জ্বলদর্চি

উপন্যাসের আয়নায় -২


উপন্যাসের আয়নায়-২

প্র শা ন্ত  ভৌ মি ক

হুমায়ূন আহমেদ : হিমুর যুক্তিহীন জগৎ 


হুমায়ূন আহমেদ এক জীবনে লিখেছেন দুই শতাধিক উপন্যাস৷ তার মধ্যে তরুণ প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন হিমু সিরিজের উপন্যাসগুলো লিখে৷ হিমু বিষয়ক সর্বমোট ২১টি উপন্যাস লিখেছেন তিনি।
হিমু চরিত্রকে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে পাই-
*হিমু কে?
** হিমু একজন তরুণ। এক কথায় ভ্যাগাবন্ড।
* হিমুর ভাল নাম কী?
** হিমালয়। 
* হিমুর পেশা কী?
** হিমুর কোন পেশা নেই, বেকার। তবে কোন কোন কাহিনিতে হিমুকে নানা রকম কাজ করতে দেখা যায়। সাধারণত হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরাটাই তার কাজ৷ 
* হিমু কি মহাপুরুষ শ্রেণির কেউ?
** না। মাঝে মাঝে সুপার ন্যাচারাল পাওয়ারের ঝলকানি দেখা যায় বটে। কিন্তু বিভিন্ন উপন্যাসে হিমু নিজেই স্বীকার করেছে- সে অতি সাধারণ মানুষ৷ তবে কখনো কখনো মনে হতেই পারে যে হিমুর আশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে। 
*হিমুর আত্মীয় স্বজন কে কে আছে? 
**নিকট আত্মীয় বলতে কেউ নেই। তবে মাজেদা খালা কিংবা মাজেদা ফুফু আছেন। আর আছে প্রেমিকা রূপা।

হিমুকে নিয়ে প্রথম বই 'ময়ূরাক্ষী' যখন লিখলেন হুমায়ূন, ভাবতেও পারেননি সিরিজটি এতটা জনপ্রিয় হবে, কিংবা এই সিরিজে এত বই লিখবেন। 'হিমু সমগ্র-১ম খণ্ড'-এর ভূমিকাতে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন-
"হিমুকে নিয়ে কতগুলি বই লিখেছি, নিজেও জানি না। মন মেজাজ খারাপ থাকলেই হিমু লিখতে বসি। মন ঠিক হয়ে যায়। বেশি লেখার ফল সব সময় শুভ হয় না৷ আমার ক্ষেত্রেও হয়নি। অনেক জায়গাতেই ল্যাজে গোবরে করে ফেলেছি। হিমুর পাঞ্জাবির পকেট থাকে না, অথচ একটা বই-এ লিখেছি সে পকেট থেকে টাকা বের করল। হিমুর মাজেদা খালা এক বই-এ হয়ে গেল মাজেদা ফুফু৷ তবে হিমু যে ঠিক আছে, তাতেই আমি খুশি। হিমু ঠিক আছে, হিমুর জগৎ ঠিক আছে৷ তার বয়স বাড়ছে না, সে বদলাচ্ছে না।"
হিমু কি হুমায়ূন আহমেদ নিজেই ছিলেন? পাঠকের প্রশ্ন ছিল সেটা। 'হিমু' বইয়ের ভূমিকাতে এই প্রশ্নের উত্তর পাই। লেখক বলেছেন- 
"হিমু আমার প্রিয় চরিত্রের একটি। যখন হিমুকে নিয়ে কিছু লিখি- নিজেকে হিমু মনে হয়, একধরনের ঘোর অনুভব করি৷ কেন এরকম হয়? মানুষ হিসেবে আমি যুক্তিবাদী। হিমুর যুক্তিহীন, রহস্যময় জগৎ কেন রকজন যুক্তিবাদীকে আকর্ষণ করবে? আমার জানা নেই।"

যখন লিখেই দিলেন তিনি হিমু নন। তখন দ্বিতীয় প্রশ্ন দাড়াল, হিমু কে? তাকে কি লেখক চেনেন?
লেখক জানালেন- "হিমুর প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক। এদের কারো সঙ্গেই আমার কখনো দেখা হয়নি।"
তবে এক জায়গায় জানিয়েছিলেন লেখকের পিতা শহিদ ফয়জুর রহমানের সঙ্গে হিমুর কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়৷ 
হিমুকে নিয়ে নানারকম মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে হুমায়ূনের। 'দরজার ওপাশে' বইয়ে হিমুর পিশাচ শ্রেণির এক মামা সরাসরি বিচারকদের বিরুদ্ধে একটা সংলাপ বলেন। সে কারণে হুমায়ূনের বিরুদ্ধে মামলা করেন জনৈক জজ সাহেব৷ সে মামলা অবশ্য শেষ অব্দি নিষ্পত্তি হয়নি। 

কোলকাতাতেও হিমুর জনপ্রিয়তা রয়েছে। একাধিক হিমু গ্রন্থের প্রকাশক 'প্রতিভাস'-এর কর্ণধার বীজেশ সাহা জানান- "এখানে প্রচুর চাহিদা হিমুর।" 
লেখকও 'চলে যায় বসন্তের দিন' বইয়ের ভূমিকায় জানিয়েছেন-
"দু'বছর আগে আমি কোলকাতা বইমেলায় গিয়েছিলাম।  বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে মাত্র ঢুকেছি,  হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক ছেলে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বলল- 'দাদা, আমি হিমু। দেখুন আমার পাঞ্জাবি- হলুদ।' আমি বললাম- 'হিমুরা তো খালি পায়ে হাঁটাহাটি করে। দেখি তোমার পা।' সে সবগুলি দাঁত বের করর তার খালি পা দেখাল।"

এছাড়াও ভক্তরা নানারকম চিঠি পাঠাত হুমায়ূনকে। একটি চিঠি আর তার উত্তরে লেখক কী বলেছিলেন সেটা দেখা যাক। চিঠিটা ছিল-
"স্যার, হিমু হইবার নিয়মাবলি দয়া করিয়া জানাইবেন। আমি একটি সিল্কের পাঞ্জাবি খরিদ করিয়াছি। আমার এক বন্ধু বলিয়াছে হিমুদের পাঞ্জাবি সুতি হইতে হইবে। এই বিষয়ে আপনার মূল্যবান মতামত জানাইয়া বাধিত করবেন।"
হুমায়ূন আহমেদ উত্তরে বলেছিলেন- "ভিক্ষা চাই না, হলুদ চিতাবাঘ সামলা।"

১৯৯০ থেকে ২০১২৷ 'ময়ূরাক্ষী'তে শুরু, 'হিমু এবং হার্ভার্ড Ph.D বল্টু ভাই' দিয়ে শেষ। কিন্তু হুমায়ূনের সাথে কি হিমুরও জীবনাবসান?
চমক হাসানের গানে-
"রূপা একা জানালায়
এখনো জানে না সে হায়-
হিমু আর কোনদিন
কোনদিন আসবে না......."

Post a Comment

0 Comments