীকে ভেঙে পড়তে দেয়নি। শোভনবাবুর ছেলে পিনাক ঋষভেরই বয়েসি। ঋষভ কলকাতায় এলে পিনাকের সঙ্গে বেশ সময় কাটে। বন্ধুর মতো আড্ডা দেয় দুজনে। পিনাকও সামনেই দাঁড়িয়েছিল। এগিয়ে এসে বলল,"তোর লাগেজগুলো দে। আমাদের বাড়িতে রেখে আসি। গাড়ি আছে। কোনও অসুবিধে নেই।"
ব্যাগপত্তর যা এনেছিল,পিনাকের গাড়িতে পাঠিয়ে দিল ঋষভ। এখন এখানে তাকে থাকতে হবে। রাত এগারোটায় ডাক্তার একবার দেখবে বাবাকে। ডাক্তারের সাথে কথা বলবে ঋষভ। দরকার হলে আরও বেটার কোনও জায়গায় নিয়ে যাবে বাবাকে। প্রয়োজন হলে বিদেশেও। বাবাকে সুস্থ করাটা এখন তার সবথেকে বড় কাজ। বাবার জন্যই সে আজ যতটুকু দাঁড়াতে পেরেছে।
মামা হয়ে সুখেন ঋষভের কাঁধে হাত রাখল। "সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছু ভাবিস না।"
রুমালে চোখ মুছল ঋষভ। (ক্রমশ)
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন
0 Comments