জ্বলদর্চি

হিমালয়ের পথে চলতে চলতে || পর্ব - ৪


হিমালয়ের পথে চলতে চলতে || পর্ব - ৪

দে ব ব্র ত  ভ ট্টা চা র্য্য
            
কেদারনাথ দর্শন 
 
 গৌরীকুণ্ডে প্রভাত আসন্ন। মোবাইলের যান্ত্রিক ঘণ্টাধ্বনি জানিয়ে দিল -
প্রস্তুত হও। বাবার চরণ বন্দনার সময় সমাগত। 
  উঠে পড়লাম। দ্রুত তৈরী হতে হবে। এত ঠাণ্ডায় তো স্নান সম্ভব নয়। বাথরুমে গিজার্ড আছে দেখেছিলাম। কিন্তু আজ ভোরে তার কোন ভূমিকা নেই। এখন গৌরীকুণ্ডে লোডশেডিং। দেবভূমির পাদদেশেও সভ্য ভারতবর্ষ থাবা বসিয়েছে। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে মোবাইলের আলোতে কোনক্রমে তৈরী হলাম। সাইড ব্যাগে টুকটাক প্রয়োজনীয় সামগ্রী ভরে কাঁধে ঝুলিয়ে নিলাম। বাইরে দেখলাম বৃষ্টি পড়ছে। জোরে নয়। এখানে জোরে বৃষ্টি খুব একটা হয় না। তবে এ বৃষ্টি ভিজিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। পাহাড়ী পথে এমন বৃষ্টি চলতেই থাকবে। হরিদ্বারে বাস স্ট্যান্ডে কেনা পনের টাকার রেন কোট বের করতে হ'ল। খুব দামী তো! সাবধানে পরার পর দেখা গেল বগলের কাছে অনেকটা সেলাই নেই। 
   দরজায় তালা লাগিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। সারা পৃথিবী এখন প্রভাতের সাধনায় মগ্ন। লোডশেডিং এর গৌরীকুণ্ড অন্ধকারে ডুবে। দেখলাম, সুধীরবাবু লাঠি হাতে আগে ভাগেই হাজির। সাথে আর একজন, রোগা লম্বা মতন ভদ্রলোক। বুঝলাম, ইনিই শালাবাবু। কিন্তু অন্য পুণ্যার্থীরা কোথায় গেলেন? ভবেশদা চুপি চুপি খবরটা দিলেন - বাকী পাঁচজন এখনও লেপের তলায়। 
  সুধীরবাবু আমাদের এগোতে বললেন। ওঁরা আর একবার চেষ্টা করতে চান, অন্যদের পথে নামানো যায় কিনা! 
  অন্ধকার এখনও তার চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছে পৃথিবীকে। সে দেওয়ালকে প্রায় ঠেলতে ঠেলতে রাস্তায় নেমে এলাম। একটু এগোতেই বুঝলাম -আমরা দুজন নই। আগে পেছনে অনেকগুলি লাঠির সম্মিলিত ধ্বনি সমান তালে এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ কেউ উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠলেন 
 -বাবা কেদারনাথ জী কী -
 আর সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য কণ্ঠের গর্জন কানে এলো 
  -জয় ----!!
  দু পাশের পাষাণ প্রাচীরে বাধা পেয়ে সে ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এলো। তীর্থপথ অগণিত ভক্তের বিগলিত হৃদয়ের প্রেমধারায় সিক্ত। লাঠির ঠুক্ ঠুক্ শব্দ। ঢালু পথ ধীরে ধীরে উপরে উঠে গেছে। দু চার পা এগোলে একটি করে ধাপ। মাঝে মাঝে হাঁক কানে আসছে -
  -সামালকে! সামালকে! 
 চারজন ডান্ডিওয়ালা একজন মানুষকে গদি আঁটা আরাম চেয়ারে বসিয়ে নিয়ে চলেছে বাবার চরণ দর্শনে। মজার ব্যাপার, এই ডান্ডিওয়ালাদের একটা বড় অংশ মুসলমান সম্প্রদায়ের। এরা প্রতিদিন তীর্থযাত্রীদের এই পথে বয়ে নিয়ে চলে। ঈশ্বর আর আল্লাহ এখানে মিলে মিশে একাকার। আসলে শব্দ দুটোই কেবল ভিন্ন। করুণা দুজনেরই সমান। ধীরে ধীরে প্রভাত জাগছে। আমাদের চারপাশে ঘিরে থাকা প্রকৃতি, মানুষজন দৃশ্যমান হচ্ছে। ডানে প্রবাহমান মন্দাকিনী। গভীর খাদের অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে চলেছে। আর বামপাশে পথের গা ঘেঁষে পাহাড়টা যেন হুমড়ি খেয়ে পড়তে চাইছে। মাথার ওপর রিমঝিম বৃষ্টির ওড়না আর পায়ের নিচে পেছল পাথরের পথ। সঙ্গে চলেছে হাজারো পায়ের শব্দ। মাঝে মাঝেই ধ্বনি জাগছে -
  -বাবা কেদারনাথ জী কী --
  মিলিত কণ্ঠে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে -
  -জয় -----!!
  দেখলাম পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অনেক ঘোড়া বাঁধা আছে। যাত্রীরা এখান থেকেই ঘোড়া সংগ্রহ করেন। সরকারী রেট অনুযায়ী ঘোড়া পিছু তেইশ শ' টাকা। কেবল ওঠার জন্য। সরকারী কর্মচারীরা টাকা জমা নিয়ে একটি ফিতে লাগানো কার্ড গলায় ঝুলিয়ে দেন। খবর পেলাম, এখানে ঘোড়ার চেয়ে খচ্চরের সংখ্যা বেশী। কারণ পাহাড়ী রাস্তায় নড়বড়ে পাথরের উপর হাঁটতে খচ্চরের উপযোগিতা অনেক বেশী। 
  আমরা এগিয়ে চললাম। কন্ কনে ঠাণ্ডা। তার সাথে বৃষ্টির যুগলবন্দী। লাঠিই ভরসা। মাঝে মাঝেই পেছন থেকে ঘোড়ার খুরের শব্দ আর সহিসের হাঁক -
  -সামালকে! জরা হটকে! 
  চোখে পড়ছে পাহাড়ের থেকে বেরিয়ে আসা পাথরে সাদা রঙের বৃত্ত আঁকা, মাঝে একটা লাল বৃত্ত। পরে জেনেছি, এ স্থানগুলি ধসপ্রবণ এলাকা। যে কোনও সময় ওপর থেকে পাথর গড়িয়ে আসতে পারে। সুতরাং সাবধান! হঠাৎ হঠাৎ পাহাড়ের খাঁজ থেকে ছোট ছোট ঝর্ণা লাফিয়ে নেমে আসছে পথের ওপর। আর একই গতিতে ডান পাশের খাদে কাঠবিড়ালীর মত ঝাঁপ দিচ্ছে। 
  মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে লম্বা শ্বাস নিচ্ছি। দেখছি, ভবেশদা আমার চেয়ে যথেষ্ট শক্ত পোক্ত। তিনি এগিয়ে চলেছেন আর আমি অনেকটা পিছিয়ে পড়ছি। উচ্চতা যত বাড়ছে পরিশ্রমের অনুভূতি ততই চেপে বসছে। দাঁড়িয়ে একটু বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। ঘোড়াগুলো খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ওদের গলায় বাঁধা ঘণ্টাধ্বনি পদাতিক যাত্রীদের আগাম সাবধান করে দেয়। তবে ভুলেও ডান প্রান্তে যাওয়া চলবে না। নদী খাদের মধ্যে গিয়ে পড়লে এক মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যেতে হবে। সব সময় পাশ দেওয়া বা বিশ্রাম নেওয়ার জন্য পাহাড়ের খাঁজে আশ্রয় নিতে হয়। 
  হঠাৎ চোখে পড়ল --নদীর প্রায় বুকের উপর একটি কংক্রিটের চাতাল। অনেকটা জায়গা জুড়ে মসৃন চাতালের মাঝ বরাবর খুব বড় করে" H" অক্ষরটি লেখা। তাকে কেন্দ্র করে আরও বড় লাল রঙের বৃত্ত। চাতালের উপর উঠে এলাম। একটু বিশ্রামও প্রয়োজন ছিল। তা ছাড়া চারিদিকের অপরূপ প্রকৃতি যেন আলোর অলঙ্কারে সেজে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি পড়া আপাতত বন্ধ। দুজনের একটা ছবি তুলবো, কাউকে পাচ্ছি না। এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। দেখলাম, দূর থেকে  একজন যাত্রী হাত নাড়তে নাড়তে এগিয়ে আসছেন -
  -কি ব্যাপার? বেশী এগোতে পারেননি দেখছি। 
  সুধীর বাবু! লাঠি হাতে এগিয়ে এলেন। শালাবাবু পেছনে। বুঝলাম, বাকিদের বোধহয় রাজি করতে পারেননি। চারজনে একটু সময় কাটালাম। ওঁনারা আমাদের এবং আমরা ওঁদের ছবি তুলে দিলাম। এই চাতালটি প্রকৃতপক্ষে অস্থায়ী হ্যালিপ্যাড। কোনো দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় উদ্ধারক্রিয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়। উত্তরাখণ্ড সরকার দেবভূমির দেখাশুনোর জন্য সদাজাগ্রত। প্রচুর মানুষকে দেখছি,পথের রক্ষনাবেক্ষণে প্রাণপাত পরিশ্রম করে চলেছেন। পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া পাথর, ঘোড়া খচ্চরের মুত্র-বিষ্ঠা দ্রুত সরিয়ে নিচ্ছে। বুঝলাম, এরা আমাদের বঙ্গ দেশীয়দের মত এতটা বুদ্ধিমান নয়। তাই কাজ করাটা এরা কর্তব্য বলে মনে করে। 
  আমরা আবার পথে ফিরে এলাম। নতুন উৎসাহে চারজনে হাঁটা শুরু করলাম। তবে কিছুটা সময় পরেই বুঝতে পারলাম, সুধীরবাবুদের সঙ্গ দেওয়া আমাদের কম্ম নয়। বয়সের অনেকটা পার্থক্য, পারবো কেন? অতএব হাত নেড়ে ওঁদের বিদায় জানালাম -
 -এগিয়ে যান। ফির মিলেঙ্গে। বাবার চরণে আবার মিলবো আমরা। 
 না, ওঁদের সাথে আর দেখা হয়নি আমাদের। নিশ্চয় ওঁদের যাত্রা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়েছে। আর বাকি পাঁচজন ও সে পুণ্যের ভাগ পেয়ে কৃতার্থ হয়েছেন। 
-------
   




                  

Post a Comment

0 Comments