জ্বলদর্চি

কবি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়



প্র ণ ব কু মা র  মু খো পা ধ্যা য় (১৯৩৭-২০২০)


আমার বই পড়া 

খুব ছােটোবেলায়, যখন হাতেখড়ি অব্দি হায়নি, মা আমাকে ঘুমপাড়ানি ছড়ার সঙ্গে এক অলীক রসায়নে মিশিয়ে শােনাতেন রবীন্দ্রনাথের 'শিশু' কাব্যগ্রন্থ থেকে একের পর এক কবিতা। শুনতে শুনতে এমনই ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম সেই বইটির, যে অক্ষর পরিচয় হওয়ার পরপরই আমারও কাজ হয়ে দাঁড়ালো ওই কবিতাগুলি বানান করে করে পড়া আর মুখস্থ করা। আমাদের বাড়িতে তেমন বইপত্র থাকত না। অথচ মা ছিলেন বইঅন্ত প্রাণ। তাই পাড়ার লাইব্রেরি থেকে নিয়মিত বই আনিয়ে মা তাঁর নেশা বজায় রাখতেন। মাঝেমধ্যে আমাকেও এনে পড়াতেন দুটো-চারটে রূপকথার বই। বাড়িতে বইপত্র তেমন না থাকলেও সৌভাগ্যক্রমে মামাবাড়িতে একেবারে উল্টো দৃশ্য। সেখানে শুধু বই আর বই। কাচের আলমারির মধ্যে, ঘরের র‍্যাক জুড়ে, কুলুঙ্গির ফাঁকফোকরে, এমনকি প্রতিটি মানুষের হাতে হাতে একটি করে বই কিংবা ম্যাগাজিন। তখনও ডাইনিং টেবিলের দিন আসেনি। মাটিতে আসন পেতে খাবার ব্যবস্থা। সেখানেও সারসার খেতে বসা মামাতাে দাদাদিদিদের প্রত্যেকের হাতে তার পছন্দের বইখানি। এইসব দেখতে দেখতে, বছরের অনেকটা সময় মামার বাড়িতে কাটাতে কাটাতে, কখন যেন অজান্তেই আমারও অভ্যেস হয়ে গেল খাবার আসনে গল্পের বই নিয়ে বসা। কিন্তু অভ্যেস হলেই তাে হল না। জোগান কই! আমার নিজস্ব সম্বল ছিল জন্মদিনে উপহার পাওয়া বইপত্র। আমার এক জ্যাঠতুতাে দাদা প্রতি জন্মদিনে আমার জন্য খুঁজে খুঁজে কিনে আনতেন চমৎকার স্বাদের নানারকম বই। যেমন, মনে পড়ছে, শিবরাম চক্রবর্তীর হাসির গল্প সংকলন 'মন্টুর মাস্টার' যদি এবছর, পরেরবার শিবরাম চক্রবর্তীরই লেখা উপন্যাস 'বাড়ি থেকে পালিয়ে'। এরসঙ্গে কোনও বছর ‘নানান দেশের নানান কথা', যে-বই পড়লে ভূগোলের জ্ঞান বেড়ে যায়, কোনও বছর কার্তিকচন্দ্র দাশগুপ্তের রূপকথার গল্পভরা বই। বইটির নাম মনে পড়ছে না, কিন্তু আশুতােষ লাইব্রেরি থেকেই যে বেরিয়েছিল, সেটা ভুলিনি। কেননা এই লাইব্রেরি থেকেই বার হত একটা ঝলমলে মাসিকপত্র, 'শিশুসাথী', যেটা কিনা শুধুই ছােটদের জন্যই। তাে, এরপরে আমরা খুদে বন্ধুরা মিলে নিজেরাই গড়ে তুলি একটি লাইব্রেরি। নাম, সবুজ পাঠাগার। দুঃখের কথা, উনিশশাে ছেচল্লিশ সালের দাঙ্গায় আমাদের পুরনাে পাড়া, পুরনাে বাড়ি, পুরনাে বন্ধুবান্ধব সবকিছু ছেড়ে আসতে হয়। আরও দুঃখজনক ঘটনা এই যে আমাদের নিজেদের উপহার পাওয়া বই দিয়ে গড়ে-তােলা লাইব্রেরিটির একটি বইও সঙ্গে করে নিয়ে আসা যায়নি। রাতারাতি পাড়া ছেড়ে আসার তাড়ায়। 
১৯৪৭ সালের পনেরােই আগস্ট আমাদের পরাধীন দেশ স্বাধীন হল। তখন কয়েকটা বছর আমাদের বড়াে ছন্নছাড়া জীবন কাটাতে হয়েছে। না ছিল নির্দিষ্ট ঠিকানা, না স্থিরচিত্তে পড়াশােনার আবহ। স্কুল বদলেছে। নতুন করে বন্ধুবৃত্ত গড়ে উঠছে। বছরের অর্ধেকটা সময় মামাবাড়িতে গিয়ে উঠতে হত মাকে আর আমাকে। মামাতাে দিদির সঙ্গী হয়ে সেইসব দিনে আমাদের বেশ কিছুটা সময় কাটত শ্রদ্ধানন্দ পার্কের উল্টো ফুটের একটা লাইব্রেরিতে। রজনী গুপ্ত ফ্রি রিডিং রুম ও লাইব্রেরি। সেখানে বসে বসেই নানান পত্রপত্রিকা দেখতাম আমরা। ক্বচিৎ দুটো চারটে বই পড়ার সুযােগ ঘটেছে। সেই সুযােগ নতুন করে পেলাম ক্লাস টেনে উঠে। ততদিনে পুরনাে পাড়ার অন্য প্রান্তে আমাদের নতুন আস্তানা জুটেছে। বাবা ছিলেন পেশায় চিকিৎসক। বাড়ির সামনের দিকে ডিসপেনসারি। পিছনের লাগোয়া বাড়িতে আমরা। সেই সময় বাড়ির সামনে থেকে ৩৩ নম্বর বাসে চেপে স্কুলে যাতায়াত করি রোজ। এন আর এস হাসপাতালের উল্টো দিকে যে-স্টপে নামতাম তার একদিকে ‘প্রাচী’ প্রেক্ষাগৃহ-সংলগ্ন ডিক্সন লেন। আরেকটু এগিয়ে যে-গলি, তার নাম সারপেনটাইন লেন। সেটা দিয়েও আমাদের স্কুলে পৌঁছানাে যায়। তবে কিনা যাবার সময় ডিক্সন লেন পছন্দের হলেও ফিরতি পথে সারপেনটাইন লেনই বাছতাম। কারণ আর কিছু নয়, ওখানে অনিবার্য আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ‘ইস্ট লাইব্রেরি’। সে কী বিশাল গ্রন্থাগার। অভাবনীয়। কত-যে বই পড়েছি এই লাইব্রেরির সহায়তায় তার সীমা পরিসীমা নেই। আরও একটি স্মৃতি এই পাঠাগার ঘিরে। সেটা হল, বিপ্লব দাশগুপ্তের সঙ্গে আলাপপরিচয় এই লাইব্রেরিরই সুবাদে। বিপ্লব ছােটো থেকেই এই লাইব্রেরিতে। বই দেওয়ানেওয়ার কাজটা ভালােবেসে করত। বিপ্লবের সঙ্গে এই আলাপ কলেজেও কাজে লাগে। আমরা একইসঙ্গে ছাত্র-ইউনিয়নের কাজকর্মে জড়িয়ে ছিলাম। পরবর্তী জীবনে, বিপ্লব যখন বিলেতফেরত এম.পি, সম্পর্ক তখনও একইরকম টাটকা। আমার বই পড়ার অভিজ্ঞতায় অবিচ্ছেদ্য ঋণ এই ইস্ট লাইব্রেরির কাছে। 
‌কলেজে ঢোকার আগেই আমার জীবনের একটা লক্ষ্য যে স্থির হয়ে গিয়েছিল, আজ, এই প্রায় সাতষট্টি বছর পরে তা কবুল করতে দ্বিধা নেই কোনও। মামাবাড়িতে তখন দু-দুজন বিখ্যাত কবি। বড়াে বড়াে সাহিত্য পত্রিকায় তাদের নিয়মিত গল্প-কবিতা প্রকাশিত হয়। একজন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, বড়ােমামার বড়াে ছেলে। অন্যজন দেবদাস পাঠক, মেজমাসীর কনিষ্ঠ পুত্র। আমার মা তাে ‘খােকা’ ওরফে নীরেন্দ্রনাথের পিসি-কাম-বন্ধু। অন্যদিকে নাকি লুকিয়ে পদ্যচর্চাও করতেন! তাই আমিও যে একসময় এসব দেখেশুনে সবার অলক্ষ্যে লেখালিখির অপটু চেষ্টা চালিয়ে যেতে উৎসাহ বোধ করব এতে আর বিস্ময়ের কী আছে। চর্চায় বিস্ময় ছিল না। কিন্তু আসল বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটল ১৯৫২-র নভেম্বর মাসে। যেদিন সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকার পাতায় আমার সেই গোপন চর্চার প্রাথমিক একটি ফসল  কবিতা নামে ছাপা হয়ে বেরুলো! আর আমায় পায় কে। লেখালেখি আর লেখালেখি!
পুরোপুরি  মজে গেলাম। সেই সঙ্গে ‘শতভিষা' নামের কবিতাপত্রের দুই সম্পাদক আলোক সরকার ও দীপংকর দাশগুপ্তের প্ররােচনায় পড়তে শুরু করলাম বাংলা কবিতার আবহমান কবিতাবলী। রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদন দত্ত, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র থেকে শুরু করে একে একে তিরিশ আর চল্লিশের কবিদের বইপত্র যেমন, সমসাময়িক কবিদের কবিতাবলীও তেমন ক্রমশ ধ্যানে আর অধ্যয়নে আমাকে পৌঁছে  দিল এক আশ্চর্য জগতে। তখন থেকে বই পড়াই হয়ে উঠল সবথেকে প্রিয় কাজ। কী না পড়েছি। নামী দৈনিকে আর সাপ্তাহিকে নিয়মিত গ্রন্থ সমালােচনার কাজ নিয়েছি সারাজীবন। বইটি পাওয়ার লােভে কিছুটা, কিছুটা উপরি উপার্জনের তাগিদে। নামী দুই প্রকাশনা সংস্থায় বিজ্ঞাপন আর বইয়ের ব্লার্ব লিখতাম। সেইসূত্রেও পড়া হয়ে যেত সব ধরনের বই। এখন তাে বয়স বেড়েছে। উপহার হিসেবেও জুটে যায় নানান বই, সারা বছর জুড়েই। আবার কখনও কখনও করতে হয়েছে কিছু কিছু পুরস্কারের বিচারকগিরি। তখনও পড়তে হয়েছে, খুঁটিয়ে পড়তে হয়েছে, একগুচ্ছ করে বই। যে-কারণেই হোক আর যখনই হোক পড়েছি, বাছবিচার করে পড়িনি। এই হল মােদ্দা কথা।
আজ তাই আমার পক্ষে পুরােপুরি দাগিয়ে দিয়ে বলা অসম্ভব যে, এই আমার পাঠকরুচির সীমানা। তবে হ্যাঁ, কয়েকটি বই আমি নিশ্চিত ফিরে ফিরে পড়তে চাই। যেমন, পরিমল রায়ের 'ইদানীং’। 'ভারত প্রেমকথা', সুবােধ ঘােষের। বিমল করের ‘খড়কুটো'। রমাপদ চৌধুরীর ‘গল্প সমগ্র’ এবং ‘বনপলাশীর পদাবলী'। ভবতোষ দত্তের ‘আট দশক’। রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী'। অমিয় চক্রবর্তীর ‘পারাপার'। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত’র ‘কবিতাসমগ্র’। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘গদ্যসমগ্র’ ও ‘কবিতা সমগ্র'। বুদ্ধদেব বসুর ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ ও ‘গদ্যসমগ্র’। এর বাইরে আমাদের সমকালের প্রতিটি কবিতার বই। এবং একটি মাত্র বই পছন্দ করার বাধ্যবাধকতা থাকলে রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান'। ‘গীতবিতান'। এবং 'গীতবিতান'।

(জ্বলদর্চি || 'লেখকের পাঠক সত্তা' বিশেষ সংখ্যা ২০১৯) 

Post a Comment

1 Comments

  1. আগে পড়িনি। এখন এই স্মৃতিঘন দিনে পড়ে আকুল হলাম। শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই কবি ও গ্রন্থবিদকে।

    ReplyDelete