জ্বলদর্চি

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে / সন্দীপ কাঞ্জিলাল


"মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কিন্তু কখনো পরাজিত হয় না"

 আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (২১/০৭/১৮৯৯ - ০২/০৭/১৯৬১)


স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ১৮৯৯ সালের ২১ শে জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের শিকাগো শহরের অন্তর্গত ওক পার্কে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম ক্লেরেন্স এডমন্ড হেমিংওয়ে পেশায় চিকিৎসক আর মা গ্রেস হল হেমিংওয়ে একজন সঙ্গীতজ্ঞ। হেমিংওয়ের নামকরণ করা হয় তাঁর মাতামহের নামে। যদিও হেমিংওয়ে এই নাম পছন্দ করতেন না। কারণ 'অস্কার ওয়াইল্ডের' নাটক " দি ইমপোর্টেন্স অব বিয়িং আর্নেস্ট" এ 'আর্নেস্ট' চরিত্রটি সাদাসিধা বোকা ছিল। 
বিংশ শতাব্দীর ইংরেজি কথাসাহিত্যে একটি ব্যতিক্রমী নাম আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। তাঁর জীবনের নানারকম ভূমিকা পরবর্তী প্রজন্মের উপর ভীষণ প্রভাব ফেলেছিল। তার সাড়া জাগানো উপন্যাস "দি ওল্ডম্যান এন্ড দি সি" র সেই বিখ্যাত উক্তি - " Man is not made for defeat.... A man can lie destroyed but not defeated ".
হেমিংওয়ের সব লেখালেখির মূল চালিকাশক্তি ছিল প্রেম, যুদ্ধ, বন্যতা এবং হারানোর দীর্ঘশ্বাস। প্রথম জীবনে মায়ের জেদাজেদিতে চেলো বাজানো শিখতে শুরু করেন। তাঁর মা প্রায়শই গ্রামে গ্রামে কনসার্ট দল নিয়ে যেতেন। এই নিয়ে পরবর্তী কালে মায়ের সঙ্গে বিরোধ হয় এবং তিনি পরবর্তী কালে বলেন, তিনি তার মাকে ঘৃণা করেন।যদিও পরে তিনি স্বীকার করেন তাঁর এই গান শেখার জন্য" ফর হুম দ্য বেল টোলস " বইটি লেখা সহজসাধ্য হয়েছিল। 
স্কুলে লেখাপড়া শেষ করে তিনি কয়েকমাস 'দি কানসাস সিটি স্টার' পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজ করেন। তারপর রেডক্রসের আ্যম্বুলেন্সের ড্রাইভার হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইটালি ফ্রন্টে যোগদান করেন (১৮১৮)। এখানে তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং ফিরে আসেন বাড়িতে। তার ফলে তিনি মিলানের রেডক্রসের হাসপাতালে ছয় মাস শয্যাশায়ী ছিলেন। 
প্যারিসে থাকাকালীন তিনি 'পাবলো পিকাসো' 'জোয়ান মিরো' প্রভৃতি চিত্রশিল্পীদের সাথে পরিচিত হন। ১৯২২ সালে সিলভিয়া বিচের বই দোকানে মার্কিন কবি 'এজরা পাউন্ডের' সাথে হেমিংওয়ের দেখা হয়। তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। এজরা পাউন্ড হেমিংওয়ের লেখায় আকৃষ্ট হন। তিনি হেমিংওয়েকে নানাভাবে সাহায্য করেন। প্যারিসে অবস্থান কালে হেমিংওয়ে টরন্টো স্টার পত্রিকার জন্য ৮৮ টি গল্প রচনা করেন।
এক বিস্ময়কর জীবনযাপন হেমিংওয়ের। তার স্ত্রী ছিলেন চারজন, যাঁরা তাঁর জীবনের একেক সময়ে প্রবেশ করেছেন এলিজাবেথ রিচার্ডসন (১৯২১-২৭), পলিন ফেইফার (১৯২৭-৪০), মার্থা গেলহর্ন(১৯৪০-৪৫) এবং তার মৃত্যু পর্যন্ত মেরি ওয়েলস (১৯৬১-৬৪)। তিন সন্তান জ্যাক, প্যাট্রিক এবং গ্রেগরি, বেঁচে আছেন শুধু প্যাট্রিক,  যিনি 'দি মুভেবল ফিস্ট' এর নবতর সংস্করণে ভূমিকা লিখেছেন।  এলিজাবেথ এবং পলিন ছিলেন দুই বান্ধবী, হেমিংওয়ে এলিজাবেথকে ত্যাগ করে বিয়ে করেন স্ত্রীর বান্ধবী পলিনকে, যেই পলিন কী-ওয়েস্টে রেখে যাওয়া হেমিংওয়ের বাড়ির ক্রেতা এবং এই বাড়িতে থাকার পুরোটা সময় হেমিংওয়ের সঙ্গেই ছিলেন। 
১৯৯৩ সালে হেমিংওয়ে সপরিবারে পূর্ব আফ্রিকায় যান। এখানে তিনি দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। তিনি আ্যমিবা  ঘটিত আমাশয় রোগে ভোগেন যার কারণে তাঁর আন্ত্রিক স্থানচ্যুতি ঘটে এবং বিমানে করে নাইরোবির হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ১৯৫৮ সালে পরপর দুটি বিমান দুর্ঘটনায় পড়েন। দ্বিতীয়টিতে এতটা আঘাতপ্রাপ্ত হন যে, তিনি মারা গেছেন বলে খবর রটে যায়। তারপর থেকে নানারকম শারিরীক সমস্যায় জড়িয়ে পড়েন। এই সময় একের পর এক সাহিত্যিক বন্ধুগণ মারা যেতে থাকলে হেমিংওয়ে হতোদ্যম হয়ে পড়েন। এরপর তিনি মদ্যপান বাড়িয়ে দেন। যা তাঁকে মৃত্যুর দিকে ত্বরান্বিত করে। 
তার উল্লেখযোগ্য রচনাবলীর মধ্যে দ্য ওল্ডম্যান আ্যন্ড দ্য সি (১৯৫২), দ্য টরেন্টস অব স্প্রিং (১৯২৬), আ্যক্রস দ্য রিভার আ্যন্ড ইনটু দ্য ট্রিজ(১৯৫০), ফর হুম দ্য বেল টোলস (১৯৪০), টু হ্যাভ আ্যন্ড হ্যাভ নট(১৯৩৭)।
এর ভেতরেই ১৯৫১ সালে মাত্র আট সপ্তাহে তিনি লেখেন তার ক্লাসিক উপন্যাস 'দি ওল্ড ম্যান আ্যন্ড দি সি'।  এটি লেখা শেষ করে তিনি বন্ধুদের বলেছিলেন, 'এটি আমার সারাজীবনের শ্রেষ্ঠতম লেখা'। এই উপন্যাসের কাহিনী উপসাগরীয় স্রোতে বিশাল এক মারলিন মাছের সাথে সান্তিয়াগোর এক বৃদ্ধ জেলের সংগ্রামের কাহিনী। 'দ্য ওল্ডম্যান আ্যন্ড দ্য সি' উপন্যাসের জন্য তিনি পেয়েছেন পুলিৎজার (১৯৫২) ও সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ১৯৫৪ সালে। ১৯৪৭ সালে আরেকটি পুরস্কার লাভ করেছিলেন, 'ব্রোঞ্জ স্টার মেডাল' তবে এটি দেওয়া হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর বীরত্বের জন্য। এর মধ্যে তাঁর বই বিক্রি হয়েছে লাখ লাখ কপি। বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যাও তাঁকে কাবু করে ফেলেছিল। একদা বুল ফাইট, শিকার এবং সমুদ্রে মাছধরা শক্তপোক্ত শরীর আর নিজের বশে ছিল না তাঁর। গাড়ি দুর্ঘটনায় ভাঙা হাঁটু, পরপর দুটো বিমান দুর্ঘটনার প্রচণ্ড অভিঘাতে চিড়ধরা মাথার খুলি, বিযুক্ত হওয়া কাঁধের জোড়, আগুনে পোড়া শরীর, ক্ষতিগ্রস্ত যকৃৎ এবং কিডনি এত সব মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক জখমের সাথে যুক্ত হয়েছিল তাঁর ইনসমনিয়া, উচ্চ রক্তচাপ, বিপজ্জনক মাদকাসক্তি ও বিষাদরোগ। 
'দ্য ওল্ডম্যান আ্যন্ড দ্য সি' অনেকে বলেছেন বুড়ো সান্তিয়াগো এই গল্পের নায়ক। অনেকে বলেছেন সমুদ্রই এই গল্পের নায়ক। এই সমুদ্র সম্ভবত সকল প্রাণীর শিক্ষক। বুড়ো সান্তিয়াগো তার ছাত্র। সে সমুদ্রকে বলে দয়ালু। ছোকরা-জেলে, যারা মোটর-বোট আর বয়া নিয়ে হাঙর ধরে, বাজারে হাঙর মাছের তেল বেচে দু'পয়সা কামায় তাদের ধারণা সমুদ্রটা পুরুষ। ওরা সমুদ্রকে বলে প্রতিদ্বন্দ্বী নয়তো শত্রু। কিন্তু বুড়ো মানুষেরা সমুদ্রকে নারীর সঙ্গেই তুলনা দেয়। সমুদ্র থেকে পায় সোহাগ আর সাহায্য। সমুদ্র আসলে কি। কি তার চরিত্র। সে নারী নাকি পুরুষ তা নিয়ে অনেকেই অনেকভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পাবলো নেরুদা তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন সমুদ্র তার কাছে ভরযৌবনা নারীর মতো। কারণ সমুদ্রে নেমে তিনি প্রথম যৌনতা অনুভব করেছিলেন। ঢেউ ধীরে ধীরে তাঁর যৌনাঙ্গ নিয়ে নাড়াচাড়া করে তাঁকে উত্তেজিত করেছিল। এই উপন্যাসের সিংহভাগ জুড়ে সমুদ্র। উপন্যাসে সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া বুড়ো সান্তিয়াগোর সংগ্রাম কাহিনীর সাথে সাথে সমুদ্রের সূক্ষ্ম বর্ণনা পাঠককে আকৃষ্ট করে দারুণভাবে। সান্তিয়াগো সমুদ্রের এক বিরাট মাছকে হত্যা করে। দিনের পর দিন তাঁকে বড়শি বিঁধিয়ে রাখে। এক ভয়াবহ যন্ত্রণা পেয়েছে মাছটি। প্রথমে মাছটি যখন সহজে ধরা দেয়নি, তখন বুড়ো হুংকার ছেড়ে বলে, "যতই বড়ো হোক, ওটাকে আমি মারবই। ওর বিরাটত্ব আর বড়াই আমি শেষ করবই।....ওকে আমি দেখাবো মানুষ কি করতে পারে আর মানুষের লেগে থাকার শক্তি কত ভয়ংকর।" মাছটি নৌকায় বেঁধে আনার সময় সমুদ্রের হাঙরগুলো উঠে আসতে থাকে। আর একটি হাঙর মৃত মাছটির গায়ে কামড় দিয়ে অনেকখানি খুবলে নেয়। এরপর বুড়ো আর মাছটির দিকে তাকায় না। ভাবতেই পারে না মাছটির অঙ্গহানি হয়েছে। তবে মাছটিকে কেউ খাচ্ছে তার জন্য যে খারাপ লাগছে তা নয়, তার খারাপ লাগছে এই জন্য যে, এতে সে দাম কম পাবে।
উপন্যাসে লেখক দেখিয়েছেন, যে মানুষ সম্প্রদায় মনে করে তারা বাদে দুনিয়ার বাকীসব জীবজন্তু উদ্ভিদ সবই মানুষের ভোগ্য। এবং মানুষই হচ্ছে প্রাণিজগতের রাজা, এই বুড়ো তাদেরই প্রতিনিধি।  
বহু অসফল প্রেমের প্রধান পুরুষ, চারবার দারপরিগ্রহকারী হেমিংওয়ের অসুস্থতা একসময় মনোবিকলনে পরিণত হয়, মেজাজ হয়ে পড়ে নিয়ন্ত্রণহীন। পত্রিকায় খবর হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাঁকে ছদ্মনামে ক্লিনিকে ভর্তি করতে হয়েছিল। ১৯৬১ সালের এপ্রিল মাসে তিনি একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। একই মাসে তাঁর দ্বিতীয় আত্মহনন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তাঁকে যখন আবার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তিনি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন। ২৬ জুন তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। অবশেষে ১৯৬১ সালের ২ জুলাই তাঁর আত্মহত্যার চতুর্থ চেষ্টা সফল হয়। নিজের প্রিয় শটগান দিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। আবার কেউ কেউ বলেন এফবিআই তাঁর বিরুদ্ধে সর্বক্ষণ নজরদারি চালাতো। হেমিংওয়ে কিউবায় থাকাকালীন তাঁর বাম মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।এফবিআই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে। ১৯৫০ সাল থেকে হেমিংওয়েকে চোখে চোখে রাখার জন্য এফবিআই একজন এজেন্ট নিয়োগ করে। এটাও তাঁর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। হেমিংওয়ে পর্যন্ত তিনি ছিলেন তাঁর পরিবারের চতুর্থতম আত্মহত্যার শিকার। 
হেমিংওয়েের সাথে জড়িত তিনটি বাড়ি মার্কিন সরকার ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে ঘোষণা করেছে। সেগুলো হলো,মিশিগানের ওয়ালুন লেকের আর্নেস্ট হেমিংওয়ে কুটির, কি ওয়েস্ট আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বাড়ি এবং কেচামে আর্নেস্ট ও ম্যারি হেমিংওয়ের বাড়ি। ইলিনয় ওক পার্কে  তার শৈশবের বাড়িটি হেমিংওয়ের স্মৃতিতে জাদুঘর ও সংরক্ষণাগার।২০১২ সালে শিকাগো লিটারেরি হল অব ফ্রেমে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাঁর নামাঙ্কিত অনেক পুরষ্কার সাহিত্যের বিষয়ে আছে, যেমন হেমিংওয়ে ফাউন্ডেশন /পেন পুরষ্কার, হেমিংওয়ে পুরষ্কার ইত্যাদি।  হেমিংওয়ে মারা গেছেন, কিন্তু কখনো  পরাজিত হননি। 

--------

Post a Comment

1 Comments