জ্বলদর্চি

তুলসীদাস মাইতি / পর্ব -২


হাজার বছরের বাংলা গান।। ২ পর্ব


তু ল সী দা স   মা ই তি

জয়দেবের গীতগোবিন্দ : বাংলা বৈষ্ণব গানে প্রবেশ

বাঙালি কবি জয়দেব নিজেই তাঁর সংগীতসমূহকে 'মধুরকোমলকান্ত পদাবলীং' ও 'মঙ্গলউজ্জ্বল' গীতি বলে অভিহিত করে বাংলা গানের একান্ত আত্মীয় প্রসঙ্গটি তৈরি করেছেন। শুধুমাত্র এইটুকু কারণেই নয়, বহুকৌণিক তাৎপর্যে জয়দেবের 'গীতগোবিন্দ'কে বাদ দিয়ে বাংলা গানের সূচনাপর্বের আলোচনা অসম্পূর্ণ থাকে।

বাংলা গান তার নিজস্বতা নিয়ে যখন প্রকাশিত হতে উন্মুখ তখন বাঙালি মননে ধর্মীয় জট। বৌদ্ধ ধর্মের অবশেষ, হিন্দু ধর্মের প্রবল নিয়ম, কোথাও কোথাও জৈন আবহ। সর্বোপরি তুর্কি আক্রমণের ফলে মুসলিম সংষ্কৃতির অভিঘাত। শিল্প সংগীত সাময়িক হকচকিয়ে গেলেও থেমে থাকল না। বাংলা গান একটা নতুন পথে এগোতে থাকলো। হিন্ধু ধর্মের ভেতর শৈব ও শাক্ত ধারার সঙ্গেই  চর্যাগানের অব্যবহিত পরবর্তী বাংলায় বৈষ্ণব সংষ্কৃতি  প্রবল হয়ে উঠলো। রাধাকৃষ্ণকেন্দ্রিক প্রেমভাবের অনুষঙ্গ সমকালীন সংগীতে রসসঞ্চার  করলো।

জয়দেব-পূর্ব পর্যায়ে  বৃহৎ বাংলাদেশেই রাধাকৃষ্ণ লীলার অনুশীলন গভীরভাবেই ছিল। এই বিষয়ক বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। শ্রীমদ্ভাগবত ও অন্যান্য ভক্তিগ্রন্থ বাঙালি মননে দীর্ঘ সময় ধরে ভক্তিরস সঞ্চারিত করেই রেখেছিল। কিন্তু বাঙালির নিজস্ব  ধারায় অনুশীলনে একটা নতুম মাত্রা পেলো।

একটা কথা সত্য, তৎকালীন বঙ্গভূমিতে বাংলা ভাষার উদ্ভব হলেও তার সংস্কৃতি শুধু বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক হয়ে উঠলো একথা মনে করার কারণ নেই। চর্যা সংগীতের হাত ধরে বাংলাভাষার গান যেমন জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা করেছে তেমনি সংস্কৃত ভাষাও এই পর্বে সোনার ফসল তুলেছে। পণ্ডিতগণ মনে করেন সরাসরি বাংলা না হলেও সংস্কৃত ও অপভ্রংশ সহ লোকায়ত আদিবাসী নানান ভাষার গানের বিস্তৃত ক্ষেত্র এই জনপদে ছিল। তবে বাংলাদেশের সংগীত সংস্কৃতি একটা নতুন খাত তৈরি করলো  একথা বলাই যায়। প্রচলিত ভাষার সংগীতধর্ম ও নতুন ভাষার প্রত্যয় পরস্পরকে প্রভাবিত করে যে মিশ্রণ গড়ে উঠলো তার ও  মার্গসঙ্গীতের কাঠামোয় যুক্ত হওয়ার প্রবণতা।
মূলত সেন রাজত্বে বৌদ্ধ ধর্ম ও তার আদর্শকে সরিয়ে ব্রাহ্মণ্য ভাবনা ও ধ্যানধারণা সমাজের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিতে শুরু করলো। ব্রাহ্মণ্য ও বৈদিক প্রতাপে অবৈদিক অপৌরানিক বিদ্যাচর্চা চলে গেল তা নয়। অবদমিত থেকে গেল সবটাই। সময়ের চলাচলে মিশে যাওয়ার চিত্রটাই পরবর্তী সংষ্কৃতির ইতিহাস। আসলে  দশম একাদশ শতকের আগে থেকেই ভারতীয় শাস্ত্রীয় ঢেউ বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার করছিল বলেই চর্যাগীতি ও জয়দেবের 'গীতগোবিন্দ', লোচনপণ্ডিত এর 'রাগরাগিনী' গ্রন্থে প্রবন্ধগীতের কাঠামো দেখা যায়। তার ভাষা ও ভাবধারায় অবশ্য নতুন আঙ্গিকেরই আভাস পাওয়া গেছে। বাঙালি কবি জয়দেব বাংলা ভাষায় নয়,তাঁর সংগীতকাব্য রচনা করেছেন সংস্কৃতে। কিন্তু এই ভাষার প্রসাদগুণ বাংলা সংগীতের সবচেয়ে নিকট আত্মীয় হয়ে উঠেছে। 

জয়দেবের গীতগোবিন্দ রাধাকৃষ্ণ প্রেম বিষয়ক একটি আকর গ্রন্থ। সংগীত, কাব্য, ও নাট্যধর্মের সমাবেশে সমকালীন বাংলা সংস্কৃতিকে এত বেশি প্রভাবিত করেছিল যে পরবর্তী বাংলা সংগীতসাহিত্য তারই প্রভাবে মুক্তি পেয়েছিল। জয়দেব কবি প্রাকৃত অপভ্রংশ মিশিয়ে এমন এক সুললিত ভাষা নির্মাণ করেছেন গানে যে বাঙালির কণ্ঠে কণ্ঠে তা স্থান পেয়ে যায়।পন্ডিত গণ মনে করেন এই গীত দেশীয় গানের রীতি মেনেই তৈরি। পাদাকুলক ছন্দে রচিত পদসমূহের ভাষা এমনই কোমল ছিল যে সহজেই সংস্কৃত  থেকে প্রাকৃতে বা প্রাকৃত থেকে সংস্কৃতে করে নেওয়া  সম্ভব হতো। আপামর বাঙালি সহজেই এই ভাষা বুঝতে সক্ষম হয়েছে। নতুন বাংলা ভাষার গীতিকারগণ সহজেই জয়দেবের ছন্দকে নিজস্ব ভাষায় রূপায়ণ করেছেন। এই ভাষা মাটির কাছাকাছি ও এতটাই হৃদয়গ্রাহী ছিল যে পরবর্তী সকল বাঙালি কবি তা অনুসরণ করেই সংগীত জগৎ নির্মাণ করেছেন। বলা বাহুল্য জয়দেবের ভাষা সর্বভারতে জনপ্রিয়তা পায়। এবং ভিন্ন ভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় জয়দেবের অনুকরণে পদাবলী রচিত হয়। তবে বাংলাভাষাতেই সবচেয়ে প্রভাব বেশি।
জয়দেব ও পদ্মাবতী সংগীতে পারদর্শী ছিলেন ।পদ্মাবতী নৃত্যের সঙ্গে গীতগোবিন্দ উপভোগ করতেন।পরাশর ছিলেন তাদের গানের সঙ্গী। অষ্টাপদী কাঠামোর বিভিন্ন সর্গে বিন্যস্ত গান রাগ ও তাল অঙ্গ ধাতু সমৃদ্ধ। ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের সঙ্গে দেশীয় সংগীতের রস মিশিয়ে এগুলি নির্মিত বলে বাঙালি মননকে ও পরবর্তী বাংলাভাষার গানকে প্রভাবিত করতে পেরেছে বেশি। প্রবন্ধ রীতিতেই গানগুলি বাঁধা। সামাজিক পরিসর যতোই ভাঙতে উন্মুখ হোক না কেন অভিজাত কুল সমকালীন সংগীতকে প্রবন্ধগীতের ছাঁদেই রাগ তাল সহযোগ করেন। অভিজাত রাগের সাথেই যুক্ত হয় দেশি রাগ। দ্বাদশ সর্গের চব্বিশটি গানে মালব, মালবগৌড়, রামক্রি, বসন্ত, গুর্জরি, কর্ণাট, দেশাখ, দেশ-বরাড়ি, গোণ্ডকিরী, ভৈরবী, বরাড়ি, বিভাস এই বারো রাগের উল্লেখসহ  রূপক, যতি, একতালী, অষ্টতালী ও নিঃসার এই পাঁচটি তাল সন্নিবেশিত। তবে জনপ্রিয়তার কারণেই বাঙালি অনেকসময় কঠোর শাস্ত্রীয় নিয়ম অতিক্রম করেই নিজস্ব ভঙ্গিতে এই গান গেয়েছে।শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, কীর্তন, পদাবলী সহ পরবর্তী বাংলা গানের ধারায় পূর্ণভাবে প্রভাব পড়েছে বাঙালি জয়দেবের এই গান। সংস্কৃত ভাষার কবি হলেও বাংলাগানের ধারার সব গীতিকারের তিনিই আদিগুরু। 
---------

Post a Comment

1 Comments

  1. আমার অতীত গানে গানে।খুব ভালো লাগছে।

    ReplyDelete