ঋ ত্বি ক ত্রি পা ঠী
আত্মহত্যার সপক্ষে
অবাক লাগে, এতদিনেও আত্মহত্যার সংজ্ঞা একই, স্থির। শব্দটির মধ্যে একমাত্র হেরে যাওয়া, পালিয়ে যাওয়া স্বভাব জ্বলজ্বল করছে। কেউ বলেন; অসুখ, বিকৃত মানসিকতা। সবাই বলেন : পাপ, মহাপাপ। কেন বলেন? অন্যরাও যে বলেন, তাই!
কোনও একটি বিষয়কে এই যে একভাবে অনন্তকাল দেখা ও ব্যাখ্যা করা ও অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া – এটাই বরং আত্মহত্যা, নিজের হাতে নিজের পাঁজর ভাঙা। এখন মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। এখন আর জনসংখ্যা বাড়িয়ে ও টিকিয়ে রেখে মানুষকে প্রকৃতিতে নিজের অস্তিত্বের যুদ্ধ-প্রস্তুতি নিতে হয় না। সুতরাং পাপ নামক শব্দ-মােড়ক হাস্যকর।
আত্মহত্যা অপরাধ ও অন্যায়। রাষ্ট্রশাসনের এই ব্যাখ্যায় যে দাদাগিরি ও লােকদেখানাে ভালবাসা, তা অসহ্য। রাষ্ট্রের অধীনে থেকে শরীর ও মনে অপুষ্টি ঘটলে রাষ্ট্র দায় নিতে চায় না। অভিমানে পালাতে চাইলে, জীবনকে আমার বলে প্রমাণ করতে চাইলে এই রাষ্ট্রই বলবে : অস্বাভাবিক মৃত্যু, তদন্ত চলছে... ইত্যাদি। রাষ্ট্র যদি অভিভাবকের ভূমিকা নিয়ে সন্তানের চলে যাওয়াকে চরম অভিমান হিসাবে দেখত, তবে রাষ্ট্রের দায় ও কর্তব্য বাড়ত বই-কি! সেই বাড়তি দায় নিতে প্রস্তুত নয় রাষ্ট্রশাসনযন্ত্র। অথচ রাষ্ট্রের দেওয়া সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী হতে হবে আমাকে! জীবন যখন আমার কাছে মূল্যহীন হয়ে উঠবে, চলে যেতে চাইব, যে আমাকে টেনে ধরবে-- তাকেই দেখাতে হবে নতুন পথ। যে পথ দেখাতে পারে না অথচ পথের নামকরণের চেষ্টা করে তার বিশ্বাসযােগ্যতা নিয়েই তো প্রশ্ন! সে তাে নিজেকেই আগে থেকে হত্যা করে বসে আছে।
আত্মহত্যার সপক্ষে আমি। আমি রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন নই। আমার আত্মহত্যা প্রবণতা রাষ্ট্রেরই।
অকারণ শখ করে কেউ নিজের প্রাণ নিজে ধ্বংস করেছে এমন উদাহরণ নেই। অথচ কারণ বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের আত্মসমীক্ষাও নেই। তাই আত্মহত্যাকে অপরাধ, অধর্ম, অন্যায় ইত্যাদি বলে রাষ্ট্র যেন বুঝেও বােঝে না : পৃথিবীর একজন মানুষও আত্মহত্যা করতে চায় না।
আমি চাই রাষ্ট্র আত্মসমীক্ষার পথে যাক। আত্মসমীক্ষাহীন রাষ্ট্র আসলে আত্মহত্যাকেই মদত দেয়। রাষ্ট্রকে সেই আত্মসমীক্ষার পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য আত্মহত্যার মতো মধুর শক্তিতে আস্থাশীল আমি। আমৃত্যু।
পৃথিবী থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া আর অন্যকে সরিয়ে দেওয়া এক কথা নয়। আত্মহত্যা আর হত্যা এক হতে যাবে কেন! অর্জন করেছি বলেই না জীবন আমার! জীবনেরই মতো অবিচ্ছেদ্য অংশ মৃত্যু। আমারই হাতে থাকবে মৃত্যু৷
বন্ধু-পরিবার-দেশ যখন আমাকে অপ্রেমে নিয়ে গিয়ে ফেলে, যখন আমাকে ধর্মের মানে অধর্মে আছাড় দেয় -- আমি শেষবারের মতো জীবনের কাছে জীবন প্রার্থনা করবো। করবোই ৷ সেই প্রার্থনায় যদি উঠে আসে, 'আরও কী ঘটে দেখা যাক' -- তবে তাই হোক। যদি উঠে আসে, 'জীবন রাখতে জীবনপাত' তথা মধুর আত্ম-বিনাশ -- তবে তাই হোক। কারণ, আমি বাঁচি আমার জন্য, এর থেকেও বড় সত্য আমি বাঁচি আমাদের জন্য।
শরীরী মৃত্যুকে আমরা বড় করে দেখি। মন ও হৃদয়ের মৃত্যুকে গুরুত্ব দেব না! অনেকেই বলেন : চলে গেল! পরিবারের কথাটুকুও ভাবল না! যে পরিবারের কাছে নিছক শরীরী সদস্য সে তাে থেকেও থাকে না। পরিবার মানে সংসার, দেশ, পৃথিবী। পৃথিবীকে ভালবাসি বলেই না অনুরাগ! রাগ। অভিমান। শত দুঃখে থেকে যাওয়া ও চলে যাওয়া-- বিপরীত নয়, সমান্তরাল।
সংযােজন:
১. ইরম শর্মিলা চানুর অনশন ও রাষ্ট্রের লড়াই আমরা সবাই জানি। বুঝি কি! শর্মিলা কি সত্যিই আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন! না কি দেশকে আত্মহত্যা থেকে বাঁচাতে! শর্মিলার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের যে লড়াই সে কি শর্মিলাকে বাঁচাতে না কি নিজের ক্ষমতা জাহির করতে!
২. এভাবে বেঁচে কী লাভ-- প্রশ্ন তুলে দুরারােগ্য পেশীর অসুখ থেকে মুক্তি নিয়েছিলেন ইতালির কবি ওয়েলবি। তাঁর বক্তব্য ছিল: আমি জীবনকে বড় ভালবাসি। তাই মৃত্যু চাই এখন। কারণ জীবন আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে অনেক বছর হল।
৩. কোনও ধর্মই আত্মহত্যার পক্ষে রায় দেয়নি। রাষ্ট্রও 'না'। এই বিচারে ধর্ম ও রাষ্ট্র প্রায় সমার্থক। অধর্মের দায় ধর্ম নিতে চায় না। রাষ্ট্রও আত্মহত্যার দায় না নিয়ে উল্টে দোষারােপ করে। দোষারােপের সুবিধের জন্য ধর্মের মােড়ককে আরও রঙিন করে তোলে।
৪. শরীর ও মনের জন্য প্রয়োজনীয় নিরপেক্ষ আলো বাতাস দিতে ব্যর্থ যে রাষ্ট্র, তার কাছে কেন নিষ্কৃতি-মৃত্যুর অধিকার প্রার্থনা করতে হবে! এটা অভিমান নয়, স্বাধিকারের দাবি। রাষ্ট্র কি জড় ! মৃত্যুর পর শোকজ্ঞাপনের কত আয়োজন, বৈচিত্র্য! অথচ মৃত্যুর আগে প্রাণের মর্যাদা কোথায়! সংখ্যাতীত ব্যক্তি। কিন্তু ব্যক্তিত্বের নিরপেক্ষতা দুর্লভ।
রাষ্ট্র মানে পরিবার, দেশ, পৃথিবী। পৃথিবীর তিন ভাগ জল। মাত্র একভাগ স্থল। জলে স্থলে চাপচাপ অবজ্ঞা ও ঘৃণা। অন্ধকার ও কুসংস্কার। নিছক স্রোত। দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এখানে বেশি দিন থাকা অসম্ভব। নিছক রং ঢঙ দেখাতে ও দেখতে, বিশেষ পরিবারের সদস্য হয়ে আমার পক্ষে থাকা অসম্ভব। আমার পৃথিবী আমাকে দাও। নইলে যাওয়ার যথাযথ পথ দাও।
এই প্রার্থনা কার কাছে! উত্তর : জীবনেরই কাছে।
------
35 Comments
খুব গভীরতাময়!
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteভিন্ন ভাবনা। চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো। ভাবতে শেখালো।
Deleteলেখাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।মেনে নিয়েও বলব আত্মহত্যা সমর্থন করা যায় না।
ReplyDeleteদুর্দান্ত লেখা। মানসিক এক বিশেষ ক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আত্মহত্যা। তার দায় সাধারণ অর্থে, তার ঘাড়েই আমরা চাপাতে অভস্ত্য যে নিজেকে হত্যা করে। রাষ্ট্রের ভূমিকায় যদি ব্যাক্তি নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে আত্মহত্যার দায়, রাষ্ট্রের হবেনা কেন? -- রচনা টি চিন্তনের ভিন্ন মাত্রা নিয়ে এল। ভালো লাগলো।
ReplyDeleteপার্থপ্রতিম আচার্য
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteপার্থপ্রতিম আচার্য
ReplyDeleteখুবই মর্মান্তিক।।
ReplyDeleteঠিক।
Deleteধন্যবাদ
অসাধারণ একটা গলিত লাভার পিন্ড।
ReplyDeleteনির্মম বাস্তব। যুক্তিপূর্ণ লেখা। রাষ্ট্র আর ধর্ম ব্যক্তি স্বাধীনতা য় আস্থাশীল নয়।
ReplyDeleteধন্যবাদ।
ReplyDeleteদারুণ লাগলো লেখাটি।
ReplyDeleteলিখার গভীর সত্যই অনন্য !
ReplyDeleteব্যক্তি - পরিবার - সমাজ- রাষ্ট্র সর্বোপরি ধরিত্রী , সব দিক তুলে ধরেছেন l
লেখাটি গুরুত্বপূর্ণ।
ReplyDeleteএকমত পোষণ করি। নিজেকে পার্থিব করে রাখবো কি রাখবোনা সেটা ব্যক্তির নিজের পছন্দ হওয়াই উচিত। আর সেটাই সম্মানের। খুব সুন্দর রচনা।
ReplyDeleteনিজের পাপের বোঝা অন্নের ঘাড়ে নামিয়ে দেওয়ার প্রবণতা মানুষের জিনগত।তাই আত্মহত্যা কে সার্থপরতার নাম দিয়ে দু-চার ফোঁটা জল ফেলেদিয়েই সব ভুলে যেতে পারে মানুষ।আর কিছু না পেলে,ভগবান তো রইল দোষ দাওয়ার জন্যে।
ReplyDeleteঅনেক আগেই পড়েছি।মন্তব্য করেছিলাম,কেন নেই বুঝতে পারছি।দুর্দান্ত লেখা।অনেকগুলি প্রশ্ন এসেছে যা ভাবাচ্ছে।
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteঅনবদ্য।
ReplyDeleteবিন্দুতে সিন্ধু দর্শন।
এই পর্বটিও খুব ভালো লাগল।বিষয়টির গভীরে গিয়ে ভেবেছেন এবং সঙ্গত প্রশ্ন তুলে রাষ্ট্রকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন।রাষ্ট্রের অবিচার আর অবহেলার কারণেই মানুষ আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে।
ReplyDeleteলেখা নিয়ে আমার কিছুই বলার সাহস নেই। তবে যে যে পয়েন্টগুলো তুলে ধরা হয়েছে একশ ভাগ সঠিক। দারুণ লেখা দারুণ 👌
ReplyDeleteঅনেক প্রশ্ন উস্কে দিয়েছেন। খুব ভালো লাগলো আপনার লেখা।
ReplyDeleteভালো লাগল
ReplyDeleteভালো লাগল
ReplyDeleteভালো লাগল
ReplyDeleteখুব সুন্দর লেখা।
ReplyDeleteখুব সুন্দর লেখা।
ReplyDeleteআত্মহত্যা অবান্তর কারণ তা দিয়ে কিছু অর্জন হয় না। আত্মহত্যা কোন পজিটিভ কাজ নয়। যন্ত্রণা থেকে পলায়ন। অবশ্যই তার দায়িত্ব সব মানবসমাজের। আত্মহত্যা কারীর নয়। মানবসমাজের লজ্জার। আত্মহত্যা কারীর কোন গৌরব বাড়ে না বা অগৌরব ও নেই। কাজেই আত্মহত্যার সপক্ষে লেখাও আমার মতে অর্থহীন।
ReplyDeleteমারাত্মক একটা লেখা। ব্যক্তি মানুষ আর রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক ও দ্বন্দ্বের স্বরূপ এবং সেই সম্পর্কিত অনেক প্রশ্ন উত্থাপনের পাশাপাশি উত্তরগুলোও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আত্মহত্যার অধিকার মানুষের থাকা উচিৎ ক্ষেত্র বিশেষে। - আমি একমত পোষণ করছি।
ReplyDeleteকে ভাবে! যন্ত্রণা কেবল অনুভব করে মৃত্যুর স্নিগ্ধতা ।
ReplyDeleteরচনাটি শুধু রচনা নয়, একটা প্রশ্ন বা তর্কের সুত্রপাত করে।কেউ সপক্ষে কেউ বিপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন সেটাই স্বাভাবিক।কিন্তু প্রশ্ন হল, এটাও তো ঠিক, যে, মানুষের নিজস্ব বিচার সব সময় ঠিক না-ও হতে পারে। হঠকারিতার বা সাময়িক উত্তেজনায় কি অন্য কারণে মানুষ ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতেও পারে।আর যদি তাতে কোন বাধা থাকে, যেই দিক সেটা, অন্ততঃ সেটা তো কিছুটা সংশোধনের রাস্তা বা সুযোগ দেয়। আজ যদি এটা মুক্ত হত, তাহলে নিছক একটা রাগারাগি বা মনখারাপ ইত্যাদি ছোট সাময়িক ঘটনা থেকেও অপমৃত্যু বেশি হত না কি? এই বাধা অন্ততঃ অনেক অমূল্য সৃষ্টিকে সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছে এটা কি আমরা অস্বীকার করতে পারি? মামণি রয়সম গোস্বামী সারাজীবনে অনেক খানি সময় আত্মহত্যার ওষুধ সঙ্গে নিয়ে ঘুরেছেন, তবু কোন বাধায় করেন নি বলেই তো আমরা তাঁকে পেলাম।আজ অমৃতা প্রীতম, কি স্টিফেন হকিং যদি আত্মহত্যা করতেন নিছক প্রাণের উপর তাঁর নিজের অধিকার থেকে, সারা পৃথিবী এবং তিনি নিজেও কি অনেক কিছু হারাতেন না। আমার অনেক কিছু বলার আছে, তবে সংক্ষেপে বলতে চাই, জিনিসটাকে বোধ হয় নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গীতে না দেখে, পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখলে অনেক চিন্তার সুবিধা হবে।
ReplyDeleteআর শেষে তো, আমি বেশি দূরে যাব কেন, স্বয়ং ঋত্বিকবাবু নিজেই তো উদাহরণ। উনি যে মানসিকতা নিয়ে রোগের সঙ্গে লড়াই করে সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন, এটা কি সাহিত্য, পৃথিবী বা তাঁর নিজের কাছেও বড় প্রাপ্তি নয়।আজ উনি যদি এই বাধায় আটকে না থাকতেন পৃথিবী কি এক বড় সম্পদকে হারাত না? তর্ক চলতেই পারে, তবে মনে হয়,পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গী অনেক সমস্যার সমাধান দেয়।
আগেই কয়েক বার পড়েছি, নিঃসন্দেহে বিষয়টি স্পর্শকাতর। তবে এটা পরিষ্কার, ঋত্বিক বাবুর পজিটিভিটি সন্দেহাতীত। এমন একটি সাহসী লেখা জীবনকে মূল্যবান মনে করলেই লেখা সম্ভব।
ReplyDeleteরাষ্ট্র আত্মসমীক্ষা কোনোদিন করেনি তাই এই অধিকার একান্তই নিজের থাকা উচিৎ। কিন্তু মরতে মরতে বেঁচে ওঠার গল্প বেশি সুন্দর।
ReplyDelete