জ্বলদর্চি

তুলসীদাস মাইতি || পর্ব-৫


হাজার বছরের বাংলা গান ।। পর্ব- ৫

তু ল সী দা স  মা ই তি

যাত্রাগান ও পাঁচালি: প্রাচীন বাংলা গানের নিজস্ব রূপ 


বৈশাখে মঞ্চ যাত্রা চ চন্দনা শুরু কল্পনা।
জৈষ্ঠ্যে  মহাস্নান যাত্রা অম্বুবাচী দিনত্রয়ম।।
……………………

মাঘে মাসি মহাদেবী রটন্তী চ চতুর্দশী।
দোলা কেলি ফাল্গুনে চ চৈত্রে যাত্রা চতুষ্টয়ী।।
দুতিযাত্রা রাসযাত্রা বাসন্তী   নীলযাত্রিকা।
এবং যাত্রা ময়া প্রোক্তা ষোড়সী ভবশোচিনী।।

প্রাচীন রমকেশব তন্ত্রে দেবীর বর্ষব্যাপী এমন ষোড়শ প্রকার যাত্রার কথা বলা হয়েছে।  শ্রীবিষ্ণুর দ্বাদশ যাত্রার কথা পুরাণেই পাই। অর্থাৎ প্রাচীন যুগ থেকেই যাত্রা শব্দটি একটু প্রচলিত শব্দ। তবে গানের সাথে তার কি সম্পর্ক বা কথাটির সংস্কৃতিগত বৃহৎ তাৎপর্য কতখানি তাও জানা জরুরি। যাত্রাগান পাঁচালি নাটক কথকতা কীর্তন - এই শব্দবিষয় গুলি বাংলা গানের সূচনালগ্ন থেকেই চলে আসছে।
এগুলি সূক্ষ্মভাবে ভিন্ন আঙ্গিকে বাংলার সংস্কৃতিতে জনপ্রিয়তা পেয়ে বাংলার ঐতিহ্যকে পূর্ণতা দিয়েছে বলা বাহুল্য।
পণ্ডিতগণ যাত্রাগানের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে নানান মতামত দিয়েছেন। তা থেকে একটা সংক্ষিপ্ত সিদ্ধান্ত আমরা নিতে পারি। 
যাত্রা শব্দটির অর্থের সংকোচ বিস্তার ঘটেছে এও সত্য। 'যাত্রা শব্দের অর্থ ছিল পিছন পিছন পিছন যাওয়া। 'আমোদ প্রমোদের জন্য বিহার যাত্রা আর ধর্ম কর্মের জন্য যাওয়াকে ধর্মযাত্রা বলা হতো।'  তবে এই যাত্রার সাথে শুভ সূচক নৃত্যগীত ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই গীতবাদ্যই পরবর্তীকালে যাত্রা নামে অভিহিত হয়েছে।
প্রথমে ছিল দেবতার যাত্রা। এবং সেই উপলক্ষে গীতবাদ্য যোগে কল্যাণবার্তার প্রকাশ। পরে রাজা বা অন্য কেউ কোনো বড় কাজে বেরোলে তার গমন উপলক্ষে যে সমবেত গমন ও গীতবাদ্যযোগে মঙ্গলবোধ জাগরণের আবহ তাকেই যাত্রা বলা হতো। 
অশোকের অনুশাসনে ধর্মযাত্রার বিশেষ প্রসঙ্গ আছে। মেগাস্থিনিস এর বিবরণে জানা যায় চন্দ্রগুপ্তের সভায় যাত্রাগানের মতো গান পরিবেশিত হতো। বঙ্গভূমিতে প্রথমে ছিল প্রচলিত ধারার যাত্রা। তারপর কৃষ্ণযাত্রা পরে চণ্ডীযাত্রা, চৈতন্যযাত্রা ইত্যাদি। মানুষের ক্ষেত্রে  বনযাত্রা, শিকার যাত্রা, যুদ্ধযাত্রা, তীর্থযাত্রা ইত্যাদি।  
আধুনিক কালে যাত্রা-নাটকে গান একটি সম্পূর্ণ পৃথক বিষয়। আর আগে সবটাই সংগীতে প্রকাশ হতো। পরস্পর সংগীতের মাধ্যমেই সংলাপ ও কাহিনী বিস্তার লাভ করতো। শুধু মনোরঞ্জন নয়  বৃহৎ কাজের জন্য মানসিক অবস্থান বা ধ্যান তৈরি হয়ে যেত এই গানে। মহাভারতে  হরিবংশ অংশে আমরা এই  ধরনের সংগীতের পরিচয় পাই। মহাযুদ্ধের আগে বিরাট রাজার প্রাসাদে পাণ্ডব, উপপাণ্ডব, কৃষ্ণ যোদ্ধাদের উপস্থিতিতে সংগীত ও সংলাপে লীলাসংগীত পরিবেশন আসলে শুভবোধ ও বীরত্ববোধ জাগিয়ে তোলার অনুষঙ্গ। প্রাচীন এই ধরনের সংস্কৃতিই  যাত্রাপালার পূর্বসূত্র।

বাঙালি জাতি কাব্যপ্রবণ জাতি তাই তারা মৌলিকভাবে যাত্রারগানের ধারাকে ভেঙে নতুন নতুন রীতি নির্মাণ করেছে। জয়দেবের গীতগোবিন্দ, উমাপতির পরিজাতমঙ্গল ও পরবর্তী শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এ যাত্রাগানের সূচনা। এই সংগীত গ্রন্থগুলিতে  রাগ ও তাল এর উল্লেখ আছে। বাংলাগানের সূচনা পর্বেই তা ভেঙে যাত্রাপালাগান জনপ্রিয়তা পায়। ক্রমশ এই ছোটো ছোটো পালাগান বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। গায়নের জন্য দল তৈরি হয়। অধিকারী, অভিনেতা, সূত্রধর, বাদ্যকার, কথক-- এইভাবে দল। বাংলাগানের ক্ষেত্রে কৃষ্ণযাত্রা খুব জনপ্রিয়তা পায়। ক্রমশ রামযাত্রা, ভাঁড়যাত্রা ইত্যাদি নানান ধরন তৈরি হয়। কৃষ্ণগীতি ছাড়াও শিব চণ্ডী মনসা নানা বিষয়ের পালাগান নির্মিত হতো। তখন যাত্রায় দৃশ্যপটাদির  ব্যবহার ছিল না গানের সঙ্গে বাজনা আর উক্তি প্রত্যুক্তি ছিল প্রধান উপজীব্য। এইসব পালাগানে ব্যবহার করা হতো বীণা, বাঁশি,ডঙ্কা,সানাই ,ঘুঙুর, নূপুর, করতাল প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণে নানান যাত্রাপালাগান হয়েছে। স্বতন্ত্রভাবে নিজস্ব মনন ও অনুভব দিয়েই ধর্মবিষয়ক বিষয়ের গভীরে মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতি কে বহমান করেছে। এবং দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেই বাংলা প্রাচীন যাত্রাগান আজ যাত্রায় পরিণত হয়েছে।  বাংলার অঞ্চলভেদে প্রচলিত বুদ্ধনাটক, কালীয়দমন সংগীত, দানদণ্ড নৃত্যগীত, ডাকের গান - এসব এর মিশ্রণ দেখা যায় বাংলা গানেও।  অনেকক্ষেত্রে গানের পয়ার অংশ গাইতেন মুলগায়ক বা অধিকারী আর 'লাচারী' অংশ একসঙ্গে গাওয়া হতো। বাংলা যাত্রাগানের ধারার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তার  বিশেষ বিশেষ চরিত্রনির্মাণের ভূমিকা। নারদ,বিবেক, দূতী, পাগল, সূত্রধার উচিত- নানান  চরিত্র মূল্যবোধ তৈরি ও রসিকতার প্রয়োজনে নির্মাণ। সাজসজ্জায় ভূষিত হয়ে  পরিবেশনের রেওয়াজ ছিল।  বাংলা সংগীত ও নাটকের ক্ষেত্রে এই প্রাচীন যাত্রাপালাগানের অনেকখানি ভূমিকা। কৃত্তিবাসের রামায়ণে তখনকার সমাজের কথাই আছে। 
"নাটগীত দেখি শুনি পরম কুতুহলে ।
 কেহ বেদ পড়ে কেহ পড়এ মঙ্গলে।।
 নানা মঙ্গল নাটগীত হিমালয়ের ঘরে 
পরম আনন্দে লোক আপনা পাসরে।।
বাংলা পাঁচালি গানের জনপ্রিয়তা ও কম ছিল না। প্রাচীন পালাগানের গায়নকাঠামোর সঙ্গে পাচালির অল্পই পার্থক্য। একটা সময় থেকে দুটো অনেকটাই ভিন্ন রূপ পেয়ে যায়।  শিব, কৃষ্ণ, রাম, চণ্ডী মনসা প্রমুখ দেবতাদের বন্দনাগানের সঙ্গেই মানবিক রসঅনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে পাঁচালি গানে। যাত্রাগানের দলের মতো পাচালির দল থাকলেও পাঁচালি পরিবেশিত হতো এককভাবে। অনেকক্ষেত্রে একজনই  অনেকের কণ্ঠ করে পাঁচালি গাইতেন। যাত্রাপালার মতোই বাদ্যযন্ত্র থাকতো অনেক। কাহিনি ভেঙে পালা আকারেও পাঁচালি গীত নির্মিত হয়েছে। আর মূলগায়েন ও দুয়ারী(দোহার)  নিয়ে এই ধরনের গান হয়েছে। বর্তমানে কীর্তনেও তাই হয়ে থাকে। পাঁচালিগানে চামরের ব্যবহার ছিল। পালি,জুড়ি দোহার নিয়ে পাঁচালির রীতি পরবর্তীকালে পদাবলী কীর্তনে, কৃষ্ণমঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল প্রভৃতি পাঁচালি গানে প্রবাহিত। আজকের রামায়ণ গানও এই গায়নরীতি থেকেই এসেছে। রামায়ণ পাঁচালি তখন মানুষের কাছে হৃদয়গ্রাহী ছিল। শুধু হিন্দুরা নন, মুসলমান কবিরাও ধর্মের বিচিত্র ভাব নিয়ে পাঁচালি রচনা করেছেন। নানান পাঁচালি ছিল সমকালে। মঙ্গলকাব্যের প্রভাবে সমাজে ছোটো বড়ো  দেবদেবীকে নিয়ে পাঁচালি গান গীত হয়েছে। লক্ষীর পাঁচালি, গঙ্গার  পাঁচালি,সত্যনারায়ণের পাঁচালি সূর্যের পাঁচালি, শনির পাঁচালি প্রভৃতি। 
যাত্রাপালাগান ও পাঁচালি থেকেই পরবর্তী কালের অনেক রকমের গান তৈরি হয়েছে।  অনেক পরে দাশরথী রায় যে চৌষট্টি পালার জনপ্রিয় পাঁচালি গেয়েছেন ভিন্নরূপে তা প্রচলিত ছিল দীর্ঘকাল। কালীয়দমন,  গোষ্ঠলীলা, মাথুর, দক্ষযজ্ঞ, তরণীসেন বধ, মানভঞ্জন, কলঙ্কভঞ্জন, গোপীগণের বস্ত্রহরণ  প্রভৃতি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
বাংলা গানের ইতিহাসে যাত্রাগান ও পাঁচালি গান পরবর্তীকালের কীর্তন, বাউল, কবিগান,  রামায়ণ গান, আখড়াই, হাফ  হাখড়াই, টপ্পা সহ বহু লোকসঙ্গীতের ভূমিকা। এই ভাবেই বাঙালি সংগীত রচয়িতা ও শিল্পীগণ ভারতীয় সংগীতের রাগসংগীতকে আত্মস্থ করে নতুন নতুন সংগীত রীতি নির্মাণ করে বাংলা গানের ভাণ্ডার বৃদ্ধি করেছেন।
(চলবে)
-------

Post a Comment

0 Comments