জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের রসায়ন বিজ্ঞানী ড. নন্দগোপাল সাহু : সাধারণ থেকে 'অসাধারণ'-এ উত্তরণের রোমহর্ষক কাহিনী -৭/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৩৮


মেদিনীপুরের রসায়ন বিজ্ঞানী ড. নন্দগোপাল সাহু : সাধারণ থেকে 'অসাধারণ'-এ উত্তরণের রোমহর্ষক কাহিনী ― ০৭

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ :

সে-ই সাতসকালে পিঠে নরম মিঠে রোদ গায়ে মেখে অফিসে পৌঁছেছেন। আরও একখানা রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের সূচনা সেদিন। সোনালী আলোয় ভিজে কংক্রিটের জঙ্গল ঘেরা বহুতল আবাসন থেকে সক্কাল সক্কাল ল্যাবে পৌঁছে গবেষণার কাজ সবে শুরু করেছেন। নিজের পরিচিত রিসার্চ ইন্সট্রুমেন্টের সম্মুখে গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন একজন তরুণ বৈজ্ঞানিক। একটানা গোঁ গোঁ আওয়াজ করছে যন্ত্রটি। আর তখনই এক কাল্পনিক, তাঁর মতে, বার্তার আগমন।

যন্ত্রের সম্মুখে একখান মাত্র চেয়ার। আরাম-কেদারায় বসে আছেন তিনি। তাঁর দৃষ্টি যন্ত্রের দিকে নিবদ্ধ; কিন্তু মন গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন। সিগন্যাল ওঠানামা সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে মিলবে ইপ্সিত ফল। তারই ভাবনায় তাড়িত মন। 'টিঁ-টিঁ, টিঁ-টিঁ'―মোবাইলে হঠাৎ বার্তা আগমন শব্দ। অন্যমনস্ক বৈজ্ঞানিকের কপালে চিন্তার ভাঁজ। বলিরেখা চিহ্নিত অংশগুলো খানিক প্রকট হল। তাঁর চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটায় যারপরনাই অসন্তুষ্ট তিনি। খানিক যেন বিরক্তি প্রকাশ পেল মনে হল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মোবাইল হাতে তুলে আন-লক করলেন স্ক্রিন। পড়লেন মেসেজখানা।

মূহুর্তে পাল্টে গেল মুখের রঙ। চোখ দুটো সামান্য ছোট হয়ে গেল। গালের নরম মাংসপেশি একটু কুঁচকে গেল হয়তোবা। দাঁত বেরল না। কিন্তু মুখমণ্ডলে একছটাক হাসির আভা স্পষ্ট।
'ধুত্তোর! ফেক নিউজ। যত্তসব আজগুবি খবর।' (মনে মনে আওড়ালেন)
ভাবলেন বটে; তবে নিশ্চিন্ত নয়। খটকা লাগল― মেসেজ সত্যি কি-না! মেসেজটি এসেছে তাঁর ই-মেইল অ্যাড্রেসে। কম্পিউটার স্ক্রিনে নিজের মেইল ইনবক্সে ক্লিক করতেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার ভেসে উঠল। ডিটেইলস পড়ে মোবাইলে কল ডায়াল করলেন বাড়িতে।
'হ্যালো। আমার ই-মেইলে একখানা নিউজ এসেছে। ফেক নিউজ। পড়ে দেখ, বেশ মজার ঘটনা'― রসিয়ে রসিয়ে কথা ক'টা নন্দবাবু শোনালেন কলিদেবীকে। আসলে পড়ামাত্র হাসির উদ্রেক হচ্ছে নন্দবাবুর। ভাবলেন বেশ রসিকতা জানে তো মেসেজ প্রেরক।

সিঙ্গাপুরে 'অ্যাসটার' (ASTAR)-এর অধীন নামীদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান 'ইনস্টিটিউট অফ ম্যাটিরিয়াল রিসার্চ অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং' (Institute of Material Research and Engineering)। সংক্ষিপ্ত নাম 'IMRE'। সেখানেই দীর্ঘ এক বছর যাবৎ গবেষণায় লিপ্ত তিনি। সকাল সকাল কেউ নির্ঘাৎ তাঁর সঙ্গে মজা করছে। মজা করে এমন উদ্ভট মেসেজ প্রেরণ করেছে― তাঁর দৃঢ় ধারণা। অথচ মেসেজটি এসেছে ইন্ডিয়া থেকে; সেখানকার এক ইউনিভার্সিটির অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে। আর সেটাই যত চিন্তার। সাত-পাঁচ বিক্ষিপ্ত ভাবনার মাঝে মিনিট দশ পরে বেজে উঠল ল্যাবরেটরির টেলিফোন। টেলিফোনের রিসিভার তুলে 'হ্যালো' বলতেই ও'প্রান্ত থেকে কলিদেবীর কণ্ঠ ভেসে এল।
'মনে হচ্ছে নিউজটা ফেক নয়, সত্যি ঘটনা। কিছুদিন পূর্বে তুমি নৈনিতালে অ্যাপ্লিকেশন করেছিলে না? সম্ভবত তার উত্তর ওই মেসেজটি'―এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলেন কলিদেবী।
'কিন্তু! কোনও ইন্টারভিউ হল না। সরাসরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট। তাও আবার 'অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর' পদে!'― নন্দবাবুর সন্দেহ-মাখা জবাব। 
'সবচে ভাল হয়, তুমি সরাসরি নিয়োগকর্তাকে ফোনে ধর। কথা বলে দেখ ঘটনাটি কতখানি সত্য'―কলিদেবীর নির্ভেজাল পরামর্শ। লক্ষ্মীদা আর শান্তিদারও একই মত। কুমায়ুন ইউনিভার্সিটি ফোন করার মূল্যবান ও নিশ্চিত শলা দিয়ে ক্ষান্ত তাঁরা।
     


তিনি যথারীতি ঘর্মাক্ত। উত্তেজনায়। ফোনে কথা হল কুমায়ুন ইউনিভার্সিটির সঙ্গে। খবরটি একশো শতাংশ খাঁটি। চাকুরীতে নিয়োগের দুটি পদ্ধতি। প্রথমত, অফলাইন কিংবা অনলাইন ইন্টারভিউ দ্বারা। দ্বিতীয়ত, 'ইন অ্যাবসেনসিয়া' (In absentia)-এর মাধ্যমে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে চাকুরী প্রার্থীর অবর্তমানে, তাঁর অভিজ্ঞতা আর সামগ্রিক কাজের মূল্যায়ন করে জব-প্যানেল বোর্ড আবেদনকারী প্রার্থীকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠায়। এমন প্রভিশন সম্পূর্ণ বৈধ। ইউনিভার্সিটির পরিস্কার বক্তব্য―
'আপনাকে 'ইন-অ্যাবসেনসিয়া'র ভিত্তিতে সিলেক্ট করা হয়েছে। প্রফেসর রিক্রুটমেন্ট কমিটি আপনাকে নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।'
      

কুমায়ুন ইউনিভার্সিটির তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর (VC) প্রফেসর রাকেশ ভাটনাগর স্যার। জহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটি (JNU) থেকে লিয়েনে কুমায়ুন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন। তিনি ইউনিভার্সিটি রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের মাথা। প্রফেসর ভাটনাগর দীর্ঘ সময় বিদেশে গবেষণা করেছেন। প্রবাসে প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণার হালহকিকত, তুলনামূলক গুণাগুণ তাঁর নখদর্পণে। এ ব্যাপারে এক্সপার্ট তিনি।

প্রবাদ আছে, রতনে রতন চেনে। প্রফেসর ভাটনাগর নন্দগোপাল বাবুর গবেষণার কাজ দেখে মুগ্ধ। যদিও দূর দূর পর্যন্ত নন্দবাবুর সঙ্গে প্রফেসরের কোনও সংযোগ নেই। প্রফেসরের জহুরী চোখ অনুজ বৈজ্ঞানিকের কাজের মান চিনতে ভুল করেনি। সেদিন মূলত তাঁর সুপারিশে নিয়োগ পত্র প্রেরণ করা হয় নন্দবাবুকে; পরের জনের ই-মেইল অ্যাড্রেসে। ঠিক তার পরের দিন সকালে অফিসে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার প্রাপ্তির শুভ সংবাদ কলিদেবী মারফত নিশ্চিত হন তিনি, যা পূর্বে বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে।

ক'টা দিন পরের ঘটনা। নন্দবাবুর মোবাইল রিংটোন বেজে উঠল। অপরিচিত নম্বর। প্রথমটায় দেশের নম্বর বলে ভ্রম হয়। বাস্তবে ফোন-কলের উৎস ভারতবর্ষ-ই। প্রফেসর ভাটনাগর স্যার উপযাচক হয়ে কল করেছেন। তাঁর কণ্ঠে সামান্য উৎকণ্ঠা―
'আপনি কুমায়ুন ইউনিভার্সিটি জয়েন করবেন তো?'
'হ্যাঁ, স্যার। আমি জয়েন করব'―ছোট্ট জবাব নন্দবাবুর।

*  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  * 
সিঙ্গাপুরের বন্ধু বান্ধব দলের উৎসাহ উদ্দীপনা খানিক তুঙ্গে। বন্ধুর সাফল্যে দারুণ খুশি সকলে। তারাই বলল―
'যা, বন্ধু। তুই দেশে ফিরে যা। দেশের জন্য কাজ কর। তুই যা।'
মনে মনে ভরসা পেল। শক্তি এল। হৃদয়ের অস্থিরতা নিমেষে দূর হয়ে গেল। সমস্ত জড়তা উবে গেল। গবেষণার উত্তম পরিবেশ-বন্ধুবান্ধব ছেড়ে নিয়ে ফেললেন নৈনিতালে আসার কঠিন সিদ্ধান্ত। কিন্তু তার আগে অনেক কাজ বাকি। বিস্তর দায়িত্ব তাঁর। প্রথমত 'ইনস্টিটিউট অফ ম্যাটিরিয়াল রিসার্চ অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং' (Institute of Material Research and Engineering)-এ বিষয়টি জানাতে হবে। নিয়ম আছে― ন্যুনতম এক মাস থেকে তিন মাস পূর্বে ইনস্টিটিউট ত্যাগের নোটিফিকেশন করতে হয়। সে-মত গুছিয়ে রিজাইন নোটিফিকেশন লিখলেন তিনি। সেটা ২০১৩ সালের জুন মাস।

দু-তিন সপ্তাহ পরের ঘটনা। প্রফেসর ভাটনাগর কুমায়ুন ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর পদে সবে ইস্তফা দিয়েছেন। চলে গেছেন দিল্লী; জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটি (সংক্ষেপে, JNU)। কুমায়ুন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন প্রফেসর এইচ. এস. ধামি। ভাইস চ্যান্সেলর ধামি'কে নন্দবাবুর বিনয়ী প্রস্তাব― সিঙ্গাপুরে গোছগাছ করতে তাঁর মাস তিনেক সময় লাগবে। প্রতিষ্ঠান থেকে মিলল সবুজ সংকেত। তিন মাসের মধ্যে কুমায়ুন ইউনিভার্সিটি জয়েন করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে ফোন করলেন তিনি।

ঘটনার মধ্যে হঠাৎ দারুণ টুইস্ট। অজান্তে অন্য কাহিনী ঢুকে পড়েছে। বেনো-জল ঢুকে পড়ে অন্যরকম দুষিত গন্ধ। নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রাপ্ত খবর― সমূহ বিপদ! স্টে-অর্ডার নোটিশ যেকোনও সময় ঝুলে যাবে। স্টে-অর্ডার রদ করার একমাত্র উপায়― ইমিডিয়েট জয়েন করতে হবে। স্টে-অর্ডার! কিন্তু কেন? কী কারণে স্টে-অর্ডার নোটিশের আশঙ্কা? যে ইন-অ্যাবসেনসিয়া গ্রাউন্ডে নন্দবাবুর নির্বাচন, তাতে ইউনিভার্সিটির কয়েকজনের সম্মতি নেই। তাদের যুক্তি― ইন-অ্যাবসেনসিয়া'তে নিয়োগ হবে কেন? এখানেই তাদের আপত্তি। যেকোনও মূল্যে নিয়োগ রদ করতে উঠে পড়ে লেগেছে তারা। তাদের লিখিত আপত্তি ইউনিভার্সিটির সর্বেসর্বা-মুখ্য উপদেষ্টা গভর্নর ড. আজিজ কুরেশি আর ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ধামি স্যার― দু'জায়গায় ফরোয়ার্ড করে দিয়েছেন তারা। অনতিবিলম্বে স্থগিতাদেশ নোটিশ এসে পড়ার বিপুল সম্ভাবনা। এটি ২০১৩ সালের জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহের ঘটনা।

মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বার উপক্রম। আশাভঙ্গের স্পষ্ট দিশা প্রতীয়মান। সিঙ্গাপুরে জমা পড়েছে পদত্যাগ পত্র। আর ওদিকে কিনা স্টে-অর্ডারের ভ্রূকুটি! এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। নদীর একুল-ওকুল দু'কুল ভেঙে পড়ার সামিল। এ হেন সংবাদ প্রাপ্তির পরে সন্ধ্যা নাগাদ দিশেহারা অবস্থা তাঁর। পায়ের নিচে সরে যাচ্ছে জমি। কী করবেন বা না করবেন বোধগম্য ঠেকছে না কিছু। অগত্যা নিয়োগকর্তা প্রফেসর ভাটনাগর স্যারকে ফোনে ধরলেন। অসহায় হয়ে বললেন―
'স্যার, কী ব্যাপার! শুনছি না-কি স্টে-অর্ডার পড়ে যাবে? প্লিজ স্যার, বিষয়টা আপনি একটু দেখুন।' নন্দবাবুর গলায় হতাশা ঝরে পড়ছে।
তক্ষুণি ভাটনাগর স্যার ফোন ডায়াল করলেন বর্তমান ভি. সি.-কে। নিশ্চিত হলেন খবরের সত্যতা। তাঁর কাছে বিষয়টা এখন দিনের আলোর মতো পরিস্কার। পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে― নন্দবাবুকে পাখি পড়া করে বোঝালেন তিনি। স্থির হল আগামীকাল এসে ইউনিভার্সিটি জয়েন করবেন নন্দবাবু। রাত্রি দশটা পর্যন্ত, সিঙ্গাপুর টাইমে, চলল আলোচনা, ঘটনার নাটকীয়তা। সিদ্ধান্ত নিতে সামান্য দোনামোনা করছেন তিনি। এত প্রতিকূলতার মাঝে নৈনিতাল আসা যুক্তিসঙ্গত হবে, না-কি সিঙ্গাপুরে থাকবেন― বড্ড দোটানায়। মনের সায় নেই ইন্ডিয়া ফেরায়। আবার হৃদয়ে অটুট বাড়ির টান।
যদিও এত ভেঙে পড়ার কিছু হয়নি এখনও। আশার প্রদীপ এখনও পুরোপুরি নিভে যায়নি। সিঙ্গাপুরে পদত্যাগের অনুমতি চেয়েছেন শুধু। পদত্যাগ মঞ্জুর হয়নি। চাইলে তিনি পদত্যাগ পত্র উইথড্র করতে পারেন। তাছাড়া IMRE-এর অফিসিয়ালরা পদত্যাগ পত্র উইথড্র করার কথা বারেবারে বলে চলেছেন। সুতরাং একেবারে হাটে-হাঁড়ি-ভেঙে-গেল মার্কা কিছু ঘটেনি।

*  *  *  *  *  *  *  *  *  *  * 

অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরের সম্মানের চাকুরী। জিনিসপত্রের গোছগাছ একটু জোরকদমে চলছে। সবাই খুব খুশি। আনন্দে আত্মহারা। ফুরফুরে আবহাওয়া। কতদিন যে দেশের মাটিতে পা রাখেনি সবাই ঠিক মনে পড়ে না। তায়, এবার থেকে দেশের মধ্যে কাজের সুবর্ণ সুযোগ। বেশ উত্তেজিত লাগছে। উত্তেজনায় ছটপট করছেন কবে ভারতে ফিরবেন। অকস্মাৎ একটি অযাচিত দুর্ঘটনা ঘটে গেল। সেটা জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। শ্বাসকষ্ট জনিত কারণে পিতা শ্যামাপদ বাবু হঠাৎই হাসপাতালে ভর্তি। অবস্থা ভালো নয়। সঙ্গীন দশা। মেজদা শ্রী অসিত কুমার সাহু আর মেজো জামাইবাবু শ্রী জগদীশ বারিককে ফোনে জিজ্ঞেস করলেন নন্দবাবু―
'বাবার শরীরের অবস্থা কেমন? আমি কী এখন বাড়ি ফিরে যাবো?'
'না, না, তোর এখন বাড়ি না এলেও চলবে। অবস্থা আপাতত স্থিতিশীল। আশা করি সব ঠিক হয়ে যাবে। আর তো মাত্র ক'টা দিন। তারপর তোরা সকলেই বাড়ি ফিরে আসছিস। সবকিছু গুছিয়ে পার্মানেন্ট চলে আয়। এখন আসার প্রয়োজন নেই'― বাড়ির লোকজনের অভিমত।

নাহ, শেষ দেখা হল না। মন্দ ভাগ্য তাঁর। পরলোকে গমন করলেন পিতৃদেব। বুকে একরাশ গভীর হতাশা। বাবাকে না দেখার যন্ত্রণা কুরে কুরে খাচ্ছে। একখণ্ড পাথর যেন চেপে বসে আছে বুকে। শূন্য খাঁচায় শুধু হাহাকার। সীমাহীন আফসোস। আফসোস বাড়ির লোকের কথা না-শুনে যদি তখন দেশে ফিরতেন, তাহলে হয়তো একবার অন্তত শেষদেখা সম্পন্ন হত।
মৃত্যুশোক কাটিয়ে ওঠার পূর্বে, পিতার মৃত্যুর দিন দশেক পরে আরেকটা অভাবনীয় ঘটনা ঘটে। দুর্ভাগ্য তাড়া করে বেড়ায় তাঁকে। বিশেষ সূত্র মারফত জরুরি খবর আসে― কুমায়ুন ইউনিভার্সিটিতে তাঁর নিয়োগকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে স্টে-অর্ডার নোটিশ যেকোনও দিন এসে পড়বে। তাঁর মাথায় হাত! সম্মুখে ঘোর বিপদ। কিংকর্তব্যবিমূঢ় তিনি। ঘটনাটি সম্ভবত ছিল অশুচি নখ-চুল কাটার আগের দিন। রাত এগারোটার সময় প্লেনের টিকিট কাটলেন। পরদিন সকাল সাড়ে পাঁচটায় ফ্লাইট। দুশ্চিন্তায় সারা রাত জেগে কাটল। দুচোখের পাতা এক করতে পারেননি। সকাল বেলা দিল্লীগামী বিমানে চেপে বসলেন। উদ্দেশ্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইউনিভার্সিটি পৌঁছে জয়েন করা। স্টে-অর্ডার নোটিশ আসার আগে।
 
দিল্লীতে নেমে প্রথমে চললেন প্রফেসর ভাটনাগর স্যারের সঙ্গে দেখা করতে। ভাটনাগর স্যার কত বড় মাপের মানুষ― এর পূর্বে কিছু জানতেন না তিনি। এসে দেখলেন-জানলেন-বুঝলেন। তিনি রীতিমত অবাক তাঁর জন্য ভাটনাগর স্যার সবরকম ব্যবস্থা করে রেখেছেন দেখে। তাঁর কী কী প্রয়োজন, বিপদে পড়লে কী কী পদক্ষেপ করা আশু কর্তব্য তার সবরকম কাগজপত্র রেডি। ভাটনাগর স্যার, তাঁর কাছে, যেন সাক্ষাৎ গডফাদার। 

*  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *

প্রফেসরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গন্তব্য সোজা নৈনিতাল। দীর্ঘ ছয়-সাত ঘণ্টার সড়ক পথ। পাহাড়ি রাস্তা। আঁকা বাঁকা; ঢেউ খেলানো। পাহাড়ের কোলে লুকিয়ে হারিয়ে যায় সর্পিল রাস্তা। দূর থেকে মনে হয় আর বুঝি রাস্তা নেই। ওই দূরে শেষ হল পথ ক্ষণিকের তরে; যেখানটায় গভীর খাদের শুরু। কিন্তু নাহ, কোত্থেকে ঠিক বেরিয়ে পড়ে আলাদিনের প্রদীপের মতো। সুড়ুৎ করে সামনে এসে হাজির হয় বিপজ্জনক বাঁক। বাঁকের পাশে বিপদসঙ্কুল পাহাড়ি খাত। নিচে খরস্রোতা নদীর উদ্যাম নাচ। বেপরোয়া গতি। পরিস্কার স্বচ্ছ জলের অবিরাম ধারা; বেদম তোড়। রাগে-অভিমানে এগিয়ে চলে সমতল অভিমুখে। পাহাড়ের গায়ে লতার মতো পেঁচিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে রাস্তাগুলি, ভালোবাসার বন্ধনে। পার্বত্য পথের চড়াই-উৎরাই শেষে এসে গেল নৈনিতাল। প্রকৃতির নৈসর্গিক দৃশ্যমালা উপভোগ করতে করতে গাড়ি পৌঁছল কুমায়ুন ইউনিভার্সিটির গেটে। গাড়ি থেকে নেমে সোজা ভাইস চ্যান্সেলরের অফিস। ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ধামি শোনালেন হাড় হিম করা তথ্য। স্টে-অর্ডার নোটিশ ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁকে জয়েন করতে দেওয়া হল না। অপূর্ণ থেকে গেল বাসনা। চোখে তখন সর্ষে ফুল। চারদিক যেন অন্ধকার। দৃষ্টি ঝাপসা।
     

ওদিকে দেশের বাড়িতে শোকের ঘন ছায়া। শ্রাদ্ধ শ্রান্তির পুরোদস্তুর আয়োজন চলছে। অথচ পিতার মৃত্যুর শোক প্রকাশ করার অবকাশ তাঁর নেই। হায় রে, বিধাতা! তুমি কি বড়ই নিঠুর? এত কষ্ট, এত দুঃখ কীভাবে সইবেন তিনি? তাঁর সামনে এখন একটাই রাস্তা খোলা। সিঙ্গাপুর ফিরে যাওয়া। ফিরে গিয়ে নিজের পুরোনো কাজে যোগ দেওয়া। গবেষণায় মনোনিবেশ করা। দুঃখ কষ্ট নিরসনের এটাই এখন একমাত্র শ্রেয় উপায়।

কিন্তু শেষ হয়েও শেষ হল না নাটক। ঘটনার মধ্যে আরও টুইস্ট। প্রফেসর ধামি-সহ অধিকাংশ প্রফেসর-অ্যাডমিনিস্ট্রটর চাইছেন― নন্দগোপাল বাবু জয়েন করুক। সকলের একই পরামর্শ― নিজের অধিকার নিজে বুঝে নেওয়া। 
একজন বললেন― 'আপনি কোর্টে যান। আপনার কাছে সব বৈধ কাগজপত্র রয়েছে। নিয়োগপত্র আছে। সমস্ত ডকুমেন্ট আপনার ফেভারে।'
তৎক্ষণাৎ আরেকজনের যুক্তি― 'কোর্টে স্টে-অর্ডারের যুক্তি ধোপে টিকবে না। আপনি জিতবেন। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারও পেয়ে যাবেন। যখন সব লিগ্যাল পেপার আপনার রয়েছে, তখন এত ভয় কীসের?'
তৃতীয় একজন বোঝালেন― 'নাকচ করে ফিরে গেলে এটাই প্রমাণিত হবে যে, স্টে-অর্ডারের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। আপনার নিয়োগ অবৈধ।' 
পেছন থেকে অন্য অফিসারের বক্তব্য― 'এ তো আপনার অধিকার। প্রাপ্য জিনিসের অধিকার আপনি ছাড়বেন কেন?'

উদ্বিগ্ন বৈজ্ঞানিক। দোদুল্যমান মন। শেষমেশ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন― 'আমি জয়েন করি বা না করি, নিজের অধিকার সহজে ছেড়ে দেব না। এ আমার দৃঢ় পণ। এ আমার মর্যাদার লড়াই। লড়াই আত্মসম্মানের।'

*  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *   

নৈনিতালে রয়েছে উত্তরাখণ্ড হাইকোর্ট। রাতটুকু হোটেলে কাটিয়ে পরের দিন দেখা করতে ছুটলেন আইনজীবীর বাড়ি। স্টে-অর্ডারের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নৈনিতাল হাইকোর্টে পিটিশন দাখিল করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গভর্নর ও ভাইস চ্যান্সেলরের বিপক্ষে। কেসের সবরকম কাগজ ভাটনাগর স্যার রেডি করে রেখেছিলেন। ফলে কাগজপত্র গুছিয়ে কেস সাজাতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি।

কোর্ট থেকে পনেরো দিনের সময়সীমা ধার্য্য করল। মহামান্য কোর্টের অকপট নির্দেশ― পনেরো দিনের মধ্যে নিয়োগ স্থগিতের উপযুক্ত কারণ দর্শাতে বলা হল। কোর্ট থেকে নোটিশ গেল গভর্নর এবং ভাইস চ্যান্সেলর অফিসে। উত্তরাখণ্ডের গভর্নর তখন ড. আজিজ কুরেশি। এক সময়ের নামকরা সায়েন্টিস্ট। 

গত রবিবার নৈনিতাল এসেছিলেন নন্দগোপাল বাবু। তারপরে চার দিন অতিবাহিত। ধৈর্য্য সহকারে নার্ভ সংযত রাখা বড় কঠিন। শুক্রবার তাঁর ফিরতি ফ্লাইট। সিঙ্গাপুর ফিরে যাওয়ার টিকিট শনিবার ভোর রাতে। আজ বৃহস্পতিবার। হাতে সময় মাত্র দেড় দিন। শেষবারের জন্য দেখা করতে গেলেন প্রফেসর ধামি'র অফিসে। ভাইস চ্যান্সেলরকে উদ্দেশ্য করে বললেন―
'টা-টা, বাই-বাই, স্যার। আমি চললাম। সিঙ্গাপুর ফিরে যাচ্ছি।'
টেনশনের শেষ নেই। তীব্র মানসিক নির্যাতন, টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে দিনগুলি অতিবাহিত হচ্ছে। দেশের বাড়িতে পিতার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান চলছে। ওদিকে সিঙ্গাপুরে পুরো ফ্যামিলি হাপিত্যেস চেয়ে বসে আছে তা‌ঁর পথ চেয়ে। আর তিনি নৈনিতালে কোর্ট-আইনজীবী-যুক্তি-পাল্টা যুক্তি ঘুঁটি সাজাতে সাজাতে ক্লান্ত। এ তিনের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে হৃদয়। চোখের সামনে দিনগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে। অমিল সমাধানের দেখা। মন খুলে দুদণ্ড কেঁদে হাল্কা হবার জো নেই তাঁর। চোখের জল শুকিয়ে গেছে। কান্নার উপায় কী! এমনই কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

সিঙ্গাপুরের অবস্থাও তখন তথৈবচ। খুব শোচনীয়। দুটো বাচ্চাকে নিয়ে কলিদেবী সেখানে অসীম টেনশনে রয়েছেন। নিরুপায় তিনি। এসময় বন্ধু সুদীপ আর তাঁর স্ত্রী অনামিকা দেবী অনবরত কলিদেবীকে খুব মেন্টাল সাপোর্ট দিয়ে গেছেন। অবিরত ফোন করে ভালো-মন্দ খোঁজ খবর নিয়েছেন প্রিয় শান্তিদা, ড. শান্তিরঞ্জন সানিগ্রাহী। শুধু পাশে দাঁড়িয়ে মেন্টাল সাপোর্ট প্রদান করা নয়, যে বার তিনেক বিমানের টিকিট অন্তিম লগ্নে বারংবার পরিবর্তন করতে হয়েছে সবই সম্ভব হয়েছে শান্তিদার সৌজন্যে। তিনি দায়িত্ব সহকারে টিকিট বদলের সমস্ত ঝুঁকি নিজের কাঁধে নিয়ে অপরিসীম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সেই কঠিন সময়ে। আর নৈনিতালে শুধু নাটকের পর নাটক।

সবকিছু ঠিকঠাক। নন্দবাবু ডিসিশন নিয়েছেন শুক্রবার গভীর রাতে রওনা হবেন দিল্লী বিমানবন্দরে। নৈনিতালের হোটেলে সব জিনিস গোছানো কমপ্লিট। এমন সময় প্রফেসর ধামি মাননীয় গভর্নরের সঙ্গে নন্দগোপাল বাবুর একটি মিটিং-এর ব্যবস্থা পাকা করলেন। সাক্ষাতের সময় শুক্রবার রাত্রি দশটা। সাক্ষাতের স্থান উত্তরাখণ্ডের রাজধানী দেরাদুনের গভর্নর হাউস নয়, দিল্লিতে গভর্নরের বাসভবন। বিশেষ কারণ হেতু মাননীয় গভর্নর এখন দিল্লিতে রয়েছেন। মিটিং-এর সংবাদ যখন নন্দবাবুর নিকট আসে, তখন বিকেল তিনটা। তাঁর হাতে সময় মাত্র সাত ঘণ্টা। নৈনিতাল থেকে দিল্লী পৌঁছতে ন্যুনতম সময় লাগে ঘণ্টা সাতেক। এখনই রওনা হলে সময় মতো পৌঁছনোর সম্ভাবনা। অন্যথায় লেট অবধারিত। মিনিট দশেকের মধ্যে গাড়িতে চড়ে বসলেন তিনি। বন্ধুর পাহাড়ি পথে প্রাণ হাতে নিয়ে ঝড়ের গতিতে চলেছে গাড়ি। 
      

দিল্লিতে কলিদেবীর এক দাদা থাকেন। নাম সুরজিৎদা, সুরজিৎ চৌধুরী। দারুণ উৎকণ্ঠায় নৈনিতাল থেকে রওনা হওয়ার সময় ফোনে যোগাযোগ করলেন সুরজিৎদার সঙ্গে। দিল্লিতে তাকে পিক-আপ করে যখন গভর্নর হাউসে পৌঁছান, ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় রাত দশটা। গভর্নর বাসভবনের গেটে কড়া সিকিউরিটি। চার-পাঁচজন বন্দুকধারী সিকিউরিটি অফিসার সজাগ রাত পাহারায় ব্যস্ত। গেটের দিকে ওদের আসতে দেখে একজন অফিসার এগিয়ে গেল। তার চাহুনিতে সজাগ জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। নন্দগোপাল বাবু শান্তভাবে আসার কারণ ব্যক্ত করলেন―
'মাননীয় গভর্নরের সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, রাত দশটায়।'
'কুরেশি স্যার অসুস্থ। উনি হাসপাতালে গেছেন'― অফিসারটির ভাবলেসহীন উত্তর।
মাথায় হাত! আর সময় নেই। ভোর চারটার ফ্লাইট। রাত্রি দুটোর মধ্যে এয়ারপোর্ট পৌঁছতে হবে। এখানে অপেক্ষা করলে ফ্লাইট মিস হতে বাধ্য। তখন টিকিট ক্যানসিল করতে হবে। তাছাড়া, এত রাতে অপেক্ষা করার পর যদি সাক্ষাৎ না হয়! মিটিং হবেই তার গ্যারান্টি কোথায়? সাক্ষাৎ না ঘটলে তখন একুল-ওকুল দু'কুল যাবে। তবুও সবদিক বিবেচনা করে ঘণ্টা খানেক অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত স্থির হল। ঘড়ির কাঁটা 'টিক-টিক-টিক' এগিয়ে চলে। এগারোটা বাজে। অথচ গভর্নরের দেখা নেই। আর না, এবার ফিরে যাওয়াই শ্রেয়। এই ভেবে দুজনে গেটের কাছে যে-ই পৌঁছেছেন, অমনি পেছন থেকে ছুটে ছুটে সিকিউরিটি অফিসারের উচ্চস্বরে আহ্বান―
'আসুন, আসুন, আসুন। স্যার ডাকছেন।'

*  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *  

সামনের চেয়ারে মুখোমুখি গভর্নর ড. আজিজ কুরেশি। উল্টোদিকে তাঁরা দুজন। রাত্রি এগারোটা। ঘরের মধ্যে পিন-ড্রপ সাইলেন্স। নিরবতা ভাঙলেন গভর্নর স্যার―
'কী ব্যাপার! প্রোবলেম কী?'
'আমি কুমায়ুন ইউনিভার্সিটি থেকে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর পদের জন্য এই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটি পেয়েছি'― লেটারটি সামনে বাড়িয়ে দিলেন নন্দবাবু।
আবার সামান্য নিরবতা। আষ্টেপৃষ্ঠে লেটারটি ভালো করে পড়লেন। যাচাই করলেন কুরেশি স্যার। এবার সামনে তাকালেন। মুখ-চোখে বিষয়টি বোধগম্য না-হওয়ার স্পষ্ট ছাপ। তিনি বললেন―
'ড. রাকেশ ভাটনাগর অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছেন?'
'আজ্ঞে হ্যাঁ, স্যার।'
'তাহলে, প্রবলেম কোথায়?'
'সিঙ্গাপুর থেকে আমি জয়েন করতে কুমায়ুন ইউনিভার্সিটি গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে জয়েন করতে দেওয়া হয়নি।'
'কেন?'
'আপনি আমাকে জয়েন করতে দেননি।'
'আমি জয়েন করতে দিইনি!'― আকাশ থেকে পড়লেন গভর্নর স্যার। চোখে মুখে বিস্ময়। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠে তাঁর পাল্টা প্রশ্ন― 'কেন? কেন আমি জয়েন করতে দেব না?'
'আপনি স্টে-অর্ডার দিয়েছেন।'
'আমি স্টে-অর্ডার দিয়েছি!'― আর এক প্রস্থ বিস্ময়ের পালা। যুক্তি খণ্ডন করে তাঁর পুনঃপ্রকাশ― 'আমার তো মনে পড়ছে না।'
'স্যার, আপনি ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ধামি স্যারকে ফোন করুন।'
কথোপকথন অলরেডি আধ ঘণ্টা উত্তীর্ণ। তারপর মিনিট তিনেকের বিরতি। গভর্নর স্যার ফোন করলেন প্রফেসর ধামি'কে। কথা বলার শেষে যথাস্থানে টেলিফোন রাখতে রাখতে তাঁর সাফাই―
'এবার মনে পড়েছে। দেখো, কেউ যদি আমার কাছে অবজেকশন নিয়ে আসে অথবা প্রতিবাদ করে, তখন সাধারণত আমরা তৎক্ষণাৎ স্টে-অর্ডার নির্দেশ দিই। তোমার কেসটা অবশ্য সম্পূর্ণ আলাদা।' নন্দবাবুর শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা সংবলিত সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ভেরিফিকেশনের ফাঁকে বললেন― 'টোটালি ডিফারেন্ট তোমার কেস। তোমাকে যদি আমরা জয়েন করতে না দিই, সেটা একটা ইন-হিউমিনিটি ব্যাপার হবে।'

আলোচনা সমাপ্ত। সঙ্গে সঙ্গে কাগজ কলম নিয়ে চিঠি লিখতে বসে পড়লেন কুরেশি স্যার। নিজের হাতে লিখলেন দেড় পৃষ্ঠার দীর্ঘ চিঠি। চিঠির ছত্রে ছত্রে ভাইস চ্যান্সেলরকে নির্দেশ পালনের উজ্জ্বল অক্ষর উদ্ভাসিত। চিঠির একটি ছত্রে তিনি লিখলেন―'আগামীকাল (শনিবার) জয়েন করিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে আমাকে রিপোর্ট করবেন।'

এগারোটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে শেষ হল লেখা। এ হেন চিঠিটি যেন ব-কলমে নন্দগোপাল বাবুর অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। মাননীয় গভর্নর তাঁকে সে-নিয়োগের সম্মতি দিলেন। সৌজন্যতা রক্ষা করে রাত সাড়ে বারোটা–একটার সময় সুরজিৎদার বাড়িতে দুজনের ফেরা। অনেক নাটুকে ঘটনার পর অবশেষে শান্তি। শনিবার সকালে ট্রেনে চড়ে নন্দগোপাল বাবু কুমায়ুন বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছান। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-অফিসারগণ যেন তাঁর-ই অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে ছিলেন ক্যাম্পাসে। সকলে সাদরে অভ্যর্থনা জানান তাঁকে। সকলের উষ্ণ অভ্যর্থনায় দূর হয়ে গেল সব দুঃখ-কষ্ট। হৃদয়ে খুশির জোয়ার। দারুণ আপ্লুত তিনি। আজ কারও প্রতি কোনও ক্ষোভ নেই। নেই অভিমান।
   
মনের গোপন দ্বারে এতদিন যে-রুদ্ধশ্বাস হৃদয়বিদারক ঘটনা জমা ছিল, বাড়ির লোকজন তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। ইচ্ছে করে তিনি বাড়িতে বলেননি। জানতে পারলে হয়তো বাড়ির মানুষগুলোর কষ্ট, উৎকণ্ঠা আরও বাড়ত। এক ঝটকায় মনখারাপের বিস্তৃত পরিধি খুলে যেত। তাতে তিনি আরও দুঃখ পেতেন। ধৈর্য্য সহকারে নিজের উপর বিশ্বাস রেখে একা একা নিজের লড়াই নিজে লড়ে গেছেন তিনি। কারণ তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল― অশুভ শক্তির আঁতাত ক্ষণস্থায়ী। অচিরেই ধুলোয় মিশে যাবে নেগেটিভ ভাবনাগুলো। পড়ে থাকবে আগামী ভোরের নূতন আলো। শীতের শেষে নরম সবুজ পাতার আগমন অবশ্যই হবে। শুভ শক্তির উন্মেষ ঘটবে।

সেদিন ইউনিভার্সিটি জয়েন করে পঁচিশ দিনের ছুটি নিয়ে ফুরফুরে মেজাজে তিনি ফিরে গেলেন সিঙ্গাপুর। শুক্রবার নয়; শনিবার রাতের পরিবর্তিত বিমানে। (চলবে)

তথ্য-ঋণ :
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের রত্নগর্ভা মাতা বিমলাদেবী
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের জ্ঞাতিখুড়ো শ্রী নগেন্দ্রনাথ সাহু
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের মেজদা শিক্ষক শ্রীঅসিত কুমার সাহু
পরম শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিক-গবেষক ড. নন্দগোপাল সাহু, কুমায়ুন ইউনিভার্সিটি, নৈনিতাল, উত্তরাখণ্ড
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের সেজদা শ্রী ননিগোপাল সাহু
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের বন্ধুস্থানীয় দাদা শিক্ষক শ্রী দেবাশীষ মান্না

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments