আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস || পর্ব -৩
শ্যা ম ল জা না
ইম্প্রেশনিজম
ফ্রান্সের কয়েকজন আধুনিক চিত্রশিল্পী আলাদা করে নির্দিষ্ট কতকগুলি দর্শনের প্রেক্ষিতে তাঁদের ছবি আঁকার পদ্ধতিটাই আমূল বদলে ফেললেন৷ এবং ওইভাবে ছবি এঁকে তাঁরা ১৮৬৩ সালে ফ্রান্সের একটি ইনটারন্যাশানাল স্যাঁলোতে প্রদর্শনীর জন্য জমা দিলেন৷ কিন্তু ওই আধুনিকতা সেই সময়ের নির্বাচকরা ধরতে সক্ষম হননি৷ ফলে, তাঁদের আঁকা সব ছবিই বাতিল হল৷ সেই সময়ে, তৎকালীন সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ান, যিনি আধুনিক ফ্রান্স ও প্যারিসের স্রষ্টা, নির্বাচিত পেন্টিংগুলি দেখতে এসেছিলেন ৷ তিনি যখন জানলেন যে, ফ্রান্সের কয়েকজন আধুনিক চিত্রশিল্পী একেবারে আনকোরা নতুন চিন্তা-ভাবনা দিয়ে একদম নতুন ধরনের সব ছবি এঁকেছেন, এবং নির্বাচকরা সেগুলি বাতিল করেছেন, তখন তিনি এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিলেন৷ তিনি বললেন— নতুন চিন্তা-ভাবনা নিয়ে এই সব ছবি আঁকা হয়েছে, এ তো ঐতিহাসিক ঘটনা! মাত্র কয়েকজন নির্বাচক একে বাতিলের সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না! তাঁরা এই স্যাঁলোতে ছবিগুলি বাতিল করেছেন, ঠিক আছে; তাঁদের সম্মানার্থে সে সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম৷ কিন্তু, এই বাতিল ছবিগুলি দিয়ে বাইরে একটা প্রদর্শনী করা হবে৷ দেশের সমস্ত জনগণকে দেখার সুযোগ করে দিতে হবে৷ তাঁরা এই নতুন চিন্তাকে সাদরে গ্রহণ করছেন কিনা, সেটা জানা অত্যন্ত জরুরি!
ওই বাতিল ছবির প্রদর্শনীটির নাম ছিল ফরাসি ভাষায়— Salon des Refusésé ৷ এটাই আধুনিক শিল্পের ইতিহাসে প্রথম ইজম-এর সূত্রপাত৷
এরপর এক দশকেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়৷ বেশ কিছু চিত্রশিল্পীদের মননে ইম্প্রেশনিজম-এর দর্শন পরিপক্ক ও স্থায়ী হয়৷ এবং ঠিক ১১ বছর বাদে ১৮৭৪ সালে, নিজেদের এই দর্শনের প্রতিফলনস্বরূপ নিজস্ব ধারায় তাঁরা একটি প্রদর্শনী করলেন৷ এঁদের মধ্যে যাঁরা উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন— Pissarro(পিসারো), Monet(মনে), Sisley(সিসলে), Dega(দেগা), Renoir(রেনোয়া), Sezanne(সেজাঁ), প্রমুখ চিত্রশিল্পীরা৷ প্রদর্শনীটি সংগঠিত হয়েছিল Felix Nadar নামে ফ্রান্সের এক ফোটোগ্রাফারের উদ্যোগে তাঁরই স্টুডিওতে৷ স্টুডিওটির নাম ফরাসিতে— Société anonyme des peintres, sculpteurs et graveurs ৷ ইংরাজি করলে দাঁড়ায়— (Anonymous society of painters, sculptors and engravers)৷
এই প্রদর্শনতে ক্লদ মনে-র(Claude Monet)একটি পেন্টিং ছিল৷ নাম— ফরাসিতে Impression, soleil levant (ইংরাজিতে Impression,Sunrise)(ছবি-ওপরের)৷ এখান থেকেই Impressionism নামকরণটি হয়েছে৷
এই ইম্প্রেশনিস্টদের মূল দর্শন হল— এতদিন যত ছবি আঁকা হয়েছে, তাতে নির্দিষ্ট কোনো একটি সময়ের আলোর ইম্প্রেশন থাকত না৷ ফলে আলোর ব্যবহার ছিল মনগড়া৷ প্রকৃতি এত রহস্যময়, কারণ সূর্য ক্ষণে ক্ষণে আলো পাল্টায়৷ আমরা প্রকৃতির এই, মুহূর্তের আলোটিকে পেন্টিং-এর মধ্যে ধরতে চাই, যা দেখামাত্রই যেন বোঝা যায়, এই ছবিটি কোন সময়ের? সকাল, বিকেল, দুপুর, না রাত্রির! এই, মুহূর্তের আলোটিকে পেন্টিং-এ ধরতে হলে দ্রুত তুলি চালাতে হবে৷ এজন্য, ক্যানভাসে রঙের প্রলেপ মোটা ও ঘন হবে ও ছবি থেকে ডিটেইল চলে যাবে৷ ফলে, ছবি আঁকার পুরোনো পদ্ধতি বাতিল হয়ে যাবে৷
দ্বিতীয়ত, আগে, ছবি আঁকার মূল উদ্দেশ্য ছিল দক্ষতা প্রদর্শন৷ কত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে(Detail)প্রকৃতিকে ক্যানভাসে ধরতে পারছি৷ ফলে বিষয় ছিল নির্দিষ্ট৷ মাদার অ্যান্ড চাইল্ড, যীশুখৃষ্ট, ল্যান্ডস্কেপ, পোট্রেট, পূর্ণাবয়ব মানুষ, যুদ্ধকাহিনি ইত্যাদি৷ তাই, দর্শকেরা যখন ছবি দেখত, শুধু চোখেরই ভূমিকা থাকত, মগজের ভূমিকা প্রায় থাকত না৷ ইম্প্রেশনিস্টরা বললেন— পৃথিবীতে ঘটা যে কোনো ঘটনাই ছবির বিষয় হতে পারে, সে বড় ঘটনা বা তুচ্ছ ঘটনা যাইই হোক না কেন৷ কারণ, আমরা ছবিতে যেমন সময়ের(আলোর)ইম্প্রেশন রাখতে চাই, তেমনি ছবির ভেতরে কিছু না কিছু বার্তাও রাখতে চাই৷
তাঁরা এই নতুন পদ্ধতিতে ছবি আঁকার জন্য আটটি নতুন প্রয়োগকৌশল(Technique) ব্যবহার করলেন(ছবি-২)—
১. ছবির ডিটেইলে না গিয়ে, মোটা, ঘন ও উজ্জ্বল রঙের ছোট ছোট পোঁছ(Stroke)দিয়ে খুব দ্রুত ছবির বিষয়ের মর্মটিকে(Essence)ধরলেন(ছবি-২ক)৷
২. ক্যানভাসে একটা রঙের সঙ্গে আর একটা রং তুলি দিয়ে ঘষে ঘষে না মিশিয়ে, তুলি দিয়ে কর্ণিকের মতো করে মোটা ও ঘন করে ক্যানভাসে একটা রঙের পাশে আর একটা রঙকে প্রয়োগ করলেন৷ এতে দর্শকের চোখে রঙের উজ্জ্বলতা অনেক বেশি ধরা পড়ল(ছবি-২খ)৷
৩. ধূসর, কালচে, বা কালো রঙের জন্য সরাসরি কালো রং ব্যবহার করা বন্ধ করল৷ তারা কালো রঙ তৈরি করল দুটি বিপরীত রং মিশিয়ে নিয়ে(ছবি-২ক)৷
৪. এতদিন ক্যানভাসে তেলরঙে ছবি আঁকার সময় একটা রঙের প্রলেপ শুকোলে তবেই তার ওপরে আর একটা রঙের প্রলেপ দেওয়া হত৷ এঁরা তা করলেন না৷ ভিজে অবস্থাতেই একটা রঙের ওপর আর একটা রঙের মোটা করে প্রলেপ দিলেন৷ এতে রঙগুলি পরস্পর মিশেছে মনে হত, অথচ রঙের প্রান্তগুলি কখনই কড়া লাগত না, বেশ নরম লাগত(ছবি-২গ)৷
৫. ফিল্মের রঙের যে স্বচ্ছতা(Transperancy), এঁরা তা কখনই ক্যানভাসে ব্যবহার করতেন না৷ কারণ, তাঁরা ক্যানভাসে যে তেলরং ব্যবহার করতেন, সেগুলো ছিল সম্পূর্ণতই অস্বচ্ছ, এবং রঙের পোঁচগুলি ছিল স্বতন্ত্র ও মোটা মোটা(ছবি-২ঘ)৷
৬. আগে, ছবিকে স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলার জন্য শিল্পীরা ব্যাকগ্রাউন্ড কালো বা কালচে করতেন৷ এঁরা এসে সেটি বাদ দিলেন৷ এঁরা সেক্ষেত্রে সাদা বা হাল্কা রং ব্যবহার করলেন(ছবি-২ঙ)৷
৭. এঁরা সবচেয়ে বেশি জোর দিলেন— প্রকৃতিতে স্বাভাবিকভাবে যে সূর্যালোকের খেলা, তার ওপর৷ এবং “এই আলো পাল্টে পাল্টে গেলে বিষয়ের রঙও পাল্টে পাল্টে যায়”— এই কনসেপ্টটির ওপর৷ এজন্য প্রায়ই তাঁরা শেষ বিকেলে সূর্যাস্তের আলো ও তার রঙকে ক্যানভাসে ধরার জন্য ছবি আঁকতেন৷
৮. এ জন্য তাঁরা বাড়ির বাইরে গিয়ে আউটডোর পেন্টিং করতেন, যাতে প্রকৃতির যে সময় অনুযায়ী আলো ও সেই আলো অনুযায়ী যে রং তাকে হুবহু ক্যানভাসে ধরা যায়৷ আর এতদিন, আগে থেকে ভেবে, প্ল্যান করে, স্টুডিওতে বসে যে মনগড়া ছবি আঁকার রেওয়াজ ছিল তা বাতিল করে দিলেন৷
এভাবেই সুত্রপাত হল ইম্প্রেশনিজম-এর৷
1 Comments
শ্যামল ইম্প্রেসনিজম এর বিবর্তন বলতে গিয়ে চমৎকার ব্যাখ্যা করেছে। যা মনোগ্রাহী,কারণ এতে ভারী বিষয়ে বলতে গিয়ে কোথাও তো জটিল হইছে নি। অনবদ্য লেখা।
ReplyDeleteপড়ছি।জানছি। প্রতীক্ষা তীব্র হচ্ছে।শুভেচ্ছা থাকলো