জ্বলদর্চি

সিরাজ ও আলকাপ


সিরাজ ও আলকাপ

 অ ত সী  ন ন্দ  গাে স্বা মী

ছোকরাকে  মেয়েদের মতাে কেশ রাখতে হবে। গায়ে সারাক্ষণ পরানাে কবে ফ্রক। হাতে চাঁদির চুড়ি। তাকে ভুলে থাকতে হবে সে পুরুষ। মেয়েদের মতাে চলতে বলতে হবে। মেয়েদের লক্ষ্য করে ভঙ্গিগুলো শিখতে হবে। (আসরে তাে তাকে শাড়ি-ব্লাউস পরানাে হবেই। কিন্তু এভাবে থাকতে থাকতে খুব শিগগির সে বদলে যায় চেহারা ও মানসিকতায়। আলকাপের ওস্তাদ বলেন, এ যেন কাঠ-খড়-মাটি দিয়ে প্রতিমা গড়ে রঙ মাখিয়ে চোখ এঁকে সাজ পরিয়ে পুজো। মনের ভেতর আছে এক মােহিনী নটী। তাকে পুরুষের শরীরে রূপ দিই। মাটি নরম না হলে যেমন প্রতিমা গড়া যায় না, তেমনি যে বয়সে দেহ কোমল থাকে, সেই বয়স না হলে চলে না। প্রতিমা বিসর্জন দিতে হয়। আমার এই পুতুলটার বেলাও তাই। 'নামুতে বারাে ওপরে বিশ'। তারপর বিসর্জন। কারণ আর ধরে রাখা যায় না ভেতরের পুরুষকে। সে ঠেলে বেরিয়ে আসে। গলা কর্কশ হয়ে যায়। কোমলতা নষ্ট হয়। তখন কেশ কাটো। চাদির চুড়ি খােলাে। খড়-কাঠ-বাঁশের ঠাট বেরিয়ে পড়েছে। মায়ার খেলা শেষ।"

বর্ণনা কৌশলই পাঠককে অবধারিত মায়ার জগতে পৌঁছে দেবে। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। নামই যথেষ্ট। বাড়তি কোনাে পরিচয় দেওয়া বাতুলতামাত্র। জীবনের শৈশব মুর্শিদাবাদের খোশবাসপুর গ্রামে। তখনই তার পরিচয় 'আলকাপ' এই লােকানাটকের সঙ্গে। পরবর্তীসময়ে নিজেই একজন আলকাপ শিল্পী হয়ে উঠলেন। শুধু তাই নয়, রাতের পর রাত এগ্রাম থেকে ওগ্রাম, এই অঞ্চল থেকে ওই অঞ্চল, এমনকি মাসের পর মাস এই দলের সঙ্গেই কাটিয়েছেন। নিজেই বলেছেন --"১৯৫০ থেকে ১৯৫৬ সালের শরতকাল অব্দি আলকাপ দলে ছিলাম। খুব কম করে ধরেই বলছি, প্রায় ষাট হাজার ঘন্টা কেটে গেছে আলকাপ জগতে। পঁচিশ বছর পরেও স্বপ্ন হয়ে সেই ষাট হাজার ঘন্টা সময় অবচেতনা থেকে মাথা তােলে মাঝে মাঝে। বিপন্ন বােধ করি।"-- এবার পাঠকের কাছে পরিষ্কার আলকাপের সঙ্গে তাঁর কী নিবিড় সম্পর্ক-- সে বিষয়ে। আলকাপের কোনাে প্রসঙ্গ নিয়ে তার সঙ্গে বসলেই সমৃদ্ধ হওয়া যেত। এই মানুষটির সঙ্গে আমার আলাপ ঠিক এমনি ভাবেই। ২০১১ সালের বইমেলায় আমার 'আলকাপ' নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। তার ঠিক কয়েকদিন বাদে রাত্রি ১০.৩০টা নাগাদ এক ভদ্রলােক ফোনে জানান তিনি 'আলকাপ' বই এর লেখিকার সঙ্গে একটু কথা বলতে চান। পরে উনি নাম বলেন। আমি তাে অবাক! এও সম্ভব! এই বয়সে 'দেশ' পত্রিকায় বই এর বিজ্ঞাপন দেখে, প্রকাশকের কাছ থেকে বইটি সংগ্রহ করে, পড়ে, ফোন নম্বর জোগাড় করে তিনি কথা বলতে চাইছেন! এ আমার পরম প্রাপ্তি। সঙ্গে অসাধারণ এক শিক্ষা অর্জন করা। তারপর বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ। আমৃত্যু তিনি সমানভাবেই আলকাপের এক গুণমুগ্ধ বিদগ্ধ ব্যক্তি। আলকাপ' এই লােকনাটকের form নিয়ে তার অনেককালের গবেষণা। সেখানে তিনি পাশ্চাত্যের নাটকের form-এর সঙ্গে কোথাও কোথাও মিলের কথাও বলেছেন। তাঁর মতে আলকাপ দর্শকদের নাটক। আলকাপের শিল্পীরা সমাজজীবনের ভেতর থেকে, বীজ সংগ্রহ করে দর্শকের মধ্যে তার প্রাণ সঞ্চার করেছেন। তার মনে হয়েছে থার্ড থিয়েটারের যে form তা তাে আসলে আলকাপেরই নাট্যরীতি। এই প্রসঙ্গে বলেছেন--
"গ্রামের গাজনে নবান্নে পালাপার্বণে পুরুষানুক্রমে যে খুচরাে নাটক বা তাৎক্ষণিক নাটক অভিনীত হয়ে এসেছে, যার বিষয়বস্তু সমকালীন গ্রামীণ কোন ঘটনা এবং যে নাটককে বলা হয় 'সঙ', তাই তাে আসলে পােস্টার ড্রামা। তবু গ্রামের ডিমভাজা শহরে সায়েবদের কাছে শেখা ওমলেট হয়ে ওঠে।"
ঐতিহ্যময় এই লােকনাটকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষটি আমৃত্যু ভেবেছেন এর উৎস ও পরম্পরা নিয়ে। নিরলস লেখক পরবর্তী জীবনে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকের সম্মানকে মাঝে মাঝে দূরে সরিয়ে দেন শিল্পী সিরাজ-এর থেকে। চোখ বন্ধ করে যখন তিনি সেই দিনগুলােতে ফিরে গেছেন সে দৃশ্য সত্যিই বর্ণনা করা অসম্ভব।

Post a Comment

0 Comments