জ্বলদর্চি

তুলসীদাস মাইতি || পর্ব - ৪


হাজার বছরের বাংলা গান  ||  পর্ব-৪


শৈব ও শাক্ত আবহ : মঙ্গলগীতের সূচনা 

প্রাচীন বাংলা গানের আবহে 'ধান ভানতে শিবের গীত'- প্রবাদটি ভীষণভাবে প্রচলিত ছিল। মদনপালের তাম্রশাসনে উল্লিখিত আছে 'ধান ভানতে মহীপালের গীত।'- এই দুই বাক্য থেকে স্পষ্ট হয় শৈব প্রভাব তখন এমনই ছিল যে, সমস্ত কর্মের সূচনাতেই শিবের বন্দনা গাওয়া হতো। আর রাজাদের  স্তুতি বন্দনা করা হতো। পালযুগে বঙ্গভূমিতে স্তুতিসঙ্গীত এর প্রচলন ছিল, চৈতন্যজীবনী গ্রন্থেই তার প্রসঙ্গ আছে। 'যোগীপাল, ভোগীপাল, মহীপাল গীত/ ইহা শুনিতে যে লোক আনন্দিত।' সমসময়ে সমস্ত রাজসভায় সভাগায়ক নিয়োগ করা হতো। তিনি এবং তার শিষ্যমণ্ডলী রাজ্যের বন্দনা করেই অন্যান্য সংগীত পরিবেশন করতেন। তবে দেববন্দনা ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। শিবের গীতি তাঁরই অঙ্গ।

সেন আমলে কৃষ্ণগীতি ও বৈষ্ণব পদগান যতই সমাজকে মাতিয়ে তুলুক না কেন শৈব ও শাক্ত প্রভাব ছিল অনেকটাই। আর এই দুই শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্বও ছিল খুব।ব্রাহ্মণ‍্যশক্তির কড়াকড়ির যুগে শিব দেবতাই অধিক ভাবে পূজিত হয়েছে। পণ্ডিতগণ মনে করেন শিবের মাহাত্ম্য প্রাচীন কাল থেকে ভারতীয় মননে বিরাজ করলেও বঙ্গ জনপদের প্রাচীন গানে অনেকটাই লৌকিক দেবতারূপে শিব প্রতীয়মান। এসময় গানে শিব অনেক ক্ষেত্রেই ঘরের মানুষ। সমকালীন স্তুতি গানে শিব কখনো কৃষক কখনো বাড়ির সর্বময় কর্তা, কখনো ভাঙড়, কখনো তন্ত্র-মন্ত্রের গুরুরূপে প্রকাশিত। পল্লী বাংলার উঠোনে উঠোনে এই শিবের গানই গাওয়া হতো। শিবায়ন কাব্য, শূন্যপুরাণ ও গোরক্ষ বিজয়ের পালায় এমন শৈব আবহ ছিল।
হিন্দুবৌদ্ধ যুগে যে সময়ে শিবের গীত প্রচলিত ছিল তখন শাক্তধর্মেরও যুগ। তুর্কিশাসন সূচনার পরে ব্রাহ্মণ‍্যবাদের নব উত্থানের কালে মঙ্গলগীত এর সূচনা হয়। নতুন ধর্মের অভিঘাত ও আগ্রাসন থেকে বাঁচার স্বার্থেই  উচ্চ শ্রেণি ও নিম্ন শ্রেণির সংস্কৃতি মিশতে থাকে। শিব ও শক্তির প্রচলিত ধারায় সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে মনসা, চণ্ডী, শীতলা, বাসুলী প্রমুখ অন্ত্যজ মানুষের নারী দেবতার আরাধনাকেন্দ্রিক পালাগান। বিবর্তিত সমাজের রূপ যাই হোক না কেন পাঁচালি ও অখ্যানসংগীত ধারার এই পালাগুলি জনপ্রিয়তা পায়। শক্তি দেবীর সাধনার সূত্র ধরেই মঙ্গলগীতের নারী দেবীর পরিকল্পনা। চর্যাপদের আমল থেকেই নারীকে শক্তিরূপে স্থান দেওয়ার রেওয়াজ পরিলক্ষিত হয়। চর্যার সাধকগণ ডোম্বিনী, চন্ডালী, সবরী প্রভৃতিকে সাধন সঙ্গিনী করে মহাসুখের চিন্তা করেছেন। তেমনিভাবেই বলা যায়, মনসামঙ্গল চণ্ডীমঙ্গল ইত্যাদি গানে শিবের প্রসঙ্গ এলেও তিনি উচ্চ শ্রেণির মানুষের দেবতা আর তাঁকে নিষ্ক্রিয় রেখে মনসা, চণ্ডী প্রমুখ অন্ত্যজ অবহেলিত মানুষের দেবীগণের ক্ষমতাকে প্রাধান্য দেওয়াই কবিদের উদ্দেশ্য ছিল। আর এই সামাজিক মিশ্রনের ফলেই সংগীতের ধারা স্বতন্ত্র হলো। আর সংগীতের মানেও কিছুটা অবনতি এলো বলে অনেকে মনে করেন। আসলে সমাজকে বার্তা দেওয়া ও অনেক ক্ষেত্রেই দুই শ্রেণির মানুষকে মেলানোই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। তবে এই  বিবর্তিত নতুন সংগীতধারা বাংলা সংগীত ধারার এক বিশেষ প্রতিনিধি হয়ে পরবর্তী সংগীতধারাকে প্রভাবিত করলো।

মঙ্গলগীতি গাওয়ার রীতির মধ্যেও ছিল অভিনবত্ব। দেবতার মাহাত্ম্যসূচক হলেও এই গীতিপর্যায়ে সংগীতধর্মটি পূর্ণরূপেই বজায় ছিল। নূপুর, মৃদঙ্গ, মন্দিরা, ঘুঙুর, ঢোল প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গীত হতো। কখনো একক কখনো বা সমবেতভাবে গাওয়া এই গান সাধারণ জনসমাজের উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল। এই বিশেষ রীতির সংগীত সম্পর্কে পণ্ডিতগণ নানান কথাই বলেছেন। মঙ্গলরাগে গাওয়া এই গান শুনলে বা গাইলে মঙ্গল হয় এই ভাবনা প্রচলিত ছিল। গায়ন বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এর অন্য নাম অষ্টাহ গীত। আট দিন ধরে গাওয়া হত বলে মনে করা হয়। এদের অষ্টমঙ্গলাও বলা হতো। 'শক্তি দেবীর বিশিষ্ট গুহ্য সংখ্যাও আট'। ভিন্ন ভিন্ন মঙ্গলসঙ্গীত গাওয়ার জন্য পালা ভিন্ন ভিন্ন ছিল। চন্ডীমঙ্গল আট + আট = ষোলোটি পালা, মনসার গানে তেরোটি পালা, ও ধর্মমঙ্গল বারোটি পালায় গাওয়ার রেওয়াজ ছিল বলে জানা যায়। চণ্ডীর গীত, বিষহরির গান, ঝাপান গান, মনসার ভাসান, ধর্মের দ্বাদশ পালা, শীতলা, ষষ্ঠীর গান - পরবর্তী বাংলা গানের অঙ্গ হয়ে আজও টিকে আছে।
জনপ্রিয়তা ও সামাজিক প্রয়োজন এতটাই ছিল যে বহু মেধাবী কবি বাংলার প্রায় সব প্রান্তে বসে মঙ্গলগীতি রচনা করেছেন। মনসা, চণ্ডী, ধর্ম, ছাড়াও পরবর্তীকালে রচিত হয়েছে শীতলা, ষষ্ঠী, গঙ্গা, কপিলা, কমলা ও সূর্যের মঙ্গলগান। দক্ষিণ রায়ের গান ও সত্যনারায়ণের পাঁচালি। ফুল্লরা ও পদ্মাবতী বারমাস্যার পর রাশি রাশি বারমাস্যা গান রচিত হয় বাংলা গীতিধারায়। বিষ্ণুপ্রিয়ার বারমাস্যা, নাগমতীর বারমাস্যা, রাধার বারমাস্যা, সখীর বারমাস্যা - এরকম বহু উদাহরণ। বেশ কয়েক শতক ধরেই চলতে থাকে এই প্রবণতা। পরে তা হয়ে ওঠে বাংলা গানের ঐতিহ্য, বাংলা সংষ্কৃতির পরম্পরা।

অধিকাংশ মঙ্গলগাথাই আসলে 'শক্তিতন্ত্রের গান'। অন্যান্য দেব বন্দনাও আছে। বাংলা গানের ধারায় তার অবদান অনস্বীকার্য। বাঙালির নিজস্বতাকে খুঁজে পাই এ পর্যায়ের গানে। ধর্মকলহকে ঘিরে বাংলার সংস্কৃতি ও সংগীতে এই গীতধারা আসলে বাংলার ব্যতিক্রমী আত্মাকেই প্রকাশ করেছে। (চলবে)
-------

Post a Comment

9 Comments

  1. অজানা এক সুন্দর অধ্যায়।

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লাগছে। অনেক তথ্য জানতে পারছি।

    ReplyDelete
  3. উপকৃত হচ্ছি

    ReplyDelete
  4. খুব সুন্দর সাবলীল এবং তথ্যপূর্ণ রচনা। গবেষণাধর্মী লেখাটি পড়ে অনেক কিছু অজানা জানতে পারলাম। লেখক এবং সম্পাদক মহাশয়কে অভিনন্দন।

    ReplyDelete
  5. পড়লাম
    ভালো লাগলো

    ReplyDelete
  6. খুব ভালো লাগলো। চলতে থাকুক।

    ReplyDelete
  7. খুব ভালো লাগলো। চলতে থাকুক।

    ReplyDelete
  8. খুব ভালো হয়েছে ।

    ReplyDelete