জ্বলদর্চি

উইলিয়াম কেরি / সন্দীপ কাঞ্জিলাল

স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল

বাংলা গদ্যের জনক উইলিয়াম কেরি (William Carey) 
(১৭/০৮/১৭৬১--০৯/০৬/১৮৩৪)


উইলিয়াম কেরি ইতিহাসের পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব যিনি বাংলা গদ্য গড়ে তুলতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৭৬১ খৃষ্টাব্দে ১৭ই আগস্ট ইংল্যান্ডের এক দরিদ্র তাঁতি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম এডমুন্ড কেরি এবং মায়ের নাম এলিজাবেথ। তিনি এক নিকোলাস নামে মুচির অধীনে  চামড়ার কাজ শেখেন। তারপর তিনি ১৭৭৯ খৃষ্টাব্দে থমাস ওন্ডারের অধীনে জুতা প্রস্তুত কারখানায় চাকরি নেন। ১৭৮১ সালের মালিকের শালী ডরোথিকে বিয়ে করেন এবং ঐ কারখানার মালিক হন। তাঁদের মোট ৭টি সন্তান হয়েছিল। দুটি মেয়ে এবং একটি ছেলে শৈশবে মারা যান। মালিক থমাস বিভিন্ন ভাষা জানতেন। কেরি তাঁর কাছ থেকে হিবরু, ইতালিয়ান ডাচ ও ফরাসি ভাষা শেখেন।

এইভাবে স্বশিক্ষিত হয়ে ওঠার কারণে স্থানীয় মিশনারীদের সঙ্গে পরিচয় হয়। মাঝে মাঝে স্হানীয় গির্জায় ভাষণ দিতেন। সেই সূত্রে ১৭৮৫ সালে স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পান। ১৭৮৯ খৃষ্টাব্দে তিনি চার্চের প্যাস্টর পদে নিযুক্ত হন। ১৭৯২ খৃষ্টাব্দে তিনি পাঁচ খন্ডের একটি বই লেখেন। বইটির নাম -  An enquiry into the obligations of christians to use means for the conversation of the heathens "। 

'কেরি সাহেবের মুন্সী' বইতে সাহিত্যিক প্রমথ নাথ বিশী মহাশয় বলেছেন,  "১৭৯২ সালে টমাস ইংল্যান্ডে ফিরে গেল।... রাম বসু কৃত একটি খৃষ্ট - মহিমা - সংগীত হাতে করে গেল। আর সেই সংগীত,... সেখানকার একটি মিশনারী সম্প্রদায়কে এমন প্রলুব্ধ করে তুললো যে, তারা অচিরে পাদ্রী উইলিয়াম কেরিকে সপরিবারে এদেশে পাঠাবারর সংকল্প করল।... টমাস ও সপরিবারে কেরি ১৭৯৩ সালের ১১ই নভেম্বর তারিখে চাঁদপাল ঘাটে এসে নামল। (প্রথম খন্ড / ১২ পরিচ্ছেদ / পৃঃ ৪২) টমাসের পুরনো মুন্সী রামরাম বসু  কেরির মুন্সীপদে নিযুক্ত হলেন। ধর্মপ্রচারের প্রবল আগ্রহ নিয়ে  কেরি এখানে এসেছেন। কিন্তু এখানে এসে দেখলেন অল্পসংখ্যক মানুষের ইংরেজি জ্ঞান আছে। কেরি পত্নীর আসার ইচ্ছে ছিলনা, কিন্তু বাধ্য হয়ে এখানে এসেছেন। কেরি পত্নী অসুস্থ। তিনি উত্তেজিত হলেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। কেরি তাই পত্নীর সাথে কলহে লিপ্ত হন না। কেরির সাংসারিক জীবন কখনও সুখের ছিল না!
ধর্মযাজক কেরি হিন্দুদের কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে উদ্ধার করতে চেয়েছেন। কেরির মহত্ত্বের উদাহরণ," কেরি সাহেবের মুন্সী" উপন্যাসে পাই--" খাঁচায় বন্দী ইংরেজের ক্রীতদাস ন্যাড়াকে কেরি উদ্ধার করেছেন। কুড়ি টাকা দিয়ে ন্যাড়াকে কিনে, রামরামের হাতে দিয়েছেন। মিসেস কেরি যুগপৎ বিস্ময়ে ক্রোধে বিরক্তিতে তর্জন করতে করতে  বলল- তুমি সত্যি ওটাকে কিনছ নাকি? কেরীর উক্তিতে তার মহানুভবতার পরিচয় প্রকাশিত--
"ডরোথি, ছেলেটাকে কিনছি বলা উচিত নয়, মানুষ সম্বন্ধে কেনাবেচা শব্দ প্রয়োগ করা খ্রীষ্টানোচিত নয়, আমি ওর মুক্তির ব্যবস্থা করছি।"

কেরির শ্যালিকা কেটি তার স্বামী দুবোয়ার নিষ্ঠুরতায়, আত্মহত্যা করেছে। এই আঘাতে অস্থিরমতি মিসেস কেরি অর্ধ-উন্মাদিনী হয়ে গেছেন। কেরির নীলকুঠির দায়িত্ব গ্রহণ ও নতুন উদ্যমে বাংলা ভাষা-চর্চার প্রসঙ্গ ইতিহাস-সমর্থিত : 
   After several fruitless attempts to settle down, carey at least succeeded in obtaining the situation of an assistant in charge of some indigo factories at madnabati....As soon as he could settle down, he applied himself to the study of Bengal. 
মদনাবাটিতে রামরাম বসুর সহায়তায়, কেরি বাইবেলের বঙ্গানুবাদ সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছেন। 

রামরাম যীশু সম্বন্ধে বাংলা ভাষায় আরো গান রচনা করেছেন। পৌত্তলিক হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে পুস্তক লিখে, জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করেছেন। কেরিকে রাম রাম বসু জানিয়েছেন: ' বাংলা সাহিত্যে গদ্য নেই বটে, তবে পদ্যের সমৃদ্ধি কম নয়।'  কেরি বললেন, আপাতত প্রয়োজন আমাদের গদ্যে।...ব্যাকরণ লিখব, অভিধান সঙ্কলন করব, তারপরে এ দুয়ের সাহায্যে মুখের ভাষার উপরে বুনিয়াদ খাড়া করে গদ্যের ইমারত গেঁথে তুলব।....প্রথমে ইংরেজি আর ফারসী থেকে অনুবাদ করে গদ্যের আড় ভাঙতে হবে।  বাংলা গদ্যের ব্যবহার সম্পর্কে কেরি উৎসাহী। 
ন্যাড়ার কাছে লোকমুখের ভাষার শিক্ষা নিয়েছেন। রাম বসুর কাছে ফারসী ও সংস্কৃত শিখেছেন। গ্রাম্যভাষা সম্পর্কে তিনি আগ্রহী। তার ইচ্ছা বাইবেলের তর্জমা করবেন অশিক্ষিত সাধারণের জন্য। কেরি রাম রাম বসু মুন্সিকে বললেন,-" স্থির করেছি ন্যাড়ার কাছে গ্রাম্য শব্দ সংগ্রহ করব, আর তোমার কাছে শিখব বাংলা গদ্য রচনার কৌশল। আর কিয়দ্দূর অগ্রসর হলে লোকমুখের ভাষায় গ্রন্থ রচনা করবো।"কেরি আর্থিক অনটন মেটাতে এক বন্ধুর অনুরোধে  নীলের কারখানার ম্যানেজার হয়ে মেদিনীপুরে যান। সেখানে ছ' বছর ছিলেন।  বাইবেলের অনুবাদ, ভাষা শিক্ষা ও ধর্মপ্রচারে মনোযোগী হওয়ায় কেরির পক্ষে নীলকুঠির দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন সম্ভব হয়নি। কেরি দায়িত্ব নেওয়ার পর, নীলকুঠির আর্থিক পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। কুঠির নায়েব, গোমস্তা, কারকুন, পাইক প্রভৃতি নূতন কাজ পেয়েছে। এখন তারা কেরির বাংলা বিদ্যালয়ের জন্য ছাত্র সংগ্রহ করে বেড়ায়। কেরির হুকুম, "যে বাড়ির ছেলে পড়তে আসবে সে বাড়ির ছ মাসের খাজনা মাপ..। দু টাকা করে জলপানি দেবার লোভ দেখিয়ে আট-দশটি ছাত্র যোগাড় করেছে কেরি। তারা সকালবেলা এসে তিন-চার ঘন্টা পড়ে যায়।"কেরি সাহেবের মুন্সী" তে সাহিত্যিক "প্রমথনাথ বিশী" মহাশয় বলেন, "শিক্ষক রাম বসু, পার্বতী ব্রাহ্মণ।.... সুযোগ পেয়ে নায়েব গোমস্তার দল দু'হাতে চুরি করতে লাগল। কেরি কোনদিন খাতাপত্র তলব করলে ওরা জন-দুই নূতন শিক্ষার্থী এনে হাজির করে। মুহুর্তের খাতাপত্রের প্রসঙ্গ ভুলে কেরি বলে ওঠে - অসীম কৃপা। প্রভুর খাতাপত্র যায় কৃপা-সমুদ্রে তলিয়ে, ছাত্র দুটিও দিন দুই বিদ্যালয়ে দেখা দিয়ে যায় তলিয়ে।"
কেরি বাংলা ভাষার চর্চায় মগ্ন। পাশের কামরায় অর্ধোন্মোদ কেরি-পত্নী আপন মনে একা একা কথা বলে যান। কেরির আরেক পুত্র পিটার হঠাৎ মারা গেছে। কেরি যখন শোকে আচ্ছন্ন, তখন উডনীর চিঠি এসেছে। তিনি কুঠি বন্ধ করে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও কেরি নিজের লক্ষ্যে স্থির। যেন সমস্তই আগের মত নিয়মিত চলছে এইভাবে সকালবেলা সে সংস্কৃত ব্যাকরণ খুলে কেবল বসেছে এমন সময়ে মিসেস কেরি ঘরের মধ্যে উঁকি মেরে বলল, "কাউকে যে দেখছি নে! সব বাঘে নিয়েছে...।"  
কেরির চরিত্রে সংকল্পের দৃঢ়তা ও মানসিক শক্তির পরিচয় পাই। উন্মাদ পত্নীর পরিচর্যা ও কঠিন সংস্কৃত ব্যাকরণের চর্চায়, তার দিনরাত্রি কেটেছে। একের পর এক বিপদ এসেছে। শেষপর্যন্ত কেরির স্ত্রী বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যান।তবু  কেরি নিজের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হন নি। বাংলা গদ্য-রীতি গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষায়, সংস্কৃত ভাষার চর্চায় নিবিষ্ট থেকেছেন। তখন সে সংস্কৃত ব্যাকরণের মডেলে বাংলা ব্যাকরণ ও সংস্কৃত অভিধানের মডেলে বাংলা অভিধান সঙ্কলন শুরু করে দিল। অন্যদিকে চলল বাইবেল তর্জমার কাজ। এদিকে  কলকাতায় দলে দলে মিশনারি এসে ভিড় করছে,তা ঈস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির পছন্দ হয়নি। তারা এ দেশে এসেছে ব্যবসা করতে। ধর্ম প্রচারের নামে তারা কোন হাঙ্গামা চায় না।তাই ধর্মপ্রচারকেরা অনেকে চলে গেলেন শ্রীরামপুর। সেটা তখন ডেনমার্ক সরকারের অধীন। তাই উইলিয়াম কেরি ১৮০০ সালের ১০ই জানুয়ারি শ্রীরামপুরে চলে এলেন। এসেই মুদ্রণযন্ত্র কেনার বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। এখানে কেরির বিচক্ষণতার পরিচয় ফুটে উঠেছে। কেরি একসময় একটি বই রচনা করে ছাপলেন। তার নাম 'ইতিহাসমালা'। বাইবেলের সেন্ট ম্যাথিউ লিখিত সুসমাচারের অনুবাদ যখন চলছে, কেরি সংবাদ পেয়েছেন কলকাতায় একটি ছাপাখানা স্বল্প মূল্যে বিক্রি হচ্ছে।  তিনি ছাপাখানাটি কিনে এনেছেন মদনাবাটিতে।
ধর্মযাজক কেরি তাহার খৃষ্টধর্মপ্রচারের মধ্যে বাঙালীর অন্তরলোকের পরিচয় পেয়ে ও তাদের মুখে নূতন ভাষা আরোপ করে জীবনবোধকে এক নূতন মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করলেন। "কেরি সাহেবের মুন্সী"  উপন্যাসের সূচনায় সাহিত্যিক  প্রমথনাথ বিশী মহাশয় কেরীকে 'মহাপ্রাণ' হিসাবে চিহ্নিত করে বলেছেন,"' কেরীর ধর্মজীবন, ধর্মপ্রচারে আগ্রহ, বাংলা গদ্য সৃষ্টিতে নিষ্ঠা ও অধ্যাবসায় অভিভূত করে দিল আমাকে।'
বিদ্যাসাগর তখনও জন্মাননি।রামমোহন সবে মাত্র। বাংলা ভাষা শিখে গদ্য রচনা করলেন এক ইউরোপীয় মিশনারী 'উইলিয়াম কেরি'। তিনি বাংলা গদ্যের জনক।
------

Post a Comment

0 Comments